কবিতার সক্রেটিস
নগরবাউল হয়ে অনেক হয়েছে হাঁটা। জমকালো বিদ্যুতের রোদে
ভাটশালিকের পায়ে সারারাত বেড়িয়েছি খুঁজে ঢের শিল্পের আহার। ক্রোধে,
ক্ষোভে ও ঘৃণায় পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মুখে অনেক মেরেছি থুতু। মানবতা-
মানবতা করে কাটিয়েছি কালো দিন রক্তলাল রাজপথে। কাগজের কুসুমের কথা
আর পাথরের প্যারাডাইসের কথা বলতে বলতে ক্লান্ত অবশেষে কণ্ঠ কোকিলের।
আজ মৃত্তিকা আমাকে ডাকে। সুনিবিড় সবুজের শীতলতা আর নিঃসীম নীলের
নৈঃশব্দ আমাকে ডাকে। আমাকে অনন্ত ডাক দিয়ে যায় কপোতাক্ষের দুই পাড়
আর তার পাড়ের পাকুড়গাছগুলো। যে-মাটিতে পূর্বপুরুষের রক্তমাংসহাড়
মাটি হয়ে মিশে আছে, আমি ফিরে যাবো দুধের সরের মতো তার গাছের ছায়ায়,
ঘাসের জঙ্গলে, মত্ত করা শেফালির ঘ্রাণে। একটি দোয়েল শিস দিয়ে যায়
অন্ধকারজড়ানো ভোরের বাতাসে শিশিরসিক্ত সজিনার ডালে প্রতিদিন; তার শিস
হেমলকের মতো পান করে, পড়ে রবো মহাকালবুকে চির কবিতার সক্রেটিস।
একটা বুনো হাঁস
গাছেরা গান গায় গাছেরা কাঁদে হাসে গাছেরা কথা বলে
সেসব শোনে শুধু একটা বুনো হাঁস নদীর বুনো জলে
জলেরা কথা বলে ছলাৎ ছল ছল হাঁসটি শোনে একা
এবং চুপ করে অবাক চেয়ে থাকে দূরের বনে একা
নদীর বুনো জলে বেড়ায় ভেসে একা একটি বুনো হাঁস
উদাস দুটি চোখে কখনো চেয়ে দ্যাখে রূপসী নীলাকাশ
আকাশ কথা বলে অসীম চুপকথা—শোনে সে কান পেতে
সে-কথা খেলা করে নদীর পাড়ে সব সবুজ ধানখেতে
কোন্ ইডেন হতে ঈভের ডাক ছাড়ে কোন্ সে বুনোগাছ!
শরীর নাচে শুনে তাধিন ধিন তা তা, হৃদয়ও জোড়ে নাচ
উড়াল দেয় বুনো হাসঁটি শূন্যেতে যেনবা সে ঈগল
নদীর বুনো জল কাঁপতে থাকে শোকে ছলাৎ ছল ছল
বলিয়া যেন যাই
চলিয়া যদি যাই, বলিয়া যেন যাই তাবৎ পৃথিবীকে:
দুঃখ নাই মনে। দুঃখ নাই, যেন একথা যাই লিখে
এবং এই কথা গাঁথিয়া অন্তরে একেলা চুপচাপ
চলিয়া যেন যাই, শরীরে লেগে থাকে সুখের উত্তাপ।
গোলাপ দেখিয়াছি, কাঁটার কথা তার পায়নি ঠাঁই মনে;
সাঁতার কাটিয়াছি চিতল মাছ হয়ে অথৈ যৌবনে,
জরা ও জীর্ণতা পারেনি ছুঁতে মন। গিয়াছে ফিরে শীত;
সত্তা জুড়ে পিক গাহিয়া উঠিয়াছে ফুলের সংগীত।
চলিয়া যদি যাই, বলিয়া যেন যাই: সত্য সুন্দর
জীবনবালুচরে দরদ দিয়ে গড়া মাটির কুঁড়েঘর;
সত্য সুন্দর রাতের জোছনা ও দিনের সভ্যতা,
মায়ের মধুডাক, সন্তানের মুখ, প্রিয়ার প্রিয়কথা ।
প্রকৃতি
কিভাবে কুঁড়িগুলো উঠিল ফুল হয়ে,
হইলো দিশেহারা বনের মৌমাছি!
যা কিছু দেখি চোখে, যায় তা ভুল হয়ে
সত্য হয় তা, যা চোখে না দেখিয়াছি।
কুঁড়িরা ফুল হয়, ঝরিয়া যায় ফুল
ভরিয়া যায় বন নতুন ফুলে ফের;
যে ছিলো কিশোরী, সে প্রণয়ে মশগুল—
ঘটিয়া যায় কত ঘটনা জগতের।
আমরা এইখানে—সত্য যত না এ,
সত্য তার চেয়ে আমরা কেউ নাই;
নদীর ঢেউ নাচে নর্তকীর পায়ে,
হয়তো আরো ঠিক কোথাও ঢেউ নাই।
এই যে সভ্যতা, কাল তা জলরাশি
এই যে জলরাশি, কাল তা সভ্যতা
সেখানে মানবীরা বলিবে ভালবাসি
ফুলের কানে কানে বলিবে ফুল কথা।
মৎস্যকন্যাদের কথা
জোছনা ডুবে গেছে সমুদ্রের নিচে,
কৃষ্ণ জলরাশি কাঁপছে থরথর;
মৎস্যকন্যারা ঘুমায় সী-বীচে;
আস্তে ফেলো পা, যাবে যে ভেঙে ঘুম।
জোছনা ডুবে গেলে সী-বীচে আসে তারা,
এলিয়ে দেয় দেহ মুক্ত হাওয়ায়;
যখনি উঁকি মারে আকাশে শুকতারা,
পালায় দল বেঁধে জলের হিমঘরে।
আস্তে ফেলো পা, একটু আওয়াজেই
আঁতকে ওঠে তারা, যেন বা ভীত মৃগ;
একটু জোরে বয় বীচের হাওয়া যেই,
পালিয়ে যায় তারা চোখের পলকে।
যায় না দেখা ভালো রাতের এই ভাগে,
আঁধার গাঢ় হয়ে ফেলেছে ঢেকে সব;
দেখতে পাও যদি তুমি আমার আগে,
দিও হে মোবাইলে একটা মিচকল।
জানতো তারা যদি আমরা কি-সভ্য,
কি-আধুনিক আর বিজ্ঞান-মনস্ক!
হবে না মোটে তারা ভোগের কু-দ্রব্য,
থাকবে রানী হয়ে হৃদয়-সাম্রাজ্যে।
বুঝি না কী আরাম সাগরে ডুব দিয়ে,
নষ্ট করে রূপ চোখের আড়ালে,
জগত জানলো না, কী হবে রূপ দিয়ে—
কবিরা লিখলো না সনেট ভালবেসে!
আমরা কি-ভদ্র, বিনয়ী ও প্রেমিক,
বুঝতো তারা, যদি আসতো কাছে, হায়!
পোষা প্রাণীর মতো আপোসে ধরা দিক,
ঘটবে কি-সহজে বংশবিস্তার।
বংশবিস্তারে আমরা বিশ্বাসী,
নইলে হয়ে যাবে জগতে বিলুপ্ত;
আস্তে পা ফ্যালো, ফেলো না নিঃশ্বাসই—
কী নড়ে ওইখানে? পালালো বুঝি ওই!
যায় না দেখা ভালো রাতের এই ভাগে,
হয়তো এসেছিল মৎস্যকন্যারা;
মানুষ দেখলেই পালায় আগে আগে
অথচ বুঝলো না প্রেমের কি-মর্ম!
বাবুই পাখি
হে শিল্পের পাখি, তোমার নিখুঁত নীড়ে আমাকেও দিও থাকিবার;
কিভাবে বানাও তুমি কোন্ মন্ত্র বলে এ মোহন শিল্প কারুকলা-
দেখিবার তুমি দিও আর কানে কানে কহিও কৌশল আঁকিবার
অমরার ছবি। তুমি শুধু গড়ো চুপচাপ, নাহি কোনো কথা বলা
অথচ আমার কাজ কথা কহিবার। কী করে কহিলে শোনে লোকে,
কিভাবে গাহিলে গান কাঁপে আসমান, কাঁপে মানুষের মহাদেশ-
জানে না অধম কারণ তোমার মতো লাগে নাই আমার এ চোখে
অমরার আলো কারণ আমাতে নাই সাধুতা-সন্ততা একলেশ।
থাকিলে চুল্লিতে, কয়লাও পায় অগ্নিরূপ; মালার সুতাও ধরে
সুঘ্রাণ সর্বাঙ্গে, বকুলের সাথে থেকে; আমি গুণহীন, যদি পাই
তোমার শিল্পের সাথে সহবাস, জানি জ্যোতিহীন নির্জীব অন্তরে
জ্বলিয়া উঠিবে দীপ, চমকায়ে দেবে চোখ তীব্র তার রোশনাই।
হে শিল্পের পাখি, তোমার নিখুঁত নীড়ে আমাকেও দিও থাকিবার;
কহিও কৌশল কানে কানে অমরার অবিনাশী ছবি আঁকিবার।
একটি হত্যাকাণ্ড ও দেশপ্রেম
তারা তাকে হত্যা করেই ফেললো
কারণ তাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্যে
সে তার জবান খোলেনি একবারও।
সে দাঁড়িয়ে ছিলো তার পুরোনো কাস্তেটি হাতে নিয়ে
ধানখেতের মাঝখানে।
তার মুখভরা ছিলো ঈশা খাঁর দাঁড়ি।
সে কোনোদিন স্কুলে গিয়েছিল বলে শোনেনি কখনো কেউ।
সত্তর বছর ধরে এ গাঁয়ের আলো ও বাতাসে
রৌদ্র ও বর্ষায়
ফলন্ত বৃক্ষের মতো বেঁচে ছিলো সে।
রাজনীতির আড্ডায়, ফুটবলের মাঠে কিংবা চায়ের দোকানে
তার উপস্থিতি কারো চোখে পড়েনি কখনো।
তাকে শুধু দেখা গেছে মাঠেঘাটে কিংবা বিলে
কখনো লাঙল নিয়ে, কখনো কোদাল, কখনো নিড়ানিÑ
সাধকের মতো সে নিমগ্ন হয়ে আছে তার নিত্যকার কাজে।
কখনো বা সেচঘরে বসে থাকতে দেখা গেছে তাকে
শ্যালো মেশিনের পাশে;
কখনো বা দেখা গেছেÑএকা একা
ঠিক করে চলেছে সে ইরি ব্লকের পানির লাইন।
কখনো গাঁয়ের হাঁটে ছুটতে দেখেছে তাকে লোকজন:
কাঁধে তার খেত থেকে তুলে আনা তরতাজা তরকারির স্তুপ।
ক্লাবের ছেলেরা তার দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল।
তাদেরকে উসকে দিয়েছিল তার সুখ ও সাফল্যে ঈর্ষান্বিত
এ গাঁয়েরই দুষ্টু কিছু লোক।
ছেলেরা পতাকা হাতে নিয়ে ছুটে গিয়েছিল তার কাছে;
বলেছিল, “ক্রিকেটে আপনি কোন্ দেশের সাপোর্টার?”
বলেছিল, “আপনাকে কেন দেখা যায় না বিজয় দিবসের
প্রভাতফেরিতে?” বলেছিল, “আপনি কি
এদেশকে ভালোবাসেন না একটুও?”
সে কেবল ফ্যালৃফ্যালৃ করে নির্বাক তাকিয়ে ছিলো
তাদের মুখের দিকে।
তার নিরবতা ভেঙে দিয়েছিল তাদের ধৈর্যের বাঁধ।
তাদের উত্তপ্ত ধমনীর ভেতর এক কড়াই গরম তেলের মতো
টগবগ করে ফুটতে থাকা তাদের বিক্ষুব্ধ দেশপ্রেম
খুনী হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো তার উপর এবং শেষমেশ
হন্যে কুকুরের মতো তাকে হত্যা করে ফেললো, পিটিয়ে।
তারা চলে গেলে, তার লাশ
ঘিরে কেঁদে উঠলো সুগন্ধি বনের বাতাস।
চারদিকের ধানখেত তার শোকে কেঁপে উঠলো থরথর।
মাঠের গরুরা, গরুদের পিঠের উপর বসে থাকা কয়েকটি ফিঙে
আর শূন্য সেচঘর
তার নামে করতে থাকলো আহাজারি।
আর এক নারী,
তার দেশ,
সিক্ত চোখ, আলুথালু কেশ—
উদ্ভিদের মতো নরম মৃত্তিকা ফুঁড়ে জেগে উঠে বলে উঠলো সক্রোধে:
‘তুমুল বর্ষায় ও প্রচণ্ড রোদে
কে আর বেসেছে ভালো তার অধিক আমাকে একদিনও?
গাছের পাতারা সাক্ষী আর জমিনের সব তৃণ,
তার চেয়ে প্রিয় আর ছিলো না কেউই, দুঃখে কি সুখে,
এ মুলুকে।’
তবু তারা দেশময় হেসে চললো বিজয়ের হাসি
এই বলে: ‘ফেলেছি বীরের মতো হত্যা করে তাকে
কারণ আমরা ভালবাসি
আর সে ভালোবাসেনি একবারও এই দেশটাকে।’
পরিচয়
আমার কোথাও যাওয়ার নেই। আমি এইখানে পড়ে আছি
বট-পাকুড়ের নিচে, হিজলছায়ায়, বঙ্গ-উপসাগরের পাড়ে
কত কাল মহাকাল। নুহের নগর থেকে আমি আসিয়াছি;
আমার শরীরে হ্যামের শোণিতধারা। আমার অস্থিতে-হাড়ে
তাঁর পুত্র হিন্দের উজ্জ্বল উপস্থিতি, যাঁহার ঔরশে ছিলো বঙ।
পিতা বঙ থেকে আমি এই বঙ্গে, বয়ে যাই তাঁরই উত্তরাধিকার।
আমার কোথাও যাওয়ার নেই। পাখি আর আকাশের নানা রঙ
দেখে দেখে আমার দিবস কাটে। কিভাবে হরিণ বাঘের শিকার
হয় বনে-আমি তাও দেখি। কখনো আনন্দে হাসি, কখনো বা
কষ্টে শ্রাবণের মতো আমি কাঁদি। জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে
তাজিং ডনের মতো থাকি আমি অবিচল- যেন জন্ম বোবা;
হঠাৎ দুঠোঁটে ফোটে খই, একতারা বেজে ওঠে বাউল এ হাতে।
কোথাও আমার যাওয়ার নেই। আমি এইখানে পড়ে আছি
বঙ্গ-উপসাগরের পাড়ে, সভ্যতার প্রায় সমান বয়সী,
প্রথম মানুষ এ দ্বীপের; নুহের নগর থেকে আমি আসিয়াছি।
সকালের সূর্য আমার কুশল পুছে, জানায় শুভেচ্ছা আমাকে রাতের শশী।
উপরের ৮টি কবিতা আমার কোথাও যাওয়ার নেই (২০১৭) কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া
রাতের নগরী
রাতের নগরী নেশায় উত্তাল।
নাচে তন্বী স্বপ্নের নারীরা
নগরনাট্যমে। বেসামাল
মানুষেরা; ওঠে
উথলে তাদের শিরা-উপশিরা
উন্মাদ উচ্ছ্বাসে। ঠোঁটে
বাজে শিস, প্রাণে কবন্ধ কামনা—
নীলপদ্মপায়ে নর্তকীর, ঝরে ঝরে পড়ে সোনা।
এইসব মানুষেরা কেবলি শরীরী;
কেবলি কামান্ধ কায়ার উল্লাসে
বেতাল, বেহুঁশ; এদের স্বপ্নের সিঁড়ি
ওঠে নাই ঊর্ধ্বাকাশে,
উল্টো নেমে গেছে নিচে, বহু নিচে
অথৈ অন্ধকারে ডোবা নরকেরও নিচে—
ঘৃণার কিরিচে
যেখানে জন্মান্ধ ডাকিনীরা কাটে চৌপ্রহর
মানুষের অবোধ অন্তর।
মানুষ আমার ভাই
একাকী থাকতে পারে যাঁরা সন্তু ফকির দরবেশ,
কবিদের কর্ম নয় স্বর্গবাস মানুষকে থুয়ে;
হয়তো মানবস্রোতে দুর্বৃত্তের নেই কোনো শেষ,
তবু আমি সেই স্রোতে ভেসে থাকি মানুষকে ছুঁয়ে।
মানুষ আমার ভাই সব দেশে, ধর্মে ও ভাষায়,
মানবী আমার বোন; মানুষের ছোট্ট এই গ্রহ
ভরে আছে পাপ-পুণ্য, দুঃখ-সুখ, হতাশা-আশায়,
ঘুরপাক খায় খালি এ-মানুষে আনুগত্য-দ্রোহ;
সব মিলে এ মানুষ, নয় কেউ ফেরেস্তা এখানে;
স্বর্গের সুরভি নয়, গায়ে এর মৃত্তিকার গন্ধ;
তারই কথা লিখে যাই রাত্রিদিন আমার এ গানে,
গেঁথে যাই তারই সাথে ছন্দ আর সুরের সম্বন্ধ।
মানুষ আমার ভাই আর বোন সমস্ত মানবীÑ
এসব নিয়েই আমি পৃথিবীর ক্ষুদ্র এক কবি।
ভেঙে পড়া কবরের ঘটনা
কবরের গর্তের ভেতর হিমশিম খাচ্ছিল সে কী যেন সামলাতে।
মারলাম যেই আমি উঁকি, লুকালো সে সাথে সাথে।
‘আবদুল! আবদুল!’ বলে আমি কতবার ডাকলাম।
ভেঙে পড়া কবরের চারদিকে আছড়ে পড়লো তার নাম।
জোছনারা ডুবে গেলে রাক্ষসের মতো নেমে এলো ভয়।
থরথর করে কাঁপতে লাগলো আমার হৃদয়।
ঘরে ফিরে সারাদিন থাকলাম শুয়ে। হঠাৎ বিকেলে কী হলো খেয়াল—
ছুটে গিয়ে দেখি, ভাঙা সেই কবরের ’পরে একটি শেয়াল।
হেই হেই করতেই গেল সে পালিয়ে, তার সাথে সাথে দিনও;
প্রার্থনায় গেল ডুবে বনের পাখিরা, বাঁশঝাড়, তরু, তৃণ।
জেগে ওঠা চন্দ্রালোকে হঠাৎ তাকিয়ে দেখি—সেই আবদুলই, হায়,
দুহাতে কী যেন ধরে মগ্ন হয়ে আছে কিসের চিন্তায়!
আমি যেই ডাকলাম তাকে, চমকে উঠে সে তাকালো উপরে।
কবরের মধ্যে বসা, দুশ্চিন্তায় তার সারা মুখ আছে ভরে।
“ও আপনি?” বলে দাঁড়ালো সে উঠে, যেন কোনো ভূত
দেখেছে হঠাৎ, যা দেখার জন্যে আদৌ ছিলো না প্রস্তুত।
দুহাতে কী তার? জানতে চাইলে এক গাল হেসে দিয়ে জানালো সে,
এ সমস্ত তারই হাড়গোড়। বলে পড়লো সে ফের বসে।
“কী হবে এ হাড় দিয়ে?” আমি বললাম। সে বললো, “হবে না কিছুই,
শুধু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সব— নষ্ট হতে হতে বুঝি রবে না কিছুই।”
বলতে বলতে কোথায় যে লুকালো সে, আর তার মিললো না খোঁজ।
মহাপ্রলয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া বুঝি এতই সহজ!
তোমার পৃথিবী চালায় দস্যুরা
তোমার পৃথিবী চালায় দস্যুরা,
মারছে মানুষ শোষণে-শাসনে;
তাদের পানীয় শোণিতের সুরা,
তবু তুমি চুপ তোমার আসনে।
আকাশ, সমুদ্র, গ্রহ ও নক্ষত্র
ওঠে আর বসে তোমার নির্দেশে;
তোমার রাজত্ব চলছে সর্বত্র,–
এ মহাবিশ্বের শুরুতে ও শেষে;
শুধু মানুষের পৃথিবীর ভার
ছেড়ে দেছো তুমি মানুষেরই হাতে,–
সেখানে দস্যুরা করে কারবার,
লুটায় সভ্যতা অস্ত্রের আঘাতে।
কাঁদছে মানুষ, হাসে শয়তান;
ঘৃণার আগুনে পুড়ে হয় খাক
তোমার পৃথিবী, যেন বা শ্মশান;
তবু তুমি চুপ, নিরব, নির্বাক।
তারও চেয়ে ভয়ঙ্কর ঝড়
সেই ঝড়, যে-ঝড়ে উপড়ে যায়
আকাশ খামচে ধরা বিশালাকৃতির বটগাছ
সেই ঝড়, পড়ে মুখ থুবড়ে যে-ঝড়ে
পুরোনো প্রাসাদ, বিদ্যুতের খুঁটি আর নগর টাওয়ার
সেই ঝড়, যে-ঝড়ে মাটিতে শুয়ে পড়ে
কাশবন, বাঁশঝাড় আর পেকে ওঠা ইরিধান মাঠে মাঠে
সেই ঝড়, যার আকস্মিক আবির্ভাবে পথের মানুষ
প্রাণান্ত ছুটতে থাকে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে
আর গাঙপাড়ের মানুষেরা সঅশ্রু জপতে থাকে
বিধাতার নাম
সেই ঝড় নয়, আজ এই জনপদে
চাই আমি তারও চেয়ে ভয়ঙ্কর ঝড়
যে-ঝড়ে সর্বাঙ্গ থেকে শুকনো পাতার মতো
ঝরঝর করে ঝরে পড়বে জমাটবাঁধা পাপ,
মিথ্যা, কুপমণ্ডুকতা, সাহসহীনতা, শোক ও সন্তাপ।
হাওড়া জংসনের একটি পাগল
হাওড়া জংসনের ডাস্টবিন থেকে খাদ্য তুলে
যে-লোকটা নেভাচ্ছে উন্মত্ত পেটের আগুন,
তার দুটি কিডনির দাম কত? কত দাম
তার দুটি উজ্জ্বল চোখের?
তল্পিতল্পা নিয়ে ছুটছে মানুষ লেন থেকে লেনে,
খুঁজতেছে ট্রেন, যাবে তারা দূর কোনো স্বপ্নের শহরে;
পেট ভরা, গোপন পকেটও ভরা তাদের নতুন চকচকে নোটে;
ছোটে তারা সভ্যতার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে সমস্ত জীবন।
শুধু এ-লোকটা বারবার ফিরে আসে স্টেশনের
ডাস্টবিনগুলোর নিকট, খোঁজে খাদ্য শকুনের মতো চোখে,
লোকে দেখলো কি দেখলো না, কিবা আসে যায় তার!
পেটের আগুন নিভে গেলে বের হয়ে আসে রাস্তায়। রাস্তার
মোড়ে বসে পিটপিট করে তাকায় সে ব্যস্ত সভ্যতার দিকে।
নিয়ন আলোয় হাওড়া জংসনের গায়ে সাঁটা
রঙিন পোস্টারগুলো দেখে হেসে ওঠে সে হঠাৎ
প্রচÐ আওয়াজে। সে-আওয়াজ চিত্তহীন সভ্যতার
তীব্র শোরগোলের সাথে ধাক্কা খেয়ে দুমড়ে মুচড়ে
হয়ে যায় স্থির, যেন এঁদো পুকুরের পচা পানি।
অনন্ত স্থবির
কেমন নিশ্চল সবকিছু, অনন্ত স্থবির—
যেন এঁদো পুকুরের পচা পানি,
কেবলি দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে বাতাসে! ঘোলা চোখ
প্রত্যেকেরই, হয়ে আছে স্থির
নিজ নিজ স্বার্থের উপর। কারো দিকে জানি
তাকাবার ফুরসত কারো নেই। একবারও
এ সত্য হৃদয়ে কারো
হয় না উদয়—
এ কোনো জীবন নয়।
জীবন তো নেকড়ের পায়ে নিশীথের পাছ পাছ ছুটে চলা;
স্লুইচ গেইট ভেঙে ফেটে পড়া পানির স্রোতের মতো
ডুবিয়ে দেওয়া সুপ্ত জনপদ; অথবা বর্শার ফলা
হয়ে বিঁধে থাকা আবু জেহেলের হৃৎপিণ্ডে। কত
পাষণ্ড সীমার কেটে চলে আজও মানুষের গলা;
কত নেমেসিস প্রচণ্ড উদ্ধত
সেজে আছে খোদা
পৃথিবীর মসনদে, যাকে মানুষ সর্বদা
খোদার অধিক করে ভয়।
যে-জীবন ভূতের সেজদায় আছে নুয়ে,
সে-জীবন মানুষের নয়।
যে-জমিনে ঝড় নেই,
তুফান-প্লাবন নেই,
নেই ভুমিকম্প—
ভূত-প্রেত রাত্রিদিন করে লম্ফঝম্প;
সেখানে জীবন জানি
হিমঘরে রাখা কোনো লাশ
কিংবা পাথরের নিচে চাপা পড়া মৃত ঘাস।
উপরের ৭টি কবিতা তোমার পৃথিবী চালায় দস্যুরা (২০২০) কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া
যেখানে বাংলাদেশ
১.
ইট-পাথরের এ-রঙমহলে আর নয়, আমি যাবো
মাটির নিঝুম দ্বীপে। সেখানে বাংলাদেশ
রাজকুমারীর মতো রূপকথা হয়ে আছে আজও।
তার রূপে বুঁদ হয়ে আছে নীলাকাশ। বিচিত্র পাখিরা
স্বাধীনতা ঠোঁটে নিয়ে উড়ে যায় ঝাঁক বেঁধে আকাশের কাছে,
তারপর ফিরে আসে সবুজাভ শীতল জমিনে ফের।
কি-নিশ্চিন্তে কাঁকড়ারা, হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকা অলস সৈকতে,
মেতে ওঠে আনন্দখেলায়! চেয়ে চেয়ে দ্যাখে তা দুদণ্ড
একটি কচ্ছপ; তারপর ধীর পায়ে নেমে যায় ঢেউ তোলা
অথই পানিতে। শিশির জড়ানো ভোরের রোদ্দুরে
বনের ভিতর থেকে বের হয়ে আসে একদল চিত্রল হরিণ;
তাদের চঞ্চল পায়ের আঘাতে নিস্তব্ধ মাঠের সুগন্ধি ঘাসেরা
কেঁপে কেঁপে ওঠে যেন ভয়ে। হঠাৎ কোথাও
ডেকে ওঠে গাঙচিল; সেই শব্দে
খসখস আওয়াজ ছড়িয়ে শুকনো পাতায়, হয়ে যায়
মুহূর্তে উধাও তারা বনের গভীরে। কেওড়ার ডালে বসে
একটি নিসঙ্গ ঘুঘু ডেকে চলে অবিরাম তার খেলার সাথীকে
মাথা কুটে কুটে। সারাদিন বুনো খরগোশ আর কাঠবিড়ালীর
চলে কত লুকোচুরি খেলা বনময়! ডাইনোসরের মতো গুইসাপ
ফণা তুলে চলে হেলেদুলে। সন্ত্রস্ত পেঁচারা দলবেঁধে
উড়ে উড়ে করে চেঁচামেচি। দূর থেকে উঁকি মারে এক জোড়া
লাজুক নেউল; এদিক-ওদিক তাকায় কয়েকবার, তারপর
ছুটে যায় নিরুদ্দেশে মুখ নিচু করে। আলো ও ছায়ায়,
রৌদ্র ও বৃষ্টিতে দুপুর ও বিকেল সেখানে ধরে কত
মোহনিয়া রূপ! সেই রূপ ম্লান করে তারপর যখন সেখানে
নেমে আসে সুদর্শনা রাত চাঁদ-তারা সাথে নিয়ে, মনে হয়,
পৃথিবীতে দুচোখ ধাঁধানো এত রূপ দ্যাখেনি কখনো কেউ
এর আগে। সোনারঙ জোছনার জলে ভিজে যাওয়া
কেওড়া পাতার আবডালে আমি যেন দেখতে পাই এক
দুধসাদা রূপসীর মুখ, যে আমাকে অত্যাশ্চর্য তার
সবুজ চোখের ইশারায় ডেকে নিয়ে যায় তার হৃদয়ের কাছে,
যে-হৃদয়ে কিলবিল করে বুনোহাঁস, পাতিঘুঘু, চিত্রল হরিণ
আর এক ঝাঁক বুজকুড়ি তোলা খোরশুলা মাছ।
২.
ইট-পাথরের এ-রঙমহলে আর নয়, আমি যাবো
আমার স্বপ্নের নারকেল জিঞ্জিরায়। সেখানে বাংলাদেশ
সুনীল সাগরপাড়ে নারকেলপাতার ঝড়ে উড়াচ্ছে উদাম চুল।
সে-চুলের সবুজ সুঘ্রাণে দিশেহারা হয়ে উড়ছে বাতাসে
বক আর মেটে চিল। সারা দিন নারকেলবনে আর সাগরের
বুনো জলে খেলা করে বুনো বাতাসেরা।
ঢেউ আর বাতাসের তোড়ে জেলেদের মাছধরা নৌকাগুলো
আছাড়ি পিছাড়ি খায়, যেন ডুবে ডুবে ভেসে ওঠা মৎস্যকন্যার ঝাঁক।
সেসব নৌকার ’পরে শুয়ে শুয়ে পোহায় রোদ্দুর যেন
শীতল পানির মাছ; জেলেদের দুচোখ জুড়ায় তারা তাদের সুরূপে।
লোকালয় থেকে দূরে আছে এক ছেঁড়া দ্বীপ। তার পাড়ে
উন্মাতাল ঢেউ এসে ছুঁড়ে মারে কোরালের স্তূপ। চারদিকে
নারকেল পাতার ঝড় আর সাগরের নিশ^াসের ধ্বনি ছাড়া
আর কোনো শব্দ নেই। হঠাৎ যখন নারকেল পাতায় বসে
কণ্ঠ ছেড়ে দিয়ে ডেকে ওঠে একটি নিসঙ্গ চিল,
অলস সৈকতে কুমিরের মতো শুয়ে শুয়ে রোদ-পোহানো সকাল
নড়েচড়ে উঠে আড়মোড়া ভাঙে, তারপর হাই তুলে, দুই হাতে
ডলে দুই চোখ, আবার ছুটতে থাকে দুপুরের দিকে।
দুপুর গড়িয়ে হয়ে যায় যখন বিকেল, সে আর এ-দ্বীপ ছেড়ে
চায় না কোথাও যেতে এক পা-ও, হাঁটুচুল রূপসীর মতো
মাজা বাঁকা করে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা নারকেল গাছের গা ঘেঁষে
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে গুনতে থাকে সাগরের ঢেউ আর পাড়ে
পড়ে থাকা অজস্র কোরাল।
৩.
ইট-পাথরের এ-রঙমহলে আর নয়, আমি যাবো
চিলের ডানায় দক্ষিণে সুন্দরবনে। সেখানে বাংলাদেশ
পশুর নদীর পাড়ে গোলপাতার ঘোমটা পরে রাজকুমারীর মতো
রূপকথা হয়ে আছে আজও। কত যে বানর পেঁচা হরিয়াল ঘুঘু
লুকোচুরি খ্যালে সারাদিন সুন্দরী কেওড়া আর হিজলের ঘন
পাতার আড়ালে! পাকা মরিচের মতো লালঠোঁট মাছরাঙা
করমজলের পাড়ে ঝুলে থাকা ধুন্দুলের ডালে বসে
সন্ন্যাসীর মতো করে ধ্যান, হঠাৎ বাঘের মতো
ঝাঁপ দিয়ে বুনোজলে ধরে নিয়ে যায় সাদা পেটঅলা মাছ,
যার গায়ে রোদ লেগে ঝকমক করে ওঠে রূপার আঙটির মতো।
গেওয়ার জঙ্গল থেকে উড়ে যায় হঠাৎ একটি দুরন্ত হট্টিটি,
উড়তে উড়তে ছাড়ে হাঁক, বিদ্যুতের মতো তা মুহূর্তে
চিরে নিয়ে যায় যেন সমস্ত অরণ্য, ভয় পেয়ে হুড়মুড় করে
ছুটতে থাকে মায়াহরিণের পাল লেজ তুলে, দ্যাখে
সুদর্শন ডোরাকাটা বাঘ ছলছল চোখে তাদের সে-দৌড়
আর মহাআক্ষেপে চাটতে থাকে ঠোঁট। কাঠঠোকরারা
পাকা সুপারির মতো শক্ত বৃক্ষদের কাÐে কাÐে ঠোঁট মেরে
ওঠায় বাঁশির মতো সুর; সেই সুরে ভেঙে যায় বনবিড়ালের
ঘুম, হাই তোলে একবার দুইবার, তারপর আবার সে
ঢলে পড়ে অথৈ ঘুমের ভিতর তাঁর নিশ্চিন্ত নিবাসে। সারা বনে,
সন্ধ্যা নামার আগেই, নেমে আসে কবরের নিস্তব্ধতা।
চলে যায় অরণ্যবাসীরা তাদের গোপন আস্তানায়। শুধু জোনাকীরা
আলোর মশাল নিয়ে নেমে পড়ে পাহারায় সারা রাত, ঘুরে ঘুরে
দ্যাখে তারা সমস্ত অরণ্য–বাঘদের আর বন্য শূকরের হাত থেকে
আছে কিনা নিরাপদে সব। যখন হঠাৎ চাঁদ মাথার উপর উঠে
ঝরায় বৃষ্টির মতো তার রূপ, ভিজে যায় গাছপালা, ঝোপঝাড়
আর করমজলের পানি; গোলপাতার ভিতর থেকে
বের হয়ে আসে এক অত্যাশ্চর্য মুখ, দুধসাদা;
তার শিশিরের মতো মুখ দেখে আমি অরফিয়ুসের মতো
তুলে নেই হাতে বাঁশি, যা বেহুঁশ হয়ে বাজতেই থাকে অবিরাম;
আমার দুচোখ তাঁকে প্রাণভরে দেখছে তো দেখছেই।
ডেকো না আমাকে আর পাথরের দেশে।
৪.
ইট-পাথরের এ-রঙমহলে আর নয়, আমি যাবো
লালনের একতারা হাতে আমার পাথরঘাটা বিলে।
সেখানে বাংলাদেশ সারাদিন সারারাত রূপকথা হয়ে আছে আজও।
পদ্ম, শাপলা ও কলমিফুলের তরতাজাঘ্রাণে ভিজে আছে
সারা বিল। উত্তাল যৌবন মেলে ধরা সেইসব ফুলের উপর
নৃত্য করে সকালের মিঠেরোদ প্রজাপতি ফড়িং ও মাতাল মৌমাছি।
পানকৌড়ি কুচবক মাছরাঙা জলপিপি খঞ্জনা ও বালিহাঁস
উড়ে উড়ে সারাদিন খুঁজে ফেরে বিলময় তাদের আহার।
পানি কেটে ছুটে যায় হঠাৎ একটা শোলমাছ
অথবা গজার বিদ্যুতের বেগে; কলার পাতার মতো কেঁপে ওঠে
কুচকুচে পানি আর সেই পানির ভিতর
ঝিরঝির করে কাঁপতে থাকে সুনীল আকাশ। পাখিদের
পাশ দিয়ে হাঁসের মতন ভেসে চলে যায় বৃদ্ধ মেঘা মোল্লা তার
পুরনো তালের ডোঙা নিয়ে; পাখিদের মতো সেও
খুঁজে ফেরে তার জীবিকা এখানে; কত পরিচিত যেন তারা
যুগ যুগ ধরে! স্বপ্নের বিলের চারধারে সুন্দরবনের মতো
দাঁড়িয়ে সবুজ গ্রাম; সেখানে লাজুক হরিণীর মতো রমণীরা
অলস প্রহরে নকশি কাঁথায় বুনে যায় এখনো তাদের
জীবনের রূপকথা। হঠাৎ সন্ধ্যায় নিজঝুম আকাশছোঁয়া
বাঁশঝাড়ের উপর দিয়ে যখন সেখানে উঁকি মারে রূপবতী চাঁদ,
তার রূপে ঝকমক করে ওঠে পাথরঘাটার পানি আর তার
থালার মতন পদ্মের পাতারা। আনন্দে আমার একতারা
বেজে ওঠে পুনরায়। দুধসাদা কোনো রূপসীর কান
শুনছে সে সুর রাত্রি জেগে জেগে।
৫.
ইট-পাথরের এ-রঙমহলে আর নয়, আমি যাবো
চলন বিলের হরিণচরায়। সেখানে বাংলাদেশ
হলুদ-মসলিন শাড়ি পরে রূপকথা হয়ে আছে আজও
সরিষার খেতের ভিতর। বিলের গহিন থেকে
জংলি বাতাস এসে নিয়ে যায় উড়াড়ে উড়ায়ে তার
শাড়ির আঁচড় আর তার কাকের চোখের মতো হাঁটুছোঁয়া চুল।
যৌবন উপচে পড়া সরিষার ফুলে ফুলে মাতাল মৌমাছি
করে যায় দুরন্ত দস্যুতা। তাদের বি¯্রস্ত ঘ্রাণে মৌ মৌ করে
সারা মাঠ। মান্দারের ডালে বসে একটি হলদে পাখি
কার কথা ভাবে একা চুপচাপ কিছুক্ষণ একমনে!
মহাকালের নৈঃশব্দ ঠোঁটে নিয়ে তারপর হঠাৎ সে উড়ে যায়
হরিণচরার গহিন সবুজে। দোয়েলেরা দলবেঁধে
সাথে করে নিয়ে আসে অজস্র শালিক, খুটে খুটে খায় তারা
ঘাসপোকা ঘুরে ঘুরে। তাদের ডানার ’পরে
সোনারঙ রৌদ্র পড়ে পিছলে পিছলে যায়। আইলের
পাশ দিয়ে মধুচাষীদের রেখে যাওয়া বাক্সবন্দী রানীমাছি
জাদুগ্রস্ত করে রাখে মউ লুটপাটে ব্যস্ত মৌমাছিদেরকে,
উড়ে উড়ে গিয়ে যারা রানীর পবিত্র পায়ে চুমু খেয়ে আসে বারবার।
কত মধু জমে এই বাক্সের ভিতর! সেই মধু চলে যায়
বোতলে বোতলে পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে; অতঃপর
ঠোঁটে ঠোঁটে মানুষের লেগে থাকে বাংলার ঘ্রাণ। আমি
বাংলার গান গাই; রূপসী আমার বাংলার গান গাইতে গাইতে
হয়ে যাই আমি পৃথিবীর কবি। পৃথিবী আমাকে চেনে
আমার বাংলার রূপে।
৬.
ইট-পাথরের এ-রঙমহলে আর নয়, আমি যাবো
জ্যোতির্ময় আমার কেশবপুরে। সেখানে বাংলাদেশ
তাতানো খেজুররসে ভিজে ফুলে ওঠা চিতোই পিঠেয়
মুখ মিষ্টি করে ছড়াচ্ছে বাতাসে বেহেস্তের সুর। সেই সুরে,
ঘুম থেকে উঠে, মিলায় দোয়েল-ঘুঘু কণ্ঠ তাদের; তাদের ঘিরে
ঝাঁক বেঁধে নৃত্য করে দুনিয়ার পেঁচা; চপল ফিঙেরা
সজিনার ডালে বসে উড়ে যায় বারবার, পুনরায় ফিরে এসে
পুলকে নাচায় সরু ডাল লেজ নেড়ে নেড়ে। নারকেল-গাছে
দৌড়োদৌড়ি করে কাঠবিড়ালীরা। হঠাৎ দুড়–ম করে খসে পড়ে
মাটির উপর মুখ খাওয়া নারকেলের মুচি। সেই শব্দে মুখ তুলে
এদিক-ওদিক চায় এক জোড়া বেজি, ঝরা কাঁঠালপাতার ’পরে
খসখস আওয়াজ তুলে ছুটে যায়, অতঃপর, ঝোপের ভিতর।
মান্দার ফুলের ’পরে সকালের রৌদ্র লেগে
লাল টুকটুকে মেয়ের মুখের মতো করে ঝকমক।
কত যে শালিক তার কাঁটাঅলা ডালে বসে জুড়ে দেয় শোরগোল!
কাশবনের ভিতর থেকে কী ভেবে হঠাৎ করে বের হয়ে আসে
একটি শেয়াল; তাকে দেখে পেঁচারা আওয়াজ করে
করে ডাকাডাকি; কয়েকটি ফিঙে তার গার কাছে গিয়ে
ছোঁ মেরে আবার উড়ে গিয়ে বসে কলার পাতায়। তার ভারে
দুলতে থাকে সেই পাতা আর নাচতে থাকে আমার হৃদয়
যেন কাঁদাখোচা পাখি। আমি একতারা হাতে নিয়ে
বের হয়ে যাই লালনের মতো বাংলার পথে পথে।
বাংলার মাটি, পানি ও বাতাস যেন কান খাড়া করে
একমনে শুনতে থাকে ফুটানো রসের মতো উথলে ওঠা
একতারার সুর, যে-সুরে কেবলি মুগ্ধতা, কেবলি স্তুতি আর
আনন্দের শিহরণ।
শ্যামল বরণ গা আর শ্যামল বরণ পা
এই গাঁয়ে এক মেয়ে ছিলো, শ্যামল বরণ গা
দেখলে মনে হতো কোনো লজ্জাবতী গাছ
ছুঁয়ে দিলে কুঁকড়ে যাবে, তুলবে না আর পা
ঘা লাগলেই ভেঙে যাবে যেমন ভাঙে কাঁচ
এই গাঁয়ে এক মেয়ে ছিলো, শ্যামল বরণ গা
হাটতো যখন মনে হতো বন-ময়ূরের নাচ
কিন্তু কারো সামনে পড়লে থমকে যেতো পা
যেমন করে চারোর ভিতর থমকে দাঁড়ায় মাছ
সেই যে শ্যামল বরণ মেয়ে, দেখেছি তার রূপ
ফুলে ফুলে নুয়ে পড়া সজনে গাছের ডাল
কৃষ্ণচ‚ড়ার সারা অঙ্গে কুসুমের স্ত‚প
কিংবা যেন উথাল গাঙে ময়ূরপঙ্খীর পাল
ঝলসে গেছে তার রূপে চোখ, চোখের হলো কী
চোখ বুজলে শ্যামল বরণ, চোখ মেললেও তাই
হৃদয়গাঙের গহিন জলে শ্যামল মেয়েটি
কালবাউশের মতো মারে নরম পায়ের ঘাই
এখন আমার চতুর্দিকে কিছুই দেখি না
শ্যামল বরণ গা দেখি আর শ্যামল বরণ পা
হোসনে আরার কালো চুল
হোসনে আরার কালো চুল ছুঁয়েছিল মাটি, যেভাবে সাপের মতো
নেমে আসে পাকুড় গাছের মাথা থেকে অসংখ্য ঝুরি শীতল মাটিতে।
তার নদীর পাড়ের মতো ঠোঁটে লেপ্টে ছিলো পাকা ডালিমের রঙ।
আর তার দুই চোখ ধান পেকে ওঠা পাথরঘাটার বিল হয়ে
আমাকে বেহুঁশ করে রেখেছিল বহু কাল। আমি তার
তরমুজের ক্ষেতের মতো বুকে কান পেতে শুনেছিলাম ঝড়ের
শা শা শব্দ আর বর্ষার ক্রন্দন। সেও কি দুখিনী বেহুলার মতো
পেয়েছিল টের, একদিন মনসার শাপ এসে তার প্রাণের লখিন্দরকে
নিয়ে যাবে মৃত্যুময় দ্বীপে, যেখানে চব্বিশ ঘন্টা
ঘড়ির কাঁটায় ঘোরে পাথুরে সভ্যতা, রোবটের হাসি আর
যন্ত্রের নিঃশ্বাস? কালের নিগড় ভেঙে
আমি ফের ফিরে যাবো পাথরঘাটায়, যেখানে হোসনে আরা
রূপকথা হয়ে আছে আজও ধবল জোছনারাতে
নীলাম্বরী শাড়ি পরে, যেন রাধা তার প্রেমান্ধ কৃষ্ণের প্রতীক্ষায়
অশ্রুসিক্ত চোখে আর তার কালো চুল ছুঁয়ে আছে বাংলার মাটি।
নদীনামা
আমার সাত শ নদী হিংসার বাণে কারা মেরে গেছে এইভাবে পৃথিবীর ’পর?
খেয়ে গেছে ইয়াজুজ-মাজুজের মতো এসে কোন্ এলিয়েন হায় সবটুকু পানি?
থৈ থৈ করে আজ বালি চারদিকে, এককালে যেখানে শুধুই ছিলো মাছদের ঘর,
সেখানে জোছনারাতে মৎস্যকন্যারা এসে জুড়তো জোনাকি-নাচ, করতো মস্তানি
তাদেরকে ঘিরে ঘিরে কুমির-শুশুক; দেখে কেঁপে কেঁপে উঠতো যে চাঁদের অন্তর।
পানির সে রাজ্যে আজ মরা ইলিশের মতো পড়ে থাকা বালিদের শুষ্ক কানাকানি
ভারী করে তোলে রোজ বাউল বাতাস; কাঁদে স্বর্গলোকে বসে বুঝি চাঁদ-সদাগর
আর কেশ এলো করে চাঁপড়ায় বুক যেন লখিন্দর-শোকে তাঁর দিশেহারা রানী।
দিবালোকে হত্যা করা সাত শ নদীর লাশ তুলে দাও কেউ এসে আমার মাথায়,
আমি জাতিসংঘের সদর দপ্তরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে চাই পাথরের মতো;
পৃথিবী দেখুক, কত পাষÐ সীমার হলে নদীদের এইভাবে হত্যা করা যায়;
সভ্যতা দেখুক, আজও কী রকম অসভ্যতা মানুষের পৃথিবীতে বর্বর উদ্ধত
ডাইনোসরের মতো সিঁটকায় দাঁত! আর কাঁদুক জগৎবাসী নদীর ব্যথায়
কারণ বিলুপ্ত হলে নদ-নদী, মানুষের সভ্যতাই হয়ে যায় বিলুপ্ত মূলত।
খই
কেউ যেন খই ভাজছে কোথাও। সে-খইয়ের সুঘ্রাণে
ভিজছে বাতাস। যে-হাত ভাজছে এই খই,
তার মুখে বিন্দু বিন্দু জমছে নিশ্চয় ঘাম,
যা সে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছতেছে বারবার। হায়,
তার মুখটাও কি তামাটে উজ্জ্বল
আমার মায়ের মতো?
বাতাসে খইয়ের ঘ্রাণ। এই ঘ্রাণ
ছুটেছে আমাকে নিয়ে গোলপাতা দিয়ে ছাওয়া
আমাদের সেই মাটির হেঁশেলে। উত্তরে পুকুর।
পশ্চিমে ছড়ানো উঠোন, যেখানে হাঁস ও মুরগির
দিনভর ছুটোছুটি। দক্ষিণে বাগান। আর পুবপাশে
নকশী কাঁথার মতো মাঠ। মাথার উপর শুধু
নুয়ে পড়া নারকেল-পাতা জাম জামরুল সফেদা ও
বাতাবি লেবুর ডাল। সব পেয়েছির সেই দেশে
মা আমার ছিলো সম্রাজ্ঞীর মতো। তাঁর
হাতে ছিলো যাদু, যার স্পর্শে ধান খই হয়ে যেতো,
চাল হয়ে যেতো মুড়ি; যাঁর কাজই ছিলো
সুঘ্রাণ ছড়ানো চারদিকে–
খাদ্যের সুঘ্রাণ, স্নেহের সুঘ্রাণ, হৃদয় শীতল করা
দরদের সুঘ্রাণ, যা আজ উন্মত্তের মতো
পথে পথে শুধু খুঁজি।
জীবন ফেলেছে ঘিরে আজ ফ্যাক্টরির ধোঁয়া,
ট্যানারির দুর্গন্ধ ও সভ্যতার দূষিত বাতাস।
নাক শুধু আজ খোঁজে মৌ মৌ করা সেই
খইয়ের সুঘ্রাণ, সর্ষে-ইলিশ ও আউশ-বেগুনের
অপূর্ব বাশনা আর খুঁজে ফেরে দুটি চোখ
মায়ের তামাটে সেই মুখ,
যার বিনিময়ে
আটটা বেহেস্তও আজ দিয়ে দিতে পারি অনায়াসে।
বৃষ্টি
কাতলা মাছের মতো হাঁ-করে কাতরাচ্ছিল তৃষ্ণার্ত জমিন,
চেয়ে ছিলো গাছপালা চাতক পাখির মতো আকাশের দিকে;
নুয়ে পড়া লতাগুল্ম দেখছিল স্বপ্নে সিক্ত-আষাঢ়ের দিন,
শস্য-শষ্প পশুপাখি চাচ্ছিল সবাই শুধু রূপালি বৃষ্টিকে।
বহু প্রতীক্ষার বৃষ্টি এলো শেষে পৃথিবীতে অমৃতের মতো,
আনন্দে উঠলো নেচে মরা খাল, মৃত মাঠ, অসুস্থ অটবি;
মুহূর্তেই দিগ্বিদিকে বয়ে গেল শান্তিঝড়; সেরে গেল ক্ষত
ছিলো যত তনু-মনে; মুছে গেল দুঃখ-গ্লানি রোগশোক সবই।
ভিজেছে জমিন, যেন তুমুল বৃষ্টিতে ভেজা তুলোর বালিশ;
ভিজেছে বৃক্ষের ডাল, কাণ্ড ও মাটির নিচে মূল যতদূর;
শুভ্র শান্তি শান্তি জলে ভিজেছে মাটির মতো দোয়েলের শিস,
পড়েছে ছড়িয়ে ক্লান্ত মাঠঘাট জনপদে প্রশান্তির সুর।
বৃষ্টি! বৃষ্টি! আহা, বৃষ্টি! প্রত্যাশার বৃষ্টি বহু প্রতীক্ষার পর।
তবু কেন বিষণ্নতা? কী চায় এমন দিনে উতল অন্তর?
বর্ষারাতের কাব্য
কি নরম অন্ধকার ঘিরে আছে চারিধার,
থেকে থেকে চমকায় বিদ্যুৎ
বিদ্যুতের সে-আলোয় স্বর্গমর্ত্য দেখে লই,
নিজেকেও মনে হয় ভূত।
সারা রাত্রি এক তালে আকাশ সমানে ঢালে
প্রশান্তির পানি পৃথিবীতে;
সে-পানিতে তনু-মন ভেজায় মাঠ ও বন,
গাছপালা কেঁপে ওঠে শীতে।
বেরিয়ে পড়েছে রাতে মৎস্যকন্যার সাথে
বুনোজলে মৎস্যকুমার
স্বর্গমর্ত্য জুড়ে আজ কারো কোনো নেই কাজ,
মন শুধু চায় অভিসার।
মহাকাল গেছে থেমে, বসন্ত এসেছে নেমে,
নিপবনে নাচে মধুমাস
এ নরম অন্ধকারে মন শুধু চায় তারে
কুসুমেই যার বসবাস।
যত দূর চোখ যায়, মন ও কল্পনা
এই পথ দিয়ে ইউরিডিসির মতো তুমি চলে গেছো।
এই পথ বাটবিলে হয়ে মিশে গেছে অনন্ত নগরে।
আমি আজও অর্ফিয়ুস হয়ে ভাঙা বাঁশি হাতে নিয়ে
বসে আছি ছাতেনতলায়, আর তুলছি তোমার সুর।
যত দূর চোখ যায়, শুধু তুমি।
যত দূর মন যায়, শুধু তুমি।
এবং কল্পনা যত দূর, শুধু তুমি।
তুমি ছাড়া কী আছে উত্তরে দক্ষিণে পশ্চিমে পুবে আর!
এখানে আষাঢ় আসে। আমার দুহাতে তার
সুগন্ধি কদম্ব তুলে দিয়ে বলে, “এরই গান গাও,
এর সুবাসের সুর তোলো তোমার বাঁশিতে।”
এখানে বসন্ত আসে। আমার দুহাতে তার
কৃষ্ণচূড়া তুলে দিয়ে বলে, “এরই গান গাও,
এর সৌন্দর্যের সুর তোলো তোমার বাঁশিতে।”
ততই আমার বাঁশি গুঁতোনো ষাঁড়ের মতো
খুটো ভেঙে নিয়ে লেজ তুলে ছুটে চলে বাটবিলে
এবং জপতে থাকে কেবলি তোমার নাম।
তুমি যে-ডাহুক দেখে উল্লসিত হতে একদিন,
সে-ডাহুক আজও আমার চারপাশে ঘুরে ঘুরে
কণ্ঠ উচ্চে তুলে কাঁদে। তুমি যে-কাঁঠালগাছ ছুঁয়ে
করেছিলে প্রণয়ের অঙ্গীকার, সে-কাঁঠালগাছ আজও
প্রত্যহ ঝরিয়ে দেয় তার পাতা তোমার আমার শোকে।
যে-সাপ তোমাকে করেছিল দংশন
আর তুমি আমাকে এখানে ফেলে চলে গিয়েছিলে
অনন্ত নগরে; চাঁদ সওদাগরের মতো দেবো না আমিও
সেই মনসার পূজা কোনোদিন।
পৃথিবী বদলে যাচ্ছে প্রতিদিন;
প্রেম তবু সেই প্রেমের স্থানেই আছে।
মানুষ বদলে যাচ্ছে প্রতিদিন;
মন তবু সেই মনের স্থানেই আছে।
কবিরা বদলে যাচ্ছে প্রতিদিন;
পৃথিবীর কথা ভুলে কবিতায় তাঁরা ধর্মাবতার, রাষ্ট্রনায়ক,
নোংরা রাজনীতি ও দেহসর্বস্ব নারীদের কথাই বলছে শুধু;
আমি তবু সেই ছাতেনতলায় বসে ভাঙা বাঁশিতে তোমার
তুলেই চলেছি সুর। আমার এ-বাঁশি জোছনা রাহুত ছাড়া
জপতে চায় না কারো নাম।
যত দূর চোখ যায়, শুধু তুমি।
যত দূর মন যায়, শুধু তুমি।
এবং কল্পনা যত দূর, শুধু তুমি।
তুমি ছাড়া কী আছে কোথায় বলো আর!
ময়না
হিজলতলীর মহিরদ্দির ভাঙা কুঁড়েঘরে
হরিণীচোখ গৌর বরণ ময়না বসত করে
লাল টুকটুক ঠোঁট দিয়ে সে ঠোকায় হৃদয়ফল
তার তৃষ্ণা মেটায় শুধু কপোতাক্ষের জল
কপোতাক্ষের বুকে যখন উথলে ওঠে বান
ময়না আমার নৃত্য জোড়ে এবং শোনায় গান
তার গানে যায় বাতাস ভিজে যেন ভেজাচুল
কিংবা যেন বাদলাদিনের সিক্ত কদমফুল
পিছন ফেলে কপোতাক্ষ আর সে গানের পাখি
শুনতে এলাম এই শহরে কাকের ডাকাডাকি
যন্ত্রদানব দাপিয়ে বেড়ায়, রোবট নাচায় পা
হৃদয় আমার ছুটে চলে হিজলতলী গাঁ
হিজলতলীর মহিরদ্দির ভাঙা কুঁড়েঘরে
হরিণীচোখ গৌর বরণ ময়না বসত করে
দেও-দানবের দেশ পেরিয়ে যেন বীরের পায়ে
আবার ফিরে এলাম আমার হিজলতলী গাঁয়ে
কিন্তু কোথায় ময়না আমার, কোথায় রে তার গান
কোথায় গেল কপোতাক্ষের উথলে ওঠা বান
বাতাস এখন পুড়ছে রোদে, মাঠে শুধুই খরা
হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে কপোতাক্ষ মরা
গোরে শুয়ে মহিরদ্দি বান্ধে সুখের ঘর
ভিটাতে তার চরে বেড়ায় বুনো কবুতর
উড়ে গেছে ময়না শোকে কোন্ সে নিরুদ্দেশ
কষ্টে দু-পা পাথর হলো, কাশফুল সব কেশ
নিশ্চিন্ত নিবাস
মৃত্তিকার অধিকার
ছাড়ে না বৃক্ষেরা এক তিলও;
শিকড়-বাকড়-মূলে সাঁড়াশির মতো
আঁকড়ে ধরে থাকে তারা মাতৃময়ী মৃত্তিকার বুক,
যেভাবে দুধের শিশু ছাড়ে না পবিত্র তার
মায়ের স্তনের অধিকার।
মৃত্তিকাকে আঁকড়ে থাকে বলেই, বৃক্ষেরা
সবুজ অরণ্য হয়ে দুচোখ ধাঁধায় পৃথিবীর,
গানের পাখিরা উড়ে উড়ে আসে
ঝাঁক বেঁধে
আর বাঘ ও হরিণ খুঁজে পায় নিশ্চিন্ত নিবাস।
আমারও অনন্ত অধিকার আমার বাংলাদেশ।
আমি এর মৃত্তিকায় শুয়ে
ইতিহাস হয়ে ফুটে ফুটে থাকবো বর্ষার
কদমফুলের মতো একদিন।
বাতাসে ভাসবে আমার কদম্বকবিতার ঘ্রাণ,
যা সর্বাঙ্গে মেখে নিয়ে ফিরে যাবে নতুন দিনের
পথিকেরা। আমি কানে কানে
কয়ে যাবো তাদেরকে এই কথা—‘মৃত্তিকাকে
আঁকড়ে ধরে থাকো সবুজ বৃক্ষের মতো,
তাহলে মৃত্তিকা তোমার স্বদেশ হবে,
মানচিত্রখেকো শকুনেরা তবে পাবে না সাহস
ভিড়তে তোমার প্রাণের ভিটেয়।’
আমার বাংলাদেশ আমার অনন্ত অধিকার।
এখানে বৃক্ষের মতো
জন্ম আমার। আবার এখানেই
থাকবো ঘুমিয়ে আমি,
যেভাবে মায়ের কোলে উদরপূর্তির পর
নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকে দুগ্ধশিশু
পরম শান্তিতে।
উপরের ১০টি কবিতা বাংলাদেশ (২০২২) কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া
—–