কামরুজ্জামান
হাজার বছরের বাংলা কবিতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি আল মাহমুদ লোকান্তরিত হলেন পনেরো ফেব্রুয়ারি দুই হাজার উনিশ সালে। এই লোকান্তরিত হওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি তার তিরাশি বছরের এক বর্ণাঢ্য সৃষ্টিশীল জাগতিক অভিযাত্রার সমাপ্তি টানলেন। তিনি আর কোনো দিন তার সৃজনমহিমা নিয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াবেন না। যে অসামান্য উচ্চারণে দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে নিজের কবিতা আবৃত্তি করতেন, সে দৃশ্যের মুখোমুখি আমরা আর কোনো দিন হবো না। সত্য প্রকাশে কিরিচের ধারের মতো তার যে বাগ্মীতা আর কোনো দিন তার মুখোমুখি হতে পারব না আমরা। কিন্তু তার বিপুল বিশাল রত্নভাণ্ডার আমাদের শুধু প্রতিদিন দান করেই যাবে; যার কোনো কমতি হবে না কোনো দিন। এ কথা অত্যুক্তি হবে না যে, যত দিন বাংলাভাষা তত দিন আল মাহমুদ। তিনি তার কর্মে সৃষ্টির সোনালি সৌকর্যে হয়ে উঠেছেন অনিবার্য এক সাহিত্য প্রতিভা; এক স্বতন্ত্র অধিষ্ঠান।
তার এই তিরোভাবের সাথে সাথে পক্ষে বিপক্ষে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে তার জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকী, লিটিলম্যাগ, পুস্তক পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছে। কলকাতা থেকে এসেছে নতুন আঙ্গিকে প্রকাশিত মাসিক ‘কৃত্তিবাস’ মেগা কবি আল মাহমুদ বিশেষ সংখ্যা। দু’তিনটি পুরনো লেখা, দুটি সাক্ষাৎকারসহ ঊনত্রিশটি লেখায় সাজানো হয়েছে এই বিশেষ আয়োজন। সাথে আল মাহমুদের সোনালী কাবিনের চৌদ্দটি সনেটও মুদ্রিত হয়েছে। কবি আল মাহমুদ সম্পর্কে এই আয়োজনেও আশ্চর্যজনকভাবে ভিত্তিহীন অভিযোগ, কদর্যতা কম নেই। জ্যোতির্ময় দত্তের ‘ইন্দ্রিয়ময় আল মাহমুদ’ লেখাটি নানা আপত্তিকর তথ্য-উপাত্তে ভরপুর। তিনি বলেছেন : ‘আল মাহমুদের মৃত্যু প্রায় কোনো রেখাপাত তো এ দেশে করেইনি, বাংলাদেশের জনহৃদয়েও তো বোধহয় তোলেনি এমন কোনো ঢেউ।’ তিনি বাংলাদেশে এসে কয়েকবার জাতীয় কবিতা পরিষদের উৎসবে যোগ দিয়ে বুঝতে পেরেছেন যে ইসলামিকত্বে ভাটা ও বাঙালিত্বে জোয়ার। আরেক জায়গায় বলছেন, আল মাহমুদ মারা গেলেন ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, কবি আল মাহমুদ মারা গিয়েছিলেন তার চল্লিশ বছর আগে। এই হলো কৃত্তিবাসের আল মাহমুদকে নিয়ে বিশাল আয়োজনের সর্বপ্রথম পরিবেশনা। জ্যোতির্ময় দত্ত কোন্ দৃষ্টিকোণ থেকে আল মাহমুদকে মূল্যায়ন করতে বসেছেন তা পরিষ্কার। তবে এতে আল মাহমুদের কিছু এসে যায় না। কিন্তু তিনি কলকাতায় বসে কি করে বুঝলেন আল মাহমুদের মৃত্যু বাংলাদেশে কোনো প্রভাব ফেলেনি! বাংলাদেশের প্রতিটি জাতীয় দৈনিকে তার মৃত্যু সংবাদ বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। প্রতিটি জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকী পাতা বিশেষ আয়োজন করেছে। সৎকবিতাপ্রেমী প্রতি হৃদয় আল মাহমুদের মৃত্যুতে ব্যথিত শোকাকুল। আর যে কথা তিনি বলেছেন নির্বোধের মতো বাঙালিত্বে আর ইসলামিকত্বে জোয়ার ভাটার কথা। আমি বলি জোয়ার-ভাটার কিছু নেই। দুই জায়গাতেই জোয়ার দেখি চিরদিন; ভাটা নয়। কিছু নেই কারণ দুই জায়গাতেই চিরদিন জোয়ার। আল মাহমুদ মুসলমানও ছিলেন সাথে বাঙালিও ছিলেন আর তাই প্রেমের কবিতার বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি কখনো অপ্রস্তুত হননি; তিনি বলেছেন, যৌনতা জীবনের অপরিহার্য বিষয়। এটাই তো আবহমান বাংলা কবিতার অন্যতম বিষয়।
আল মাহমুদের মৃত্যু চল্লিশ বছর আগেই ঘটেছে বলে তিনি যে মন্তব্য করেছেন, তাতে বোঝাই যায়, জ্যোতির্ময় দত্ত পরের মুখে ঝাল খেয়েছেন! পরিষ্কার করে বলতে গেলে বলব, আল মাহমুদ পাঠে তার দারুণ ঘাটতি আছে। প্রতিটি কাব্যগ্রন্থে আল মাহমুদ নতুন করে জন্ম নিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রতিটি দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে তার কাব্যভাষা বাংলাদেশের মানুষকে নতুন রাস্তা দেখিয়েছে। যখন ওয়ান ইলেভেন-এর সামরিক জান্তা জাতির বুকে চেপে বসেছে, তখন আল মাহমুদ লিখলেন ‘সেলাই করা মুখ’। আর যখন চারদিকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রক্তের হোলিখেলা চলছে তখন লিখলেন, ‘এ কি অশ্রু এ কি রক্ত’। বাংলাদেশ থেকে জাহানারা পারভীন ‘আত্মঘাতী আল মাহমুদ’ শিরোনামে যে লেখার অবতারণা করেছেন তা অত্যন্ত মানহানিকর এবং মিথ্যার বেসাতিমাত্র। পারভীন লিখছেন, ‘যৌবনের সাম্যবাদী কমিউনিস্ট কবি মধ্য বয়সে পথভ্রষ্ট হলেন’, ‘সোনালী কাবিন লেখা হাতে লিখলেন গোলাম আযমের জীবনী। সামান্য অর্থের বিনিময়ে বিক্রি হলেন।’ কী আশ্চর্য! আল মাহমুদ ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলেন আর অমনি পথভ্রষ্ট হয়ে গেলেন? আর গোলাম আযমের জীবনী লিখেছেন আল মাহমুদ এই আনকোরা তথ্য পারভীন কোথায় পেলেন? বিষয়টি জানতে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। সুতরাং এটা হচ্ছে মিথ্যা তথ্য দিয়ে নিছক বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা। কবি আল মাহমুদ তার জীবনের সূচনালগ্নে সাম্যবাদী চিন্তায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন, লিখেছিলেন–
‘আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন
পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণীর উচ্ছেদ।’ এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ইসলামে বিশ্বাস করলে কী আর সাম্যবাদী থাকা যায় না? যতদূর জানি ইসলামও তো সম্পদের সুষম বণ্টনের কথাই বলে। কবি আল মাহমুদ সব জেনেশুনেই ইসলামের মাহাত্ম্য নিজের চেতনায় ধারণ করেছিলেন। কোনো জাগতিক লোভ তাকে তাড়া করেনি। জাহানারা পারভীনের সেই সময়গুলো প্রত্যক্ষ করবার সুযোগ হয়নি যখন আশির দশকের মধ্যভাগে কবি আল মাহমুদ সমালোচনার তুমুল ঘূর্ণিপাকে। তখন দেখেছি কি অসামান্য সাহস নিয়ে তিনি একাই মোকাবেলা করছেন প্রবল বিরুদ্ধ বাতাস।
এখানে জাহানারা পারভীনের জ্ঞাতার্থে বলতে চাই, আল মাহমুদ তার সাহিত্যজীবনে একটিই জীবনী লিখেছিলেন আর সেটি মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়া সাল্লামের জীবনী। আমি আল মাহমুদের শিল্পকলা একাডেমির দফতরে বসে বেশ কয়েক দিন সে বইয়ের প্রুফ দেখায় সহযোগিতা করি। বইটি পরে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়। এটাকেই কি জাহানারা অন্ধের মতো গোলাম আযমের জীবনী বলছেন?আর এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল ঠিক তখনই একজন স্বঘোষিত নাস্তিক শিবনারায়ণ রায় ‘একজন খাঁটি কবি’ শিরোনামে আল মাহমুদকে নিয়ে লিখলেন প্রবন্ধ। সেখানে তিনি তার ধর্মবিশ্বাস নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা করলেন। তিনি কিন্তু কোথাও আল মাহমুদকে ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক, পশ্চাৎপদ হিসেবে সনাক্ত করেননি। সনাক্ত করলেন একজন খাঁটি কবি হিসেবে। শিবনারায়ণ রায় যখন ঢাকা এসেছিলেন তখন কবি আবিদ আজাদের ‘শিল্পতরু’র আড্ডায় একাধিকবার আল মাহমুদ সম্পর্কে তার মূল্যায়ন শ্রবণ করার বিরল সৌভাগ্য আমার হয়েছে। যা তিনি পরে সবিস্তারে একাধিক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন। বোধকরি এ বিষয়ে আর অযথা কালি খরচ করার কোনো প্রয়োজন নেই। শিবনারায়ণ রায়ের লেখাগুলো পাঠ করে নিলেই যথেষ্ট। আরেক কিংবদন্তি সাহিত্য প্রতিভা কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তার রচনায় আল মাহমুদের কাব্যশৈলীর যে উচ্চ প্রশংসা করেছেন তা অসামান্য। ‘বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কবির নাম আল মাহমুদ’ শিরোনামে কবি সুবোধ সরকার যে আলোচনা উপস্থাপন করেছেন, আল মাহমুদকে যারা অন্য চোখে বা বাঁকা চোখে দেখতে চান তারা একবার পাঠ করে নিতে পারেন। সুবোধ সরকার প্রকৃত কবির মূল্যায়নই করেছেন তার বোধ বিবেচনায়। দেবকুমার সোম ‘আল মাহমুদ ও তাঁর গদ্য’ প্রবন্ধে আরেকটি অসত্য তথ্য উপস্থাপন করেছেন যে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সামরিক শাসক এরশাদকে তিনি সার্টিফিকেট দিয়ে কবি বানিয়েছেন। এই তথ্যটি যে সর্বৈব মিথ্যা এটা কবিতাকর্মীমাত্রই জানেন। এই মহান দায়িত্বটি সম্পাদন করেছিলেন সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’ সম্পাদক কবি শামসুর রাহমান। তিনি আশির দশকের মধ্যভাগে বিচিত্রায় ‘শামসুর রাহমান মনোনীত এরশাদের একগুচ্ছ কবিতা’ এই শিরোনামে এরশাদের কবিতা ছেপে সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। যাক এসব প্রসঙ্গ। এগুলো বহু আগেই মীমাংসিত, নতুন করে কাসুন্দি ঘাঁটবার প্রয়োজন হতো না যদি ‘কৃত্তিবাস’ টেরা চোখে অনচ্ছ আল মাহমুদকে উপস্থাপন না করত। একটু অন্য দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। একটু সৌন্দর্যের দিকে। কবি, কথাশিল্পী তারাপদ রায় তার লেখায় জানাচ্ছেন ‘আল মাহমুদ আমার বহু পুরানো বন্ধু। সে প্রায় পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল। হঠাৎ আশির দশকে শুনলাম যে আল মাহমুদ মোল্লা হয়ে গেছে। কথাটা বিশ্বাস হয়নি। পরে আবিষ্কার করেছি যে আল মাহমুদ বয়সের সঙ্গে ধার্মিক হয়েছে, তবে সে সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠেনি।’ ‘সমগ্রতায় কবি আল মাহমুদ’ শীর্ষক রচনায় কবি অমিতাভ দাশগুপ্ত বলছেন, কবি আল মাহমুদকে নিয়ে ‘আপনি’ আজ্ঞে করে লেখা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমি তাকে আঙুলে গোনা বন্ধুদের একজন বলে মনে করি। সে আমাকে বলে ‘জিগরি দোস্ত’। একই প্রবন্ধে অন্য জায়গায় বলেছেন তিনি ‘আমি নাস্তিক। আল মাহমুদ ধর্মভীরু। আমি সাম্যবাদে বিশ্বাসী। তাত্ত্বিক অর্থে আল মাহমুদ তা নয়। তবু আমরা বন্ধু। আমি তার দোস্ত। মিল সেই আসল জায়গাটিতে যেখানে মনুষ্যত্বের অপহ্নব, সেখানেই আমরা সম্পূর্ণভাবে অভিন্ন।
হিন্দোল ভট্টাচার্য তার ‘হাজার বছরে একবার লিখিত হয় সোনালী কাবিন’-এ আল মাহমুদ এর কাব্যশৈলীর অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন। সোনালী কাবিন থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় একজন কবি তার কাব্য ব্যক্তিত্বের শিকড়েই এই সংযোগের আধ্যাত্মিকতাকে যেমন ধারণ করে থাকেন, তেমন ধারণ করে থাকেন সাম্যবাদী ভাবনাকেও। আবার একটু পেছনের দিকে ফিরে গিয়ে এই লেখার সমাপ্তি টানব। আল মাহমুদের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির বিষয়ে কিছু কথা। তার সাথে আশির দশকের প্রথম থেকে ছায়াসঙ্গী হয়ে থেকে দেখেছি, তার কোনো অপ্রাপ্তির দুঃখ ছিল না। তিনি সবসময় সন্তুষ্ট ছিলেন। বলতেন, এই জীবনে বাংলা কবিতা লিখে যে আদর সম্মান স্নেহ ভালোবাসা আমি পেয়েছি আমার কোনো আফসোস নেই। মাহমুদ ভাই বলতেন : আমার কালে আমি দেশ বিদেশের সব গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার সম্মান আদায় করে নিয়েছি। তবু আল মাহমুদের মহাপ্রয়াণে যারা নানা প্রশ্ন তোলেন, রাষ্ট্রীয় সম্মানের কথা বলেন, তাদের বলতে চাই যে, রাষ্ট্রকে বলা হয়ে থাকে রাষ্ট্রযন্ত্র। তাই এটা স্বাভাবিক যে যন্ত্র অনেক সময় বিকল থাকে। কখনো কখনো সুইচ অন থাকে না কিংবা নানাবিধ সমস্যায় নিপতিত থাকে, ফলে যন্ত্রের কাছে সব সময় সরল আচরণ আশা করা সম্ভব নয়।
কবিতাপ্রেমীরা প্রায় সবাই জানেন যে, বোদলেয়ারের পারলৌকিক শোভাযাত্রায় মাত্র এগারোজন মানুষ অংশগ্রহণ করেছিলেন। অনেকেই তুষার পড়ে উলের টুপি নষ্ট হতে পারে এই ভয়ে শামিল হননি। এই তো কবির ভাগ্য! রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরও কলকাতার এলিট হিন্দু সম্প্রদায় তাকে নানা কটুকাটব্য করতে ছাড়েনি। জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু আজও রহস্যজনক, মৃত্যু না আত্মহত্যা? লোরকাকে হত্যা করল সন্ত্রাসবাদীরা। এমন দুর্ভাগ্যের কথার কোনো শেষ নেই। প্রদীপের জন্ম সে তো নিজে জ্বলে পুড়ে আলো ছড়াতেই।
বর্তমান কৃত্তিবাস সম্পাদক বীজেশ সাহাও টেলিফোনে জানিয়েছেন কবি আল মাহমুদকে পাগলের মতো ভালোবাসার কথা। ভালোবাসা থেকেই কৃত্তিবাসের এই আয়োজন সেটা বোধগম্য। কৃত্তিবাসকে জানাই আন্তরিক সাধুবাদ।
কৃতজ্ঞতায় : অন্যদিগন্ত