ড. ফজলুল হক তুহিন
বাঙালির মাঝে ঘরে ফেরার পিপাসা চিরন্তন। প্রত্যাবর্তনের লজ্জা ভুলে সে আপন আশ্রয়ে এক সময় ফিরতে চায়; যেখানে আশৈশব আপন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মধ্যে বসবাস করেছেন। নিজ ঠিকানায় ফেরার টান তাই রক্তের মধ্যে প্রবহমান থাকে। জীবন-জীবিকার জন্য দূর-দূরান্তের নগর সভ্যতায় দিনযাপন করতে হয়; আবার শেকড়ের টানেও অনেক সময় ফিরতে হয়। বাঙালির এই ফেরার মায়াবী ঠিকানার নাম ‘নিশ্চিন্দিপুর’। ইছামতির তীরে ‘নিশ্চিন্দিপুর’– বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃজনশৈলী ও কল্পনাশক্তির ছোঁয়ায় সৃষ্টি; মায়াময় এক গ্রাম, আবহমান বাঙালির স্বস্তির জায়গা, ইউটোপিয়া নয়, বাস্তবের মুক্তির মোহময় কেন্দ্র। ‘পথের পাঁচালী’তে এই গ্রামজগৎ বা মনোজাগতিক কেন্দ্রের সৃষ্টি; এখান থেকেই বৃহৎ পৃথিবীর পথে বেরিয়ে পড়া; আর ‘অপরাজিত’তে সেই বৃহৎ বহির্জগৎ থেকে তৃষ্ণা নিবারণের জন্য ফিরে আসা। ফেরার পিপাসায় অনিবার্য ফিরে আসা ও উত্তর-প্রজন্মকে শেকড় চেনানো। বাংলা সাহিত্যে অপুর এই গ্রাম হয়ে উঠেছে মধ্যবিত্ত বাঙালির স্বপ্নলোক, আকাক্সক্ষা, কল্পনা ও তৃষ্ণা-তৃপ্তির জায়গা, মনোজগতের শেকড়, উৎসভূমি। মানুষের উত্থান যেখান থেকে, সেই উৎসে ফেরার তাড়না বা টান মানুষের সহজাত প্রবণতা।
উনিশ শতকে বঙ্গীয় নজজাগৃতি কলকাতাকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনে নিয়ে আসে প্রচণ্ড এক জীবনপিপাসা, ঐহিকতা, পাশ্চাত্যমুখিতা, চাঞ্চল্য ও নতুনের প্রতি তৃষ্ণা। এই মাননিক পরিবর্তন ও মানসযাত্রায় নিঃসন্দেহে পশ্চিমের রোমান্টিক যুগের বিজ্ঞান ও সাহিত্যাদর্শ প্রেরণা যুগিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ এই রোমান্টিক ধারার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন। তিরিশের কালেও গদ্য ও কাব্য উভয় ক্ষেত্রে এই ভাবধারা সঞ্চারিত। অসামান্য সৃষ্টি ‘পথের পাঁচালী’ (১৯২৯) ও ‘অপরাজিত’তে (১৯৩১) বিভূতিভূষণ কাব্যিক আবহে প্রকৃতি ও জীবনের গভীর ও নিবিড় এক আত্মীয়তার সম্পর্ক অখণ্ড ও অবিচ্ছিন্ন সত্তায় ধারণ করে এক ভিন্ন, নতুন ও স্বকীয় জগৎ আবিষ্কার ও নির্মাণ করেন।
‘নিশ্চিন্দিপুর’ বা আপন গ্রামজগৎ বা স্বদেশ নির্মাণ ও প্রত্যার্বতন বাঙালির সাহিত্যসৃষ্টিতে নতুন নয়; পশ্চিম অভিমুখি মধুসূদনের ‘চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলী’তে এই আবহমান গ্রামধারণার সূচনা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আপন গ্রাম হিসেবে প্রকৃতি ও জননীর অভিন্ন রূপ গ্রামবাংলাকে নির্বাচন করেন; যেহেতু তিনি বাংলা ছেড়ে কোথাও যাননি, সেহেতু ফিরে আসার প্রসঙ্গ অবান্তর। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় গ্রামজগতকে আপন আশ্রয়স্থল ভেবেছেন, সেখানকার মানুষকে নিজের লোক গণ্য করেছেন। পরবর্তীকালে জীবনানন্দ দাশ ‘রূপসী বাংলা’য় রূপ-রস-গন্ধময় আবহমান এক গ্রামবাংলাকে নির্মাণ করেন। অমিয় চক্রবর্তী দেশ-বিদেশ ভ্রমণ এবং দীর্ঘ প্রবাসজীবনের এক পর্যায়ে ‘পারাপারে’, ‘পালাবদলে’ ও ‘ঘরে ফেরার দিনে’র বেশকিছু কবিতায় স্বদেশের আপন গ্রামজগতে ফিরে আসেন। বিষ্ণু দে ‘অন্বিষ্ট’, ‘নাম রেখেছি কোমল গান্ধার’ ও ‘আলেখ্য’ কাব্যে নিজস্ব গ্রামভুবন সৃষ্টি করেন। অন্যদিকে একই সময়পর্বে জসীমউদ্দীন বাংলার লোকঐতিহ্যময়, পূর্ব-বাংলার প্রকৃতিআশ্রিত নদীমাতৃক জীবনের এক অকৃত্রিম, পূর্ণাঙ্গ পল্লীবাংলা সৃষ্টি করেন। গ্রাম তাঁর কাছে পরিপূর্ণ এক বিশ্ব, তাঁর নিজস্ব শিকড় সেখানে প্রোথিত। একুশোত্তর বাংলা কাব্যে নদীমাতৃক ও গ্রামকেন্দ্রিক বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে আল মাহমুদের জন্মভূমি ও স্বদেশ আপন গ্রামবিশ্ব। নগরের অবক্ষয়প্রাপ্ত অনিকেত জীবন থেকে মুক্তি খুঁজে পেয়েছেন সেই গ্রামদেশের বিশাল পটভূমিকায়। তবে তাঁর ‘নিশ্চিন্দিপুর’ রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ-জসীমউদ্দীনের অঙ্কিত গ্রামজগৎ নয়; নদীভাঙা সংগ্রামী এক গ্রামজনপদ। আধুনিক কালের এইসব লেখক বাংলার প্রকৃতিনির্ভর গ্রাম ও গ্রামসমাজকে আপন জমিন-জায়গা-আশ্রয় বা ঠিকানা হিসিবে বিবেচনা করেছেন। ভাব-ভাবনা ও কল্পনার বৈচিত্র্য থাকার পরও একটা কেন্দ্রীয় স্থান বা ‘নিশ্চিন্দিপুর’ এঁরা নিজের মতো করে সৃষ্টি করেছেন; অধিকাংশই ফিরে এসেছেন সময়ের বিবর্তনে, জীবনের অনিবার্য তাগিদে।
অপুর ‘নিশ্চিন্দিপুর’ কেমন দেখতে? কেন সেখানে বিস্ময়, মুগ্ধতা, মুক্তি ও জীবনানন্দ সে খুঁজে পেয়েছে? কী এমন হিরন্ময় গুপ্তধন আছে সেখানে, যা সে সবসময় বহন করেছে ফিরে না আসা পর্যন্ত? এইসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে ‘আম-আঁটির ভেঁপু’ অধ্যায়ে। দুর্গার সহযোগে অপু প্রথমত ‘নিশ্চিন্দিপুর’ আবিস্কার করেছে প ইন্দ্রিয় দিয়ে নিজের মতো করে, নিজস্ব ভূগোল সে তৈরি করে নিয়েছে প্রকৃতিময় এই গ্রামকে কেন্দ্র করে; যার সঙ্গে আত্মীয়তা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। অপুর শৈশব কাটিতেছিলো এই প্রকৃতির সহিত ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে। এক ঋতু কাটিয়া গিয়া কখন অন্য ঋতু পড়ে– গাছপালায়, আকাশে বাতাসে, পাখির কাকলিতে তাহার বার্তা রটে। ঋতুতে ঋতুতে ইছামতির নব নব পরিবর্তনশীল রূপ সম্বন্ধে তাহার চেতনা জাগ্রত হইয়া উঠিয়ছিল– কোন্ ঋতু গাছপালায় জলে-স্থলে-শূন্যে ফুলে ফলে কি পরিবর্তন ঘটায় তাহা সে ভালো করিয়া চিনিয়া ফেলিয়াছিল। ইহাদের সহিত এই ঘনিষ্ঠ যোগ সে ভালবাসে, ইহাদের ছাড়া সে জীবন কল্পনা করিতে পারে না। এই বিরাট অপরূপ ছবি চোখের উপরে রাখিয়া সে মানুষ হইতেছিল। [পথের পাঁচালী] আসলে অপুর মানসিক অগ্রযাত্রা, ধারাবাহিক গঠন প্রক্রিয়া, ধারাক্রম, অপরিচয়ের সাথে পরিচয়, অজানার সাঙ্গে বন্ধুত্ব, বিস্ময়ের নাগাল পাওয়া ইত্যাদি সম্পন্ন হয়েছে ‘নিশ্চিন্দিপুরে’র বিপুল-বিশাল-বিচিত্র নিসর্গ, সমাজ ও সংস্কৃতির ঐতিহ্যে। নিসর্গের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের গভীর আত্মীয়তা এবং দূরসঞ্চারী প্রভাব অপু শৈশব জীবন থেকে ক্রমান্বয়ে অর্জন করেছে। তবে অপুর মধ্যে সহজাতভাবে কাজ করেছে এ্যাডভেঞ্চার, রোমা , রোমান্টিকতা। দূর দেশ, পাহাড়, পর্বত, সমুদ্র, মরুভূমি, কল্পলোক, রূপকথা তাকে বারবার অনুপ্রেরণা, উত্তেজনা, হাতছানি দিয়ে ডেকেছে। এই আহ্বান সে নিজের গ্রামের প্রকৃতিতে, প্রচলিত পৌরাণিক কাহিনীতে, যাত্রায়, বইপত্রে, কলকাতা থেকে আগত পত্রিকায়, বিদ্যালয়ে, আত্মীয়সজনের মুখে শোনা রূপকথায় শুনেছে ও অনুভব করেছে। ‘নিশ্চিন্দিপুর’ থেকেই অপু নিজের মতো করে সৃষ্টি করে নিয়েছে আপন কল্পলোক এবং অল্প বয়সেই আবিষ্কার করেছে ও সিদ্ধান্তে এসেছে তাদের ‘নিশ্চিন্দিপুর’ পৃথিবীর মধ্যে সেরা। এই গ্রাম ছেড়ে কোথাও যাওয়ার বাসনা অপুর কখনো হয়নি। পরিবারের ইচ্ছায় তাকে ‘নিশ্চিন্দিপুর’ ছাড়তে হয়। কিন্তু ‘নিশ্চিন্দিপুর’ অপুর মনোজগত থেকে এক মুহূর্ত কালও দূরে সরে যায়নি। বরং পরবর্তীকালে লেখক জীবনের পথে প্রতিটা সময়ে এই গ্রামজগত তাকে টেনেছে ও প্রেরণা জুগিয়েছে। বাংলার বসন্ত, চৈত্র-বৈশাখের মাঠে, বনে, বাগানে, যেখানে-সেখানে, কোকিলের এলোমেলো ডাকে, নতপল্লব নাগকেশর গাছের অজস্র ফুলের ভারে, বনফুলের গন্ধভরা জ্যোৎস্নাসিগ্ধ দক্ষিণ হাওয়ায় উল্লাসে আনন্দনৃত্য শুরু করিয়াছে। এরূপ অপরূপ বসন্তদৃশ্য অপু জীবনে এই প্রথম দেখিল। এই অল্প বয়সেই তাহার মনে বাংলার মাঠ, নদী, নিরালা বনপ্রান্তরের সুমুখ জ্যোৎস্নারাত্রির যে মায়ারূপ অঙ্কিত হইয়া গিয়াছিল, তাহার উত্তরকালের শিল্পীজীবনের কল্পনা-মুহূর্তগুলি মাধুর্যে ও প্রেরণায় ভরিয়া তুলিবার তাহাই ছিল শ্রেষ্ঠ উপাদান। [পথের পাঁচালী] ‘নিশ্চিন্দিপুর’ ছেড়ে গিয়ে অপু পরিবারের সঙ্গে এক বদ্ধ, বন্দী, সংকীর্ণ ও নিসর্গহীন পরিবেশে রুদ্ধশ্বাসে দিনযাপন করতে থাকে। এমন অবস্থায় ‘নিশ্চিন্দিপুর’ তাকে প্রতিনিয়ত ডাক দিয়ে যায়। শাঁখারীপুকুর, বাঁশবন, সোনাডাঙ্গার স্বপ্নমাখানো মাঠ, পুষ্পিত ছাতিম বন, কদমতলার সাহেবের ঘাট, দেবী বিশালাক্ষী, লেবুফুলের গন্ধ, সজনেতলার ছায়া, শিরিষ সোদালি বনে পাখির ডাক, ইছামতিতে বর্ষার ঢল, ঝোপে ঝোপে নাটাকাঁটা, বনকলমির ফুল, বন অপরাপিতার নীল ফুল, বনেঘেরা বাড়ির উঠোন, শান্ত বিকেলের নৈশব্দ, ভালোবাসার রাণুদির কথা অপুর মনকে তোলপাড় করে দেয়; তাই তাঁর আকুতি: আমাদের যেন নিশ্চিন্দিপুর ফেরা হয়– ভগবান– তুমি এই কোরো ঠিক যেন নিশ্চিন্দিপুর যাওয়া হয়– নৈলে বাঁচবো না– পায়ে পড়ি তোমার–। [পথের পাঁচালী] কিন্তু পথের দেবতা প্রসন্ন হেসে অপুকে সামনে, আরো সামনে চলতে বলেন: নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে, দেশ ছেড়ে বিদেশ, অপরিচিত জগৎ; সেজন্যই অপুকে ঘরছাড়া করে এনেছেন। এই দেবতা আসলে স্বয়ং বিভূতিভূষণ। তবে লেখক অপুর আকুতিকে সম্মান জানিয়েছেন অপুর ফেরার মাধ্যমে।
মুক্তিপাগল অপু ঘরছাড়া হয়ে বিপুলা জগতের অন্বেষণে সবসময় সচেষ্ট থেকেছে; কিন্তু ‘নিশ্চিন্দিপুর’ নামের স্বপ্নময় শৈশবসৃস্মিলোক থেকে মুহূর্তকাল বিচ্ছিন্ন হয়নি। দূরের স্কুলে ভর্তি হয়ে নতুন অভিজ্ঞতা ও পরিবেশে সে রোমান্স, বিজ্ঞান ও এ্যাডভেঞ্চার সম্পর্কে অবগত হয়। ফলে অপুর তিয়াসা আরো বেড়ে যায়। কলকাতায় কলেজে পড়ার সময় সে ইতিহাস, বিজ্ঞান-জ্যোতির্বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন সম্পর্কে ব্যাপক কৌতূহলী হয়ে ওঠে। জ্ঞান-বিজ্ঞান-ইতিহাস-প্রকৃতির অফুরন্ত জগতে বিচরণের আনন্দ, বিস্ময় ও মুগ্ধতা তাকে আবিষ্ট করে রাখে। অন্যদিকে চরম দারিদ্র্যের আঘাতে জর্জরিত হতে থাকে। ছাত্রজীবনে অপু স্কলার্শিপ পেয়ে, টিউশনি করে লেখাপড়ার খরচ, খাওয়াপরার ব্যয় করতে গিয়ে দারুণ হিমশিম খেয়ে ওঠে; পরে চাকুরি করেও এই অভাবের হাত থেকে রেহাই পায়নি। এইসব তিক্ত অভিজ্ঞতায় জীবনপিপাসু অপু কলকাতার ধরাবাঁধা, একঘেয়েমি, বদ্ধ পরিবেশে অতিষ্ঠ হয়ে বারবার মুক্তি কামনা করে; সুযোগ পেয়ে ভারতবর্ষের মানচিত্র দেখে ভ্রমণে বের হয় মুক্তির নেশায়। নাগপুরের পাহাড়ে চাকরি নিয়ে বিশাল প্রকৃতির অপার বিস্ময় ও রোমাে র মধ্যে শুরু করে জীবনের নতুন আর এক অধ্যায়। কিন্তু চ ল, ভ্রমণপিয়াসী মনের অধিকারি অপু ফিরে আসে বাংলায়; বাংলাকে সে চিনেছে বাংলার বাইরে গিয়ে। অনেকদিন পরে বাংলায় ফিরে বাংলার গ্রামীণ প্রকৃতির দৃশ্য ও মানুষজন দেখে অপুর চোখ-মন-প্রাণ জুড়িয়ে গেছে। শিশুপুত্র কাজলকে নিয়ে মনসাপোতায় অপু ঘুরে আসে; উদ্দেশ্য কাগলকে নিজের বেড়ে ওঠার দ্বিতীয় আশ্রয় চেনানো।
ইছামতির প্রবহমান ধারার মতো অপুর জীবন; কোথাও এক জায়গায় থামেনি। জীবনজীবিকার তাগিদে কলকাতায় তাকে বারবার ফিরতে ও থাকতে হয়েছে; কিন্তু স্বস্তি পায়নি কখনো। মুক্তির জন্য প্রাণ আকুলিব্যাকুলি করে উঠেছে। অনেক দেশ ঘুরে, ভ্রমণ করেও সে শান্ত হয়নি; জীবনানন্দের ছন্দে সে অগ্রসর হয়েছে অনবরত। একটা পথিক মন ও অনুসন্ধিৎসু চোখ সবসময় খুঁজে ফিরেছে মহাজীবন ও মহাজগতের রহস্য এবং কাক্সিক্ষত জায়গা বা গন্তব্য। ফলে মনের নদীতে জমতে পারেনি ক্লান্তি-নিরানন্দ-ক্ষোভ-হতাশা-ভয়। তাই অপু আর্থিক কষ্টে পরাজিত হয়নি; কোনো বাঁধনে বাঁধা পড়েনি; বরং প্রতিনিয়ত মনের আনন্দ উচ্ছ¡ছিত প্রাচুর্যে ভরে ওঠে; সারা বিশ্বজগতের রহস্য সম্পর্কে সে সচেতন হয়ে উঠে। তাই অপু শুধু অগ্রসর হয়েছে সামনে। এই সামনে চলার তরী ভিড়েছে ‘নিশ্চিন্দিপুরে’ অথবা ‘নিশ্চিন্দিপুর’ শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠেছে আকাক্সিক্ষত গন্তব্য। অপুর জীবনের সমস্ত আনন্দ, স্বপ্ন, স্মৃতি, কল্পনা ও মুক্তির ভিত্তিভূমি এই ‘নিশ্চিন্দিপুর’। এখানেই সে প্রথম উপলব্ধি করে এই জগতের আড়ালে আর একটা জগৎ আছে। দৃশ্যমান জীবন ও জগতের অন্তরালবর্তী রূপের পরিচয় অপু একান্ত কাছের মানুষজন– অনিল, দিদি দুর্গা, জননী, অপর্ণা এবং শেষে লীলার মৃত্যুর মাধ্যমে অনুভব করে। বন্ধনহীন ও অতৃপ্ত অপু সেই জীবনজগতের গোপন স্বরূপটির ইঙ্গিতে জীবনানন্দে উজ্জীবিত। আবার একটা অনুসন্ধানী ও তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি ও মন তাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের আর্থসামাজিক করুণ অবস্থার কাছে পরাজয় স্বীকার করতে দেয় না। দৈশিক ও বৈশ্বিক এই অস্থিরতা-অনটনের বাস্তবতা থেকে মুক্তির রোমান্টিকতা প্রয়োজন ছিলো অপুর; সেই রোমান্টিক প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের নাম ‘নিশ্চিন্দিপুর’। তার দৃষ্টিভঙ্গিও রোমান্টিক: অনুভূতি, আশা, কল্পনা, স্বপ্ন– এসবই জীবন। …সুখ ও দুঃখ দুই-ই অপূর্ব। জীবন খুব বড় একটা রোমান্স– বেঁচে থেকে একে ভোগ করাই রোমান্স– অতি তুচ্ছতম, হীনতম একঘেয়ে জীবনও রোমান্স। [অপরাজিত] জীবনজগতপিপাসু অপু তাই সেই রোমান্টিক জগতে ফিরে আসে উত্তরাধিকারী নিয়ে। বন্ধু প্রণবের কাছে প্রত্যাবর্তনের অনুভূতি ব্যক্ত করেছে এভাবে: শৈশবের গ্রামখানাতে ফিরে এসে জীবনের এই সৌন্দর্যরূপটাই শুধু চোখে দেখছি। এতদিনের জীবনটা একচমকে দেখবার এমন সুযোগ আর হয়নি কখনো। এত বিচিত্র অনুভূতি, এত পরিবর্তন, এত রস– অনেকক্ষণ শুয়ে শুয়ে চারিধারের রৌদ্রদীপ্ত মধ্যাহ্নের অপূর্ব শান্তির মধ্যে কত কথাই মনে আসে, কত বছরের আগেকার সে শৈশবসুরটা যেন কানে বাজে, এক পুরানো শান্ত দুপুরের রহস্যময় সুর…কত দিগন্তব্যাপী মাঠের মধ্যে এই শান্ত দুপুরে কত বটের তলা, রাখালের বাঁশির সুরের ওপারের যে দেশটি অনন্ত তার কথাই মনে আসে। [অপরাজিত]
‘নিশ্চিন্দিপুরে’ ফিরে নিজের উত্তরাধিকারীকে অপুর মনে হয়েছে জন্মান্তরের পথিক-আত্ম। অতীতের কবেকার কোন্ জগৎ থেকে তার আগমন: জন্ম; আবার ভবিষ্যতের কোন্ জগতে তার চলে যাওয়া: মৃত্যু; আবার ফিরে ফিরে আসা: নবজন্ম– এভাবেই জীবনের চক্র। স্পষ্টত বিভূতিভূষণ জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী। জন্মান্তরের ঘুর্ণিচাকায় জীবন-মৃত্যুর এই আবর্তন ও অভিযান আনন্দে, যৌবনে, পুণ্যে, দুঃখে, শোকে ও শান্তিতে সম্পন্ন হয়েই পূর্ণতর ও বৃহত্তর জীবনের সৃষ্টি-নির্মাণ। অপুর জীবন জন্মান্তরের আবর্তধারায় একটিমাত্র ঢেউ; প্রবহমান অখণ্ড জীবনের পরবর্তী ঢেউয়ের নাম কাজল– যার জীবন যুক্ত পূর্ববর্তী জীবনঢেউয়ের সঙ্গে। অপু উত্তর-প্রজন্মসহ প্রত্যাবর্তন করে ‘নিশ্চিন্দিপুরে’। কিন্তু সে অপরাজিত বৃহত্তর জীবন-রহস্যের তৃষ্ণায় ও সন্ধানে সেখানে স্থায়ী না হয়ে বেরিয়ে পড়ে অপরিচিত ও অজানা সেই পথে পথের দেবতা তাকে যে পথে ঘরছাড়া করে এনেছিলো। আর অপু কাজলের মাধ্যমে অনিবার্যভাবে ফিরে আসে ‘নিশ্চিন্দিপুর’। অপুর শৈশব জীবনের ছায়া কাজলের আগমনে ‘নিশ্চিন্দিপুর’ হয়ে ওঠে তাই বাঙালির জন্মান্তরের একান্ত আপন ঠিকানা। ‘অপরাজিত’ শেষ হয় ঔপন্যাসিকের অসামান্য ইঙ্গতময় মন্তব্যে: যুগে যুগে অপরাজিত জীবন-রহস্য কি অপূর্ব মহিমাতেই আবার আত্মপ্রকাশ করে! খোকার বাবা একটু ভুল করিয়াছিল। চব্বিশ বৎসরের অনুপস্থিতির পর অবোধ বালক অপু আবার ‘নিশ্চিন্দিপুর’ ফিরিয়া আসিয়াছে। [অপরাজিত] একুশ শতকের যন্ত্রবান্ধব ও প্রযুক্তিবন্ধনে বন্ধি বর্তমান বাঙালি জীবনেও আবহমান গ্রামবাংলার প্রতিনিধি গ্রাম বা কেন্দ্রিয় স্থান বা মুক্তির ঠিকানা বা স্বপ্নলোক বলতে বোঝায় সেই অদ্বিতীয় ও অপরাজিত ‘নিশ্চিন্দিপুর’।