ড. ইসরাইল খান
সাতচল্লিশে বঙ্গবিভাগের পর পূর্ববাঙলা থেকে আটচল্লিশ সাল পর্যন্ত কোনও সাহিত্য-সাময়িকী প্রকাশিত হয়নি বলে একটা কথা চালু আছে। কিন্তু তা কতোটা সত্য ? সাপ্তাহিক ‘চাবুক’ তো ১৯৩২ থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছিল ঢাকা থেকে উনিশ শো পঞ্চাশ-বায়ান্ন পর্যন্তই। আরও অনেক পত্রিকা প্রকাশের তথ্য আছে। কিন্তু ঢাকা থেকে নতুন পত্রিকা প্রকাশের তথ্য খুঁজতে গিয়ে কৃষ্টি আর সীমান্ত ছাড়া আর কোনো সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশের তথ্য জানা যায় না। কৃষ্টি কার্তিক ১৩৫৪-তে ঢাকা থেকে এবং সীমান্ত চট্টগ্রাম থেকে একই বাংলা মাসে প্রকাশিত হয় মাহবুবউল আলম চৌধুরী ও সুচরিত চৌধুরীর সম্পাদনায়। খ্রীস্টিয় মাসের হিসাবে ‘সীমান্ত’ থেকে কৃষ্টির পূর্ববর্তী। কৃষ্টি’র গায়ে প্রকাশের তারিখ অক্টোবর-নভেম্বর ১৯৪৭। সীমান্ত’র গায়ে লেখা শুধু নভেম্বর ১৯৪৭।
হিসাবের আবর্তে ঘোরাঘুরি না-করলে স্বাধীন পাকিস্তান থেকে একসঙ্গেই দুটি শহর থেকে খাঁটি দুটি প্রগতিশীল সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশিত হয় বলে ধরে নেয়াই সঙ্গত। দুটিই ঐতিহাসিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ। যদিও পাকি-হয়রানি উৎরে সীমান্ত পাঁচ বছর চলে, আর কৃষ্টি মাত্র এক সংখ্যাতেই অবসিত হয়। আজ শুধুই কৃষ্টির কথা। কৃষ্টি ও সীমান্ত এবং ঐ কালের সাময়িকপত্রে চিত্রিত হয়ে আছে অকপটে সাতচল্লিশের আগের ও পরের বাঙলার নানাজাতের সমাজচিত্র।
একটি সাহিত্য-পত্রিকায় যে-সমস্ত বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত, কৃষ্টি’তে তা পাওয়া যায়। নিয়মিত প্রকাশের অভিপ্রায় কৃষ্টির ছিল। মার্কসীয়-মতাদর্শে বিশ্বাসী হওয়ায় এবং কৃষ্টির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যগণ হিন্দু বিধায় প্রথম সংখ্যার পর মুসলিম লীগের অত্যাচারে আর প্রকাশিত হতে পারেনি। প্রথম সংখ্যার কটি রচনার নিচে ‘ক্রমশ’ লেখা ছিল। কিন্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রতি আর বাংলা ভাষার পক্ষে থাকায় কৃষ্টি’কে পাকিস্তান সরকারের ঘোরতর সন্দেহের মধ্যে পড়তে হয়। তাছাড়া দাঙ্গা চলছিলই। ১৯৫০ সালের দাঙ্গার ভয়াবহতা দেখে কৃষ্টির উদ্যোক্তারা দেশত্যাগ করেছিলেন বলে মনে হয়। কারণ এরপর কৃষ্টির কারো কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।
কৃষ্টির একটি সংখ্যামাত্র প্রকাশের নমুনা পেলেও তাতেই পূর্ব বাঙলার সংস্কৃতির ইতিহাসে কৃষ্টি নিজেকে স্থায়ীরূপে প্রতিষ্ঠিত করে যেতে সক্ষম হয়েছে। এই পত্রিকার বক্তব্য ও শৈল্পিকমান অসাধারণ উন্নত। একটি যথার্থ সাহিত্য পত্রিকা যে সমাজ সংস্কৃতি ও সাহিত্য-শিল্পের উন্নতি সাধনের মহান ব্রত নিয়েই প্রকাশ পেয়ে থাকে সেই সচেতনতা সক্ষমতা ও স্বদেশ হিতৈষণা তাঁদের ছিল।
কৃষ্টি প্রকাশিত হয় গোদনাইল নারায়গঞ্জ থেকে। পরিচালকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন সুধাংশু রায়, প্রভাত সরকার, সাধন চাটার্জী, ফুলদা রায় ও জীবন গোস্বামী। সম্পাদক-প্রকাশক বা মূদ্রক হিসাবে কারও নাম ছিল না। ডাবল ডিমাই সাইজ সাদা কাগজ ৫৬ পৃষ্ঠার মধ্যে বিজ্ঞাপন ১০ পৃষ্ঠায় প্রায় বিশটি-বাইশটি। বিজ্ঞাপনগুলো সেকালের ঢাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি চিত্র তুলে ধরে। বলা হয়েছিল : ‘প্রতি বাংলা মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রকাশিত হইবে। কার্তিক হইতে বর্ষ আরম্ভ। প্রতি সংখ্যার মূল্য আট আনা। কবিতা গল্প নাটক প্রবন্ধাদি সাদরে গৃহীত হইবে।’ মুদ্রণপারিপাট্য ভালো। কয়েকটি উপশিরোনামে সম্পাদকীয় বিনস্ত– উল্লসিত সাম্রাজ্যবাদী, বাঙালি বিদ্বেষ, শিক্ষার ভাবী মাধ্যম, পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা শহর ইত্যাদি। শীলা দেবীর প্রবন্ধ আছে ‘রবীন্দ্রনাথের চিঠি’ নামে। আবদুল মান্নান, গোপাল ব্যানার্জী, কিরণশংকর সেনগুপ্ত, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও অনিমেশ দাশগুপ্তের কবিতা ও প্রভাতকিরণ সরকারের গল্প সুরেন্দ্রমোহন পঞ্চতীর্থ লিখিত কবি চন্দ্রাবতীর জীবনী–প্রবন্ধ ছদ্মনামের ঘন্টাকালেঅভিনয়যোগ্য একটি নাটিকা সাইরেন প্রভৃতি এর রচনাবলি। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল পাকিস্তানের ভিত্তিমূলে কুঠারাঘাত হানা মনীষী মুহম্মদ এনামুল হকের ঐতিহাসিক প্রবন্ধ ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার পরিপ্রেক্ষিতে উর্দু ও বাংলা’ শীর্ষক প্রবন্ধ। পরিচালকদের কেউ হয়ত লিখেছিলেন ‘পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প-সম্ভার : বস্ত্রশিল্প’ সম্পর্কে যাতে রয়েছে সেকালে নারায়ণগঞ্জ তথা পূর্ববাঙলার বস্ত্রকলসমূহের বিবরণ। সম্পাদকীয়য় বলা হয়:
‘কৃষ্টি পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতিমূলক বাংলা মাসিক পত্রিকা। অনেকেই নামের উপর জোর দিয়ে থাকেন…এরপরও যদি অর্থ খোঁজেন বলবো, কিছু আছে। চলতি সাময়িকপত্রিকার মতো গল্প প্রবন্ধ কবিতা নাটক ইত্যাদি দিয়ে পাঠকদের মনোরঞ্জন একটি উদ্দেশ্য হলেও যুগের দাবি মেটানোও আমাদের লক্ষ্য। কতটুকুই বা পারবো?
(তাঁরা বলেন)–বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে যে ‘কালচার’ গড়ে উঠেছে আমরা তারই অনুশীলন করে যাবো। অনেকে প্রশ্ন করেন ভাষাগত কালচার কি ভৌগোলিক সীমারেখা দ্বারা নির্দেশিত হবে ? কিন্তু কালচারের বাস্তবসত্তা খুঁজতে গেলে আমরা ভুল করবো। … সমগ্র বাংলা ভাষা-ভাষী ব্যক্তির মাঝে যে বিশেষ মনোবৃত্তি যুগ-যুগ ধরে ফল্গুনদীর মতো অন্তর্নিহিত তার পরিস্ফুটনকেই বলবো ‘কালচার’। আমরা তাকেই প্রকাশ করতে চেষ্টা করবো। তাকেই সহজভাবে অনুবাদ করতে গিয়ে নামের সাথে সত্তার সামঞ্জস্য রাখতে পারিনি, বলেছি ‘কৃষ্টি’। রসিকসমাজ একে সংস্কৃতি বলেও আখ্যা দিতে পারেন। তাতে আমাদের কোনও আপত্তি নেই। পত্রিকার বিষয়বস্তুই নামকেই জাগিয়ে তুলবে।’
কৃষ্টি সাহিত্যিক পত্রিকা। বিশেষভাবে সাহিত্যই এর উপজীব্য। কিন্তু এ সাময়িকপত্রিকা। তাই বর্তমানকে আলোচনা করতে গিয়ে রাজনীতি বা সমাজনীতির ছোঁয়াচ একেবারে এড়াতে হয়ত পারব না। কিন্তু রাজনীতি বা সমাজনীতির কোন বিশেষ মতবাদের সমর্থক আমরা নই। তাই আমরা সাময়িক রাজনীতি বা সমাজনীতি নিরপেক্ষভাবে আলোচনা করব।…নতুন লেখকগোষ্ঠীকে প্রতিভা বিকাশের জন্য সাহায্য করবো তাঁদের সাহিত্যিক প্রচেষ্টাকে অব্যাহত রাখবার জন্যে। এতে করে যদি আমরা একজন সাহিত্যিককেও বাংলা সাহিত্যের আসরে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি তাহলে আমাদের উদ্যম সার্থক হবে।…দেশের চঞ্চল পরিস্থিতির জন্য… আপ্রাণ চেষ্টায়….অত্যন্ত অল্প সময়ে বের করেছি… ত্রæটি পরের সংখ্যায় ঘটতে দেবো না।’
‘কৃষ্টি’র লেখাগুলো ঐতিহাসিক বিবেচনায় আজ মূল্যবান সমাজ-দর্পণ হয়ে পড়েছে। এর বিজ্ঞাপনগুলোর মধ্যে অধিকাংশই বস্ত্রমিলের এবং প্রেসের। এ-থেকে অনুমান করা যায় পত্রিকা প্রকাশের নেপথ্যে বস্ত্রমিলের মালিক-পুঁজিপতিদের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল এবং সমাজতান্ত্রিক ভাবনা এবং শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থ বিবেচনাকালে বস্ত্র-মালিকদের স্বার্থকেও তাঁরা অগ্রাহ্য করবেন না। বস্ত্রমিলের বিজ্ঞাপন দিতে গিয়ে যেসব কথা লেখা হয়েছে, তাতে যেমন তৎকালীন সমাজের একটি চিত্র পাওয়া যায়, তেমনি বস্ত্রশিল্পের এবং শ্রমিকশ্রেণীর বিভিন্ন দাবি-দাওয়া প্রসঙ্গে সমালোচিত সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণায় অসঙ্গতি বা মালিক-স্বার্থের প্রতি আনুক‚ল্য প্রকাশ পেয়েছে। সম্পাদকগোষ্ঠীর কোনো কোনো সদস্য কি বস্ত্রমিলের মালিকদের ঘণিষ্ট কেউ ছিলেন ? লক্ষ্মী স্পিনিং এ্যাণ্ড উইভিং মিলস লিঃ, নারায়ণগঞ্জ-এর বিজ্ঞাপনে লেখা হয়েছে : ‘অন্ন ও বস্ত্রের দারুণ দুর্ভিক্ষ আজ আমাদের সকল উৎসবকে ম্লান করিয়া দিয়াছে।’ ‘ভারতবর্ষ আজ স্বাধীনতা লাভ করিয়াছে কিন্তু আজও আমরা পরিধেয় বস্ত্রের জন্য বিদেশী আমদানীর মুখাপেক্ষী। আজ এই বৈপ্লবিক যুগেও যদি আমরা স্বাবলম্বী হবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা না করি, তবে আমাদের বহু বৎসরের আত্মত্যাগ ব্যর্থ হয়ে যাবে।’
‘পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প-সম্ভার : বস্ত্রশিল্প’ শীর্ষক নিবন্ধে লেখা হয়েছে : ‘সমাজ ও সাহিত্যে শিল্পের স্থানকে অস্বীকার করা চলেনা। তাই শিল্পের সম্বন্ধে যেকোন প্রবন্ধ সাদরে গৃহীত হবে।’ এই পার্থিব জগতে সমস্ত সমস্যার মূলে রয়েছে যতো প্রশ্ন তারমধ্যে অন্যতম বস্ত্র-সমস্যা। পূর্বপাকিস্তানে এই সমস্যার সমাধান করতে হলে বস্ত্রশিল্পের সার্বিক পর্যালোচনা দরকার। দেখা যাবে বস্ত্রশিল্পের ক্ষেত্রে যান্ত্রিকযুগের একাধিপত্য। পূর্ব-পাকিস্তানের বস্ত্রমিলগুলোর উৎপাদনের অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে-যা তথ্য হিসেবে আজ উল্লেখযোগ্য :
বস্ত্রকলসমূহ তাঁত সংখ্যা উৎপাদনের হার
১. ঢাকেশ্বরী কটন মিল (১নং মিল) ৭৮০ ৩৩,০০,০০০ গজ
২. ঢাকেশ্বরী কটন মিল (২নং মিল) ৫১১
৩. চিত্তরঞ্জন কটন মিল ১৫০ ৪,০০,০০০ গজ
৪. লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিল ২২২ ৪,২৫,০০০ গজ
৫. ঢাকা কটন মিল ১২৪ ২,২৫,০০০গজ
৬. মোহিনী মিল (১নং) ৫১৭ ১৫,০০,০০০ গজ
৭. আচার্য প্রফুল্লচন্দ্ৰ কটন মিল ১১০ ২,০০,০০০গজ
৮. ন্যাশনাল কটন মিল ৩০০ ৬,০০,০০০ গজ
৯.ভাগ্যলক্ষ্মী কটন মিল ৬ ১২,০০০ গজ
১০. আবুবকর সিদ্দিক কটন মিল ১০০ ২,০০,০০০ গজ
১১. লক্ষ্মী স্পিনিং মিল –
—————————————
মোট =২৮০০ ৬৮,৬২,০০০ গজ
পর্যালোচনায় বলা হয় : এইসব মিল থেকে উৎপাদনের সঠিক তথ্য পাওয়া না-গেলেও সম্ভাব্য উৎপাদন হিসাব করেই আমরা আলোচনা করেছি। দেখা যায় পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত কল থেকে মাসে মোট প্রায় ৬৮,৬২,০০০ গজ কাপড় পাওয়া যায়–, অর্থাৎ বছরে প্রায় ৮,২৪,৬৪০,০০০ গজ কাপড় পাওয়া যায়। পূর্ব পাকিস্তানের লোক সংখ্যা প্রায় ৩,৯১,১১,৯১২। বছরে ১টি লোকের অন্যূন ৩০ গজ কাপড়ের প্রয়োজন পড়ে। ২০ গজ ধরলেও…উৎপাদিত কাপড়ের পরিমাণ থেকে সোয়া দুই গজ কাপড় মাথা পিছু পেতে পারি। এত বড় সমস্যা সমাধান করতে হলে উৎপাদিত কাপড়ের পরিমাণে দশগুণ বাড়াতে হবে। শুধু কলের সংখ্যা বাড়ালে চলবেনাÑতার সঙ্গে প্রয়োজন হবে সুদক্ষ কারিগরের। মিল মালিকগণকে শুধু কল উৎপাদন এবং লাভের অঙ্ক দেখলেই চলবেনা। যে শ্রমিক এ উৎপাদন ও লাভের অঙ্ক বাড়িয়ে চলেছে তাঁদের উপরও দৃষ্টি দিতে হবে। তাঁদের দক্ষতার (ঊঋঋওঈওঊঘঈণ) বিরুদ্ধে নালিশ জানালেই চলবেনা তাদের দক্ষতা বাড়াবার জন্য তাদের জীবন-ধারণের মান বাড়িয়ে তুলতে হবেÑবুঝিয়ে দিতে হবে দায়িত্ববোধকে।…শ্রমিকের জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। শ্রমিকদেরও একটা দায়িত্ব আছে। সে দায়িত্ব কতটুকুন তাঁরা পালন করবেন তাও তলিয়ে দেখতে হবে। একদিকে যেমন সস্তা সাম্যবাদী বুলি আওড়িয়ে শ্রমিকদের অস্বাভাবিক দাবী পূরণের আশায় বিভ্রান্ত করে দেওয়া উচিত নয়, তেমনি শ্রমিকদের অশিক্ষিত রেখে তাঁদের জীবনমান কমিয়ে, তাঁদের দক্ষতাকে পঙ্গু করে রাখা উচিত নয়।…শ্রেণী সংগ্রাম বা পষধংং ংঃৎঁমমষব-এর যুক্তি দেখিয়ে মার্কসীয়পন্থীরা যেমন দেশের শিল্পকে পঙ্গু করে তুলছে, তেমনি ইঁৎমধহরহম মাস্টারের মত উপেক্ষা করে শিল্পের প্রসার ক্ষুণ্ন করে তুলছেন।৪
কৃষ্টি-র রাষ্ট্রীয়-আদর্শবোধের প্রতিফলন ঘটেছে সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী চিন্তার সপক্ষে অবস্থান নেয়াতে। ঐতিহ্যের প্রশ্নেও বাঙালির অবিভাজ্য সাংস্কৃতিক সত্তাকেই তাঁরা প্রাধান্য দিয়েছেন। পাকিস্তানি সংস্কৃতি অর্থাৎ একজাতি একধর্ম একরাষ্ট্র এক স্বার্থÑএই চিন্তাকে সর্বাত্মকভাবে সমর্থন করেননি কৃষ্টির কর্ণধারেরা। তাঁরা কটাক্ষ হেনেছেন আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদকেও। ‘উল্লসিত সাম্রজ্যবাদী’ শীর্ষক সম্পাদকীয় নিবন্ধে লেখা হয় :
‘জটিল ক‚টনীতির দুর্ভেদ্য চক্রান্ত ও সুদীর্ঘ দু শতাব্দীব্যাপী শ্রম ও সাধনার ফলে ভারতবর্ষের জাতীয় জীবনে যে সার্থক সা¤প্রদায়িক কলহের সুদৃঢ় ভিত্তি রচনা করা হয়েছে তাতে করে চার্চিল যে অত্যধিক প্রলুব্ধ হয়েছেন তা তাঁর সম্প্রতি প্রদত্ত এক্সেস শহরের বক্তৃতাতেই পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে।…কুচক্রী বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এতদিন নির্বিবাদে যাদের শোষণ করে আসছিল, আজ তারা বৃটিশ নাগপাশ ছিন্ন করেও সুস্থ বোধ করতে পারছে না এটুকুই কি সাম্রাজ্যবাদীদের আজ সান্ত্বনার কারণ নয় ? আজ আমাদের একথা কিছুতেই ভুললে চলবেনা যে সা¤প্রদায়িক অশান্তি যদি এখনও প্রশ্রয় পায় তাহলে আমাদের সর্বনাশ অনিবার্য। দেশের সাংস্কৃতিক ঐক্যবোধকে সুষ্ঠু ও সমুন্নত রাখবার গুরুদায়িত্ব আজ আমাদেরই ওপর ন্যস্ত। যারা এখনও মধ্যযুগীয় দুর্নীতি সমর্থন করে তারাই যে নিঃসংশয়ে নবজাত পাকিস্তান এবং ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু একথা উপলব্ধি করবার সময় আমাদের সম্মুখীন।’
‘বাঙালি বিদ্বেষ’ শীর্ষক সম্পাদকীয়য় বলা হয় :
‘বিহার ও আসামের বিভিন্নস্থানে বাঙালি বিদ্বেষ অত্যন্ত প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। …বাঙলা ও আসামের মধ্যে বিদ্বেষের প্রশ্ন নিতান্তই অবাঞ্চনীয়, যুক্তিহীন ও বিষ্ময়কর ; বরং বাঙালি ও অসমিয়াদের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্ব ও অকুণ্ঠ নৈকট্যের প্রসারই সমধিক কাম্য।’
‘শিক্ষার ভাবী মাধ্যম’ শীর্ষক সম্পাদকীয়র কয়েকটি কথা…
‘আজ আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি; পরকীয় প্রভাব-জর্জর-সাংস্কৃতিক মোহ থেকে নিষ্কৃতি লাভ করবার এই-ই প্রকৃষ্ট সময়। ইংরেজি ভাষার সাংস্কৃতিক মূল্য অস্বীকার না করলেও রাষ্ট্রীয় জীবনের গঠনমূলক সম্পর্কে ইংরেজি ভাষার মূল্য আমরা অস্বীকার করবো বৈকি ! শুধু শিক্ষা-সংক্রান্ত ব্যাপারেই নয়, শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রেও বাংলার মাধ্যম সুপ্রবর্তিত হোক্ আমরা এ কামনাই করবো।’
পত্রিকাটি কমিউনিস্ট, পাকিস্তান-বিরোধি এবং ভারতের দালাল খ্যাতি পেয়ে চুপষে গেলেও তাঁরা যে দেশপ্রেমিক স্বদেশহিতৈষী ছিলেন এবং পূর্ববাঙলার সার্বিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা শহরেরও শ্রীবৃদ্ধি, চাইতেন, তার পরিচয় পাওয়া যায় ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা শহর’ শীর্ষক সম্পাদকীয় মন্তব্যে। নতুন রাজধানীকে উন্নত করার এবং রাজধানীর সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসিক বাসস্থানের ব্যবস্থা করা যে জরুরি সে-বিষয়ে পত্রিকাটি যুগোপযোগী প্রস্তাব উত্থাপন করে এবং রেখে-ঢেকে তাঁরা যে-কথাটি বলতে চেয়েছেন, তাহলো সংখ্যালঘু হিন্দুদেরকে জোর করে বাড়ী থেকে তাড়িয়ে/উঠিয়ে দিয়ে সরকারি কর্মচারিদের বাসস্থান-সমস্যা দুরিকরণের প্রয়াস হীনপদ্ধতি। পরিত্যক্ত বাড়ি দখল সম্পর্কে পত্রিকার বক্তব্য : ‘সরকারপক্ষও যেমনি বাড়ি দখল করবার মনোভাব রাখবেন না, জনসাধারণও তেমনি বাড়ি আটক রাখবার মনোভাব রাখবেন না।’ সরকারি মনোভাবকে কটাক্ষ করা হলেও চাপের মুখে এ ব্যাপারে খোলাখুলি মতামত ব্যক্ত করতে পারছিলেন না বলে কমিউনিস্ট বা মার্কসীয় মতাদর্শের পত্রিকার তথা সংখ্যালঘুদের বাক্-ব্যক্তি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা যে কতোটা হুমকির সম্মুখীন ছিল মানসচক্ষু সামান্য উন্মীলন করলে তা সহজে উপলব্ধি করা যায়।
ড. মুহম্মদ এনামুল হক পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ উন্নতির চিন্তা করে সকল বিষয়েই যেনো আদর্শ-স্থানীয় হয়ে ওঠে পাকিস্তানের সকল নাগরিক– সেজন্য অবতারণা করেছিলেন রাষ্ট্রভাষার পরিপ্রেক্ষিত। এই প্রবন্ধে তিনি উর্দুকে একটি অপরিচিত বিদেশি ভাষা বলে বর্ণনা করেন এবং এই ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, ‘এই ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা রূপে স্বীকার করিয়া লইলে, বাংলা ভাষার সমাধি রচনা করিতে হইবে এবং সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানবাসীরও জাতি হিসাবে ‘গোর’ দেওয়ার আয়োজন করিতে হইবে।’ রাষ্ট্রভাষার সঙ্গে জাতীয় মর্যাদা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন জড়িত। উর্দু ইসলামি সাহিত্যে সমৃদ্ধ, উত্তর ভারতীয় মুসলমানদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা দরকার–। এইসব যুক্তির অসারতা প্রদর্শন করে লেখক পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য উর্দু এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেবার প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন :
‘এক রাষ্ট্রে একাধিক রাষ্ট্র ভাষা অচল এই শ্রেণীর ধারণা সাম্রাজ্যবাদের পরিপোষক। উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রমাত্র করার সম্ভাব্য ফলাফল বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন : ‘ইহাতে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সর্বনাশ ঘটিবে।…উর্দু বাহিয়া আসিবে পূর্ব-পাকিস্তানবাসীর মরণ, রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয়, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মৃত্যু। এই রাষ্ট্রীয় ভাষার সূত্র ধরিয়া ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি সর্ববিষয়ে পূর্বপাকিস্তান হইবে উত্তর ভারতীয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানী উর্দুওয়ালাদের শাসন ও শোষণের ক্ষেত্র, যেমন ভারত ছিল ইংরেজি রাষ্ট্র ভাষার সূত্রে ইংরেজদের শাসন ও শোষণের ক্ষেত্র’–এই বক্তব্যে উর্দুকে বিদেশি ইংরেজির মত রাষ্ট্রভাষার সমপর্যায়ে স্থাপন এবং একমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার প্রস্তাবকে ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শোষণের হাতিয়ার হিসেবে বর্ণনা লক্ষণীয়।’ ৫
মুহম্মদ এনামুল হকের প্রবন্ধটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব লাভ করার সাথে সাথে ‘কৃষ্টি’ও স্মরণীয়ের মর্যাদা লাভ করেছে। প্রবন্ধের মূল্যবান অংশটা উদ্ধৃত করা হলো :
‘পাকিস্তান একটি বিশাল রাষ্ট্র। পূর্ব ও পশ্চিম– এই দুই অঞ্চলে ইহা বিভক্ত।…এক অংশের সহিত অপর অংশের যোগাযোগ রক্ষা করা একটা জটিল সমস্যায় পরিণত হইয়াছে।… দেশে অশান্তি দেখা দিলে যোগাযোগ রক্ষা করা একরূপ কঠিন। এই সমস্যার সুচারু সমাধান কখন সম্ভবপর হইবে, তাহা একমাত্র ভবিতব্যই বলিতে পারে।
‘সংস্কৃতির দিক হইতেও পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের অবস্থা একরূপ নহে… প্রকৃতিই এই অঞ্চলের লোককে এমনভাবে সৃষ্টি করিয়াছে যে, ইহাদের মধ্যে… সাংস্কৃতিক দিক হইতে কোন প্রকার সামঞ্জস্য নাই। তবে ধর্মীয় দিক হইতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান একসূত্রে আবদ্ধ–বলা বাহুল্য, এই অঞ্চলদ্বয়ের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কথা বাদ দিয়াই চিন্তা করা হইতেছে। মনে রাখা উচিত, ধর্ম্ম মানব-সংস্কৃতির একটি প্রধান অংশ বটে, কিন্তু ইহা তাহার সমস্তটুকু নয়। একমাত্র ধর্ম ব্যতীত মানব সংস্কৃতির অন্যান্য দিক, যেমন, ভৌগলিক প্রভাব, মানব-গোষ্ঠীগত বৈশিষ্ট্য, জীবন-যাপন-প্রণালী শিক্ষা-দীক্ষা আচার-ব্যবহার প্রভৃতি দিক হইতে পাকিস্তানের উভয় অংশে সাদৃশ্যের চেয়ে বৈসাদৃশ্যের ভাগই বেশী।’ ধর্ম-বন্ধনও অচ্ছেদ্য বন্ধন নহে।…ভাষার বন্ধনও অচ্ছেদ্য বন্ধন নহে।…ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক প্রেরণাকে যাহারা এই নবীন রাষ্ট্রের অন্তঃসলিলা ফল্গু বলিয়া মনে করেন, কিংবা প্রকৃত রাষ্ট্রীয় বন্ধন বলিয়া নির্বিচার স্বীকার করেন, তাহাদের রাষ্ট্রীয় দৃষ্টি স্বচ্ছ ত নহেই; বরং অদূরদর্শিতার ঘোর কুয়াশাজালে সমাচ্ছন্ন।…পাকিস্তান রাষ্ট্রগঠনে ধর্ম বা স¤প্রদায় বড় নহে আত্মনিয়ন্ত্রণই বড়। কেননা আত্মনিয়ন্ত্রণ-নীতির ভিত্তিতেই এই রাষ্ট্র পরিকল্পিত ও পরিমূর্তিত। মনে রাখিতে হইবে, আত্মনিয়ন্ত্রণ-নীতি স্বার্থপরতার নীতি,–নিঃস্বার্থতার নীতি নহে। এইজন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে আত্মনিয়ন্ত্রণের অর্থ আত্মপ্রাধান্য স্থাপন;–আত্মবিসর্জন নহে। কারণ আপন-আপন ধর্ম-কর্ম শিক্ষা-দীক্ষা ভাব-ভাষা সভ্যতা-সংস্কৃতি জীবন-যাপন প্রণালী প্রভৃতির ন্যায় বিষয়গুলো সম্মানজনকভাবে রক্ষা ও পুষ্ট করিয়া স্বাধীনভাবে বাঁচিয়া থাকার নামই আত্মনিয়ন্ত্রণ। যেখানে আত্মনিয়ন্ত্রের প্রশ্ন, ধরিয়া লইতে হইবে, সেখানে নিজের চিন্তাই প্রবল অপরের চিন্তা দুর্বল। এই নীতিতে পাকিস্তান-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত বলিয়া এই রাষ্ট্রান্তর্গত দেশগুলি বিশেষ করিয়া পূর্বপাকিস্তান যদি নিজের কথাই বেশী করিয়া চিন্তা করে, তাহাতে অস্বাভাবিকতা দেখিবার কোন সঙ্গত কারণ নাই। প্রকৃতপক্ষে পূর্বপাকিস্তান বর্তমানে নিজের কথাই বেশী করিয়া ভাবিতেছে। ইহার একমাত্র কারণ, নানাদিক হইতে আজ তাহার আত্মনিয়ন্ত্রণনীতি আক্রান্ত। অধিকন্তু ভাষার দিক হইতে এই নীতি আক্রান্ত হইবার যে সম্ভাবনা স¤প্রতি দেখা দিয়াছে, তাহাতে পূর্বপাকিস্তানের পক্ষে বিচলিত হইবারই
কথা। পূর্বপাকিস্তানের আপন ভাষা বাংলা। আত্মনিয়ন্ত্রণনীতি অনুসৃত হইলে, পাকিস্তানের দিক হইতে বাংলা ভাষার উপর হস্তক্ষেপ করা যায়না। কিন্তু চতুর্দিকের হাব-ভাব দেখিয়া মনে হইতেছে, রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে বাংলা উর্দুর দ্বারা স্থানান্তরিত হইবে। এই সম্ভাবনাই পূর্ব-পাকিস্তানের জীবনী-শক্তির মূলে আঘাত করিয়াছে। সুতরাং পূর্বপাকিস্তান বিচলিত না হইয়া পারে না।
‘সম্প্রতি অনেকেই উর্দুকে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা রূপে চালাইবার কথা চিন্তা করিতেছেন।… তবে, একথা একান্তই সত্য যে, যদি তাঁহারা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ করেন, তাঁহাদের মাতৃভাষা বাংলাকে উদ্বন্ধনে মারিবার ব্যবস্থা পূর্বাহ্নেই করিয়া রাখিতে হইবে। কেননা রাষ্ট্রভাষার পশ্চাতে থাকিবে এক বিরাট রাষ্ট্রশক্তি। এই ভাষার সহিত সংগ্রাম করিয়া বাঁচিয়া থাকার শক্তি যে বাংলাভাষার নাই, সে কথা মনে করিনা। কিন্তু তাহা জীবন্মৃত অবস্থায় বাঁচা–আত্মনিয়ন্ত্রণের নীতিতে বাঁচা নয়। এই জাতীয় বাঁচার চেয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণের নীতিতে বাঁচার মূল্য অনেক। আমার দেশে আমি ঘরে বাহিরে আমার ভাষায় কথা বলিতে পারিব না, আমার ভাষায় লিখিতে পড়িতে পারিব না, ব্যবসা-বাণিজ্য চালাইতে পারিব না, মনের মত করিয়া সুখ দুঃখ প্রকাশ করিতে পারিব না;–ইহার চেয়ে বৃহৎ আত্মপ্রবঞ্চনা ও আত্মহত্যা আছে কি ? সত্যই আমরা আত্মপবঞ্চনা ও আত্মহত্যাকে যদি আত্মনিয়ন্ত্রণ বলিয়া স্বীকার করিয়া লই, তবে কে আমাদিগকে বাঁচাইবে?’
লেখক উর্দুর পক্ষের যুক্তিগুলো খণ্ডন করেন একে একে। যেমন : ‘উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা রূপে পাকিস্তানে চালু করিবার পক্ষে আর একটি যুক্তি দেখান হইয়া থাকে ; তাহা ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে যোগাযোগ ও ভাব আদান-প্রদানের অজুহাত। ইহার ন্যায় এমন দুর্বল যুক্তি সচরাচর খুব বেশী দেখা যায় না।… ধর্মের নামে যাহারা অকারণে উর্দুপ্রীতি পোষণ করিয়া থাকেন, তাহারা একান্তই ভ্রান্ত।’ নানা দিক থেকে তিনি উর্দুর সপক্ষ সুপারিশগুলোর পর্যালোচনা করে বাংলার বিপক্ষ যুক্তিগুলো খণ্ডন করে উপসংহারে তিনি বলেন: ‘মোটের ওপর, বাংলাকে ছাড়িয়া উর্দুকে রাষ্ট্রভাষারূপে পূর্ব-পাকিস্তানবাসী গ্রহণ করিলে তাহাদেও রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মৃত্যু অনিবার্য। ইংরেজ আমলের প্রথমদিকে বাংলার মুসলমান ইংরেজী ভাষাকে গ্রহণ না করিয়া যে-জাতীয় আত্মঘাতী ভুল করিয়াছিলেন, পূর্ব-পাকিস্তানবাসী এইবার উর্দুকে গ্রহণ করিলে অবিকল ঐ জাতীয় আর একটি রাজনৈতিক ভুলের পুনরাবৃত্তি করিবেন। এখনও এই ভুল করা হয় নাই, এখনও সাবধান হইবার সময় আছে। যাহাতে এই জাতীয় আত্মঘাতী এবং জাতিঘাতী ভুল অদূর ভবিষ্যতে না হইতে পারে, এখন হইতে সেই বিষয়ে সকলের সজাগ ও সচেষ্টা হওয়া অত্যন্ত আবশ্যক।’
পত্রিকার সার্বিক চারিত্রের সঙ্গে ভাব-বক্তব্য ও চিন্তার সঙ্গে মুদ্রিত কবিতা গল্প-নাটকের বক্তব্য ও চিন্তাধারার সঙ্গতি রয়েছে। বলা বাহুল্য, রচনাগুলো নির্বাচনের মধ্যদিয়েও চিন্তাধারার বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। আবদুল মান্নান একজন কিশোর কবি । ‘তার ঝাণ্ডা উড়াও’ শীর্ষক কবিতায় অসা¤প্রদায়িক ভাবটি স্পষ্ট ফুটে উঠেছে : ‘আশার তরী বেয়ে রে আজ জিন্না জহর পেল ফুল/উচ্চ করি আজকেরে তোর স্বাধীনতার ঝান্ডা তোল/জাতির বিচার ভেদ ভুলিব/সবার সাথে হাত মিলাবো/হিন্দু-মোসলেম ভাই বলিয়া বুকে দিব কোল’। গোপালচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জাতীয় পতাকা’ শীর্ষক কবিতায় সাম্যবাদী চিন্তা প্রকাশ পেয়েছে নতুন দেশের পরিবর্তিত নতুন পরিস্থিতিতে সর্বশ্রেণীর সর্বহারাদের প্রতি নতুনভাবে মনোযোগের দাবি নিয়ে : ‘দুশো বছরের শ্বেত জিঞ্জির খোল/জাতীয় পতাকা উর্দ্ধ গগনে বীর দর্পে তোল।/নীচতায় ভরা হিংসা বিষের হানাহানি ভোল…/নব আদর্শে গঠনের কাজে লাগো/পুরানো সমাজে গাণ্ডীব হাতে বিপ্লব নিয়ে জাগো।/পুণ্য লগনে বিপ্লবী বীর নওজোয়ান/স্বাধীন পতাকা দলে দলে সবারে তোরা ডাকিয়া আন।/সর্বহারা মজদুর সাথে কাঁধে কাঁধ দিয়ে আয় কৃষাণ/ত্যাগের মন্ত্রে দৃঢ় বিশ্বাসে এই পতাকার রাখিতে মান।’ কিরণশংকর সেনগুপ্ত ‘স্তব্ধতা’ শীর্ষক কবিতায় মানুষের হৃদয়দৈন্য দূর করার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ। তাঁর দুঃখ হলো, জিজ্ঞাসা-চিহ্নিত সামাজিক ব্যাধিগুলোর এখনও নিরাময় হলো না। ‘হৃদয়ের গভীর কোণে প্রশ্ন জাগে আর কতকাল/পৃথিবীতে নেমে এসে স্তব্ধত কেবল/বাড়াবে হৃদয় দৈন্য বেদনা অতল ;
‘রবীন্দ্রনাথের চিঠি’ প্রবন্ধে তৎকালীন সমাজ সাহিত্য ও সমকালকে জানবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। চিঠির মূল্য সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের চিঠি বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ। রবীন্দ্র-সাহিত্যের আলোচনা পাকিস্তানে ছিলই না যখনÑতখন কৃষ্টির প্রয়াস ছিল ব্যতিক্রমী। অবশ্য এর কারণও ছিল। ক্রমে দেখা যাবে, পূর্ববাঙলার পত্র-পত্রিকায় রবীন্দ্র-বিষয়ক আলোচনা আরো কমে আসবে এবং এক সময় থাকবেই না। ১৯৬১ ও ১৯৬৭-র পরে বৃদ্ধি পাবে আবার। রাজনীতিও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের সঙ্গে-সঙ্গে সাহিত্যচিন্তায় রবীন্দ্র-প্রসঙ্গও পরিবর্তনের ইতিহাসকে কৃষ্টি ধারণ করে আছে। নাটক ‘সাইরেন’-এ জীবন-নাটকের পাঠ এবং জীবনের প্রতি অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছে। ‘স্মৃতি-তীর্থ’ শীর্ষক গল্পে বিশ শতকের প্রথম দিককার রাজনীতির প্রেক্ষাপটে সোস্যালিস্ট রেভুলেশন্যারী পার্টির কর্মী শিক্ষিত দুই তরুণ-তরুণীর প্রেমের ঘটনা ব্যক্ত হলেও এতে দেশসেবার ব্রত আদর্শরূপে উপস্থাপিত। নায়ক প্রেমিকা তনুশ্রীর নামে তার পৈত্রিক জমিদারি বাড়িটি পার্টি-অফিসের জন্য দান করে নাম রাখে ‘তনুশ্রী-ভবন’, তথাপি দুজন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন না। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ত্যাগী চরিত্র সৃজন গল্পের উদ্দেশ্য। সেকালে এরকম গল্প লেখা হতো।
পত্রিকাটির পরিচয়ে দুটো বিষয় স্পষ্টÑসংখ্যায় কম হলেও মুসলিম লেখক আছেন এবং তাঁরা চিন্তায়ও প্রাগ্রসর। সাতচল্লিশ-সংলগ্ন সময়কালে পূর্ববাঙলার হিন্দুসমাজের বর্ণাঢ্যতার পরিচয় আছে এ পত্রিকায় ; আর আছে বেদনাদায়ক চিত্র–সরকারি কর্মকর্তাদের দ্বারা হিন্দুদের আবাসগুলো একে একে দখল হয়ে যাওয়ার বিবরণ। এই দখল বা অধিগ্রহণের কালে কতো যে জীবন-বিরোধী অমানবিক ঘটনার অবতারণা হয়েছিল তাও সহজেই অনুমান করা যায়। সমাজ পরিবর্তিত হতে-হতে যে নতুনমাত্রা লাভ করবেÑকৃষ্টি তারও সাক্ষ্য দেয়।
১৯৪৭ সনে প্রকাশিত মাসিক ‘কৃষ্টি’ সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সমাজ-ভাবনার ক্ষেত্রে এক অবিস্মরণীয় ভ‚মিকা পালনের ব্রত নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল। কিন্তু সামাজিক সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিই তাঁদেরকে বেশী দূর অগ্রসর হতে দেয়নি। তবু যে অভিপ্রায় ফুটে উঠেছে একটি সংখ্যার মধ্যদিয়েওÑতা অত্যন্ত উজ্জ্বল এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বের দাবিদার। অনেকেই আমরা জানি না–পাকি-আমলের উর্দু-বাংলার রাজনীতি ও তৎকালীন সামাজিক অবস্থার আলোচনার সূত্রপাত ঘটে এই কৃষ্টিতে প্রকাশিত মুহম্মদ এনামুল হকের প্রবন্ধ ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার পরিপ্রেক্ষিতে উর্দু ও বাংলার মাধ্যমে।
কিন্তু দুঃখ এই, কৃষ্টির কোনো কপি এখন আর কোথাও কারও কাছে আছে বলে জানা যায় না। আছে শুধু কৃষ্টির কিছু স্মৃতিচিত্র ; কেবলমাত্র আমার পুরোনো দিনের নোট-খাতায়।