মাহমুদ নোমান
কত অল্পে আমাদেরই মধ্য থেকে,বুকের পাশ থেকে যেন আমাদের বলতে না পারা কথাসব আলমগীর রেজা চৌধুরীর কবিতা। কত সহজে এসবে পাঠকের হৃদয়টাকে বশ করে, সৃষ্টির অনিন্দ্য অস্থিরতায় মোহাবিষ্ট করে রাখে। এমনটাই মনে হয়েছে কবি আলমগীর রেজা চৌধুরীর ‘প্রিয়াংকার জন্য হৃদয়নাথ’ কবিতার বইটির পাঠশেষে। বইটির নাম শুনে প্রায় সবাই মুখস্ত ভাবনা আওড়াবেন যতটাই স্বাভাবিকতায়,পড়তে পড়তে বইটি পড়াশেষে নিজেকে জানান দেবেন কতোটা বোকামি করেছেন হালকা ভেবে নেওয়ার জন্য; কেননা আলমগীর রেজা চৌধুরীর কবিতার শিরোনাম কেবল অদৃশ্য ফাঁদ,অন্দরের আঙ্গিকটা কত বৈচিত্রের,বিষয়ের ক্ষেত্রে এমন সুগভীর; মানুষের প্রাত্যহিকী ব্যতিরেকে অতীত ভবিষ্যতের পর্দা দুলিয়ে দেয় খুব নিবীড়ে….
কবি আলমগীর রেজা চৌধুরীর অন্যান্য বইয়ে মানুষের সৃষ্ট ছন্দের যে সুষম আকুলতা দেখতে পাই,সেখান থেকে ‘প্রিয়াংকার জন্য হৃদয়নাথ’ কবিতার বইটি একেবারে ব্যতিক্রম। আমার কাছে তাই আলাদা গুরুত্ববহ,তবে ভাবনার ভাবসাবে নিজস্বতা এড়িয়ে যায়নি,এই ভাবছন্দ সুখপাঠ্য মনে হয়েছে ; সত্যিকার অর্থে,আলমগীর রেজা চৌধুরী কবিতার জগতে বেশ চৌকষ,কম পরিশ্রমী মনে হলেও; সাদামাটা শব্দে কী তুমুল ব্যঞ্জনায় উদ্দীপ্ত আর মনোলোভা চিত্রপট এঁকে দেন। পরাবাস্তবতার বিভ্রম বলি বা ঠেঁস কথা,সেই বাস্তবতার অতলে পাঠকের ভাবনার জগত মিলেমিশে একেবারে দুরন্তর খোরগোশের নাচন বুঝি…..
তবে সবকিছুর মধ্যে মানবতার বীজ রোপিত,এটা সহজে অনুমেয়। সবশেষে বা শুরুতে বললেও বলতে হয় আলমগীর রেজা চৌধুরী তারুণ্যে দারুণ স্বপ্নবাজ কবি; সংযত,মার্জিত, তবে হঠাৎ উত্থিত হাহাকার থামিয়েও স্বপ্নের নবায়ন করতে জানেন। যখন বলেন—
ভ্রমণজনিত ক্লান্ত চোখ তুলে আধেক পৃথিবী দেখলাম,/ যার নাম প্রিয়াংকা
–১১পৃ.)
খ.
তুমি ভাবছ রোমিও অথবা চন্ডীদাস।/
দূর,ও সময় অনেক আগেই পাল্টে গেছে—/এই আধুনিক যুগে বরঞ্চ নিউট্রন- প্রোটন/ হলে মানাত বেশ!/ ওসবে আমার ঘৃণা আছে।/দেখ না শক্তিধররা কেমন নির্লজ্জের মতো/ পারমাণবিক সম্মেলন ডাকে শান্তির নামে।/ আমি রক অ্যান্ড রোলের সাথে আলীমের ভাটিয়ালি শুনতে চাই।/ তুমি আমাকে হৃদয়নাথ বলে জেনো।
–১৭ পৃ.)
গ.
মধ্যদুপুরে আকাশের কাছে ওড়ে চিল/স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকে ক্রাচে ভর দেয়া বিষণ্ন যুবক;/মনে হয় একাত্তরে হৃদয়নাথ যুদ্ধ থেকে ফেরে/হৃদয়নাথ,যুদ্ধ থেকে ফেরে/ হৃদয়নাথ,ক্ষত নিয়ে ফেরে/ হৃদয়নাথ, মিছিল নিয়ে ফেরে/ হৃদয়নাথ,ভালোবাসার কাছে ফিরে নাই।
–৪৭ পৃ.)
০২.
‘প্রিয়াংকার জন্য হৃদয়নাথ’ কবিতার বইটি মূলত সিরিজ কবিতার সংকলন। মোট পঁচিশটি কবিতার সাথে, প্রত্যেকটি কবিতার পূর্ববর্তী পৃষ্ঠায় ধ্রুব এষের দারুণ স্কেচ। এসবের সাথে বইটির শুরুর কবিতা পড়লে পাঠক নির্দ্বিধায় অতি উৎসাহিত হয়ে ভেতরে যাবেন। কবিতাগুলো পরস্পরের সাথে ভাবে, ছন্দে, চিত্রকল্পে, উপমায় আর বিষয়ে মিলপূর্বক যথার্থতায় উপলব্ধির ব্যাপারটা বেশ মজবুতি গড়ন। রাষ্ট্রীয় সংগ্রামের ইতিহাস সাদামাটা শিরোনামে কেমন আন্তরিক ধ্বনিত,সেটার চমৎকারিত্বে অতি উত্তম পন্থা মনে হয়েছে–
চৈতন্যজুড়ে মানুষ, প্রিয়াংকার মানবিক অধিকার!/চৌদিকে ফসল লুণ্ঠন,বোলহীন ঘুঘুপাখি–/স্তব্ধ দেশ,স্বৈরাচার কাঁধে বসে হাঁক ডাকে।/হৃদয়নাথের চৈতন্যজুড়ে প্রিয়াংকা।/ স্বদেশ ডাকে,ফসল ডাকে,মানুষ ডাকে,/ আমি এখন মিছিলে যাই।
–৩১ পৃ.)
কিংবা,
সোনালি বিশ্বাস বুকে লক্ষ্যভেদী কালের অর্জুন,/ যেভাবে ফিরেছে ঘরে স্বপ্নভুক যতটুকু প্রেম–/তোমাকে দিলাম সখি স্বদেশের নিকষিত হেম,/ প্রাপ্যটুকু চাই, বুকে বাহুলতা– হাতে স্টেনগান।/আগামী ভুবনে তুমি আর আছে অথই নীলিমা–/ তুমি হাত দাও,আমি তুলে দেব ভোরের সুষমা।
–৪৯ পৃ.)
জাত কবিদের এই একটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ্য যে,এতোকিছুর মধ্যেও নিজস্বতা অটুট, মাটির ঘ্রাণে শেকড়ের কথা সবকিছুর ঊর্ধ্বে রেখেছেন কবি আলমগীর রেজা চৌধুরী…
………
প্রিয়াংকার জন্য হৃদয়নাথ
আলমগীর রেজা চৌধুরী
প্রচ্ছদ: শতাব্দী জাহিদ
জয়তী প্রকাশনী
মূল্য: ১৮০ টাকা
বইমেলা, ২০১৮