spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদকবিতাফেরদৌস নাহার এর কবিতা

ফেরদৌস নাহার এর কবিতা

১.
প্রতিবিম্বের অনুবাদ

সেই রেললাইন
বারবার সেই জলের কাছে, আমার সব মনে আছে
বিকেলের শান্তনীল চোখ জলে ফেলে বসে আছে আকাশ
কেউ একজন হেঁটে আসবে বলে তুমি দৌড়ে গিয়েছিলে
রেললাইন ধরে। আকুল ওলটপালট হয়তো একেই বলে
সে বসন্তে লালজামা গায়ে সবুজ গাছেদের দিকে তাকিয়ে
আন্দামানে উড়ে যাওয়া নির্বাসিত পাখিগুলো বলেছিল–
সব ফাঁকি! জলের ছায়া হাসে, হাসতে হাসতে মায়া বাড়ে
মায়া থেকে উঠে দাঁড়ায় অজানা নৈঃশব্দ্য, ভেসে আসে হুইসিল প্রতিবিম্বের অনুবাদ বারবার বলে, দেখে নাও আরো একবার
নির্জন ওয়েটিং রুমে কিছু ফেলে গেলে কিনা

২.
সানগ্লাস খুলে বলো

বারবার যেতে চাই পুরোপুরি তোমার কাছে
কোনো অর্ধেক নয়, কোনো অংশত নয়, সম্পর্ণ তোমার কাছে
এই তুমিটা কে? বাজারি সানগ্লাস পরা একজন অজানা আগন্তুক
যাকে মনে করছি খুব চিনি, আসলে ষোল আনাই কি ফাঁকি
ফাঁকি দেয়া এক একটি মানচিত্রে যে যে প্রণয় ছবি আঁকা শুন-শান ঝিম-ঝিম সেইসব সম্পর্ক কিছু তার মানে রাখে না
বারবার বারান্দায় এসে বলছে- দরজাটা খোলা রেখে গিয়েছ বলে
কালরাতে সম্পূর্ণ চুরি গেছে আপন সঞ্চয়ের সরল মাপকাঠি, শুধু
নেয়া হয়নি সেই অগ্নিপাত, যে তোমার বুকের ভেতরে করে বসবাস আহা কী দুঃসাহস!
সানগ্লাস খুলে তুমি এই কথাটাই আরেকবার বল তো দেখি

৩.
কুয়াশা

এখানে এখন ভয়াবহ অরণ্য
ঘন ছায়া বুকে নিয়ে গান গায় সে
কেউ শুনুক আর নাই শুনুক
বারবার উচ্চারণে বেকায়দা হলেও গান গাবে সে
এই শরতে নতুন করে প্রেম নিবেদন করেছে কেউ
নেয়া হল না বলে চারদিক নিশ্চুপ
নিবেদনেও যে বেদনা থাকে এ-কথা আবারো জানলাম
সীমাহীন রোদে আর পোড়াব না তামাটে জীবন
অনেক খরার পর যেটুকু বৃষ্টিপাত বাকি, তাতে
শরতের বাঁধভাঙা আঘাতে ক্ষত আঁকব না বলে
চলে যেতে যেতে পিছনের ফেলে আসি ছায়া
ভয়াবহ অরণ্য ডাকছে বারবার
তবু স্পষ্ট করে বলছি না– বিদায়

৪.
ক্রসফায়ার

অপূর্ব এই ঝরে যাওয়া
বাতাসের সাথে সাথে তাল রেখে চল, নয় ঝরে যাও
যারা চোখ ও মনের শ্রুশ্রূষা জানে বলে মনে হয়েছিল
তাদের বুকে মরুভূমি খরাচর ঘন অন্ধকার
এসব জানতে গিয়ে নিজের গায়েও লেগেছে ধুলো
বিষপিঁপড়ের কামড়ে চুলকাতে চুলকাতে রক্তাক্ত
তবুতো জানা হল
ঈর্ষা ও করুণাই আজ ভালোবাসা। এইসব অভিনয়
ঝুঁকে ঝুঁকে কুয়ো জলে দেখে নেয় লুকানো স্বরূপ
জলাতঙ্ক রোগে ভুগেও সারাবেলা তৃষ্ণার চাপকল চাপা

৫.
ব্রিজের দমকা হাওয়ায়

সময় হল না কিছুতেই
পাগলামি যেটুকু করেছি কেউ তা পাগলামি ভাবেনি
ব্রিজের দমকা হাওয়ায় বারবার মনে হয়
বিশ্বের বাড়ি ছিল বিশ্ব থেকে দূরে
পৃথিবীর হাজার মাইল ওপারে হাঁপাতে হাঁপাতে
কেউ ভুল করলে এখনও সে রাগ করে থাকে
প্রচারের সব আয়োজন প্রচার থেকে পরিচিত
দগ্ধ ক্ষতের গায়ে এজন্মের পাপ লিখে রাখে
সকালের আগেভাগে বিকেলের যাত্রা জানিয়ে গেল
কাল আমার কাটেনি ভালো
বুনো বৃষ্টি বুনেছে তাকে
সে কি তবে বাসেনি ভালো

৬.
তথাগত যখন হাসপাতালে

বৃষ্টির মাঝে একা গৌতমকে দাঁড় করিয়ে এলে!
সারাদিন আলোর ইশারা নিয়ে কাটাকুটি খেলা করে
তার চোখে অনেক উজান নদী ভাটির গান গাইতে গাইতে
সেই যে গেল, এলো না ফিরে। তুমিও কি খুঁজেছ তাকে
বৃষ্টিতে রাত্রি কাবার অসমান জলঝড়
অন্ধ পথিকের পথচলা শ্রবণ নির্ভর
সব জেনেও কেন তারে রেখে এলে
এই শরতে অসুখে পড়েছিল। তাই দেখে ফেলেছ নগ্ন অবয়ব
জানি কী করে কখন হাসপাতাল থেকে ফিরে বারবার মনে পড়ল–
মাঝখানে অনেকটা পথ মুছে গেছে, মধ্যরাতের আরাধ্য বছরের
এক একটি ঘোরতর জলসাঁতার। কিছু গান কণ্ঠে ছিল, তাও গেছে
সারাদিন ইশারায় কাটাকুটি খেলে যায় তথাগত হাসপাতালে এখন

৭.
অগোছালো দেহ

ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন
এখানে আবারও ঠাণ্ডা পড়ছে বৃষ্টি হচ্ছে খুব
দানাদার মৌসু্মি হাওয়া স্নেহবশত ঠোঁটে রাখছে ঠোঁট
বরিশালে কেমন বৃষ্টি, কেমন রোদ
জীবনানন্দ কি ভিজে পুড়ে ঘরে ফিরছেন রোজ
এইসব গল্পের ঝাঁঝা রোদ্দুর দুপুরকে ফেলে রেখে
বিকেলকে জড়িয়ে ধরে
বৃষ্টির অগোছালো দেহ শরীরে আছড়ে পড়ে
পড়ে নাকি
প্রতীক্ষায় বছর যায়, দিনরাত্রির ত্রিভুবন যায়
ডাকে, আয় বৃষ্টি আয়

৮.
মেসিপোটেমিয়ান জেলখানা

পতনের শব্দে কাঁপে বেনামা পাহাড়
এইমাত্র নেমে আসা একঝাঁক নতুন সারস
টাইগ্রিস ইউফ্রেতিসের পাড়ে এসে ভিড় জমাল
সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম গভীর কাজল চোখে
সেই হল কাল, সাথে সাথে বন্দি হলাম
মেসিপোটেমিয়ার জেলখানায় আটকে ছিলাম
আমাকে ওরা দেশান্তরী অবৈধ করেছিল
হয়তো হাজার বছর কেউই পায়নি খোঁজ
একদিন কী যেন কী ভেবে, কোনো এক ভোরে
ওরা আমাকে ছেড়েও দিল, ইস্তাম্বুলের পথে বলল, দৌড় লাগাও! দূর হও এখান থেকে!
আমি জানি না কী ছিল অপরাধ
ততদিনে জেনে গেছি সম্পূর্ণ পৃথিবী আমার নয়
দৌড়াতে পারি না, বারবার হোঁচোট খাই
মা বলে কেঁদে উঠি আতাতুর্কের মূর্তির নিচে
হাঁপাতে হাঁপাতে আবারো ঊর্ধ্বশ্বাস। যা ভাগ!
এভাবেই কতকাল দৌড়েই চলছি জানি না
সব শেষে থেমে যাব রুশদেশে গিয়ে। যেখানে
ফিওদর দস্তয়েভস্কি জেলখানার সাত নম্বর কয়েদি

৯.
ঈশ্বরের বাড়ি

জানো তো আমার মাঝে যে ঈশ্ব্রর বসবাস করে তার অনেক মৃত্যু
পথে পথে ঘোলা জলের কারসাজি তবু তার কথা মনে আসে
কত ক্ষীণ শ্বাসের পাশে পড়ে আছে চেনাজানা কিছু সংলাপ
কিছু সংগোপন যাবার বেলা নীরব কথোপকথন বারবার বলছে
সব গান মুছে যাবে কিছুই থাকে না গোপন
তার কথাই ঠিক। শাটেল ধরে তার বাড়ি গিয়েছিলাম
সে এক আদিম দিনের ঝরাপাতা পথ। কেউ মনে রাখল না
স্মৃতিগত সব পথ একদিন পথিকও ভুলে যায়
হোক না বাদামি রং পুড়ে পুড়ে আরো গাঢ়
পানিভাঙা জীবন এবারে নেবার হলে নিয়ে নেবে তার ঠিকানা
যেখানে পড়শি বেসে হেসে হেসে খেলা করে তাহাদের ঈশ্বর

১০.
উড়ে যায় কবিদের পাখি

স্বপ্নের পাশে বসে অপেক্ষা করছি
ঘুম ভেঙে গেলে বলো জল খাবে কিনা
চুপচাপ চলে যাওয়া যায়
যাবার আগে অনেকগুলো গল্প একসাথে বেঁধে
আকাশে উড়িয়ে দেয়া হবে
সেজন্যে কিছুটা বিশ্রাম নিচ্ছ
আমাদের বেলা বেড়ে যায়
কপালের মাঝখানে না-দেখা জানালা খুলে
উড়ে যায় কবিদের পাখি
গায়ে কালশিটে
তবু বসে থাকে স্বপ্নখোর তামুক সাজিয়ে
বসে থাকি বেশ
আমাকে বলো জল খাবে কিনা
পাগলামি ছাড়া পাগলের কিছুই থাকল না
জলের অতল ডাকে, আয়
আসব কী, এখন যাবার বেলা– যাই!

……..

কবিতা ভাবনা

ভাবনা আমার কোথা থেকে যে আসে! আর কবিতা নিয়ে কী আর বলব, সব সময় কষ্ট দিয়েছে, দিচ্ছে, দেবে কষ্ট–প্রণয়ে জেগে থাকতেই ভাল লাগছে। মহৎ কিছু করে ফেলার জন্যে তো কবিতা লিখি না, লিখি নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে। কত শত কথা, কত যে নগ্নতা, কত দংশন, কত না চিৎকার সব গছিয়ে দিচ্ছি ওর বুকে। তো, সে আমাকে খুঁড়ে খাবে না তো কে খাবে? আমি রাক্ষসের বত্রিশ পাটি দাঁত রথের মেলায় বেঁচতে এসে কবিতাকে মূদ্রা করি, মনে মনে বলে উঠি, বেশ করেছি! পোড়া মাটির তত্ত্ব-তালাশে কবিতার দেহ ভরে শতাব্দীর সমান যজ্ঞানল, দাউ দাউ পুড়ছে সে, সেই সাথে পুনঃপুন পুড়ছি পোড়া মাটির আমি। আমার মাঝে আমার আত্মহত্যা কিংবা বেঁচে থাকা যুগপৎ কবিতার প্যারাস্যুট নিয়ে দিব্যি নেমে পড়ছে ভবলীলার মাঠে। আর নেমেই দাঁত বের করে হাসছে, বলছে, দেখ, ভাবনার অনিবার্য উন্মাদ আমি, প্রত্ন-প্রণয়ের রক্তাক্ত রণাঙ্গন, হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়া কিংবা যা কিছু ভাবনা সব আমি, অধিশ্বর, ক্ষুদ্র, বৃহৎ সব সব সব, আমিই চরম!
পরিচিতি : ফেরদৌস নাহারের জন্ম, বেড়ে ওঠা সবই বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে। তবু নির্দিষ্ট কোনো জেলা নয় পুরো দেশটাকেই বাড়ি মনে করেন। পথের নেশা তাকে করেছে ঘরছাড়া। ঘুরতে ঘুরতে এখন আটলান্টিক মহাসাগরের পাড়ে, কানাডায়। সেখানে জীবন যাপনের পাশাপাশি জীবন উৎযাপন করেন কবিতা এবং লেখালিখির খরস্রোতা নদীতে বৈঠা বেয়ে। কবিতার পাশাপাশি লিখছেন নানারকমের গদ্য, অনুবাদ ও আঁকছেন ছবি। বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্যান্ডদল ‘মাইলস’-এর সংগীত রচয়িতাও। প্রিয় বিষয় মানুষ এবং প্রকৃতি। প্রকৃতির মাঝে সবচেয়ে প্রিয় সমুদ্র। এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে ১৩টি কবিতা ও ৩টি প্রবন্ধের বই।

কবিতা : ছিঁড়ে যাই বিংশতি বন্ধন(চর্যাপদ ১৯৮৬), সময় ভেঙ্গেছে সংশয় (নিখিল ১৯৮৭), উলঙ্গ সেনাপতি অক্টোপাস প্রেম (নসাস ১৯৮৮), দেহঘর রক্তপাখি (চর্যাপদ ১৯৯৩), সমুদ্রে যাবো অবিচল এলোমেলো (বিশাকা ১৯৯৬), বর্ষার দুয়েন্দে (শ্রাবণ ২০০১), উদ্ধত আয়ু (অন্যপ্রকাশ ২০০৯), বৃষ্টির কোনো বিদেশ নেই (ভাষাচিত্র ২০০৯), পান করি জগৎ তরল (অ্যাডর্ন ২০১০), চারুঘাটের নৌকোগুলো (আড়িয়াল ২০১৩), নেশার ঘোরে কবিতা ওড়ে (আড়িয়াল ২০১৩), পাখিদের ধর্মগ্রন্থ (কৌরব ২০১৫), নাভি ও নন্দন (চৈতন্য ২০১৫)।

প্রবন্ধ: কবিতার নিজস্ব প্রহর (প্রত্ন ২০০২), পশ্চিমে হেলান দেয়া গদ্য (আড়িয়াল ২০১২), কফি শপ (বাহান্ন প্রকাশ ২০১৫)।

এছাড়া বাংলাদেশ ও ভারত থেকে বারোটি যৌথ কবিতা সংকলন।

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ