spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যপো'র ছায়ার সঙ্গে এক বিকেল

লিখেছেন : কাজী জহিরুল ইসলাম

পো’র ছায়ার সঙ্গে এক বিকেল

কাজী জহিরুল ইসলাম 

একবার সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে একটা কবিতা লিখলাম। কবিতার নাম “ইনস্যাক্ট প্লান্ট”। কবিতাটি লিখেছি সকালবেলা, আমার অফিসে বসে। কিছুক্ষণ পরে অফিসের পিয়ন লিটন এককাপ চা আর খবরের কাগজ এনে টেবিলের ওপর রাখলো। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জনকন্ঠের পাতা উল্টাচ্ছি, হঠাৎ চোখে পড়ে, আজ সত্যজিৎ রায়ের প্র‍য়ান দিবস। এমন ঘটনা প্রায়শই ঘটে। কেউ কী হিসেব মিলিয়ে দেয়? হয়ত। সম্ভবত সেজন্যই আমি কোনো বিপদে বিচলিত হই না। এরও নিশ্চয়ই একটা হিসেব আছে। যার হিসেব তিনিই মিলিয়ে দেবেন। 

গত কয়েক দিন ধরেই মাথায় ঘুরছে এডগার এলান পো। কেন ঘুরছে কে জানে? আজ দুপুরে কবি সৈয়দ কামরুলকে ফোন দিলাম। কি করছেন? 

কিছু না।

শরীর কেমন এখন? কোভিডের ধকল কি গেছে?

অনেকটাই।

বেরুবেন?

কোথায় যাবেন?

এডগার এলান পো’র বাড়ি দেখতে।

হ্যাঁ যাবো।

একজন কবির কাছে সম্রাট, জমিদারের রাজপ্রাসাদের চেয়ে কবির জীর্ণ কুটির অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যখন কোনো শহর বা লোকালয়ে বেড়াতে যাই, খুঁজে বের করার চেষ্টা করি, আশে-পাশে কোনো কবি আছেন কিনা, কোনো প্রয়াত কবির স্মৃতিচিহ্ন আছে কিনা। 

আজ ২৭ জানুয়ারি। ৮ দিন আগে, ১৯ জানুয়ারি ছিল কবি, গল্পকার, আমেরিকার গোয়েন্দা গল্পের প্রবর্তক, বৈজ্ঞানিক কল্প-কাহিনীর জনক এডগার এলান পোর ২১৪ তম জন্মদিন। কী জানি হয়ত ১৯ জানুয়ারিই আমার মাথায় পো’র পোকাটি ঢুকেছিল। মানুষ যে বিচ্ছিন্ন নয় তা আর কতবার বলবো? ৩২ লক্ষ বছর আগে আবিসিনিয়ায় মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়েছিল লুসি, আমি কি তার জিন বহন করছি না? মানুষ কখনোই মরে না, মাংসের জামাটা বদলায় কেবল। 

সৈয়দ কামরুলকে জ্যামাইকার বাসা থেকে তুলে ব্রঙ্কসের দিকে যখন যাত্রা করি তখনও বিকেল ৩টা বাজতে কিছু বাকি আছে। গাঢ় অন্ধকারের উৎসমূল থেকে মেঘের পাহাড় ভেঙে পড়ে। এক ফালি রোদের উঁকি শেষ জানুয়ারির শীতে সোনার খনির মতো ঝলমল করে ওঠে। 

আমরা ব্রঙ্কস কাউন্টিতে, এলান পো’র কটেজের সামনে গাড়ি থামালাম চারটার কাছাকাছি। ‘পার্ক নিউইয়র্ক সিটি’ অ্যাপসের মাধ্যমে পার্কিং ফি দিয়ে যখন গাড়ি থেকে নামছি, এবং সৈয়দ কামরুল যখন পেছনের দরোজা খুলে তার সাদাকালো স্কার্ফটি নিচ্ছিলেন, তখন চালকের পেছনের আসনে যেন কাউকে দেখতে পেলাম। নিতান্তই এক বালক। গায়ের রঙ শাদা, নাদুসনুদুস লম্বাটে মুখ, মাথার মাঝখানে সিঁথি, হাঁটুর ওপর যুথবদ্ধ দুই হাতের তালু। সবুজ চোখ দুটিতে গন্তব্যহীন দৃষ্টি। 

হ্যাঁ, আমি চিনি এই কিশোরকে। ১৮০৯ সালের ১৯ জানুয়ারি বোস্টনে জন্মগ্রহণ করার এক বছরের মাথায়ই অভিনেতা পিতা ডেভিড পো ওকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করেন। দু’ বছরের মধ্যেই অভিনেত্রী মা এলিজাবেথ পো পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। অনাথ শিশুটির আশ্রয়দাতা জন এলান এবং ফ্রান্সিস এলান দম্পতি ওকে নিয়ে যান ভার্জিনিয়ার রিচমন্ডে। 

আমাদের সঙ্গে, যেন পথ দেখাতেই, গাড়ি থেকে নামেন বালক এডগার। কিন্তু কটেজের দরোজা তো বন্ধ, ঢুকবো কীভাবে?

ওয়াকওয়েটি খানিক নিচে নেমে আবার যখন উঁচুতে, পো-পার্কের ফটকের দিকে উঠছিল, তখন সিনেমার দৃশ্যের মত বালকের খোলস ভেঙে বেরিয়ে এলো এক পুরোদস্তুর পুরুষ। লাল আভা বের হচ্ছে ওর কালচে চুল থেকে। একই মনিটরে যেন দুটি স্ক্রিন, একটিতে খুব দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে সময়, অন্যটি দাঁড়িয়ে আছে একুশ শতকের প্রথম সিকিতে।

এলান দম্পতি কখনোই ওকে নিবন্ধন করে দত্তক নেননি। জনের সঙ্গে প্রায়শই ঝগড়া হতো এডগারের। পড়ার খরচ মেটাতেও মাঝে মাঝে অনীহা দেখাত জন। একবার অভিমান করে বাড়ি ছেড়ে চলেই যায় এডগার। যোগ দেয় সেনাবাহিনীতে। কিন্তু ওখানেও ফেল মারে সে। ফিরে আসে এলান পরিবারে। তখনই নিজের নিয়তি ঠিক করে ফেলে কিশোর, লেখকই হবে সে।

“তোমাদের না, দুর্ভাগ্য আমার। আমার সৌভাগ্যের দরোজা চিরকালই বন্ধ ছিল।”

এডগারের মুখ থেকে কথাটা যেন আর্তনাদের মত বেরিয়ে এলো।

শেষ বিকেলের লাল আলো ফ্ল্যাশ লাইটের মতো এসে চোখে লাগছে। সেই আলোতে ব্রঙ্কসের ২৬৪০  গ্র‍্যান্ড কনকোর্স রোডের বাসাটি কেকের ওপর বসানো ক্রাউনের মতো জ্বলজ্বল করছে। 

এটিই তোমার বাড়ি?

ভাড়া বাড়ি।

কতদিন ছিলে এখানে?

৩ বছর। ১৮৪৬ থেকে ১৮৪৯।

ভার্জিনিয়া?

ওকে নিয়েই উঠি এই বাড়িতে। ১০০ ডলার বাৎসরিক ভাড়া ছিল বাড়িটার। ভার্জিনিয়া তখন খুব অসুস্থ। যক্ষাটা জেঁকে বসেছে। এই ঘরেই ও মারা যায়, ১৮৪৭-এ।

তোমার মাও তো?

হ্যাঁ যক্ষায়ই।

একটা কথা বলো তো এডগার, “হেলেন, দাই বিউটি ইজ টু মি/ লাইক দোজ নিশিয়ান বার্ক্স অব ইওর” এই পঙক্তিগুলো কি তুমি সত্যি তোমার বন্ধুর মা জেইনকে নিয়ে লিখেছিলে?

শোনো, ওরা এটা বলে বলে আমার মাথায় এমনভাবে ঢুকিয়ে দিয়েছে এখন আমিও এটাই বিশ্বাস করি।

জেইনকে ভালোবেসেছিলে?

হয়ত। ভালোবাসা কী বলো তো? হ্যাঁ জেইনের স্পর্শে আমার মধ্যে একটা অন্যরকম অনুভূতি হয়েছিল।

আসলে এটাই ভালোবাসা। নিজের ভেতরে একটা ভাঙচুর। 

তোমাকে একটা কথা বলি, কাউকে ভালোবাসতে আমি খুব ভয় পেতাম। আমার মধ্যে এই ধারণা কাজ করত, যদি আমি কাউকে ভালোবাসি সে খুব শিগগিরই মারা যাবে।

বলো কি?

বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেল জন্মের পরপরই। মাকে আঁকড়ে ধরলাম। তিন বছরেই আমাকে অনাথ করে মা চলে গেলেন। জেইনকে ভালো লাগত, সেও চলে গেল।

এটা তো ঠিক, জেইনের মৃত্যুতে তুমি খুব ভেঙে পড়েছিলে?

তখন ধারণাটা আরো বদ্ধমূল হয়, এই ভয়টাই আমাকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়।

“টু হেলেন” যখন ছাপা হয়, ১৮৩১ সালে, তখন তোমার বয়স ২২ বছর। জেইন মারা যায় আরো বেশ ক’বছর আগে। তুমি কেন সমালোচকদের বলোনি যে এটা তুমি জেইনকে নিয়ে লেখনি?

আমি নিজেই কী নিশ্চিত ছিলাম?

‘টু হেলেন’ লেখার বেশ ক’বছর পরে বিয়ে করেছ তাই না?

৫ বছর পরে।

তখন তুমি ২৭ বছরের তাগড়া যুবক, বিয়ে করলে ১৩ বছরের এক শিশুকে? তাও আবার আপন চাচাত বোন?

ভার্জিনিয়াকে দেখার পর আমার মধ্যে কী যেন হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল ওকে ছাড়া আমি একদিনও বাঁচতে পারবো না।

চাচাত বোনকে বিয়ে করার বিষয়ে পারিবারিক কোনো বাঁধা ছিল না?

একদম না। ১৯ শতকে আমেরিকায় এটাই প্রথা ছিল। খুঁজে দেখো, অনেক বিখ্যাত আমেরিকান চাচাত, খালাত, মামাত, ফুপাত ভাই-বোনের মধ্যেই বিয়ে করেছে। ১৮৮০ সাল পর্যন্ত এ ধরণের বিয়ে খুব জনপ্রিয় ছিল।

ভার্জিনিয়াকে হারাবার ভয় তোমাকে তাড়া করত?

সব সময়। বাইরে গেলেই মনে হত ফিরে এসে ওকে আর দেখবো না। 

তোমার আশঙ্কাই সত্যি হলো।

আমি লক্ষ করলাম ওর সবুজ চোখ দুটি রঙ পাল্টাতে শুরু করেছে। নীল হয়ে ওঠা পাথরের বল দুটি হঠাৎ গলে গেল। হাডসনের ঢেউ এখন সেখানে। 

আমরা লোহার শিক দিয়ে ঘেরা পো- কটেজের পশ্চিম দিকে দাঁড়িয়ে আছি। সৈয়দ কামরুল এবং আমি দুজনই একসঙ্গে হতাশা ব্যক্ত করলাম। এ-কী অবস্থা! এতো বড়ো একজন কবির বাড়ি, কেমন ধুসর, হতচ্ছাড়া। আশপাশে গাছপালা নেই, কোনো চাকচিক্য নেই। 

ভালো করে তাকান, এই ধুসর দারিদ্রের মধ্যেও একটা নির্লিপ্ত শান্তি আছে কিন্তু। 

তা আছে। তা ছাড়া সামারে নিশ্চয়ই ফুলের সমারোহও থাকে। 

আমরা কটেজটিকে দেখার জন্য ওকে বৃত্তাকারে প্রদক্ষিণ করি। সব তীর্থকেই তো মানুষ প্রদক্ষিণ করে। শুধু মানুষ কেন, গ্রহ-নক্ষত্রও কী তা করছে না? 

বড়ো রাস্তার সঙ্গে যে লোহার ফেঞ্চ, ওখানে লোহার কালো বোর্ড সাঁটানো। ওতে লেখা আছে, এটিই ছিল মার্কিন কবি এডগার এলান পো’র শেষ নিবাস। ১৮৪৬ সালের বসন্তে অসুস্থ স্ত্রী ভার্জিনিয়া পো এবং শ্বাশুরি মারিয়া ক্লেমকে নিয়ে এই বাড়িতেই তিনি ওঠেন।  বাড়িটির মালিক ছিলেন তখন জন ভ্যালেন্টাইন। ১৮৭৪ সালে খবরের কাগজে সংবাদ ছাপা হয়, অসংখ্য মানুষ কবির শেষ বাসস্থানটি দেখতে ভিড় জমাচ্ছেন। ততোদিনে তার জনপ্রিয়তার পারদ অনেক উঁচুতে উঠে গেছে। ১৮৮৪ সালে প্যাট্রিক জে কিয়ারি এই বাড়িটি কিনে নেন। বাড়িটি কবির স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষণের জন্য প্যাট্রিক নিউইয়র্ক সিটির কাছে প্রস্তাব দেন কিন্তু সিটি কর্তৃপক্ষ তাতে রাজি হননি। এর পর দ্রুত আরো কয়েকবার বাড়িটির মালিকানা হাত বদল হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯১৩ সালে নিউইয়র্ক সিটি কর্তৃপক্ষ এই বাড়িটি কিনে নেয়। ১৯৭৫ সাল থেকে এডগার এলান পোর কটেজকে একটি ঐতিহাসিক জাদুঘর হিসেবে রক্ষণাবেক্ষণ করছে ব্রঙ্কস কাউন্টি হিস্টোরিক্যাল সোসাইটি। সোসাইটিকে সহযোগিতা দিচ্ছে নিউইয়র্ক সিটি পার্ক অ্যান্ড হিস্টোরিক সোসাইটি ট্রাস্ট। ১৯৬৬ সাল থেকে নিউইয়র্ক সিটি কর্তৃপক্ষ এই কটেজটিকে একটি ল্যান্ডমার্ক স্থাপনা হিসেবে ঘোষণা করেছে।

বিশেষত্বহীন একটি দরিদ্র গোছের হাই রেঞ্চ। শাদা রং করা ভাইনিলের দেয়াল, একটি বারান্দা এবং দুটি চিমনি। ১৮১২ সালে যখন বাড়িটি নির্মাণ করা হয়, এর মাত্র ২৭ বছর আগে আমেরিকা গ্যাস ব্যবহার শুরু করে, বিদ্যুতের ব্যবহার তখনও মার্কিনীদের চিন্তায় আসেনি। কাজেই শীতকালে ঘর উষ্ণ রাখার জন্য প্রাকৃতিক ফায়ার প্লেসে ব্যবহার করা হত কাঠের জ্বালানি। যথার্থ কারণেই বাড়িটিতে দুটি চিমনি বসানো হয়েছে। বুঝলাম, হেরিটেজ প্রোপার্টি, ঠিক যে রকম বাড়িতে কবি ছিলেন তেমনই রাখার আবশ্যকতা আছে, তাই বলে ছাদের শিঙ্গেলগুলোরও এই দশা করে রাখতে হবে? ব্যবস্থাপনায় দারিদ্রের কিংবা অবহেলার একটা সুস্পষ্ট ছাপ যে কারোরই চোখে পড়বে।

এডগার এলান পো ছিলেন আমেরিকার প্রথম সফল লেখক যিনি লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন। তার রচনা সমগ্রের দিকে তাকালে বিস্মিত হতে হয়, যখন জানি মাত্র ৪০ বছর বয়সে থেমে যায় তার কলম, পাড়ি জমান পরপারে। দশ ভলিউমে তার রচনা সমগ্র পাওয়া যায়, প্রতিটি ভলিউমের কলেবর ৫শ পৃষ্ঠার ওপরে।

র‍্যাভেন বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে ছিল, টু হেলেন নিয়ে বাংলা সাহিত্যে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে, আজও হচ্ছে। এর মূল কারণ হলো বাংলা ভাষার বিখ্যাত কবিতা ‘বনলতা সেন’ জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন টু হেলেন কবিতাটির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে। ভূমেন্দ্র গুহের কাছে জীবনানন্দ দাশ তা সরাসরি অস্বীকার করলেও ‘টু হেলেন’ যে তিনি পড়েছেন তার ইঙ্গিত পাওয়া যায় যখন তিনি বলেন, তুমি যা পড়ো, যে পরিবেশে তোমার মনোজগৎ বিচরণ করে তোমার লেখায় তো সেই ভাষাই আসবে।

বাঙালি কবিদের মধ্যে যে কয়জনের বিদেশি সাহিত্যের পাঠ অতি উচ্চ পর্যায়ের সৈয়দ কামরুল তাদের একজন। আমি কথাটি তাকে জিজ্ঞেস করি, আপনার কী মনে হয়? টু হেলেনের প্রভাব আছে কি?

দেখেন, চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে গেলে মৌলিক রচনা খুব কমই পাবেন। অনেক মহৎ শিল্পই মিউটেশন। এখন কথা হচ্ছে কে কত ভালোভাবে সেটা করতে পারেন। কতটা নতুন রঙের প্রলেপ তাতে দিতে পারেন। জীবনানন্দ দাশ যেটা করেছেন, তিনি বিষয়গুলোকে লোকালাইজ করতে পেরছেন সফলতার সঙ্গে। 

আমার মনে হয় আপনার মন্তব্যটি যথার্থ এবং গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ তো ৩২ লক্ষ বছর ধরে জিন মিউটেড করেই আজকের অবয়বে দাঁড়িয়েছে। কাজেই অন্যের কাজ না দেখেও, অন্যের সাহিত্য না পড়েও একই ধরনের শিল্প সৃষ্টি করতে পারে। বরং পড়ে নিতে পারলে বা দেখে নিতে পারলে নতুন শিল্পীর জন্য আরও সুবিধা হয়, যতটা সম্ভব ভিন্নতা আনার চেষ্টা করা যেতে পারে। নিজের ভাষার মানুষের উপযোগী করে মিউটেড করতে পারাটাও তো এক ধরনের মৌলিকত্ব।

অন্ধকারের পাহাড়টা মাথা তুলে দাঁড়াবার আগেই আমাদের কিছু ছবি তুলে ফেলতে হবে। কটেজের চৌহদ্দির বাইরেও অনেকখানি ফাঁকা জায়গা পো-পার্কের অংশ। লৌহদণ্ডের বেড়া দিয়ে ঘেরা পুরো পার্কটি। এখানে-ওখানে খুব ছোটো ছোটো সাইন, সেগুলোতে লেখা পো-পার্ক। পার্কের পশ্চিম প্রান্তে একটি সিমেন্টের উঁচু বেদী, নান্দনিক কিছু কলামের ওপর দাঁড়িয়ে আছে বেদীর ছাদ। আমরা ওরও ছবি তুলি। তখন একটি কায়াহীন ছায়া আমাদের মাঝখানে এসে দাঁড়ায়।

আমরা ভূত দেখার মত চমকে উঠি।

ছায়ার মধ্যেই টের পাই বয়স আরো বেড়ে গেছে। তবে বয়সের ভারে নয়, ছায়াটি কুঁজো হয়ে আছে অসুস্থতার কারণে।

হেই এডগার, এতক্ষণ কোথায় ছিলে, আর এ-কী অবস্থা তোমার?

আমাকে এক্ষুণি হাসপাতালে নিয়ে চলো। হয়ত আমি আর বাঁচবো না।

আমার তো মনে হয় মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানে অপ্রকৃতিস্থ হওয়া ছাড়া তোমার আর তেমন কিছুই হয়নি। 

ছায়াটি স্থুল হচ্ছে, গুটিয়ে যাচ্ছে। এখন একটি গোলাকার বৃত্ত ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

এডগার, এডগার…

আমি বেশ জোরেই কয়েকবার ডাক দিই। ফাকা পার্কে, বাতাসের গায়ে, আমার কন্ঠ প্রতিধ্বনিত হয়। ছায়াটি সম্প্রসারিত হতে থাকে। হাত, পা গজায় এবং ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। 

এবার ও জোরে জোরে হাসছে। ও কী পাগল হয়ে গেল? ছায়াটিকে শান্ত করতে কিংবা ওর মনোযোগ অন্য দিকে ফেরাতে আমি এডগারের নারীদের প্রসঙ্গ তুলি।

মেয়ে পটানোর জন্য তুমি কিন্তু অসততা করেছ।

সম্ভবত ছায়াটি উৎকর্ণ হলো।

সারাহ হেলেন হুইটম্যানকে পটানোর জন্য তুমি ওকে বলেছিলে “টু হেলেন” কবিতাটি ওকে নিয়ে লিখেছ?

ছায়াটি তখন আকাশ কাঁপিয়ে হেসে ওঠে।

কবিতার শিরোনামেই তো হেলেন আছে।

সেটা তো ট্রয়ের হেলেন, প্রতীকী, আর কবিতাটি তো তুমি জেইনকে নিয়ে লিখেছ, ছাপা হয়েছে ১৮৩১ সালে। সারাহ হেলেনের সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে ১৮৪৮ সালে।

তুমি একজন কবি হয়ে মূর্খদের মতো কথা বলো না তো? আমাকে আক্রমণ করতে চাও তো অন্য কিছু বলো। একটি কবিতার ব্যপ্তি তুমি বোঝো না? এক নারীতেই কবিতাকে বেঁধে ফেলতে চাও?

আমার একটা পর্যবেক্ষণ আছে তোমার নারীদের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া নিয়ে, বলবো?

হ্যাঁ, বলো।

সারাহ হেলেন হুইটম্যান ছিল তোমার চেয়ে দশ বছরের বড়ো, জেইনও ছিল ১৪/১৫ বছরের বড়ো। আমার মনে হয় কি জানো?

ছায়াটি নীরব।

আমার মনে হয় তুমি খুব শিশুকালে মা হারিয়েছ, তাই মাতৃস্নেহের একটা প্রবল তৃষ্ণা তোমার মধ্যে ছিল। সেজন্যই জ্যেষ্ঠ নারীদের প্রেমে পড়তে। ওদেরকে একাধারে তুমি মা এবং প্রেমিকার আসনে বসাতে।

শেষ জানুয়ারির খটখটে শুকনো পার্কের মাটি ভিজতে শুরু করে।

সে-কী তুমি কাঁদছ?

ছায়াটি তখনও নীরব। দুটি শীর্ণ ধারা ছায়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে গড়াতে থাকে।

তোমাকে দুঃখ দিয়ে থাকলে আমি দুঃখিত। না, না, সব নারীই তো আর বড়ো ছিল না। সারাহ শেলটন তো তোমার সমবয়সীই ছিল, ভার্জিনিয়ান গার্ল।

এবার ও নিজেকে গুছিয়ে নিল।

তুমি কী একটা জিনিস লক্ষ করেছ, নারীরা আমাকে কেবল দুঃখই দিয়েছে, কেউ দুদণ্ড শান্তি দেয়নি, ভালোবাসা দেয়নি। আমরা দুজন দুটি কলেজে পড়তে গিয়ে বিচ্ছিন্ন হলাম, সারাহ আমাকে না জানিয়ে বিয়ে করে ফেললো। ভার্জিনিয়ার মৃত্যুর পরে খবর পেলাম সারাহর স্বামী মারা গেছে, আমি ওকে প্রস্তাব দিলাম বিয়ে করার, ও রাজী হলো না।

কিন্তু তোমার কফিনের পাশে দাঁড়িয়ে সারাহই সবচেয়ে বেশি অশ্রুপাত করেছে। হাসপাতালে তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়েছে মৃত্যুর কারণ জানার জন্য।

এর দশদিন পরেই একটা তারিখ ওকে দিয়েছিলাম, বিয়ে করার।

হয়ত ও মনে মনে রাজী ছিল। তুমিই তো সময় দিলে না। মদ গিলতে গিলতে চলে গেলে। 

খুব কষ্ট হচ্ছে এখন।

ন্যান্সি কিন্তু তোমাকে খুব ভালোবাসত।

এই এই, ন্যান্সি বলবে না, আমি ওর নাম দিয়েছি অ্যানি, অ্যানি বলবে।

দুঃখিত, অ্যানি। হ্যাঁ, জানো তো ওর স্বামীর মৃত্যুর পর নিজের নাম ও এফিডেভিট করে রেখেছে অ্যানি রিচমন্ড। তোমার দেয়া নাম। তুমি পারতেও, এই আমেরিকার মত দেশে বসে প্লেটোনিক লাভ। চুমু টুমু খাওনি, না?

নাহ, সুযোগ পাইনি।

ওকে নিয়ে তো একটা কবিতাও লিখেছিলে?

হ্যাঁ “ফর অ্যানি”। ও খুব পছন্দ করেছিল কবিতাটি।

আমি কিন্তু তোমার একটা জিনিসের খুব তারিফ করি। ভার্জিনিয়ার জীবদ্দশায় তুমি কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলেও তাকাওনি। তবে তুমি পারো বটে। ওই দুবছরেই তিন তিনটা প্রেম!

শোনো কবি, ভার্জিনিয়াকে হারিয়ে আমি পাগল হয়ে যাই। ডাল ভেঙে ধপাশ করে মাটিতে পড়ে গিয়ে আমি একটি নিরাপদ ডালের জন্য সব গাছেই ওঠার চেষ্টা করেছি। কিন্তু জীবন আমার অনুকূলে ছিল না। মৃত্যুই আমার আপন হয়ে উঠলো।

দেখো এটা একদম বাজে কথা। তোমার মত একজন সংগ্রামী পুরুষ অ্যালকোহলের কাছে আশ্রয় নেবে এটা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। প্রত্যাখ্যান তো তোমার জন্মদাগ, এ-তো আর নতুন কিছু নয়?

ছায়াটি হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল। কারণ ততক্ষণে দিবসের আলো নিভে গেছে।

হলিসউড, নিউইয়র্ক। ২৯ জানুয়ারি ২০২৩।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

পথিক মোস্তফা on সাক্ষাৎকার : নয়ন আহমেদ
সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা