কাজী জহিরুল ইসলাম
ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে আমার স্ত্রী তিন মাসের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ইবনে সিনা হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন। ঘন ঘন বাজ পড়ছে। বৃষ্টিতে ভিজে না আবার বাচ্চাটার নিউমোনিয়া হয়ে যায়। অসুখ-বিসুখ কিছু না। জন্মের পর রুটিন করে কিছু টিকা দিতে হয়, সেই টিকা দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া। সাথে আমার যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু উপায় নেই। সাপ্তাহিক পূর্ণিমার নির্বাহী সম্পাদক আতাহার খান টেলিফোন করে দুই ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছেন। এর মধ্যে ঈদের উপন্যাস শেষ করে জমা দিতে না পারলে ছাপা হবে না, টাকাও পাওয়া যাবে না। এই টাকাটা না পেলে ঈদের বাজার করা হবে না।
ও যাওয়ার সময় বারান্দার গ্রিলের দরোজায় তালা দিয়ে যায় নি। আজকাল শংকর এলাকায় ছিচকে চোরের খুব উপদ্রব বেড়েছে। উঠি উঠি করে আমিও উঠতে পারছি না। লেখাটা চরম একটা ক্লাইমেক্সে এসে গেছে। হুড়মুড় করে স্যুট-টাই পরা এক ছয়ফুট লম্বা অচেনা লোক এসে ঘরে ঢুকে পড়ে। ওর সারা গা ভেজা, কালো রঙের স্যুট থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। মাথার চুল ভিজে এমন হয়েছে, ভেজা দাঁড়কাকের মতো লাগছে এখন লোকটিকে। কে আপনি?
স্যার, আমার নাম আবসার উদ্দিন। আমি আপনার একজন ভক্ত। অনেক কষ্ট করে আপনার বাসা খুঁজে বের করেছি। আমি কি স্যার একটু বসতে পারি?
দেখেন ভাই, আমি এখন খুব ব্যস্ত আছি, আপনি দয়া করে আরেক দিন আসেন।
স্যার, আপনার সঙ্গে আমার কথা বলা ভীষণ দরকার। জীবন-মরণ সমস্যা।
কি বলছেন আপনি? আমি কি ডাক্তার না কবিরাজ, যে জীবন-মরণ সমস্যা নিয়ে আমার সাথে কথা বলবেন?
স্যার, আমার কথা আপনাকে শুনতেই হবে। লোকটি তার ভেজা পাছা নিয়ে আমার লেখার টেবিলের ডানদিকে, দেয়ালের সাথে ঠেস দেওয়া বেতের সোফাটায় বসে পড়লো।
কি আশ্চর্য, সোফাটা ভিজিয়ে ফেলছেন তো। আমি যারপরনাই বিরক্ত হই। লোকটি নির্বিকার। যেন অন্যের বাড়িতে এসে তার সোফা ভেজানো, গায়ের পানিতে ঘর ভেজানো কোন বিষয়ই না।
দেখেন ভাই, আমি একজন লেখক মানুষ। দুই ঘণ্টার মধ্যে একটি লেখা শেষ করতে না পারলে বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে। এই লেখাটা জমা দিলে আমি কিছু টাকা পাব। সেই টাকায় ঈদের বাজার করা হবে। আপনি দয়া করে বিকেলের দিকে আসেন। আমাকে মাফ করেন ভাই।
লোকটি আমাকে কিছুতেই মাফ করলো না। সে তেমনি নির্বিকার ভঙ্গিতে তার নিজের এজেন্ডার দিকেই এগুতে থাকে।
স্যার, আমি আপনার মাত্র একটি ঘণ্টা সময় নেব। এই একঘণ্টা সময়ের জন্য আমি আপনাকে উপযুক্ত ফি দেব। টাকাটা আমি নিয়েই এসেছি। বলেই লোকটি একটি নীল রঙের প্যাকেট বের করে আমার হাতে দেয়। প্যাকেটটা ভিজে চুপসে গেছে। আমিও লোভী মানুষের মতো খামটি খুলে ফেলি। অনেকগুলো পাচ’শ টাকার নোট। কুড়ি-পঁচিশ হাজার টাকার কম হবে না। খামটি আমি অতিদ্রুত তার হাতে ফেরত দিয়ে এবার খুব রেগে যাই।
কে আপনি? বের হন আমার বাসা থেকে। বের হন। টাকা দিয়ে একজন লেখককে কিনতে এসেছেন? লোকটি আমার উত্তেজনাকে মোটেও পাত্তা দিলো না। সে তেমনি নির্বিকার বসে আছে।
স্যার, আমি আপনার ভীষণ ভক্ত। আপনাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করি। আমি স্যার আপনাকে আমার জীবনের গল্প বলতে এসেছি। আমি চাই এই গল্পটি আপনি লিখেন।
অনেক সময় অনেক অচেনা ভক্ত হঠাৎ বাসায় এসে হাজির হয়। মেয়ে ভক্ত এলে ওরা যতক্ষণ বাসায় থাকে ততক্ষণ আমার স্ত্রী চোখে চোখে রাখেন, ছেলে হলে তেমন গুরুত্ব দেন না, তিনি তার নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। এই লোককে তেমন সাধারণ ভক্তদের দলে ফেলা যাচ্ছে না। হয় লোকটা পাগল, না হয় বড় ধরনের কোন মতলববাজ। মতলবটা কি ঠিক ধরতে পারছি না। বর্ষাকালে স্যুট পরে ঘুরছে। একমাত্র পাগল আর উকিল ছাড়া এই গরমের মধ্যে কেউ স্যুট পরে থাকে না। একজন মানুষ এতো কষ্ট করে আমার বাসা খুঁজে বের করেছে। নিজের জীবনের গল্প শোনানোর জন্য আমাকে মোটা অঙ্কের পারিশ্রমিক দিতে চাইছে, আবার বলছে এটা তার জীবন-মরণ সমস্যা। বিষয়টার মধ্যে আমি রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি। ভাগ্যিস আমার স্ত্রী বাসায় নেই। থাকলে নির্ঘাৎ এই লোককে চোর-ডাকাত সন্দেহ করতেন এবং সাথে সাথে পুলিশে ফোন করে একটা হুলস্থুল কান্ড বাঁধিয়ে দিতেন।
বৃষ্টির তোড় আরো বেড়ে যায়। একতলা দালানের একটি স্টুডিও ধরনের এপার্টমেন্টে থাকি আমরা। পেছনে রান্নাঘর এবং বাথরুম, সামনে বড়সড় একটি বারান্দা, বারান্দার গ্রিলে বাঁশের চিপস লাগানো, তার সামনে এক চিলতে উঠোন। পুরো উঠোনটাই সিমেন্টে মোড়ানো। উঠোনের ঠিক মাঝখানে একটি কদম গাছ। ঝড়-বৃষ্টির তোড়ে অসংখ্য কদমফুল পরে পুরো উঠোনে বিছিয়ে আছে। বৃষ্টির স্রোতধারায় কদমফুলগুলো ছুটে গিয়ে লোহার গেইটের নিচে, যেখানে পানি বেরুনোর জন্য একটি ফুটো আছে, ওখানে জড়ো হয়েছে। পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। উঠোনে এখন রীতিমতো একটি ছোটখাট পুকুর। পুকুরের জলে ভাসছে বর্ষার কদম ফুল। লোকটি তার জীবনের গল্প বলতে শুরু করে।
ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার নবীনগরে আমার বাড়ি। দড়িকান্দি গ্রাম। খুব ছোট ঘরের ছেলে স্যার। কলেরায় বাবা মারা যায়। কোন জমি-জমা নেই। বিধবা মা একরকম ভিক্ষা করেই অন্ন-বস্ত্রের জোগাড় করেন। আমাদের গ্রামের সবচেয়ে ধনী মানুষ মুসলেহ উদ্দিন সাহেব ঢাকার গ্রীন রোডে থাকতেন। বিরাট শিল্পপতি। তিনি আমার মাকে বলেন, তোর ছেলেরে আমি নিয়া গেলাম, পড়ালেখা শিখামু। গ্রামের লোকেরা বড়লোকদের এইসব প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করে না। পড়ালেখা শেখানোর কথা বলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে ঢাকায় নিয়ে আসে। তারপর বাড়ির ঝি-দারোয়ান বানায়। মুসলেহ উদ্দিন সাহেব আমাকে স্কুলে ভর্তি করে দেন। ছোটলোকের রক্ত, পড়ালেখা মাথায় ঢোকে না।
লোকটিতো দেখা যায় তার হোল লাইফস্টোরি বলতে শুরু করেছে।
ভাই শুনুন, আরেকটু সংক্ষেপে বলুন। যে কোন সময় আমার স্ত্রী এসে যাবে। দেখতেইতো পাচ্ছেন, আমাদের একটি মাত্র ঘর, তখন কিন্তু গল্প শেষ না করেই আপনাকে চলে যেতে হবে।
ঠিক আছে স্যার, সংক্ষেপেই বলছি। দুইবার মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে ফেল করি। এরপর পড়ালেখা ছেড়ে দিই। মুসলেহ উদ্দীন সাহেবের ছোট ছেলে লিটন আমার চেয়ে বছর পাঁচেকের ছোট, সে তখন কলেজে পড়ে। একদিন হঠাৎ একটি মেয়ের সাথে দেখা হয়। গ্রীনরোডেই বাসা, বদরুন্নেসা কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। মেয়েটিকে দেখার সাথে সাথে আমার মাথা ঘুরে যায়। ওই যে স্যার ওয়ার্ডওয়ার্থের দুটি লাইন আছে না, ‘She was a phantom of delight/When first she gleamed upon my sight.’ এক্সাক্টলি এরকম একটা অনুভূতি হয় আমার মধ্যে। এই মেয়েকে না পেলে আমি বাঁচবো না। কিন্তু কিভাবে মেয়েকে প্রস্তাব দিবো আমার মাথায় কিছুই আসছে না। লিটন বুদ্ধি দেয়, আবসার ভাই, আপনে চিঠি দেন। লিটনের হাতের লেখা সুন্দর। ওকে দিয়ে চিঠি লেখাই। লিটন চিঠি লিখে দেয়, আমি নিউমার্কেটের পোস্ট অফিসে গিয়ে ওদের বাসার ঠিকানায় পোস্ট করে দিয়ে আসি। চিঠির নিচে শুধু লিখি, তোমার আমি। কোন নাম নেই। এভাবে তিন মাস যায়। আমার এখন একটাই কাজ। রোজ সকালে ওর পেছন পেছন সাইকেল চালিয়ে বদরুন্নেসা কলেজে যাওয়া, সারাদিন কলেজের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা, আবার কলেজ ছুটি হলে ওর পেছন পেছন ফিরে আসা। কলেজ ছুটির পর গেইটের দিকে তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে থাকি। শত শত মেয়ের ভিড়ে যখনি ওর মুখটা দেখি কি-যে ভালো লাগে, আপনি লেখক মানুষ আপনি বুঝবেন, আমার বুঝিয়ে বলার ভাষা নেই।
মেয়েটির নাম কি?
প্রিয়াংকা। প্রিয়াংকা তরফদার। আমি তখনো জানতাম না, ওরা হিন্দু। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান, জৈন, শিখ যাই হোক, আমার কোন সমস্যা নেই, আমি প্রিয়াংকাকে চাই। ওকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। এরই মধ্যে প্রিয়াংকা বুঝে গেছে যে চিঠিগুলি আমি দিই। মেয়েটি যারপরনাই আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করে। আমি লিটনের ওপর ক্ষেপে যাই, ব্যাটা ভালো ভাষা দিয়া চিঠি লেখ, কবিতা দিয়া লেখ। আমি নিউমার্কেট গিয়ে তিনটা প্রেমপত্র লেখার বই কিনে আনি। সেখান থেকে কবিতার কোটেশন দিয়ে দিয়ে চিঠি লিখতে থাকি। প্রিয়াংকা কলেজে যাওয়ার জন্য গেইট থেকে বের হতেই আমি ওর মুখোমুখি দাঁড়াই। তারপর ওর হাতে একটি জবাফুল গুঁজে দিয়ে দৌড় দেই। প্রিয়া আমাকে পেছন থেকে একটার পর একটা ইংরেজীতে গালি দিতে থাকে। যে গালির অর্থ বুঝি না সেই গালি শুনে আমার মেজাজ খারাপ হয়। পরদিন লিটনকে সাথে নিয়ে যাই। ওকে একটি ঝোপের ভেতরে লুকিয়ে রেখে একই কান্ড আবারো করি। এবার আর দৌড় দিই না। ওর হাতে জবাফুল দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। প্রিয়া সমানে ইংরেজীতে গালি দিতে থাকে। পরে লিটন ডিকশনারী দেখে আমাকে সেইসব গালির অর্থ বলে দেয়। অর্থ তেমন খারাপ কিছু না। বোকা, বুদ্ধু এই জাতীয়। একটা খুব খারাপ গালি দেয়, সেইটা সহ্য করতে পারি নাই। জারজ।
সহ্য করতে না পেরে কি করলেন?
নিজের হাত আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেললাম। আবসার উদ্দিন ওর ডান হাত উল্টো করে তুলে ধরে পোড়া হাতের ক্ষতচিহ্ন দেখালো।
সেই পোড়া হাত নিয়েই ওর পেছন পেছন কলেজে যাই। একহাতে সাইকেল চালাই। ওকে একদিন না দেখলেই আমি অস্থির হয়ে উঠি।
একদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে দেখি লিটন গৃহবন্দী। ওকে ঘরে তালাবন্ধ করে রাখা হয়েছে। ঘটনা কি? প্রিয়াংকার বাবা এসে আমার সব প্রেমপত্র মুসলেহ উদ্দিন সাহেবের হাতে দিয়ে গেছেন। হাতের লেখা দেখে সবাই বুঝে গেছে এগুলো লিটনের লেখা। লিটন চাপে পড়ে বলে দিয়েছে এগুলো আমার কাজ, আমি প্রিয়াংকাকে ভালোবাসি। মুসলেহ উদ্দিন সাহেব সেই রাতেই আমাকে বাসা থেকে বের করে দেন।
ছোটলোকের রক্তে অভিমান বেশি থাকে। আমি রাগে, ক্ষোভে আর সেই বাসায় ফিরে যাইনি। এক বন্ধুর সাহায্যে গ্রীনরোডের একটি মেসে গিয়ে উঠি। পরদিন সেই মেসে পুলিশ এসে হাজির। সুকুমার তরফদার, প্রিয়াংকার বাবা আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। সাতদিন হাজতে থাকি। পুলিশ ভালোবাসার মূল্য বোঝে না স্যার। পুলিশের হৃদয়ে কোন ভালোবাসা নেই। ওরা আমাকে পিটিয়ে সারা গা ফাটিয়ে ফেলে। সাতদিন পর মুসলেহ উদ্দিন সাহেব আমাকে ছাড়িয়ে আনেন।
এই আপনার জীবনের গল্প?
গল্পের একাংশ। এরপর শুরু হয় ঘটনার ইউ টার্ণ। প্রিয়াংকা এখন আমার প্রেমে হাবুডুব খেতে শুরু করে। কলেজ ফাঁকি দিয়ে আমরা চলে যাই নানান জায়গায়, বোটানিক্যাল গার্ডেন, স্মৃতিসৌধ, আরো কোথায় কোথায়। স্যার, আমি যখন প্রিয়ার হাতটা ছুঁয়ে থাকি, মনে হয় এই পৃথিবীতে আমার চেয়ে ধনী আর কেউ নেই। যখনি ওর বাড়ি ফেরার সময় হয় আমি তখন হয়ে যাই এক অন্ধ ভিখিরি। অর্থ-বৃত্তহীন, দিক-দিশাহীন এক মূল্যহীন প্রাণী। রবার্ট ফ্রস্টের ভাষায়, ‘And when I come to the garden ground/The whir of sober birds/Up from the tangle of withered weeds/Is sadder than any words.’
এরপর প্রিয়া হারিয়ে যায় আমার জীবন থেকে।
মানে কি? ওর বিয়ে হয়ে যায়?
আমার হাত থেকে বাঁচবার জন্য ওর বাবা এক রাতের আঁধারে সপরিবারে এই এলাকা ছেড়ে চলে যায়।
এরপর একটু থামে আবসার উদ্দিন। কিছুটা আনমনা হয়ে যায়। মাথা নিচু করে তাকায় ফ্লোরের দিকে। ওর প্যান্টের ঝুল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ে মোজাইকের ফ্লোরে একটা স্রোতধারা তৈরী হয়। আবসার উদ্দিন সেই মন্থর গতির শীর্ণ স্রোতধারার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমার খুব বেশিদিন লাগেনি ওদের খুঁজে বের করতে। ওরা গেন্ডারিয়ায় গিয়ে বাসা ভাড়া নেয়। কিন্তু যখন আমি ওদের বাসা খুঁজে বের করি তখন সব শেষ।
প্রিয়াংকা…
হ্যাঁ, স্যার। প্রিয়াংকা আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
কিছু মনে করবেন না আবসার উদ্দিন সাহেব। আমি খুবই দুঃখিত যে আপনার জীবনে এমন একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু গল্প লিখবার জন্য এই প্লটটি তেমন আকর্ষণীয় নয়। এমন গল্প হাজার হাজার লেখা হয়েছে বাংলা সাহিত্যে।
স্যার, গল্প এখানেই শেষ নয়। এর পরের অংশটাই আসল গল্প। আর সেটাই আমার জীবন-মরণ সমস্যা।
আচ্ছা, একটা কথা বলুনতো। আপনি বলেছেন, আপনি দুইবার এসএসসি দিয়ে ফেল করেছেন, প্রেমপত্র লেখাতেন অন্যকে দিয়ে। কিন্তু ওয়ার্ডসওয়ার্থ, রবার্ট ফ্রস্টের উদ্ধৃতি, তাছাড়া আপনার ইংরেজী উচ্চারণ শুনে তো মনে হয় না, আপনি লেখা-পড়া না জানা একজন মানুষ।
স্যার, প্রিয়া চলে যাবার পর আমি সম্পূর্ণ বদলে যাই। প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে এসএসসি, এইচএসসি পাশ করি। এরপর জগন্নাথ কলেজ থেকে ইংরেজী সাহিত্যে অনার্সসহ মাস্টার্স করি। ততোদিনে আমার সরকারী চাকরীবাকরীর বয়স পার হয়ে গেছে। তাই চাকরী না খুঁজে ব্যবসা শুরু করি। প্রথমে বায়িং হাউস, পরে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী। এখন আমার ছয়টা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী। মতিঝিলের এলাহি চেম্বারে কর্পোরেট অফিস।
এবার আসল ঘটনায় আসি। বছর দুই আগের কথা। আমি অফিসে বসে কাজ করছি। পিয়ন এসে খবর দেয়, স্যার বোরকা পরা এক ভদ্রমহিলা আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে। আমি বলি, পাঠিয়ে দাও।
ভদ্রমহিলা আমার মুখোমুখি একটি চেয়ারে বসে। এরপর মুখের ওপর থেকে নেকাব সরিয়ে খিলখিল করে হেসে ওঠে। আমি চমকে উঠি, এ কি করে সম্ভব? প্রিয়াংকা তুমি। তাহলে যে…
ওরা তোমাকে বোকা বানিয়েছে। বাবা আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয় এক বুড়ো ব্যবসায়ীর সাথে। বুড়োটা পরশুদিন মারা গেছে। ওইতো ছবি।
আমি সাথে সাথে খবরের কাগজটি টেবিল থেকে তুলে নিই। পেছনের পাতায় শোক সংবাদ। শিল্পপতি সুনীল কুমার স্বর্গবাসী হয়েছেন।
ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট সুনীল কুমারের স্ত্রী তুমি?
ছিলাম। এখন তার বিধবা। এবার বল তুমি কেমন আছো? জানি তুমি এখনো বিয়ে করনি।
কিভাবে জানো?
ওমা, ভেবেছো আমি তোমার কোন খোঁজ রাখিনি?
তাহলে যোগাযোগ করনি কেন?
কিভাবে করি, ওই বুড়োটা অক্টোপাসের মতো আঁকড়ে রাখতো না?
কোথাও বেরুতে পারতে না তাই বলে?
তা পারতাম।
তুমি নিশ্চয়ই আমার ফোন নাম্বারও জানতে? ফোন কর নি কেন?
বড়লোকের বউদের অনেক রেস্ট্রিকশন থাকে। বুড়োটা আমার পেছনে সারাক্ষণ টিকটিকি লাগিয়ে রাখতো। বাদ দাওতো এসব। এতোবছর পর দেখা। ঝগড়া করবে?
না ঝগড়া করবো না। আমার প্রিয়া বেঁচে আছে, এর চেয়ে আনন্দের খবর আর কি আছে। আমি আজ এতো খুশি যে আজ যে যা চাইবে আমি তাকে তাই দিয়ে দেব।
আমাকেও দেবে?
অবশ্যই।
তাহলে চলো।
কোথায়?
কাজী অফিসে। আজই আমরা বিয়ে করবো। আমি পুরোপুরি তৈরী হয়েই এসেছি। তোমাদের ধর্মমতেই করবো। মুসলমান হয়ে।
এরপর আমরা কমলাপুর কাজী অফিসে যাই। বিয়ে করি। আনন্দের আতিশয্যে বাসায় ফেরার পথে গাড়িতেই আমি ওকে জড়িয়ে ধরতে গেলে প্রিয়াংকা বাধা দিয়ে বলে, এখন নয়, আগে বাসায় চলোতো। তারপর ওসব হবে।
আমরা বাসায় ফিরি। উত্তরায় আমার বিশাল বাড়ি। কিছু কাজের লোক, দারোয়ান, ড্রাইভার ছাড়া আর কেউ নেই। ওরাই ফুল-টুল এনে বাসর সাজায়। আমি কিছু বন্ধুকে আমন্ত্রণ জানাতে চাইলে প্রিয়া বাধা দেয়।
আমাকে বাসরঘরে বিছানায় বসিয়ে প্রিয়া বলে, তুমি একটু অপেক্ষা কর আমি আসছি।
আমি অপেক্ষা করছি। প্রিয়া আর আসে না। আমি উঠে ওকে খুঁজতে যাই। বাথরুমে নেই। অন্য কোন রুমে নেই। দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করি, ও বলে, না স্যার ম্যাডামতো বাইর হন নাই। তাহলে গেল কোথায়? আমি ছাদে উঠি, রেলিঙের ওপর দিয়ে চারপাশে তাকিয়ে নিচে উঁকি দিয়ে দেখি, লাফিয়ে পড়লো নাতো? না, কোথাও নেই। নিশ্চয়ই প্রিয়াংকার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে। হয়ত সে পালিয়ে গেছে। নিচে নেমে আমি দারোয়ানকে কষে চড় লাগাই। ব্যাটা ফাঁকিবাজ, কোথায় ছিলি, একজন মানুষ বেরিয়ে গেল আর তুই দেখলি না?
এরপর আমি সুনীল বাবুর আত্মীয়-স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করি। তার বিধবা স্ত্রীর নাম সুরবালা। প্রিয়াংকা নামে তার কোন স্ত্রী ছিল না। আমি গেন্ডারিয়ায় যাই। তরফদারবাবুরা ওখানে আর থাকে না। তবে প্রতিবেশীদের কেউ কেউ মনে করতে পারেন, প্রিয়াংকা নামের একটি হিন্দু মেয়ে অনেক বছর আগে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল।
আবসার উদ্দিন সাহেব। গল্পের এই অংশটা ইন্টারেস্টিং। তবে এরকম গল্পও বাংলা সাহিত্যে লেখা হয়েছে।
স্যার, আমি কোন গল্প বলছি না। আমি আমার জীবনের ঘটনা বলছি। যে প্রিয়াংকাকে আমি পাগলের মতো ভালবাসতাম, সেই প্রিয়াংকা এখন আমার আতঙ্ক। আমি ঘুমাতে পারি না। কাজ করতে পারি না। দশ মিনিটের জন্য একা থাকতে পারি না। সারাক্ষণ সে আমাকে ফলো করে। মাঝরাতে আমার পাশে এসে শুয়ে পড়ে। খুনসুটি করে। অফিস থেকে বাসায় ফিরেছি, হঠাৎ দেখি সে আমার জন্য ট্রেতে করে চা নিয়ে আসছে। সকালে অফিসে যাচ্ছি, দেখি সে আমার পাশের সীটে, গাড়িতে বসে আছে।
আপনি একজন সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে দেখা করেন।
করিনি ভেবেছেন? কোন লাভ হচ্ছে না। তাইতো আপনার কাছে এসেছি।
আমি একজন লেখক মানুষ। আমি কি করতে পারি?
আপনিই পারেন আমাকে বাঁচাতে। আপনি স্যার, এই গল্পটি লিখবেন। আমি দরকার হলে বিজ্ঞাপন হিসেবে বাংলাদেশের সব কাগজে ছেপে দেব। বই বের করবো। সবাইকে বিনা মূল্যে বিতরণ করবো। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তাহলে ও আর আসবে না আমার কাছে। ও প্রায়ই আমাকে বলে, খবরদার আমার কথা কাউকে বলবে না। ঘটনাটি সারাদেশে জানাজানি হয়ে গেলে ও পালিয়ে যাবে। আমাকে বাঁচান স্যার।
আবসার উদ্দিন সাহেব, আমি একজন লেখক। কোনো সাইকিয়াট্রিস্ট নই। তবুও আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যা মনে হয়, আপনি প্রিয়াংকাকে এতো বেশী ভালোবাসতেন যে আপনার অবচেতন যে কোন সুন্দরী নারীর ওপর প্রিয়াংকার মুখটাই বসিয়ে দেয়। সেই দিন আপনার অফিসে, আমার ধারণা অন্য একজন মহিলা এসেছিলেন, এবং আপনার অবচেতন সেই মহিলাকে প্রিয়াংকা বানিয়ে ফেলেছে।
স্যার, আমার মাথায় কোন সমস্যা নেই। আমি একজন সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ। বিষয়টি নিয়ে আমি ঠান্ডা মাথায় অনেক ভেবেছি। স্বপ্ন, ভ্রম, অবচেতন মনের কারসাজি এসব নিয়ে অনেক ভেবেছি, অনেক স্টাডিও করেছি। অফিস থেকে ফেরার পর প্রিয়াংকা আমার জন্য ট্রেতে করে চা নিয়ে এসেছে। ধূমায়িত গরম চা। সেই চা আমি খেয়েছি। বলুন, এই চা-টা কি মিথ্যা?
না, চা-টা মিথ্যা না। চা প্রিয়াংকা নিয়ে আসে নি। আমার ধারণা আপনার বাড়িতে একজন যুবতী কাজের মেয়ে আছে। মেয়েটি যুবতী এবং সুন্দরী। কি ঠিক বলেছি?
হ্যাঁ, ওর নাম নাসিমা।
আপনার জন্য নাসিমা চা নিয়ে এসেছে। প্রিয়াংকা নয়। দেখুন আবসার উদ্দিন সাহেব, এসব বিষয়ে আমি বিশেষজ্ঞ নই। লেখালেখি করি বলে নানান বিষয়ে কিছু স্টাডি করতে হয়। সেই সামান্য জ্ঞান থেকে যুক্তি দিয়ে বিষয়টা আমি নিজের জন্যই বোঝার চেষ্টা করছি। আমার এক বন্ধু আছে, খুব বড় সাইকিয়াট্রিস্ট, ডঃ সবুর খান। আমি নোট লিখে দিচ্ছি, আপনি ডঃ সবুরের সাথে দেখা করেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সে আপনাকে হেল্প করতে পারবে।
কোন লাভ হবে না স্যার। আপনি শুধু কথা দেন গল্পটি আপনি লিখবেন। চরিত্রগুলোর সত্যনাম ব্যবহার করে লিখবেন। কোন কাল্পনিক নাম ব্যবহার করবেন না।
ঠিক আছে, কথা দিলাম।
তখনি আবসার উদ্দিন হঠাৎ উৎকর্ণ হয়।
ওই যে স্যার, এসে গেছে। আপনার বারান্দায় বসে আছে। আমি ওর বসার শব্দ পেলাম।
আমি আবসার উদ্দিনের দিকে তাকিয়ে একটি অর্থহীন হাসি দিই। বৃষ্টি থেমে গেছে অনেকক্ষণ আগে। উঠানে কারো পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ভেজা উঠানে সেন্ডেলের শপ শপ শব্দ। আমি নিশ্চিত আমার স্ত্রী ক্লিনিক থেকে ফিরে এসেছে। ওকে রিসিভ করার জন্য আমি উঠে বারান্দায় যাই। গ্রীলের ওপর বাঁশের চিপস লাগানো দরোজাটা ভেজানো। আমি দরোজা খুলি। দরোজা খোলার শব্দ পেয়ে কেউ একজন অতি দ্রুত শপ শপ শপ শপ শব্দ করে ভেজা উঠোন মাড়িয়ে বাড়ির মূল লোহার গেইট খুলে রাস্তায় বেরিয়ে গেল। যাবার সময় আমি এক ঝলকের জন্য ওর পেছন দিকটা দেখতে পাই। কমলা রঙের শাড়ী পরা একজন ত্রিশোত্তীর্ণ নারী।
আমার পিঠের ওপর নিঃশ্বাস ফেলে আবসার উদ্দিন বলেন, প্রিয়াংকা। আপনাকে দেখে পালিয়ে গেল।
আমি বারান্দা কাঁপিয়ে হো হো হো হো করে হেসে উঠি। ঝড়-বৃষ্টির সময় কয়েকটি চড়ুই ভেন্টিলেটরের ফাঁকে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। আমার বিকট হাসির শব্দে ওরা উড়ে পালালো।
আরে ধুর বোকা। ও-তো ওপরতলার ভাড়াটিয়া, আমাদের টিয়া ভাবী।
আবসার উদ্দিন বেরিয়ে যায়। আমি অস্থিরভাবে ঘরের মধ্যে পায়চারী করতে থাকি।
ক্র্যাডল থেকে রিসিভার তুলে ডঃ সবুরকে ফোন করি।
বন্ধু শোন। জরুরী একটা বিষয় আছে, আমি রাতে তোমার বাসায় আসছি।
বছর পাঁচেক হয়ে গেছে। আমি এখন নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে থাকি। ফোর্টি থার্ড স্ট্রীটে, একটি দুই কামরার এপার্টমেন্টে আমার বাসা। আজও আমার স্ত্রী বাসায় নেই। বাচ্চাদের নিয়ে গ্রীষ্মের ছুটিতে বাংলাদেশে বেড়াতে গেছে। ডোর বেল বাজছে। রোববার সকাল। বালিশের নিচ থেকে হাতঘড়িটা বের করে সময় দেখি। সকাল আটটা। বিছানা ছাড়ার জন্য আটটা যথেষ্ট সকাল হলেও ছুটির দিনগুলোতে আমি বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠি। বিরক্তি নিয়ে দরোজা খুলি।
সস্ত্রীক আবসার উদ্দিন।
চিনতে পেরেছেন, স্যার? আমি আবসার উদ্দিন। ভেতরে আসবো?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই। আসুন আসুন।
আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। শর্টস পরে ঘুমিয়েছিলাম। হোক না আমেরিকা, এই পোশাকে একজন বাঙালী রমণীর সামনে বসে থাকা যায় না। অতিদ্রুত বাথরুমে ঢুকে একটা পাজামা পরে আসি। এলোমেলো ঘরটাকে গোছানোর একটা ব্যর্থ চেষ্টা করি। সোফার পিলোগুলো মাটিতে পড়ে আছে, ওগুলো সোফার ওপর তুলে দিয়ে কফি টেবিলটা সোজা করি।
স্যার, আপনাকে ধন্যবাদ দিতে এলাম।
আমি কফি টেবিলের নিচের শেলফে রাখা অগোছালো বইগুলো সোজা করতে করতে বলি, জানলেন কি করে আমি এখানে আছি? আর আপনিই বা নিউ ইয়র্কে কি করছেন?
আপনার গল্পটা ছাপা হওয়ার পর প্রিয়াংকা আর আসেনি। ডঃ সবুরের পরামর্শে আমি বিয়ে করি। এরপর ব্যবসা-বাণিজ্য সব বেচে দিয়ে আমেরিকায় চলে আসি। আমরা থাকি নিউ জার্সিতে। ক’দিন আগে জানতে পারলাম আপনিও আমেরিকাতেই আছেন। খুঁজে বের করতে তেমন অসুবিধা হয় নি। এখানকার খবরের কাগজগুলো সাহায্য করেছে।
এই তাহলে আপনার নতুন প্রিয়াংকা।
আপনি ঠিকই বলেছেন। বিষয়টা খুব কাকতালীয় হলেও, ওর নামও প্রিয়াংকা।
প্রিয়াংকা তখন আমার দিকে তাকিয়ে খুব মিষ্টি করে হাসে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে সেদিন বৃষ্টি ধোয়া সকালে যে মেয়েটিকে জলের ওপর দিয়ে শপশপ করে হেঁটে চলে যেতে দেখেছি, এ সেই মেয়ে।
টান টান উত্তেজনা কাজী জহিরুল ইসলামের “প্রিয়াংকা” গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। ভীষণ ভালো লেগেছে। অভিনন্দন গল্পকারকে।
অনেক ধন্যবাদ প্রিয় মাহিন আলম।