spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদঅন্যান্যপ্রসঙ্গ : কবি জাহিদুল হক : স্মরণ ও ভ্রম 

প্রসঙ্গ : কবি জাহিদুল হক : স্মরণ ও ভ্রম 

তারুণ্যের প্রিয়মুখ কবি-সাংবাদিক শিমুল সালাহউদ্দিন সম্প্রতি একটি স্মৃতিচারণমূলক লেখা– “বেদনাপুত্র জাহিদুল হকের ধ্রুপদ সাধনা ও কিছু স্মৃতি” প্রকাশকাল : ১৭ জানুয়ারী ২০২৪–লিখেছেন সদ্য লোকান্তরিত কবি জাহিদুল হক স্মরণে —বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম পত্রিকায়। 

লেখাটি শিমুলের অন্যান্য লেখাগুলির মতোই সুখপাঠ্য ও তথ্যবহুল। কবি জাহিদুল হককে নিয়ে এমন একটি লেখার জন্য শিমুল সালাহউদ্দিন কে ধন্যবাদ জানানো যায়। কিন্তু স্মৃতি চারণের এক পর্যায়ে গিয়ে লক্ষ্য করা যায়, লেখাটির একটি বিরাট অংশ শিমুল সালাহউদ্দিন, ” বাংলা রিভিউ”-এ প্রকাশিত (প্রকাশকাল : ১৬, জানুয়ারী ২০২৪) জনপ্রিয় লেখক-কবি কাজী জহিরুল ইসলামের “চিরশিল্পের দেশে চলে গেলেন জাহিদুল হক ” থেকে হুবহু উদ্ধৃত করেছেন কোন রকম তথ্যসূত্র উল্লেখ অথবা ঋণ স্বীকার না করেই! 

আমরা জানি, শিমুল সালাহউদ্দিন একজন সচেতন সাংবাদিক ও কবি। তার তো এমন ভুল হওয়ার কথা নয়! এই ভুল কি ইচ্ছাকৃত? 

আমরা ধরে নিবো, এটি অনিচ্ছাকৃত –যদি তিনি (শিমুল সালাহউদ্দিন), তার লেখাটিতে (যে অংশ তিনি উদ্ধৃত করছেন) লেখক এবং আমাদের পত্রিকার উল্লেখ করেন এবং সংশোধনী দেন।  

পাঠকদের সুবিধার্থে  শিমুল সালাহউদ্দিন  এবং কাজী জহিরুল ইসলামের লেখা দুটি নিম্নে প্রকাশিত হলো। 

[সম্পাদক : বাংলা রিভিউ ]

বেদনাপুত্র জাহিদুল হকের ধ্রুপদ সাধনা ও কিছু স্মৃতি

ঠিকানা লাগবে না মশাই। হোটেল থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি নেবেন, বলবেন সুচিত্রা সেনের বাড়িতে যাব।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন

Published : 17 Jan 2024, 00:52 AM

Updated : 17 Jan 2024, 00:52 AM

স্পষ্টভাষী মিতবাক কবি জাহিদুল হক, জাহিদ ভাইয়ের সাথে প্রথম কবে দেখা হয়েছে ভুলেই গেছি প্রায়। বইমেলায়, টেলিভিশনে, নানা কবিতার আড্ডায় জাহিদ ভাইকে দেখেছি। স্মৃতি হাঁতড়ে যেটি মনে পড়ছে সেটির সময়কাল ২০১৩ এর নভেম্বর (৩০), অধুনালুপ্ত নতুনধারার আয়োজন কবিতা পড়তে গিয়েছিলাম পাবলিক লাইব্রেরির সেমিনার হল দুইয়ে। সে আয়োজনের আমন্ত্রণপত্র ঘেঁটে দেখতে পাচ্ছি নতুনধারা সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান ও অতিথি সম্পাদক ফরিদ কবির কর্তৃক প্রেরিত সে আমন্ত্রণপত্র অনুসারে সেখানে কবিতা পাঠের জন্য আমার পাশাপাশি আমন্ত্রিত ছিলেন কবি জাহিদুল হক। আরো ছিলেন আনোয়ারা সৈয়দ হক, শামসুল ফয়েজ, মুজতবা আহমেদ মুরশেদ, কামরুল হাসান, আহমেদ স্বপন মাহমুদ, নভেরা হোসেন, সোহেল হাসান গালিব এবং আলতাফ শাহনেওয়াজ। প্রায় এক দশক আগের ঘটনা, তবে আমার আবছা মনে আছে আমার প্রকাশিতব্য বই কথাচুপকথা থেকে দুই কি তিনটি কবিতা আমি পড়েছিলাম। কবিতা পাঠের শেষে আড্ডায় আমাকে আলাদা করে ডেকে কথা বললেন জাহিদ ভাই, মুগ্ধচোখে— স্নেহাতুর কণ্ঠে। ছন্দ ও শব্দপ্রয়োগের প্রসংশা করেছিলেন, বইটা কারা বের করবে শুনে নিয়েছিলেন। বলেছিলেন রেডিওতে যেতে, শাহবাগেই অফিস!

একটি ২৪ ঘন্টার সংবাদমাধ্যমের কর্মীর যা হয়, কথা রাখতে পারিনি, যাওয়াও হয়নি জাহিদ ভাইয়ের সাথে দেখা করতে। দেখা হলেই মনে হতো আহা জাহিদ ভাই বলেছিলেন, আমি তো গেলাম না। আদতে জীবনের এতো টানাপোড়েন… সোনায় সোহাগার মতো মিলন আর আমাদের হলো কই!

এরপরের মোলাকাতটি অবশ্য কবিতাবাংলার আয়োজনে, ৯ আগস্ট ২০১৪, কাঁটাবনে। কবিতাবাংলা আয়োজিত চেতনকবিতার দ্বাদশ আয়োজনে। আমাকে আয়োজকরা জানিয়েছিলেন আমার কবিতার বই ‘কথাচুপকথা…’ নিয়ে আলাপ করবেন একজন অগ্রজ কবি। তাঁর নামটি আমাকে বলেননি। তড়িঘরি করে অফিসের কাজ শেষ করে ও অন্যদের ঘাড়ে কিছু কাজ চাপিয়ে দিয়ে যখন গিয়ে পৌঁছলাম তার অনেকক্ষণ আগে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। ব্যানারে দেখি আমার কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ, আরেকটা কথাসাহিত্যের বইয়ের পাশে। তা নিয়েই নাকি আলোচনা করবেন অধ্যাপক মোহাম্মদ মুনিরুজ্জামান. কবি সানাউল হক খান, মুহম্মদ নূরুল হুদা, জাহিদুল হক, মতিন বৈরাগী ও ফরিদ আহমদ দুলালের মতোন অগ্রজজনেরা। বেশ একটু অবাক হলাম। তো এক্সটেম্পোর আলাপ করলেন আমার বইটি নিয়ে দুজন। সানাউল হক খান এবং জাহিদুল হক। জাহিদ ভাইয়ের কবিতার পঠনপাঠন থেকেই আমার তিনি খুব প্রিয় কবি হয়ে উঠেছিলেন, তো তিনি সেবার যে প্রসংশাপূর্ণ আলোচনা করলেন তা থেকে নিশ্চিত হলাম বাকীদের কেউ পড়ুন কী না পড়ুন জাহিদুল হক এবং সানাউল হক খান বইটি খুঁটিয়ে পড়েছেন। কি প্রশংসা করেছেন তা আর না বলি, সে এখানে প্রাসঙ্গিকও নয়। প্রাসঙ্গিক হলো, কবি জাহিদুল হকের নজর ও চয়েস। নতুনধারার আয়োজনে কবিতা শুনে একজন অতি তরুণের নাম মনে রাখা, বইটি নিজের আগ্রহে যোগাড় করা এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোন সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও সুযোগ পাওয়ামাত্র সেই তরুণের বুক কাব্যের আত্মবিশ্বাসে ফুলিয়ে দেয়ার মতো একটি ‘কান্ড’ ঘটিয়ে ফেলা।

এরপর বহুবার জাহিদ ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছে, দেখা হলেই দুষ্টুমি করতেন, কী মিঞা, ললাটভাসা রোদে কি ছায়া পড়েছে নাকি, সাথে কেউ নেই কেন? তারপর ধীরে ধীরে খোঁজখবর নিতেন, কাজের কি খবর কি করছো কি পড়ছো। আমি খোঁচাতাম আচ্ছা জাহিদ ভাই মুজতবা আলীর ইন্টারভিউ করেছিলেন ঐ গল্পটা বলেন না! কিংবা সুচিত্রাকে কি সেদিন আসলেই চুমু খেয়েছিলেন জাহিদ ভাই!

আমাদের জাহিদ ভাই, কবি জাহিদুল হক লজ্জ্বায় লাল হয়ে যেতেন। বলতেন, কী সব তীলকে যে তোমরা মুখে মুখে তাল বানাও। আমি কবিগিরি ব্যবহার করে শুধু দেখা করতে গিয়েছিলাম। আমরা বলতাম, না জাহিদ ভাই আপনি বলছেন না, এড়িয়ে যাচ্ছেন। নইলে তারপর বারবার আপনি কোলকাতা কেন যেতেন! জাহিদ ভাই হাসতেন, তার সেই প্রাণখোলা হাসি। মাঝে মাঝে ক্ষেপে গিয়ে বলতেন আমাকে আবুল হাসান ভেবো না, আমি কিন্তু অকৃতদার; ডুব দেই কিন্তু ভিজি না! আমরা হেসে উঠতাম। (জাহিদ ভাই পরে ২০১৭ সালে বিয়ে করেছিলেন, মাত্র বছর দুয়েক পর তার স্ত্রী মারা যায়, সে আরেক ট্রাজেডি)

পূর্ব পশ্চিমের যশোর সাহিত্য উৎসব কিংবা বাংলামোটরের জহুরা টাওয়ারে কবিতার আয়োজনে দেখা হয়ে গেল জাহিদ ভাইয়ের সাথে। সব কবিরা যেখানে কবিতা পড়লেন দেখে দেখে জাহিদ ভাই মূর্তিমান ব্যতিক্রম। টানা মুখস্ত কবিতা শুনিয়ে গেলেন। তার মধ্যে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবার আসা সৈয়দ মুজতবা আলীর ইন্টারভিউর গল্প। তখন তিনি রেডিও বাংলাদেশ-এর প্রযোজক।

সেদিন সে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা কয়েকজন কবিও। এর মধ্যে সৈয়দ হাসমত জালাল যাবেন উত্তরায়, আমারও গন্তব্য সেদিকে। আয়োজকদের কাঁধে ভার জাহিদ ভাইকেও বাসায় পৌঁছে দেবার। পূর্ব পশ্চিমের নির্বাহী সম্পাদক চঞ্চল কবীর বললেন, শিমুল ভাই আপনি একটু দায়িত্ব নেন, আমি গাড়ি দিচ্ছি, জাহিদ ভাইকে বনশ্রী নামিয়ে আপনারা উত্তরা যান, হাসমত জালাল ভাইকে ড্রপ করে আমার ড্রাইভার আপনাকে উত্তরায় নামিয়ে আসবে। একে জ্যামের শহর, দুইয়ে বৃহস্পতিবার, কিন্তু দুই কবির সান্নিধ্য পাওয়ার লোভে ঘুরপথ এ যাত্রায় রাজী হয়ে গেলাম। গাড়িতে উঠেই শুরু হলো কবিতার গল্প, হাসমত জালাল এবং জাহিদুল হক দুজনেরই কণ্ঠস্থ নিজেদের অনেক কবিতা, আমার সে তুলনায় কম। কিন্তু কবিতা পাঠ আর গল্পে কখন সময় গেলো আর কখন বনশ্রী চলে এলো টেরই পেলাম না। নিজের নায়িকার কথা ভেবে আরব সাগর তীরে দাঁড়ানো এক বিমানসৈনিক সৈয়দ হাসমত জালালের দুর্দান্ত এক কবিতা শোনার পর কবিতার নায়িকার প্রশ্নেই এলো অমোঘ সেই প্রসঙ্গ। সুচিত্রা সেন। জাহিদ ভাইদের আমলের নায়িকা শুধু নন যিনি, যিনি জাহিদুল হকের স্বপ্নের নায়িকা। জাহিদ ভাই ঘোরগ্রস্তের মতো প্রেমিকাচেহারা নিয়ে বলছেন তখন—  “আমি তার আগে কলকাতায় খুব একটা যাইনি। মাত্র দুবার। দ্বিতীয়বারের গল্প এটা বুঝলে। একদিন কফি হাউসে বসে আড্ডা দিচ্ছি। সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং অপর্ণা সেন। অপর্ণা আমাকে বলেন, আপনাকে তো আগে কখনো দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না। আমি বলি,আমি কলকাতায় আগে মাত্র একবার এসেছি। আসলে কলকাতার প্রতি আমার কোনো মোহ নেই। শুধু দুজন মানুষের টানে দুবার এসেছি। অপর্ণা তখন খুব উৎসুক এবং আহত হলেন। তিনি বললেন, কলকাতা ব্রিটিশ ভারতের ইন্টেলেকচুয়াল হাব, কত শত বিখ্যাত মানুষ এখানে জন্মেছে, থেকেছে, আর আপনি মাত্র দুজন মানুষের আকর্ষণে এখানে এসেছেন! কোন সে দুজন সৌভাগ্যবান বা সৌভাগ্যবতী, নাম জানতে পারি কি?

আমি বললাম, অবশ্যই জানতে পারেন। তাদের একজন বুদ্ধদেব বসু, যার সঙ্গে দেখা হবার আর কোনো সুযোগ নেই। অপর্ণা জিজ্ঞেস করলেন আরেকজন, আমি বললাম আরেকজনের সাথেও দেখা হওয়ার সুযোগ নেই, যদিও তিনি বেঁচে আছেন।

অপর্ণা জিজ্ঞেস করলেন কে! আমি বললাম, অন্যজন সুচিত্রা সেন। আমার খুব ইচ্ছে এবার তার সঙ্গে দেখা করে যাব। অপর্ণা এমন মুখভঙ্গি করলেন যেন আকাশের চাঁদ হাতে চাইছি।

এরপর আমরা অনেকক্ষণ আড্ডা দিয়ে যখন উঠে যাচ্ছি তখন সৌমিত্র বলেন, জাহিদ, সুচিত্রা তো আজকাল কারো সঙ্গে দেখা করেন না, নীরবে নিভৃতে জীবন যাপন করছেন। আমি একজনের ফোন নাম্বার দিই, যোগাযোগ করে দেখতে পারেন। আমি পরদিন হোটেল থেকে ফোন করলাম, এক ভদ্রলোক ধরলেন। তিনি, সুচিত্রা সেনের যিনি দেখাশোনা করেন, একজন বৃদ্ধ লোক। অনিরুদ্ধ বা এমন কোন নাম। তিনি আমাকে জানিয়ে দিলেন দিদি কারো সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করেন না, আর সাংবাদিক টাইপের কারো সঙ্গে তো নয়ই। আমি এবার সুর পাল্টে বললাম, আপনি বলবেন আমি একজন কবি, বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুধু তার সঙ্গে দেখা করতে, আমি দিদিকে আমার বইটা দিয়েই চলে যাবো, এক মিনিটও বসবো না। অনিরুদ্ধ বললেন, হবে না। তিনি কারো সঙ্গেই দেখা করবেন না। আমি বললাম,  ঠিক আছে, আপনি অন্তত দিদিকে আমার কথাটা বলুন, ‘না’ টা তার মুখ থেকেই শুনি। পরদিন জাহিদ ভাইয়ের হোটেলে ফোন করে সেই ভদ্রলোক জানান, দিদিকে আপনার কথা বলেছি, তিনি আমার ওপর ক্ষেপে গেছেন।

আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম উফফফ। তারপর? জাহিদ ভাই বলছেন— তখন আমি খুব আহত এবং আশাহত হলাম। আমার প্রিয় নায়িকাকে এক নজর দেখতে পাবো না? আমার টাকাও ফুরিয়ে আসছে। সেই হোটেল ছেড়ে দিয়ে একটি সস্তার হোটেলে উঠি। কলকাতার হোটেলগুলোর তখন একটা নিয়ম ছিল, কেউ অন্য হোটেলে ট্রান্সফার হলে নতুন হোটেলের ঠিকানা, রুম নাম্বার আগের হোটেলকে জানাতে হত। আমি তাই করি। পরদিন আমার নতুন হোটেলে সেই ভদ্রলোক ছুটে আসেন। আমি তখন বাইরে ছিলাম, তিনি অনেকক্ষণ আমার জন্য অপেক্ষা করেন। তখন তো আর মোবাইল ফোনের যুগ ছিল না, চাইলেই কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা যেত না। আমি ফিরে এলে তিনি আমার ওপর ভীষণ ক্ষেপে যান। আপনি যে হোটেল বদলেছেন, আমাকে জানাবেন না মশাই। তখনই তিনি বলেন, সকালে নাশতার টেবিলে বসে দিদি হঠাৎ বলছেন, হ্যাঁ রে তোর বাংলাদেশের সেই কবিটাকে কাল বিকেলে আসতে বলিস তো। আপনি খুব সৌভাগ্যবান মশাই, দিদির দেখা পেয়ে যাবেন। আমি তখন বলি, কখন যাবো?

ঠিক পাঁচটায়। দিদি কিন্তু সময়ের ব্যাপারে খুব সচেতন। এক মিনিটও যেন দেরী না হয়।

আমি ঠিক পাঁচটায়ই চলে আসবো। ঠিকানাটা বলুন, আমি লিখে নিচ্ছি।

ঠিকানা লাগবে না মশাই। হোটেল থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি নেবেন, বলবেন সুচিত্রা সেনের বাড়িতে যাব। পাঁচটা বাজার পাঁচ মিনিট আগেই আমি পৌঁছে যাই। গিয়ে পাঁচ মিনিট গেটের বাইরে অপেক্ষা করি। ড্রয়িংরুমে আমি বসে আছি। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি আসেন। আমি নিজের নাম বলে তার হাতে আমার বইটা দিই। এরপর বলি, দিদি, অনুমতি দিলে আমার জীবনের একটা ঘটনা আপনাকে শোনাতে চাই, দুমিনিটের বেশি লাগবে না, এটা বলেই আমি চলে যাবো। তিনি ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলেন।  আমি আপনার সব সিনেমাই দেখেছি। হারানো সুর দেখতে গিয়ে একটা বিপদে পড়েছিলাম। আমি তখন স্কুলে পড়ি। মা জানতেন আমি আপনার খুব ভক্ত। হারানো সুর তখন আমাদের সিনেমা হলে এসেছে। সন্ধ্যায় পড়ার টেবিল থেকে পালিয়ে সিনেমা দেখতে চলে যাই। রাতে ফিরে এসে যখন খেতে বসেছি, মা আমার ভাতের প্লেট টেনে নিয়ে যান। বলেন, সুচিত্রা সেনকে গিয়ে বল তোকে ভাত দিতে।

একথা শুনে তিনি হাসতে শুরু করেন। তার সেই বিখ্যাত হাসি। এরপর বলেন, সুচিত্রা সেন তোমাকে ভাত খাওয়াবে, তুমি খেয়ে যাবে। এরপর অনেকক্ষণ গল্প করি।

বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে চেয়েছেন। মাঝে মাঝেই তিনি উঠে যাচ্ছিলেন, বুঝতে পারছিলাম রান্নাঘরের তদারকি করতেই উঠে যাচ্ছিলেন এবং প্রতিবার ফিরে এসেই জিজ্ঞেস করতেন, মা কি বললো, আবার বলো তো। বেশ কয়েকবার তিনি এই ঘটনাটি জানতে চাইলেন এবং প্রতিবার আমার কথা শুনে হাসতে শুরু করলেন’’।

এতক্ষণে ড্রাইভার আমাদের বলেছেন আমরা বনশ্রীতে, তুমুল আড্ডার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নেমে গেলেন জাহিদ ভাই, বাকি রাস্তাটা আমি আর হাসমত জলিলও সুচিত্রার সিনেমার গল্পে মত্ত হয়ে থাকলাম।

ওহ মনে পড়েছে, জাহিদ ভাইয়ের একটা ছোট্ট ইন্টারভিউ করেছিলাম আমি ২০১৬/১৭ সালের দিকে, বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ বিষয়ে। সেই ইন্টারভিউর র’ফুটেজ থেকে উদ্ধৃত করি। জাহিদ ভাইকে সাতই মার্চের ভাষণের দিনের ঢাকা বেতারের ভেতরের দৃশ্য কেমন ছিলো জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বলছিলেন—  “১৯৭১-এর ১৮ জানুয়ারি আমি যোগ দেই ঢাকা কেন্দ্রে। এক শিক্ষককে অনুরোধ করে এই পোস্টিং নিয়েছিলাম যেনো এই উত্তাল সময়ে আমি ঢাকার কেন্দ্রে থাকতে পারি। ঢাকা বেতারের সুবিধা হলো, প্রায় সবাই ছিলেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। ঐতিহাসিক ৭ মার্চে আমি শাহবাগ কেন্দ্রের অফিসার ইনচার্জ ছিলাম। এটা তখন বিশাল বিষয়। অনেক ক্ষমতাধর ছিলাম কিন্তু। আমরা পরিকল্পনা করলাম বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার করবো। সব প্রস্তুত। কিন্তু শেষ মুহূর্তে করাচি থেকে বার্তা এলো ভাষণ প্রচার করা যাবে না। তাদের ভয় ছিল, বঙ্গবন্ধু যদি স্বাধীনতার ঘোষণা করে দেন! মাথায় আগুন উঠে গেল আমার। এমনিতেই বাম রাজনীতি করে আসা ছেলে, সবাই আমাকে মানতো। ভাষণ প্রচারে বাধা আসায় আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, ঢাকা কেন্দ্র বন্ধ করে দেবো। আমি আর আশফাকুর রহমান খান, আমার সিনিয়র কলিগ। চমৎকার মানুষ ছিলেন। তাকে নিয়ে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিলাম, চলো রেডিও বন্ধ করে দেই। সবাই তখনই মাস্টার কন্ট্রোল রুমে (এমসিআর) গেলাম। সন্ধ্যা ছয়টা-সাড়ে ছয়টা হবে। সেখানে গিয়ে একে অপরের হাতে হাত রেখে স্টেশন সুইচ অফ করে দিলাম।

বঙ্গবন্ধু নিজেই তো সেদিন বলেছিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি…’। সেই মন্ত্রবলেই রেডিও বন্ধ করে বেরিয়ে পড়লাম। এই কাজের মাধ্যমে আমিই তো স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করেছিলাম। এর আগে তো যুদ্ধটা শুরু হয়নি। এই গৌরব আমি করতেই চাই। আমিসহ সেদিন আরও যারা সহকর্মী ছিলেন, সবাই মিলেই মুক্তির যুদ্ধটা শুরু করেছি বেতার থেকে। পরেরদিন অবশ্য, সচিব-মন্ত্রী-সামরিক বাহিনী পর্যন্ত গড়ালো বিষয়টা। এরপর সিদ্ধান্ত হলো, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বেতার সম্প্রচার করবে। আমাদের আশ্বস্ত করলো। আমরা পরদিন আবারও কাজে ফিরলাম।‘

শুধু সাতই মার্চের ভাষণ বিষয়ে নয়, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর জাহিদুল হক লিখেছিলেন দৈনিক সংবাদের পাতায় প্রথম কবিতাটি। যে কবিতা পরে বহু-বহুবার নানা অনুষ্ঠানে আয়োজনে পড়েছেন তিনি—

হঠাৎ রঙিন গোলাপ দেখে

মুজিব দেখে ভুল করি

কোথায় পেলি অমন কুসুম

সোনার বাংলা আ মরি

কোথায় পেলি পদ্মা মেঘনা

কার নামে সে কুলুকুলু

মসজিদে তোর প্রাণের আজান

মন্দিরে তোর উলু

(গোলাপ/ জাহিদুল হক)

বিটিভির ভিডিও লিংক: https://www.youtube.com/watch?v=S6e94AzBGms

আজীবন ধ্রুপদি কবিতার সাধনা করেছেন জাহিদুল হক, কবিতার বইগুলোর শিরোনাম দেখলেই তা যে কোন কবিতার পাঠক টের পাবেন। পকেট ভর্তি মেঘ, তোমার হোমার, নীল দূতাবাস, সেই নিঃশ্বাসগুচ্ছ, পারীগুচ্ছ ও অন্যান্য কবিতা, এই ট্রেনটির নাম গার্সিয়া লোরকা, এ উৎসবে আমি একা— কী দারুণ রোমান্টিক সব নাম।

মাত্র শ’খানেক গান লিখেই জনপ্রিয় গীতিকবি হিসেবে খ্যাতি পেয়েছেন। ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর ত নয়, তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়’ সুবীর নন্দীর কণ্ঠে গীত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে মানুষের মুখে মুখে। কিন্তু নিজে জাহিদুল হক কখনো গীতিকবি হিসেবে পরিচিত হতে চাননি, নিজেই লিখেছেন, “গান লিখতে চাইনি একেবারেই। সামান্য যে ক’টি গান রচনা করেছি, সেগুলোর অন্যতম কৃতিত্ব সুরকার কমল দাশগুপ্ত, আব্দুল আহাদ এবং খন্দকার নূরুল আলমের। তারাই আমাকে কবিতা থেকে গানে আসতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তারা প্রায়ই বলতেন, ‘কী মিষ্টি তোমার কবিতা, তুমি আমাদের জন্য গান লেখো না কেন? আমাদের এক-দুটো গান লিখে দিলে কী হয়!’ আমি বলতাম, গানের বাণীর যে অবস্থা, গীতিকারদের যে অবস্থা– এমন পরিবেশে গান লেখার আগ্রহ পেতাম না। একরকম নাক সিটকানো বিষয় আমার মধ্যে কাজ করতো। তবুও তারা থামেননি। বিভিন্ন সময়ে আমাকে চাপ দিয়ে বলতেন, ‘ঠিক আছে, তুমি তোমার মতো করেই লিখো। সমস্যা তো নেই। কিন্তু লিখো।’

তখন ভাবলাম, আসলেই তো আমার মতো করে লিখতে পারি। আমার গানের লিরিক কবিতার দিকে ঝুঁকিয়ে দিতে পারি। এই ভেবে লেখার চেষ্টা করেছি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত’’। অথচ একাধিক গণমাধ্যম উনার মৃত্যুর খবরে হেডলাইন করেছে গীতিকবি জাহিদুল হক মারা গেছেন— এ যে কী তীব্র বেদনার জাহিদুল হকের শুভার্থীদের জন্য, হায় বার্তাকক্ষের বরাহশাবকরা যদি জানতেন! গানের লিরিক কবিতার দিকে ঝুঁকিয়ে দেয়া মানুষটা আগে কবি, গীতিকবি নন, তার পরিচয় গীতিকবি হতে পারে না।

বেদনারই বরপুত্র ছিলেন জাহিদুল হক আদতে, কাকে কাকে যেন তাকে ডাকতেও শুনেছি বেদনাপুত্র। কিন্তু সমস্ত বেদনা ছাপিয়ে এক জীবনে উদযাপনও ছিল জাহিদুল হকের যাপনে। ফেনি সাহিত্যসভার উদ্বোধনী, কবির সংবর্ধনা আয়োজনে গিয়েছিলাম শাবিহ মাহমুদ কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে কদিন আগে। কী যে খুশি হলেন জাহিদ ভাই আমাকে দেখে! অনুষ্ঠান শেষে রাতে আড্ডা হলো, পরদিন ভোরে ঢাকাযাত্রা হবে বলে অনেক আড্ডার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শেষ হওয়া সে আড্ডাই যে শেষ আড্ডা হবে কে জানতো!

এই ছবিটা দেখুন, এই যে ভাবটা দেখতেছেন না, আপাদমস্তক এক কবির ভাব। মুঞ্জিত পলকের ভেতর নাকি পাথর হয়ে গেছে তাঁর দুটি চোখ।

জাহিদ ভাই, ধ্রুপদি বাংলা কবিতার ভুবনে আপনি অমর, আপনি থাকবেন। আমরা কেবল এ মরপৃথিবী থেকে আপনাকে সাময়িক বিদায় জানাতে পারি। আপনার সাথে আড্ডা, কবিতা নিয়ে গভীর কথকতা খুব মিস করব। কিভাবে আর শুনব আপনার কণ্ঠস্থ কবিতাগুলো, কী দারুণ মগ্ন উচ্চারণেই না আপনি পড়তেন—

আমায় একটু আকাশ দেবে

তোমার মনের ওপাশ থেকে

যেই পাশেতে উদাস হাওয়া

উদাস মেঘের জটলা থাকে,

সেই পাশেতে রঙিন সুতায়

ছোট্ট একটা ঘুড়ি ওড়াব!

আমায় একটু চক্ষু দেবে

তোমার চোখের সাগর থেকে,

আধার চোখের সাগর পাড়ে

একবার আমি নাইতে যাব!

আমায় একটু বসতে দেবে

হৃদ উঠোনের দখিন পাশে,

এ পাশটাতে ছোট্ট একটা

হাসনাহেনার গাছ লাগাব!

আমায় একটু স্বপ্ন দেবে

স্বপ্ন মালার শেষের থেকে

রংধনুটার একটু এনে

স্বপ্ন তোমার রাঙিয়ে দেব!

আমায় একটু রাত্রি দেবে

মন ফাগুনের রাত্রি থেকে,

বটের তলে নিরব বসে

রাখালী বাঁশির গান শোনাব!

আমায় একটু বাতাস দেবে

হৃদপাথারের ওপাশ থেকে,

চৈতী রাতের হিমেল হয়ে

গোপনে তোমার গায়ে জড়াব!

আমায় একটু জীবন দেবে

ওই জীবনের কিনার থেকে,

এই জীবনের রংতুলিতে

ওই জীবনটা রাঙিয়ে দেব!

(ইচ্ছেছবি/ জাহিদুল হক)

বাংলা কবিতার বেদনাপুত্র, প্রিয় জাহিদুল হক, নিজের প্রিয় সমস্ত কিছু নিয়ে ভালো থাকবেন আপনি, দেখা হবে স্বর্গের নিলাভ প্রান্তরে অনন্ত আড্ডায়।  

চিরশিল্পের দেশে চলে গেলেন জাহিদুল হক 

 কাজী জহিরুল ইসলাম  

ডিসেম্বরের ৫ তারিখে জাহিদ ভাইয়ের সঙ্গে এক ঘন্টা ফোনে কথা হয়। কবি জাহিদুল হকের জীবনে কত মজার এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে তা অনেকেই জানেন না। জানেন না এজন্য যে তিনি এইসব কথা কখনো লিখেননি। আমাদের শেষ আলাপচারিতায় আমি বলি, জাহিদ ভাই, এগুলো আপনি লিখছেন না কেন? জাহিদ ভাই বলেন, হ্যাঁ  লিখবো, লিখবো। আমি জানি তার লেখা হবে না। গদ্য লেখার বেলায় তিনি খুবই অলস। তার সর্বশেষ প্রকাশিত কবিতার বই ‘মিকেলাঞ্জেলো ও অন্যান্য সনেট’ এর ভূমিকা লিখতে দুবছর লেগেছে, সেই লোক নিজের জীবনের মজার ঘটনাগুলো গদ্যে খুব দ্রুতই লিখে ফেলবেন তা আমি অন্তত বিশ্বাস করিনি। আমি বরং তাকে বলি, আপনার লিখতে হবে না, আপনি আমাকে বলেন, আমি লিখবো। তিনি বলেন, সেটাই বরং ভালো। তখন তিনি বলতে শুরু করেন। শোনো, সোফিয়া লরেনের সঙ্গে সারাদিন তার ইতালির এপার্টমেন্টে কাটানোর গল্প তো তোমাকে বলেছি, এবার আরো একজন বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে আমার সময় কাটানোর গল্প শোনো। জাহিদ ভাইয়ের খুব ইউরোপ প্রীতি, এ-নিয়ে তাকে আমরা কম খোঁচাইনি, ধরেই নিয়েছি এবারও হয়ত কোনো ইউরোপীয় বিখ্যাত কবির সঙ্গে তার আড্ডার কথা বলবেন। কিন্তু না, তিনি প্রাচ্যের বিখ্যাত শহর কলকাতার গল্প বলতে শুরু করলেন।

আমি কিন্তু কলকাতায় খুব একটা যাইনি, মাত্র দুবার গিয়েছি। দ্বিতীয়বার যখন যাই তখন একদিন কফি হাউসে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। সঙ্গে ছিলেন সৌমিত্র চট্টপাধ্যায় এবং অপর্ণা সেন। অপর্ণা আমাকে বলেন, আপনাকে তো আগে কখনো দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না। আমি বলি, না দেখেননি, আমি কলকাতায় আর মাত্র একবার এসেছি। আসলে কলকাতার প্রতি আমার কোনো মোহ নেই। শুধু দুজন মানুষের টানে দুবার এসেছি। অপর্ণা তখন খুব উৎসুক এবং আহত হলেন। তিনি বলেন, কলকাতা হচ্ছে ব্রিটিশ ভারতের ইন্টেলেকচুয়াল হাব, কত শত বিখ্যাত মানুষ এখানে জন্মেছে, থেকেছে, আর আপনি মাত্র দুজন মানুষের আকর্ষণে এখানে এসেছেন! কোন সে দুজন সৌভাগ্যবান বা সৌভাগ্যবতী, নাম জানতে পারি কি? 

অবশ্যই জানতে পারেন। তাদের একজন বুদ্ধদেব বসু, যার সঙ্গে দেখা হবার আর কোনো সুযোগ নেই, অন্যজন সুচিত্রা সেন। আমার খুব ইচ্ছে এবার তার সঙ্গে দেখা করার। এরপর আমরা অনেকক্ষণ আড্ডা দেই, উঠবার মুহূর্তে সৌমিত্র দা বলেন, জাহিদ, সুচিত্রা তো আজকাল কারো সঙ্গে দেখা করেন না, নীরবে নিভৃতে একলার জীবন যাপন করছেন। আমি একজনের ফোন নাম্বার দিই, যোগাযোগ করে দেখতে পারেন।

আমি খুব মন দিয়ে জাহিদ ভাইয়ের গল্প শুনি। এরপর তিনি সেই নাম্বারে ফোন করলে এক ভদ্রলোক ধরেন। তিনি, সুচিত্রা সেনের যিনি দেখাশোনা করেন, একজন বয়স্ক বাজার সরকার টাইপের লোক, তার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেন। ভদ্রলোকের নামটা জাহিদ ভাই বলেছিলেন কিন্তু আমি ভুলে গেছি। তিনি সাফ জানিয়ে দেন দিদি কারো সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করেন না, আর সাংবাদিক টাইপের কারো সঙ্গে তো নয়ই। জাহিদ ভাই এবার সুর পাল্টান, বলেন, আপনি বলবেন আমি একজন কবি, বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুধু তার সঙ্গে দেখা করতে, আমি দিদিকে আমার বইটা দিয়েই চলে যাবো, এক মিনিটও বসবো না। বাজার সরকার বলেন, হবে না। তিনি কারো সঙ্গেই দেখা করবেন না। জাহিদ ভাই, আবারও বলেন, ঠিক আছে, আপনি অন্তত দিদিকে আমার কথাটা বলুন, ‘না’ টা তার মুখ থেকেই আসুক। পরদিন জাহিদ ভাইয়ের হোটেলে ফোন করে সেই ভদ্রলোক জানান, দিদিকে আপনার কথা বলেছি, তিনি আমার ওপর ক্ষেপে গেছেন।

জাহিদ ভাই বলেন, তখন আমি খুব আহত এবং আশাহত হই। আমার প্রিয় নায়িকাকে এক নজর দেখতে পাবো না?। আমার টাকাও ফুরিয়ে আসছে। সেই হোটেল ছেড়ে দিয়ে একটি সস্তার হোটেলে উঠি। কলকাতার হোটেলগুলোর তখন একটা নিয়ম ছিল, কেউ অন্য হোটেলে ট্রান্সফার হলে নতুন হোটেলের ঠিকানা, রুম নাম্বার আগের হোটেলকে জানাতে হত। আমি তাই করি। পরদিন আমার নতুন হোটেলে সেই ভদ্রলোক ছুটে আসেন। আমি তখন বাইরে ছিলাম, তিনি অনেকক্ষণ আমার জন্য অপেক্ষা করেন। তখন তো আর মোবাইল ফোনের যুগ ছিল না, চাইলেই কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা যেত না। আমি ফিরে এলে তিনি আমার ওপর ভীষণ ক্ষেপে যান। আপনি যে হোটেল বদলেছেন, আমাকে জানাবেন না মশাই। তখনই তিনি সুখবরটা দেন। সকালে নাশতার টেবিলে বসে দিদি হঠাৎ বলছেন, হ্যাঁরে তোর বাংলাদেশের সেই লোকটাকে কাল বিকেলে আসতে বলিস তো। আপনি খুব সৌভাগ্যবান মশাই, দিদির দেখা পেয়ে যাবেন। আমি তখন বলি, কখন যাবো?

ঠিক পাঁচটায়। দিদি কিন্তু সময়ের ব্যাপারে খুব সচেতন। এক মিনিটও যেন দেরী না হয়।

আমি ঠিক পাঁচটায়ই চলে আসবো। ঠিকানাটা বলুন, আমি লিখে নিচ্ছি।

ঠিকানা লাগবে না মশাই। হোটেল থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি নেবেন, বলবেন সুচিত্রা সেনের বাড়িতে যাব।

পাঁচটা বাজার পাঁচ মিনিট আগেই আমি পৌছে যাই। গিয়ে পাঁচ মিনিট গেটেই বাইরে অপেক্ষা করি। ড্রয়িংরুমে আমি বসে আছি। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি আসেন। আমি নিজের নাম বলে তার হাতে আমার বইটা দিই। এরপর বলি, দিদি, অনুমতি দিলে আমার জীবনের একটা ঘটনা আপনাকে শোনাতে চাই, দুমিনিটের বেশি লাগবে না, এটা বলেই আমি চলে যাবো। তিনি ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলেন। 

আমি আপনার সব সিনেমাই দেখেছি। হারানো সুর দেখতে গিয়ে একটা বিপদে পড়েছিলাম। আমি তখন স্কুলে পড়ি। মা জানতেন আমি আপনার খুব ভক্ত। হারানো সুর তখন আমাদের সিনেমা হলে এসেছে। সন্ধ্যায় পড়ার টেবিল থেকে পালিয়ে সিনেমা দেখতে চলে যাই। রাতে ফিরে এসে যখন খেতে বসেছি, মা আমার ভাতের প্লেট টেনে নিয়ে যান। বলেন, সুচিত্রা সেনকে গিয়ে বল ভাত দিতে। 

একথা শুনে তিনি হাসতে শুরু করেন। তার সেই বিখ্যাত হাসি। এরপর বলেন, সুচিত্রা সেন তোমাকে ভাত খাওয়াবে, তুমি খেয়ে যাবে। এরপর অনেকক্ষণ গল্প করি। বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে চেয়েছেন। মাঝে মাঝেই তিনি উঠে যাচ্ছিলেন, বুঝতে পারছিলাম রান্নাঘরের তদারকি করতেই উঠছিলেন। ফিরে এসেই, জিজ্ঞেস করতেন, মা কি বললো, আবার বলো তো। বেশ কয়েকবার তিনি এই ঘটনাটি জানতে চাইলেন এবং প্রতিবার আমার কথা শুনে হাসতে শুরু করলেন।

আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই খবর পাই আমাদের প্রিয় জাহিদ ভাই আর নেই। অনেকেই ফেইসবুকে তার ছবিসহ মৃত্যুসংবাদ পোস্ট করেছেন। লেখক, অনুবাদক এবং আমলা, আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ লিয়াকত খান ইনবক্সে তার মৃত্যুসংবাদ এবং তার সম্পর্কে কিছু তথ্য পাঠান। 

জাহিদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার কবে, কখন প্রথম দেখা হয়েছিল মনে নেই, তবে কোভিডের সময় আমরা খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠি। প্রতিদিন জাহিদ ভাই আমাদের সঙ্গে “কফি ও কবিতা” ভার্চুয়াল আড্ডায় যোগ দিতেন। ভালো করে তার মুখ দেখা যেত না। জাহিদ ভাই ঢুকলেই আমি বলতাম, এই যে অন্ধকারের প্রাণী এসেছে। জাহিদ ভাই হাসতেন। একদিন এই অন্ধকারের কারণ জানান, বলেন, আমার এক আত্মীয়া অসুস্থ, আমি এখন সাভারের একটি হাসপাতালে। এরপর একদিন জানতে চাই কে সেই আত্মীয়া? জাহিদ ভাইয়ের বয়স সত্তরের ওপরে, রাত জেগে রোগীর সেবা করার জন্য এটি উপযুক্ত বয়স নয়। সেই নারীর কি আর কোনো আত্মীয় স্বজন নেই? একদিন জানতে চাই, জাহিদ ভাই কে তিনি? তিনি বলেন, তোমাকে পরে বলবো। এরপর একদিন বলেন, আমার স্ত্রী। 

আমি অবাক হই, স্ত্রী! জাহিদ ভাই তো চিরকুমার। কবে বিয়ে করলেন? মাহবুব হাসানকে বলি, জাহিদ ভাই কি বিয়ে করেছেন? মাহবুব বলেন, না তো। আমাকে যে বললেন, হাসপাতালে তার স্ত্রীর সেবা করছেন। মাহবুব বলেন, হয়ত আপনার সঙ্গে ফান করেছেন। আমি মনে মনে ভাবি এমন একটা বিষয় নিয়ে কেউ ফান করে। এরপর তার স্ত্রীর নাম জানতে চাই, তিনি বলেন, তোমাকে পরে বলবো। আমি অনুমান করি কিছু একটা ঝামেলা আছে।

গত অক্টোবরে যখন ঢাকায় যাই, কবিতা ক্যাফেতে আমাকে নিয়ে যে অনুষ্ঠানটি হলো, সেটির তারিখ জাহিদ ভাই জোর করেই বৃহস্পতিবার ২৬ অক্টোবর করতে বলেন। তিনি বলেন, আমাকে উত্তরবঙ্গে যেতে হবে, আমার স্ত্রীর মৃত্যুবার্ষিকী, পুরো আয়োজনটা আমাকে দেখাশুনা করতে হচ্ছে, অন্যদিকে তোমার অনুষ্ঠানেও আমি থাকতে চাই, তুমি প্লিজ শুক্রবারে না করে বৃহস্পতিবারেই করো।

ঢাকার বনশ্রীর ই ব্লকে জাহিদ ভাই তার পৈত্রিক জমিতে বাড়ি করেছেন। আমিও ঢাকায় গেলে আমার ছোটো ভাই বিটনের ফ্ল্যাটে, বনশ্রীতেই উঠি। পাশাপাশি থাকার কারণে প্রতিদিনই আমাদের দেখা হয়। সকালে একসঙ্গে চা-পরোটা খাই সান্দ্রা রেস্টুরেন্টে আর আড্ডা দিই। ই এবং এফ ব্লকের অ্যাভিনিউটিকে আমি বলতে শুরু করি পোয়েটস অ্যাভেনিউ, মূলত এই অ্যাভিনিউর ওপরেই জাহিদুল হকের বাড়ি, তার কারণেই আমি বলি এটির নাম পোয়েটস অ্যাভেনিউ। একদিন চেপে ধরলে তার বিয়ের ঘটনাটি বলেন। তার স্ত্রীর নাম রেবেকা সুলতানা, বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী।

আমি চিরকুমারই ছিলাম। ভদ্রমহিলা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন, তার পাশে থাকা খুব দরকার। অবিবাহিত একজন পুরুষ পাশে থেকে সেবা করবে এটা তো বাংলাদেশের সমাজ মেনে নেবে না। তার বদনাম হবে। জানতাম তিনি হয়ত মাস ছয়েক আছেন। তখন তার পাশে থেকে সেবা করার জন্য আমরা বিয়ে করি। ২০২১ সালের ৩০ অক্টোবর তিনি মারা যান। 

জাহিদ ভাই আমেরিকায় আসতে চেয়েছিলেন। স্ট্রোক করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন নতুন বছরের শুরুতেই। ঠিক এর কয়েকদিন আগেই আমাকে ফোন করে বলেন, ইনভাইটেশন লেটারটা পাঠিয়ে দাও, আমি ভিসার জন্য এপ্লাই করে দিই। আমি বলি, আগে সিদ্ধান্ত নিন আসবেন কিনা। আপনাকে ভিসা দেবেই। ভিসার জন্য হাজার বিশেক টাকা খরচ হবে, যদি সিদ্ধান্ত নেন আসবেন তবেই ভিসা নিন। ইনভাইটেশন আমি যে কোনো মুহূর্তে পাঠিয়ে দিতে পারব।

কে কখন কোন দেশে পৌঁছে যায় কে জানে। জাহিদ ভাই এখন এমন এক দেশের ভিসা পেয়েছেন, প্লেনে উঠেছেন, পৌছেও গেছেন, যেখান থেকে আর কখনো ফিরে আসতে হয় না এবং সেখানে আমরা সকলেই যাবো একদিন। হয়ত ওটাই আমাদের দেশ, এখানে বেড়াতে এসেছিলাম। 

সুবীর নন্দীর গাওয়া “আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়/ তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়” তার লেখা অসম্ভব জনপ্রিয় একটি গান। এটি ছাড়াও তিনি আরো অনেক জনপ্রিয় গানের রচয়িতা। যেমন: কথা দাও কথাগুলো ফেরত নেবে না, স্বাধীনতা তুমি আমার বাড়িতে এসো, যে দেশে বাতাস স্মৃতির স্পর্শে ভারী, কত দিন পরে দেখা ভালো আছো তো ইত্যাদি। গীতিকার হিসেবেই মূলত জাহিদুল হক বিখ্যাত। যদিও তার বেশ কিছু সুখপাঠ্য ও পাঠক নন্দিত কবিতাও রয়েছে। 

বাংলাদেশ বেতারের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে পেশাগত দায়িত্ব পালন করা ছাড়াও তিনি সাংবাদিকতা করেছেন ডয়েচে ভ্যালিতে, দৈনিক সংবাদ পত্রিকায়। বিটিভিতে অনেক দিন ধরেই “চিরশিল্পের বাড়ি” নামে একটি অনুষ্ঠান করছিলেন। আমি যখন ঢাকায় ছিলাম তখন বলেন, তুমি থাকতে থাকতে যদি রেকর্ডিংয়ের শিডিউল পড়ে তাহলে এবার তোমাকে গেস্ট হিসেবে আমন্ত্রণ জানাবো। 

জাহিদ ভাইয়ের কাছে অভিজ্ঞতার এক সোনার খনি ছিল। আর কিছুদিন সময় পেলে হয়ত আরো কিছু বের করে আনতে পারতাম। এই আফসোসটা থেকেই গেল। 

জাহিদ ভাইয়ের শিল্পরুচী খুব উঁচু পর্যায়ের ছিল এটা আমি সব সময় টের পেয়েছি। আমাদের শিল্পাঙ্গনের নোংরামী তিনি পছন্দ করতেন না কিন্তু একজন সজ্জন ভদ্রলোক হবার কারণে নীরবে কষ্ট পেতেন, কাউকে কিছু বলতেনও না। জাহিদ ভাইয়ের আত্মা চিরশান্তিতে এক শিল্পের বাগানে ঘুরে বেড়াক, উড়ে বেড়াক এই প্রার্থনা করি।

১৪ জানুয়ারি, ২০২৪। ম্যানহাটন, নিউইয়র্ক

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

পথিক মোস্তফা on সাক্ষাৎকার : নয়ন আহমেদ
সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা