আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ’র কবিতা পাঠ পাঠকের জন্য একটি নতুন অভিজ্ঞতা। কেননা তার কবিতা গতানুগতিক নয়। তার কবিতা মাল্টিলেয়ারড, কখনো বিমূর্ত বা বাস্তবতা-পরাবাস্তবতার টেক্সচারে রচিত। অন্ততপক্ষে তার প্রথম পর্বের কবিতাগুলো তাই। তার কবিতা প্রথম পাঠেই উন্মোচিত হয় না সহজে, পাঠকের আরো একটু সময় করে পড়ে নিতে হয়। তখন ধীরে ধীরে তার অবগুন্ঠন ভাঙতে থাকে আর আমরা বিস্ময়ে তার কবিতায় অবগাহন করতে থাকি। কিন্তু সাঈদের কবিতা এক জায়গায় আটকে থাকে নি, বদলেছে বহুবার। বাংলাদেশে থাকা অবস্থায় তার কবিতা স্বদেশের শিকড়জুড়ে, বাঙালির ইতিহাস, উত্থান, পতন, গৌরব গাথায় লতাপাতার মতো জড়িয়ে ছিল। ’পলাশী ও পানিপথ’ ’গানের বাহিরে কবিতাগুচ্ছ’ ’নোমেন্স জোন পেরিয়ে’ ’জল্লাদ ও মুখোশ বিষয়ক প্ররোচনাগুলি’ কাব্যগ্রন্থে এই নিশানাগুলো লক্ষ্য করা যায়। সময়ের সাথে সাথে বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ী অভিবাসনের পর তার কবিতা বদলে গেছে আবারো, ভেতর ও বাইরে। কন্টেন্ট আর ফর্ম এর সাথে সাথে বদলে গেছে ভাষা। জিয়ো পোয়েটিক্স-এ যেমন কবির স্থানীয় জীবন, ভূপ্রকৃতি কবিতায় আত্মস্থ’ হয়, তেমনিভাবে তার কবিতায়ও তার নতুন আবাসস্থল– অস্ট্রেলিয়ার জলবায়ু, প্রকৃতি, তার ইমিগ্রেন্ট হবার আনন্দ ও যাতনা দুই প্রকাশ পেয়েছে। ’শাদা সন্ত মেঘদল’ ও ’ক্রমশ আপেলপাতা বেয়ে’ এবং ‘নতুন পাণ্ডুলিপির দিনে’ কাব্যগ্রন্থগুলিতে এসবের পরিচয় মেলে। আবার তাকে দেখা যায়– এক আবিদের কলমে মা’বুদকে কাছে পাবার নিমগ্ন সুরের, মরমি কবিতাগুচ্ছ লিখতে(সিজদা ও অন্যান্য ইসরা)। কোরান ও ইসলামিক ইতিহাস –ঐতিহ্যস্নাত কাব্যগ্রন্থ– ‘সমস্ত বিসমিল্লাহ’। এ যেন এক নতুন আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ। তার এই ধারার কবিতাগুলো ইতোমধ্যেই এক ভাষা-ঐশ্বর্য নিয়ে পাঠকের মনে জায়গা করে নিয়েছে। আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ’র কবিতার বিশেষ গুণ– তার কবিতা বোঝার আগেই পাঠকের ভালো লেগে যায়, কারণ তার কবিতার শক্তি– এর যাদুময় ভাষা। তার কাছে ভাষা শুধুমাত্র অতি সরল রৈখিক বা এবসার্ড চিন্তা ভাবনা প্রকাশের বাহন নয়, তার আছে ইতিহাস, সমাজ মানুষ ও রাজনীতির কাছে দায়বদ্ধতা। হয়ত সেখান থেকেই তার কবিতায় যুগপৎ বিস্ময় আর বেদনাবোধের একটি চিকন স্রোত লক্ষ্য করা যায়। তাই তার লেখা ব্যক্তি মানুষের স্বরলিপি হয়েও আবার তা বহু মানুষের ক্যালিওগ্রাফি যেন।
নির্বাচিত ত্রিশের জন্য–এ আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ’র প্রথম থেকে সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত মোট ১১টি কাব্যগ্রন্থ’– শীতমৃত্যু ও জলতরঙ্গ (১৯৯৫), বাল্মীকির মৌনকথন (১৯৯৬), পলাশী ও পানিপথ(২০০৯), গানের বাহিরে কবিতাগুচ্ছ(২০১০), শাদা সন্ত মেঘদল(২০১১), জল্লাদ ও মুখোশ বিষয়ক প্ররোচনাগুলি(২০১২), নো ম্যান্স জোন পেরিয়ে(২০১২), ক্রমশ আপেলপাতা বেয়ে(২০১৫), সিজদা ও অন্যান্য ইসরা(২০১৬), নতুন পাণ্ডুলিপির দিনে(২০২০) ও সমস্ত বিসমিল্লাহ(২০২২) থেকে পাঠকপ্রিয় কবিতাগুলো নির্বাচিত করা হয়েছে।
নদী অভিজ্ঞতা
নুড়ি থেকে দৌড়ে ধরলে ধবধবে শাদা মাছ
নিবিড় পাতাল রক্তে তোমাকে ছোঁবার সাধ
মাছ হয়ে জাগে।
প্রসংগ ত্যাগ করে আয়নার ভিতরে গিয়ে বসলে
নগ্ন কাঁচ নিলাজ মোহে নিজের কুহক খুলে দেখালো-
ভাবলে মৃত্যু খুব ঝুলন্ত থাকে- শাদা মাছে।
আবার নদীকে একটি লাল সুতোয় পেঁচিয়ে রাখলে চোখে।
দূরে পালিয়ে বেড়ালো কোনো কোনো জন্ম
যার সম্পর্ক হৃত– মাতৃ বিভাজনে।
আর গলা থেকে বের হলো মৃত স্বপ্নডাল
তখন বাহবা বললো প্রত্ন ধীবর
তার মাছমৃত্যু তোমার জিবে।
(শীতমৃত্যু ও জলতরঙ্গ, ১৯৯৫)
পথে পাওয়া আলো
দীঘিপাড়ে আলো- ফুটে উঠা জেব্রাশিশু, অন্তর্মুখী।
স্বপ্ন থেকে ডাকে যেন সহোদরা বোন, জন্ম জন্ম নীল।
বয়স উত্তীর্ণ ভোরে ডিমের সময় হলো
আলো নিচে গিয়ে ধুন্ধুলের বোঁটা থেকে ছিড়ে দিলো ফুল।
মনে পড়ে পথশ্রম
ফেলে এসেছি কোকিল কথা দয়া ও দাক্ষিণ্য
পায়ের খরায় জমে থাকা জল
জলে জলে কুকুর লড়াই- ঐতিহাসিক।
জেগে থাকি সর্ন্তপণে বেলা উঠে বোধিদ্রুমে
ঝোপ থেকে পাখাসঞ্চারী এক চাঁদ
দোল খেয়ে পড়ে গেলো কোথায় কোন প্রহরী দ্বীপে।
পাতার কিনারে আলো- জলঘরা ভরে নেবে অতীত মুহূর্ত
ফিরে আসার দরোজা ভেবে মাথাটি বাড়াই,
দীঘিপাড়ে আলো- ফুলে উঠা জ্যোৎস্নাশিশু, মাতৃমুখী।
পথিক নিহত হলো জামা খুলে।
(বাল্মীকির মৌনকথন, ১৯৯৬)
পলাশী
জিজ্ঞেস করো। ঘোড়া হে উড়ন্ত অশ্ব, তোমার পিঠে কে ভাসমান।
জিজ্ঞেস করো। প্রর্বতক, পথিক অথবা গোপন রাজদূত কিনা।
জিজ্ঞেস করো। জিজ্ঞেস করো। কারণ সম্মুখে আমাদের গণজমায়েত।
কারণ এটি জানা দরকার আরোহীর আগুন আমাদের ভিটেমাটি
কতোটুকু পোড়াবে।
জিজ্ঞেস করো। হাতি, হে উজ্জ্বল ঐরাবত কতোদূর যাবে।
অথবা কাকে নিয়ে যাবে। জিজ্ঞেস করো।
জিজ্ঞেস করো। কারণ সম্মুখে আমাদের ভোজসভা।
কারণ এটি জানা দরকার কী সংবাদ ছিন্ন করে দেবে
ক্ষুদিরামের কণ্ঠ।
ঘোড়া আসছে ঘোড়া যাচ্ছে। আমাদের গ্রাম্য চুল্লি ভরা
বিরামহীন বরফের স্তর।
ইংরেজ আসছে নবাব নামছে। আমাদের পিতা প্রপিতামহের
সমাধি, কঙ্কাল।
আমাদের পলাশী বলতে আমার একটি বোন
আদিঅন্তে ভাতের থালা হাতে পথে পথে ঘুরছে
তার অনাগত সন্তানের নাম সিরাজদৌল্লাহ।
(পলাশী ও পানিপথ, ২০০৯)
জীবনানন্দ দাশ স্মরণে
পাথরও রক্ত চায় যেনো মহাভারতের মুনি
যাহা চায় তাহাই জীবন্ত মাঠে।
ঐ আসছে ভেসে শুদ্ধতম ঘিলুর সুঘ্রাণ
নাসারন্ধ্রে হাত রেখে দেখা যাবে-
জল কীভাবে আলোর ভূমিকায় ঘুরে ঘুরে
ট্রামের ভাষায় কথা বলে।
অধিকন্তু ট্রাম– বনলতা সেন
দেখে মাথার টানেলে হরিতকি গাছের প্রতিভা
দুটো চড়ুই অনন্ত ভ্রমণের কথা বলে গেছে কতোদিন।
হাজার বছর ধরে বিকেলের গৃহমুখি রাস্তা
অপেক্ষায় এমন অপার্থিব পথিকের
যার আছে তৃণ ইতিহাস গভীর কলসে।
বরিশালের শিশির মাখা পথের ঘটনা শেষ
জেগে আছে কলকাতার শিকারি হীনম্মন্য রাস্তা।
দেখে- নির্বিবাদি এক মানুষের ক্রোমোজমে
ধানসিঁড়ি জলের ক’ফোটা।
অযোনিসম্ভূত মহিলার প্রতিলিপি
আর বাঙলা কবিতার ভবিষ্যৎ।
তখন আমরা আমাদের বাণিজ্যপ্রবণ চলাফেরা,
শুকনো পাতায় জল ঢেলে অনেক সময় ধরে
রেলপথ অতিক্রম করে আসি।
জানি মূঢ় ভারতবর্ষের কয়েকটি আর্য গাথা
একদিকে চিরজীবী অশোকের ভ্রাতৃবধ আর একদিন
বাঙলা কবিতা লেখেন জীবনানন্দ দাশ।
(পলাশী ও পানিপথ, ২০০৯)
পানিপথ
দেহাবশেষ নিয়ে ফিরেছি ঘাটে। বংশচিহ্ন অপহৃত।
পরিচয় বলতে শুধু আধপোড়া নাভিখণ্ড।
তার স্মরণে একলা মানুষ।
দূরে লালরশ্মি, আগুন। উত্থিত ঘোড়ার ফণা
মনে করিয়ে দিচ্ছে প্রয়োজনে সেও অজগর।
নদী নদী শূন্য প্রবজ্যা। ঘূর্ণিজলে কানাইয়ের নাও
পাতালমুখো।
একদিন নিদ্রাশেষে ঘুটে কুড়োনির মেয়ে
ঘেমে ওঠা ভাতের হাড়ি স্পর্শ করে দেখে
মাঠে মাঠে শস্যের যুবক ভস্ম হয়ে গেছে।
অশোক গাছের নিচে রাঢ় বাংলার মেলা
তখন সবুজ শীতকাল।
হিম জামার নিচে আগুনের জন্ম
অর্থাৎ অগ্নি বাসরে বাল্যবিবাহ।
বধূ দাঁড়িয়ে আছে কুয়োতলার কাছে
কিন্তু তার কাছে এমন সংবাদ নেই–
যে সে বিছানা সাজাবে।
শুধু কুণ্ডলিত রণধ্বনি ভ্রমবিকাশে দেখা যায়।
মোঘলবধে উজ্জীবিত শেরবাহিনী।
এই পথেই শুভযাত্রী বরপুত্র অওদিপাউস আসবে
অপেক্ষায় আছে ক্রমাগত বিবাহযোগ্যা মাতা
হায় নিয়তি সন্ততি সবকিছু পানিপথে লেখা।
এখন এই গান ঘুরে ঘুরে আসে
চড়ুইয়ের মতো নাচে
আমি দৌড়ে যাই, পুত্র দৌড়ে যায়
পানিপথ গন্ধম নামে গড়াগড়ি খায়।
(পলাশী ও পানিপথ, ২০০৯)
মীনকে
(নদীতীরে রাজা ধীবর)
মীন, আমার ধৈর্যচ্যুতি হয়। সহস্র বছর কূলে বসে থাকা, ও হো মীন আমার ধর্মচ্যূতি হয়।
তুমি জল ছেড়ে উঠছো না! এই প্রার্থনার রূপ দেখছো না।
মীন, মীন আমি নিহত। আমার নৌকা ধ্বংসপ্রাপ্ত, আমার ছিপ নিয়ে গ্যাছে কালো কেউটে সাপ।
এই রাত্রিকাল। আমার মেয়ে রজঃস্বলা। ও হো মীন প্রকাশিত হও। দেশে দেশে অন্নগীত,
মাঠে শুধু মানুষের হাড়, মীন তুমি উঠছো না। লোকালয়ে ধোঁয়া, চাঁদ পুড়ে যাচ্ছে।
মীন, মীন তুমি এখনো… রজঃস্রাব নিঃশেষ হবে প্রভাতে। আমরা বংশহীন হবো কুটিল গ্রীষ্মে।
ও হো মীন তুমি শুনছো না।
(পলাশী ও পানিপথ, ২০০৯)
আম্রকানন
আমের বাগানে গড়ে ওঠে চোরের প্রার্থনা।
প্রভু বর দিয়ো আর দুটি আম দিয়ো
যেন আমের আসরে ভেসে যায় পুত্রের চেহারা।
তখন নিশ্চুপ ঝরে পড়ে একটি বাদামী ফল
আম নয় আরো কিছু ধ্রুবফল নিচু হয়ে নামে।
সর্ব অঙ্গে কালিদহ নখদন্ত দাঁতের আঁচড়
বলি প্রভু, গরীবের সাথে আদিঅন্ত মশকারা।
রাত হলে আম বাগানে আবারো আসি
তখন বাগান হয়ে যায় আম্রকানন।
আমের শরীর থেকে বের হয়ে আসে ফলের প্রাচীন ভাষা-
ইতিহাসবিদ বলো এমন কবিতা কিভাবে পাও?
তখন কুয়াশা ধোঁয়া চোখে চোখে পড়ে
শত শত হাতি ঘোড়া ছুটাছুটি করে।
তারপর গীত হয় মন্ত্রবলে বাক্য হয়
’সেরাজের বাহিনী পুতুলের মতো দাঁড়াইয়া রহিলো’
গোলাবারুদের জায়গায় বরফযুগের নিস্তব্ধতা।
আমি চোর- বোধিহীন বান্দা বুঝি না আমের রহস্য।
এবার প্রথম মনে হলো প্রার্থনার চেয়ে আরো কলা
গুপ্তলীলা আছে আমের গভীরে।
গাঢ় আমফল, আম্রকানন। শাদা চোখে শুধুই বাগান
ভেতরে ভেতরে গুহ্যকথা, চোরের অধিক সর্পলীলা।
(গানের বাহিরে কবিতাগুচ্ছ ,২০১০)
যু দ্ধ ক্ষে ত্র
ফেলে গেছ রক্তকম্বলে
পাশে কাঁটাতারের সীমানা
তোমাকে অধিকার অথবা হরণ করি কোন সাহসে।
ভূমিদখলের অভিশাপ নিয়েছি মাথায়
কাছে আসে দূরে যায় শত্রু-ছাউনি
আশেপাশে জাতিপ্রথা কামুফ্লাজ রীতি
সেহেতু অতিসাবধানতা
সদা মন বাঘ বাঘদাস ।
দেশ অপহরণের মন্ত্র জপি
ট্রেঞ্চের পাশে বন্ধু রাইফেল
উড়ে যায় বোমারু বিমান গুলি খাওয়া পাখি।
কখন শেষ হয় এই ধর্মযুদ্ধ
কখন সরে যায়
হামজার বুক থেকে আবু সুফিয়ানের বল্লম।
কখন ঘণ্টা বাজে স্কুলে
কাঁটাতারের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন আম্মা
কবর খোঁড়া শেষ হলে-
শাদা পতাকা উত্তোলন।
(শাদা সন্ত মেঘদল, ২০১১ )
স র ল তা
সরলতা ধরে রাখি
প্রিয় আম গাছ তুমি আমার আত্মীয়।
এই শিকারমুখর জনসভায় তোমার যদি ছায়া পাই
যেমন সতত আম্রবীথিকায়।
পরিহারপ্রবণতা মুদ্রা হয়ে আসে, তবু ভালো লাগে
তবু মানুষের ভালোবাসা চাই।
দূর থেকে কী সব পাঠাও-
বিষখালি মাঠঘরে শত্রু, রাইফেল
কবুতর হানটিং- এসব সমাধি বিহবলতা
পথে পথে শিকারি যেমন।
একটি যে আগুন তারও ফুলশিখা এই বিভোর বাতাসে।
সরলতা মনপ্রাণ দিয়ে, আগর জ্বালিয়ে অপেক্ষায় থাকি-
তুমি মাংস ব্যবসায়ীর পালঙ্ক থেকে ছুটে এসে
আমাকে বিবাহ করো।
কণ্ঠভরা সীতাহার, সিনেমা শো – সবকিছু নোনসেন্স
মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ধারণা যেমন।
(শাদা সন্ত মেঘদল, ২০১১ )
চিঠিভূমি
চিঠি লেখার পাতাভরে পুতুলঘর, গরুগাড়ি, ধুলিপথ নাম না জানা ছায়াপ্রাচীনের ইচ্ছা। লালনীল রোলটানা জলরাস্তা- ডাকঘরের জানালা ফাঁক করে নিয়ে যায় মেয়েদের স্কুলে। পিটিমাঠে হাত বদল- জ্বলছে শরীর লুকানোর বাসনা! দেখছি কামিজের নিচেও শহীদ হয় ঘরেফেরা রাত্রিতস্কর।
বেহালা বাজানো হরিণের ভাষা – রাতভর অবসর, জন্মদান, চিকিৎসা ব্যবস্থা এইসব লীলাখেলা শান্ত হয় চিঠিতে। শৈশবের হারিয়ে যাওয়া বলের নামে মাঠে মাঠে শীতনিবাস চাইছি। আর লিখছি নিদ্রাকাতর কুয়াশাকবিতা। হলুদ খড়ের দেশে প্রাণগর্ভে বেজে উঠে আগুনের বেহালা।
জলকাতরতা এই গাছের বাকল প্যাপিরাসে। তাই ভিজে যাচ্ছে সকালের বিছানা শাদাকালো বর্ষায়। আর নুয়ে পড়া বালিহাঁস পুকুরঘাটে গ্রামে ফেরার কথা ভাবছে। শিশুকোলে বাতাসে দাঁড়ানো তুমি – শরীর খুলে পথ দেখাও এই চিঠিভূমিতে।
(নো-ম্যানস জোন পেরিয়ে, ২০১২)
শিমার
ছড়িয়ে পড়ছে গোষ্ঠীহিংসা, সিপাহীদের ঘোড়া। দুলছে কারো মন লুণ্ঠনের আশায়।
মাঠে মাঠে দখলের খেলা, ভাতৃবধের রক্ত। কলিজা চূর্ণ করার সম্মোহন শক্তি বধির ইস্পাতে।
পাশে ছেলেমেয়েদের খেলনা পুতুল- রেহেলে গোলাপ-পাতার গন্ধ।
আছে যে লোমশূন্য, স্মিত হেসে খঞ্জর চালায় ইমামের গলায়। ক্লান্ত জিহবার স্তর ক্লান্ত পিতামহের প্রিয় দৌহিত্র। ’জোরে চালাও জোরে’ সহাস্যে অনুমোদন করে নিয়তির নির্দেশ – মনুষ্য জবাই।
অপেক্ষা করে যে দূরে, সর্বকালে সমস্ত সময়ে- তার চোখে ঝুলে সিংহাসনের মায়া। জান বাজি ধরে দৌড়ায় ভাড়াটে কাতেল। পূর্বে বা পশ্চিমে, বাড়ির পাশে ঝোপজঙ্গলে লুকিয়ে থাকে বন্ধুবেশে বিছানার
(নো-ম্যানস জোন পেরিয়ে, ২০১২)
স্নোয়ী মাউন্টেনের কাছে
তুষার প্রপাত দেখে দেখে শুধু কবিতাই করবো। তোমাকে বলি।
শাদা পাহাড়ের নিম্নদেশে সীতাহার, দুলদুল ঘোড়া- যাই উড়ে আসুক।
তোমাকে বলি।
লাল এপ্রোনের গার্ড -আপনার হাতেও বিদেশি সভ্যতার ছলাকলা, তাড়াহুড়া।
যাই যাই করছে উটপাখি, সবুজ বিড়াল। বাস থেকে নেমে পড়া মেয়েটার শরীরে
সোনালি কবুতর। আমি গমদানা খুঁজে খুঁজে হয়রান। এই জাতীয় হরেক রকমের
মিলনমেলাতে স্তন ধরে, বাঘ হওয়ার বাসনা থাকে মানুষের!
নীল ঘাসে অতিথীরা বসে থাকে। এমন সকালবেলা নাস্তার টেবিলে
যেন পৃথিবীর দেহে কোনোদিন মানুষই উঠেনি!
তার আমপড়া, জামপড়া স্মৃতি তরল মদের সাথে তুল্য।
আমাদের সব আলোচনা শেষে হয় দলহারা এই বুনো হরিণের পথজ্ঞান দেখে।
তুমি যেই পথে থাকো তাকে তুষার প্রপাতের সাথে মেশানো যায় না।
হাত ধরে অতিদূরে গাড়ি করে যাবে কালোমহিষের পালকেরা
(নো-ম্যানস জোন পেরিয়ে, ২০১২)
শেষ বাসা
আজিমপুর কবরস্থানের কাছে বাসা
ছাদের হাওয়ায় উড়ে আসে বিডিআরদের খাকী।
সেনাদের প্যারেড দিয়ে দূর পরিখার চালচিত্রঃ
মানুষের শেষ বাগান তলিয়ে যাবে রাইফেলের বাটে।
নিউমার্কেটে গিয়ে বাজার করি,
সবজি সোয়াবিন, এইসব মৌসুমি ফল, মাংসগোলাপ
নিয়ে আসি এক চাঁদকলের রিক্সায়।
বউ রান্না করে কাচামরিচের লালসবুজে,
পানি জুড়ে বিছানা রাত্রিতাড়নার ঝিলিক।
বাচ্চারা সাপলুডু খেলছে, টেলিভিশনে ম্যাকগাইভার
সব কটি জানালার ছাপচিত্র ভেসে আসছে পড়ার টেবিলে।
রাত্রি ঘন হলে এক জুঁই বিছানায় শুতে যাই
বালিশ ঘেঁষে বৃষ্টিদিনের শালিখ ওড়ে।
আর
ভাইবোনদের হাড় এসে মিশে যায় কুয়াশাচাদরে।
(জল্লাদ ও মুখোশ বিষয়ক প্ররোচনাগুলি, ২০১০)
গানের আসরে
ঘুর্ণ্যমান বায়ুপৃষ্ঠে তোমার কথা পাচ্ছি
এত সুর তারান্নুম, এত জলবিছানো
সিম্ফনি সোনাটা
গ্রহ অনু-গ্রহ সমুদ্র করে তুলছে।
উড়ন্ত শরীর আমার- কোনো মাধ্যকর্ষণই পাচ্ছি না,
হালকা পালকের স্মৃতিগুচ্ছ জাগছে মাথার গুগোলে।
ভিড়ের মধ্যে তোমার ঠোঁট নড়ে…
পুতুলখেলার মাইম, ঝি টিকা ঝি … ডিজে …রিডু
উড়ে আসছে পুচ্ছে লুকানো কার হারানো চাবি!
একটু একটু আলগা হচ্ছে বন্ধুর মুখ
বদ্ধ ভিড়ের হামলা। আরো কিছু ছায়া আরো কিছু
উড়ে চলা গাছ- পা মিলিয়ে দিচ্ছে ম্যামথ ভূপৃষ্ঠের ওপর।
আমি তাদের কী নামে ডাকি- কী নাম দিই
এই বিহ্বল মায়াস্রোতার!
(ক্রমশ আপেলপাতা বেয়ে, ২০১৫)
হিজাব
লুকিয়ে লুকিয়ে থাকো
আর আমি আল্লাহ আল্লাহ করি
চোখগুলি খুলে রাখি ওজু আর কুয়োতলাতে।
যে কণ্ঠধ্বনি দাও -তার নোটেশনে মাটিতে ভায়োলিন
বাজে, বাজে না এমন মন্থর ময়ূর ও কোকিল
তোমার সৌন্দর্যগুলি ছড়িয়ে পড়ছে
জমজমের পানিতে।
আর তুমি কেবল দূর হয়ে পড়ছ
রাস্তা খুলে আমি পাথরে, মজনুন মজনুন!
এত দালান এত কাঁটাতার লাগছে গলায়
তোমার নামটিও নিতে পারছি না!
বৃষ্টিদিনে
মেঘ হয়ে ভাসছে তোমার হারিয়ে যাওয়া বোতাম।
(ক্রমশ আপেলপাতা বেয়ে, ২০১৫)
কবিতাভাবনা
লাফিয়ে উঠছে লাল মোরগ বিনা বাতাসে
মরা মানুষের মুখ থেকে জীবিতের বাড়ি
ঝোল,কেরুয়া, তিল তেলাপিয়া।
আর গোসল শব্দে পাজামার গন্ধ
এমন স্ত্রীবিহীন কাঠ শহরে
রক্ত লাইলাক তুমি!
শুধু মুদ্রা হয়ে চলো। প্রজাপতির বদলে কয়েন,
গমের রুটি, এইসব হাতের হাওয়া, মশগুল।
লোহার হাতল ধরে, লটকে পড়া হতভম্ব শেয়ালেরা
ফিরে আসে সুর্যতরুণ সন্ধ্যার বিচে।
তবুও আঙুর ফল টক!
এই শীতে
ক্লান্ত একটি যবনিকা বুট জুতার ভেতর-
মচমচ হাঁটার শিল্পে সঙ্গম ধারণা অবিরত।
বিউটি পারলারে বড় স্তনের পোস্টার দেখে দেখে
কবিতার ভেতরে সারারাত লাল মোরগের ওঠানামা!
(ক্রমশ আপেলপাতা বেয়ে, ২০১৫)
মা’বুদ
পলায়নপর আয়তক্ষেত্র থেকে
পিছু পিছু আসছি
বুকে জ্ঞানফল বুকে নক্ষত্র গ্যালারির চাঁদমারি।
যারা মুগ্ধ ধ্যানে দাঁড়িয়ে আছে কোণাকোণি
তাদের পাজামার সাদায়- টগবগে দুলদুল।
নিখিলের সব ধু-ধু পেরিয়ে পাগড়িগুলি
পথে পথে উড়ছে।
যেভাবে তারা ডাকছে
যেভাবে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে গলা থেকে
যেভাবে মিশে যাচ্ছে সীমানা ও সাকিন
সেরকম ডাক আমি কখনো ডাকিনি!
সেই দুঃখে
আমি যাবো কি যাবো না – নাকি তাদের ফেলে
এই নীল জাম্পারের নিচে থাকা
কৃষ্ণ আয়না ধরে বসে থাকবো- এ কথা ভাবছি।
সেই ভাবনা দেখে শিষ দিল সিজদারত পাখি
তার ডানা থেকে তাসবিহ
তার ঠোঁট থেকে ইয়া আল্লাহ!
(সিজদা ও অন্যান্য ইসরা, ২০১৬)
ক্বাবা
যে সব শহরে ক্বাবা নাই
সেখানে সোনালি ঘণ্টা বাজে
আরবি ওয়াল পেইন্টিং থেকে উড়ে কালো সমুদ্রপাহাড়,
স্কুলে যেতে যেতে মেয়েরা গমের পাউরুটি ছুঁড়ে
আর কবতুরগুলি পাশের পাহাড়ে হাড্ডি হয়ে যায়।
আমি যেখানে থাকি তার একটিও নাই
না ক্বাবা, না কালো আরবি ওয়াল পেইন্টিং
কোনো কবুতরও মেঘে মেঘে ঘুর্ণি মারে না সহজে।
শুধু আ্যাশ কালারের গাড়িগুলি মুরগির বাচ্চাদের মতো
রাউন্ডঅ্যাবাউটে ঘুরে।
সেজন্য আমার মনে শত দুঃখ জাগে
আমি মধ্য রাতে মায়ের ঘুমানো মুখটার দিকে চাই
আর একটা জায়নামাজ খুঁজি।
কিন্তু মা তো অনেক আগেই মরে গেছে
তাহলে কেন যে তার কবরের দিকে বিছানা বাড়াই!
আর রাগবি খেলার মাঠে নবী ইব্রাহিমকে খুঁজি।
(সিজদা ও অন্যান্য ইসরা, ২০১৬)
পাশা খেলার দম নিয়ে গুলি ছুঁড়ে বীর
তাদের ডাকি। তাই শুনে জেগে উঠে মরহুম।
উপস্থিত দেয় রাহমান আর রাহীমে।
শ্বাস থেকে জিন্দা ছড়িয়ে পড়ছে
মসজিদের কোণায়।
(সিজদা ও অন্যান্য ইসরা, ২০১৬)
হেরা
আমি তোমার ভেতরে
নাকি তুমি আমার ভেতরে!
নাকি আমাকেই তুমি শিষ দিয়ে নিয়ে গেছ জনমের আগে।
আমি কালা পাগল- আমার ঘুম জাগরণে কী সব খবর
আমাকে অসাড় করে নামে কোন ইসরার জগৎ।
যেন পৃথিবীর শেষ শূন্যস্থান
যেন জিন্দা কবরে করেছি বাসস্থান
যেন পাতালে পাতালে জাগে গায়েবির দরশন।
মাথায় ফকির সেজে বসে আছি কার অপেক্ষায়?
তাকে তো জানি না আমি
তাকে তো চিনি না আমি
শুধু তার ঢোলের বাজনা পাই হাড় ও সিনায়।
জানি সে একটি বাঁশি
এক অদ্বিতীয় অদেখার গান।
বাঁশি আমাকে বাজায়
নাকি আমি বাঁশি হয়ে যাই!
(সিজদা ও অন্যান্য ইসরা, ২০১৬)
ইলম
কিতাব
নিদ্রা নিদ্রাহীন সন্তদের দলে
রক্ত জাগাও পাথরের ফুলে!
আর জমজমের বৃষ্টি পড়ে দুশমনের গ্রামে।
আয়াত
আমি ছেড়ে তুমি জাগো
করো আমিহীন সর্বনাশ আমাকে!
শূন্য হাড় পড়ে থাকি লাল কাঁকড়ার বীচে।
আবু জেহেল
আসর ক্রমশ বড় হতে থাকে
তার চেয়ে বড় অন্ধকারের গাছ
আর সব পাখি উড়তে থাকে মোহম্মদের(সঃ) দিকে।
(সিজদা ও অন্যান্য ইসরা, ২০১৬)
সালাম বাংলা
সালাম বাংলা, তোমাকে নিয়েছি গুপ্ত ডালিমে
স্কুলের টেবিলে, গোসলের অতি গরম পানিতে।
জনকলরব, লোহার পাথর, খানসেনা আর
পলাশী সিরাজ, ইমাম হোসেন কারবালা খঞ্জরে!
যেন বা আমার কলিজা তোমার
যেন বা তোমাকে দিয়েছি হাজারো পানিপথ!
তোমার শুধুই জয় হোক- ওগো অক্ষয় হিমালয়!
তুমি কি শুধুই সীমানা ছাড়াবে- রক্ত লেগুনে?
কী চাও শিকারি ভাষায় গোলাপ গোকূলে
সবুজে পতাকা পেরিয়ে পাগল কিশোরে?
আমাকে কী দান করবে বলো এ ছিন্ন সকালে?
তামার পাত্র গলিয়ে সাজাবে মনসার বিষ?
নাকি ফেলে যাবে ভারতবর্ষ, নো-ম্যানস ল্যাণ্ডে?
শরীরে আমার জমেছে খণ্ড বরফ এবং পিপাসার আলো
হাঁটছি রায়টে, বোমারু বিমান, গুমন্ত ঘোড়াশালে!
সালাম বাঙলা, আমাকে শুইয়ে ধরো তুমি গোপন পাতালে
আমার জানালা বন্ধ! বন্দী আমি রাক্ষসের দখলে!
(নতুন পাণ্ডুলিপির দিনে, ২০২০)
ভাষাপ্রিয়দের সাথে
ভাষাপ্রিয়দের সাথে বসে থাকি।
শিস দেই, লেজ নাড়ি। দেখি সীমানা বিস্তৃত।
দেখি- লাখো মুখোশের বার্বি, ব্লাকহোল।
তাদের সিনায় রাক্ষসের ভাষালিপি- ম্যাজিক অক্ষর।
যেন তিতির মরণ শেষে- দাঁতে দাঁতে মাংস।
আর আগুন ফাটছে জানালায়-
লম্বা তাদের জাহিম, যেন বাগান ছিল না কোনোদিন
ছিল না ময়ূর যে হামদ করে রাখবে।
তার চেয়ে রক্ত ঝরল নিমপাতা, দুধ সরোবর!
তুমি সেই চোখ চাও? যা কোনোদিন ফুটবে না!
তাহলে ভাষাপ্রিয়দের সাথে ঝুলে থাকো
লেখো নিঝুম ঠিকানা- কয়েদিদের গ্রামে
আর কবরের গান গাও ।
ভাষাপ্রিয়দের সাথে বসে থাকি। শিস দেই, লেজ নাড়ি।
দেখি শত্রু নামছে এয়ারগান নিয়ে, দেখি বুক ছিঁড়ে
কাবিলের মুখ
দেখি ভাষাবাহিনী ড্রিল করে আনে লোহার কফিন।
(নতুন পাণ্ডুলিপির দিনে, ২০২০)
পুরস্কার
পুরস্কারের কথা বলব না আমি।
তোমরা এই হাতিগাছ নিয়ে চলে যাও
পলাশী, আম্রকাননে।
দেখো- লর্ড ক্লাইভ কিভাবে কাছে টানছে
জগৎ শেঠ, রাজা রাজবল্লভ। আর
দেখো একটি ভাঙ্গা নৌকা ও
সিরাজের পরিত্যক্ত জুতাখানি।
আর শোনো মর্মাহত মুর্শিদাবাদ,
তার দেয়ালের
হায় সিরাজ হায় সিরাজ প্রতিধবনি!
তার চেয়ে আমি বাদ মাগরিব এইসব পেস্তা বাদাম
আর মাঠভরা খরগোশের রূপ নিয়ে বসে থাকব।
দেখব অড়হর পাতার শীষ,
দেখব একটি কপিফুলের তন্দ্রা ছিঁড়ে
নেমে আসছে হাজার হাজার মৌ-দরবেশ।
আমি শুধু সারি সারি সবুজ চাই
চন্দ্রচোরদের তরমুজ বাগানে।
যেখানে লাল নিয়ে নৃত্য করছে
এতিম পিপড়েদের দল।
(নতুন পাণ্ডুলিপির দিনে, ২০২০)
আমার আল্লাহ
(কবি সৈয়দ তারিককে)
মানুষের দেহে থাকেন না তিনি, নাই কোনো জীব ও জন্তুতে।
সবই সৃষ্টি তার, স্রষ্টা তিনি। তিনি আলিমুল গায়েব, অদৃশ্য।
সব কিছুই ছুটছে তার পিছু, তিনি জানেন জাহির ও বাতেন।
বান্দাদের কন্ট্রোলার তিনি, তিনি দেন হিদায়েত কিংবা গোমরাহি।
তিনিই শব্দ, তিনিই বাক্য, শক্তি দেন কথা বলবার
তার কাছ থেকে সরে গেলে আওলিয়া সাজে শয়তান।
পুত্তলিকায় হাজির নাই তিনি, নাই কোনো পীর বা মুর্শিদে
সবকিছুর ওপরে তিনি, মহাপ্রভু বসেন আরশে- সিংহাসনে।
কারো পিতা নন তিনি। কোনো সৃষ্টি নয় তার- পুত্র অথবা কন্যা।
আদমও সৃষ্টি তার, ইব্রাহিম কিংবা মরিয়ম পুত্র- যিশু।
নাফসে পাবে না তাকে, না পাবে মোরাকাবায়।
আবিদের ঈমান, আমলে তিনি, তাকে পাওয়া যায়
নবিজীর হাদিসে, সালাতে; আল কোরআন, সিজদায়।
তিনিই একক। নাই তার অংশীদার, কেউ দ্বিতীয় অপর ।
শুরুতেও তিনি, সমাপ্তিও তিনি, রাহমানুর রাহিম-আল্লাহ!
(সমস্ত বিসমিল্লাহ, ২০২২)
বাঙ্গালি মুসলমান কবি
আমি বাঙ্গালি মুসলমান কবি
আমার সামনে ঝুলে রবীন্দ্রনাথের ছবি।
বলে- তুই এত দিওয়ানা হলি
ওরে ও মুসলমান কবি!
আমি বলি- আমারে একটা নাম দেন
ওহে শান্তিনিকেতনী পির।
বন্ধক রাখেন তরবারি- ধনুক ও তীর।
আমাকে কবিতাভাষা দেন নদী নদী।
আমি যেন মাছ হই- মাছের শিকারি।
আমার উঠোনে জাগে নিমগাছ
তার ফুল ছাড়ে আজব কস্তরি ঘ্রাণ
আমি বাঙ্গালি মুসলমান কবি।
আমি বাঞ্চা করি- জীবনানন্দের পাখিচোখ
ঘুরি- রূপসী বাংলার মাঠে ঘাটে- দোয়েল চড়ুই ।
যেন আমার মাথায় মাল্যকরে ভাঁটফুল
কাঁধে নাচে- সুরঞ্জনা, তার গন্ধরাজ চুল।
আমি হারিয়েছি সবকথা
আমার জিহ্বা থেকে নামে ধান ও কুয়াশা।
আমি লাশকাটা ঘরে করি আনাগোনা
সাতটি তারার মগ্ন তিমিরে আমার ফানা ফিল্লাহ।
আমি হারিয়েছি আমার জবান ও আল্লাহ!
আমি বাঙ্গালি মুসলমান কবি।
আমি মায়াবী আজান দেবো শোলাকিয়া মাঠে।
আমার সুজুদ হবে ধুল ধূলি নীলাম্বরি ঘাসে।
লাখো মুসল্লি তিতির উড়ে আমগাছে ।
তারা গুজরান করে রাত তাহাজ্জুদে
যেন চারিদিকে নেমেছে ফেরেস্তাদের ভিড়।
আমার কলিজায় বাজে আল কোরানের সুর
কালাম ও কলিমায়- জ্বীন, শয়তান দূর
আমি বাঙ্গালি মুসলমান কবি।
আমি জন্ম লই- মেঘনা ও যমুনার তীরে
আমাকে কে পর করে- দূর আরবের দেশে?
তাদের সহাস্য শয়তানি থোরাই কেয়ার করি।
দেখো বাংলাভাষায় করেছি সহিহ কবিতার চাষ
আমি শব্দ-তাসবিতে নাম করি আর রাহমান
লাল ডালিমদানায় দেখি তার কুদরতি জ্ঞান।
আমার মঞ্জিল- নাফসুল মুত্মাঈন
আমি শান্ত সমাহিত- ক্বালবুল সালিম
আমি বাঙ্গালি মুসলমান কবি।
(সমস্ত বিসমিল্লাহ, ২০২২)
রুমি
সোজা পথেই ছিলেন মাওলানা
সিরাতুম মুস্তাকিম
সালাত আর সিজদায়
আলো আর আখিরায়।
একদিন কোন কুহক এসে
ডেকে নিয়ে যায়
শারিয়ার বাইরে, অন্ধ
দাল্লিনে!
নিজের ছায়ার কাছে ঘুরে ঘুরে
আজগুবি নাচ, গান বাজনা!
যে কাজগুলি করেন নাই
স্বয়ং রাসুল অথবা সাহাবা।
কোন কুহক এসে ডেকে নিয়ে যায়
তার নাম কী জালালউদ্দিন
তার নাম কী তাবরিজি শামস?
(সমস্ত বিসমিল্লাহ, ২০২২)
আমি ও ২২ শে শ্রাবণ
বাইশে শ্রাবণ আসলে পরে
একটা রবীন্দ্রনাথ আমার পাশে বইসা থাকে।
আমার গরুর মাংস খাওয়া দেখলে তিনি চইলা যান না
বা আমার ‘আল্লাহু আকবর’ বইলা আজান দিলেও
রাগ করেন না। তিনি আমার মুখের দিকে তাকাইয়া থাকেন।
আমি সোনার তরী, গীতাঞ্জলি নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ-
এইসব কবিতা আবৃত্তি কইরা শোনাই।
রবীন্দ্রনাথের পিপাসা লাগে। আমি পানি আইনা দেই।
এক সময় তিনি চায়ের কথা বললে, আমি চা বানাইয়া দেই।
আমি বলি দেখেন আপনে মুসলমানদের নিয়া লিখেন নাই
বইলা আমার কোন দুঃখ নাই। এইটা হইতেই পারে।
কিন্তু আপনে আমাগোরে বহিরাগত বলছেন।
ভিনদেশি বলছেন- এতে আমি কষ্ট পাইছি।
আমি বলি ‘শুনেন কবি, আপনিও তো বাইরের লোকই।
এইটা শুইনা রবীন্দ্রনাথ লজ্জা পায়। মুখ ঘুরাইয়া
জানালার দিকে তাকাইয়া থাকে।
তখন আমার নবিজীর কথা মনে পড়ে।
তিনি কীভাবে একজন আবিসিনিও আর কালো
আমার ভাই- বেলালকে বুকে জড়াইয়া নিছেন।
এইসবই ইসলামের শিক্ষা। এইখানে
জাতপাতের কোনো ভেদাভেদ নাই।
তাই ৮০০ বছরের রাজত্বের পরও মুসলমানরা
ভারতবর্ষ থাইকা কাউরে চইলা যাইতে বলে নাই।
তারপরও বাইশে শ্রাবণ আসলে পরে
একটা রবীন্দ্রনাথ আমার পাশে বইসা থাকে।
সব কথা শোনার পরও তিনি কোথাও চইলা যান না।
আমার ভাষার মধ্যে চুপি চুপি নৌকা চালাইয়া যান!
(সমস্ত বিসমিল্লাহ, ২০২২)
আমার নবী
আপনার কথা ভাবতে গেলেই আমার দু’চোখ ভরে পানি চলে আসে। কারো জন্য এমন হয় না আমার কখনো। আপনাকে কত খুঁজে বেড়াই! মাঠে ময়দানে, সবুজে, হলুদে। ভীরে, জনশূন্যে। এই তো আপনি আসছেন, হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন! কিন্তু আপনাকে আমি কোথাও পাই না! যেদিকে তাকাই শুধু কাঁটাতারের সীমানা।
আপনি জন্মে ছিলেন আমার সময়ের অনেক অনেক আগে। আহা কত আগে, কত আগে! আমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে আপনি, কিন্তু আবার কীভাবে আমার কাছে বাস্তব হয়ে যান! যেন আমি দেখছি আপনাকে, কথা বলছি, হেঁটে যাচ্ছি আপনার সাথে। দেখছি আপনার মুখ থেকে আলো ফুটে উঠছে, চোখ থেকে আকাশ ঝরে পড়ছে।
আমি আপনাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করছি! অবশ হয়ে পড়ছে আমার শরীর, বন্ধ হয়ে পড়ছে জবান। যেন ভারী এক পাহাড় টেনে চলছি ক্রমশ! এক সময় আমি ঘুমিয়ে পড়ি আর ভাবি- ওরা কী করত যারা আপনার কাছে কাছে থাকত? ভালোবাসায় নিজেকেই ভুলে যেত? শ্রদ্ধায় ব্যাকুল হয়ে পড়ত? নাকি আপনার কাছ থেকে সরতেই চাইত না কোনোদিন? আর অই যে মেঘদল যারা আপনাকে ঢেকে রেখেছিল, সেই যে সাহাবী গাছ যে আপনাকে ছায়া দিয়েছিল। আমি তো তাদের মত এত সোভাগ্যবান হতেও পারলাম না, হায়!। আমি তো ধুলিও হতে পারলাম না সেই পথটির যার মধ্য দিয়ে আপনি রোজ হেঁটে যেতেন, প্রিয়।
(সমস্ত বিসমিল্লাহ, ২০২২)
মাওলানা
হযরতে মজে আছে মাওলানা
দিলে বাজে রব্বানা
আমি মুক্তাদি রুকুতে শামিল-
পড়ি সুবহানা।
মাওলানা ধীরে মধুর কিরাত করে
আমার ক্বলবে- গোপন রক্ত ঝরে।
নিজেকে হারিয়ে নিজেকেই খুঁজি
সুজুদে হয়েছি ফানাহ ফিল্লা।
মাওলানা, মাওলানা কী শোনাও সুরে সুরে?
কীভাবে পা রাখি আজ লাল মসজিদের বাইরে?
আমার গোলাপ ফুটে আয়াত আল্লাহ’র
বুকে মরা গাছ জাগে কালাম আল্লাহ’র
আমি হারিয়েছি পৃথিবীর ঘড়ি- সময় ধারণা।
মাওলানা প্রিয় মাওলানা
আমি নিহত হয়েছি দুনিয়ার ভাষা-
ঝোপ জঙ্গলে, রুপসী হেলেনে
আমার হদয় শক্ত হয়েছে আনন্দ গানে।
আমি পূজা করি আমার নাফস আমমারা
আমি বিদ্রোহ করি সকালে বিকালে!
মাওলানা প্রিয় মাওলানা
আমি আজ কোথাও যাবো না
আমি ঘুমিয়ে পড়বো তোমার কিরাতে
আমি মোম হয়ে গলে পড়বো আলিফ লাম মিমে
আমি ভুলে যাবো আমার নাম ও ঠিকানা।
(সমস্ত বিসমিল্লাহ, ২০২২)
তোমাকে খুঁজি
নিরাকারে তুমি থাকো, তোমাকে দেখার যে কোনো উপায় নাই।
সে ব্যথায় আমি বিচলিত, চোখ মেলে অপেক্ষায় থাকি
রুকু আর সিজদার গহীনে তোমাকে খুঁজি।
তুমি কেবল দূরেই থাকো, আসো না সাক্ষাৎ রূপে
তোমার দিদার হবে কেবলই আমার জান্নাতে পেলে!
তোমাকে আসমা উল হুসনার সত্যে উপলদ্ধি করি
তাই ভাষাই মাধ্যম হয় তোমাকে পাওয়ার।
যেন ভাষা-দুনিয়ায় তুমি রয়েছ হাজির!
আমি ভাষা-বীনা কোনো পথ পাইনা মালিক।
আমি ভিখারির বেশে নামাজে দাঁড়াই।
তোমার হঠাৎ উপস্থিতি টের পেতে চাই।
তুমি তাই- যেই নাম ধরে ডাকি
নিরানব্বই নামের নূরে তুমি স্বয়ং প্রকাশ আল্লাহ!
তুমি আকারে নাই কিন্তু অক্ষরে আছো
সুরাহ ফাতিহা থেকে সুরা নাস পর্যন্ত মায়াবী কালামে
তুমি হও প্রকাশিত। যেন জিন্দা সব আরবি অক্ষর-
আমার ক্বলবে- সুরে সুরে কথা বলতেছে।
তোমার নামের কারিশমা প্রতিটি হরফ থেকে উপচিয়ে পড়ে!
এই কি তোমার রূপ হে আল্লাহ, ইয়া জুল জালালি ওয়াল ইকরাম’?
তোমাকে দেখার লোভে আমি ক্রমাগত আরবি কালামে মশগুল।
যেন বা আলিফ, লাম মিমের রহস্য খুলে- তুমি আলো করে
উপস্থিত হও- আমার সালাতে!
(সমস্ত বিসমিল্লাহ, ২০২২)