🌿
তৈমুর খান
_______________________________
আত্মবোধের জাগরণ
🗣️
জফির সেতু(১৯৭১) নব্বই দশকের কবি হিসেবে আমাদের কাছে অতি পরিচিত একটি নাম। যাঁকে মাটি ও মর্মের, আদি-অন্তহীন মানবসভ্যতার প্রত্নচেতনার কবি হিসেবেই উল্লেখ করা যায়। তাঁর ভাবনার ব্যাপ্তি এতটাই গভীর এবং বিস্তৃত যে বারবার তিনি আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যান পুরাণে, ইতিহাসে, দর্শনে এবং আদিম সৃষ্টির চৈতন্যে। তাঁর ভাবনার মধ্যে ব্যক্তি নয়, সামগ্রিক জীবনচেতনার পরিচয়টিই উঠে আসে যা খণ্ডিত সময় ভেদ করে অখণ্ডিত প্রবাহমানতায় আমাদের ঠেলে দেয়। আত্মবোধের জাগরণ টের পাই তখন। আত্মস্বীকারের পরম্পরা থেকেই নিজেকে সমূহের মধ্যে আবিষ্কার করি।আর এই আত্মস্বীকারের মধ্যদিয়েই একজন প্রকৃত কবিকে চেনা যায়। জফির সেতু বলেছেন:”সমাজ-রাষ্ট্রের বিকৃতি, স্থূলতা ও অন্যায় কবিকে বিদ্ধ করতে পারে। পারে নিজেকে নিজের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে। কবির অবদমিত ব্যক্তিসত্তাও এক্ষেত্রে বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পারে। কবি হয়ে উঠতে পারেন কুণ্ঠাহীন। মানুষ হিসেবে কবির যে-ঊনতা তা তিনি প্রকাশ করতেই পারেন। মানুষ নীচ ঘৃণ্য অধম ইত্যাদি হতেই পারে, কিন্তু তাও ঠিক যে, এসবকে ছাপিয়ে তার মানবিক সত্তাটাই প্রধান হয়ে উঠতে চায়। আমার মনে হয় কবির আত্মস্বীকারে মাহাত্ম্য এখানেই।”(কবির আত্মস্বীকার)। এই মানবিক সত্তাটিরই প্রকাশ ঘটেছে তাঁর কবিতায়।
এখন পর্যন্ত জফির সেতুর ১৫টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ‘বহুবর্ণ রক্তবীজ’ (২০০৪), ‘সহস্র ভোল্টের বাঘ’ (২০০৬), ‘স্যানাটোরিয়াম’ (২০০৮), ‘তাঁবুর নিচে দূতাবাস’ (২০১১), ‘সিন্ধু দ্রাবিড়ের ঘোটকী’ (২০১২), ‘জাতক ও দণ্ডকারণ্য’ (২০১৩), ‘সুতো দিয়ে বানানো সূর্যেরা’ (২০১৪), ‘Turtle Has No Wings’ (2014), ‘ময়ূর উজানে ভাসো'(২০১৪), ‘ডুমুরের গোপন ইশারা'(২০১৪), ‘প্রস্তরলিখিত’ (২০১৫), ‘ইয়েস, ইউ ব্লাডি বাস্টার্ডস’ (২০১৫), ‘এখন মৃগয়া'(২০১৬), ‘আবারও শবর’ (২০১৬), ‘তিন ভাগ রক্ত’(২০১৯) ইত্যাদি। ব্যক্তি, সময়, রাষ্ট্র, ইতিহাস সবকিছুর মধ্যেই এক মানবিক উত্থানকেই তিনি তুলে আনতে চেয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর কবিতায় বিশ্বায়ন ঘটেছে। ব্যক্তিক শূন্যতা ছাড়িয়ে গেছে বৈশ্বিক শূন্যতার কাছে। তিনি নিজ নারীটিকে শুধু কবিতায় খোঁজেননি, আবহমানের প্রত্ন প্রেমিকাকেই খুঁজেছেন। ঐতিহাসিক নারী-পুরুষের প্রেম ও ধ্বংসকে মহাসভ্যতার আলোকে মহাকাব্যিক ক্ষেত্র থেকে তুলে ধরেছেন। তাই প্রাচ্য-পাশ্চাত্য একাকার হয়ে গেছে। সময়ের সীমানাও অতিক্রম করে গেছে তাঁর ভাবনায়।
আত্মবোধের বিস্তার
🗣️
এই মহাকাব্যিক প্রেক্ষাপটে মানবসভ্যতার উত্থানের সঙ্গে তাঁর আত্মবোধেরও বিস্তার ঘটেছে। কবি যেন প্রত্নউপলব্ধিকে ধারণ করেই কাব্যকলার দর্শনকে লিপিবদ্ধ করেছেন। তাই কবিতাগুলিতে যেমন ঐতিহাসিক নিদর্শন আছে, তেমনি প্রাগৈতিহাসিক প্রবৃত্তিরও জাগরণ আছে। সবমিলিয়েই তিনি খুঁজে পেয়েছেন আদিমচক্র যা বারবার রূপান্তরিত হয়ে ফিরে এসেছে আজকের দিনেও। সুতরাং রিয়ালিজম্ বা সুরলিয়ালিজম্ যা-ই বলি না কেন, সৃষ্টির সব বিন্যাসে এই পরম্পরাকে অনুধাবন করেই তিনি মহাজীবনের প্রজ্ঞায় পৌঁছাতে চেয়েছেন। আর আশ্চর্য এই কারণেই যে, তিনি তাঁর কাব্য নির্মিতির বৃহৎ পরিসরে গতিবাদের অন্বয় সাধনও করতে পেরেছেন। রোমান্টিক স্ফুরণকে বাস্তবতার আলোয় এবং অতিবাস্তবতাকে পৌরাণিক ঐতিহ্যের সম্মোহনে মুক্তি দিতে পেরেছেন।
‘জাতক ও দণ্ডকারণ্য’ কাব্যে পৃথিবীর আদি মানুষ আদমের সন্তান হাবিল ও কাবিলের মধ্যে লড়াই হয় নারীকে পাওয়ার জন্যই। বোনের সঙ্গেই ভাইয়ের বিবাহ এবং তাকে দখলের লড়াই। ঈশ্বরকে তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে চলতে থাকে উৎসর্গ। ভাই বোন সম্পর্কের বিবাহকে কবি বলেছেন ‘আদিপাপ’। যা অজাচার হিসেবেই গণ্য হয়। কবিতায় লিখেছেন:
“ভগ্নী তুমি সরে দাড়াও! চিৎকার করে একজন
আকলিমা কাঁদে আর ভাবে এই দুই পুরুষের ক্রোধের উৎস কী?
হাবিল ও কাবিল মল্লযুদ্ধে মেতে উঠেছে পৃথিবীর প্রথম প্রান্তরে
আকলিমা দেখে দুজনের শরীরের মাঝখানে দুটি করে অণ্ডকোষ আছে
আর তার একটিও নেই
হাবিলের রক্ত মাটিতে গড়িয়ে পড়ে আর কাবিল উল্লাস করে
আকলিমা ভীত হয়
তার উষ্ণ জরায়ুতে হাবিলের বলি দেওয়া ভেড়ার মাথা তখন ছটফট করছে।”
আদম ইভ এর মধ্যেদিয়েই আদিপাপের জন্ম হলো। মানবজন্মের উৎসেই কবি যে হিংসার দেখা পেলেন তা মানবসভ্যতার ক্রিয়াকাণ্ডে ফুটে উঠতে থাকল। জেরুজালেম, কাশ্মীর সেই সংঘাতেরই দৃষ্টান্ত। রক্তাক্ত কররেখায় ঘুরপাক খাচ্ছে একটা সৌরবিশ্ব। পৌরাণিক উপকথাগুলিও এই সূত্রেই উঠে এসেছে। অর্ফিয়ুস, ইউরিদাইসও বর্তমানে মিশে গেছে। আমাদের সংস্কার, বিশ্বাস, ধর্ম, সংস্কৃতি, ইতিহাস যেদিক থেকেই এগুলি দেখি না কেন—এগুলি মানবসভ্যতাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে এবং আমাদের মননে স্থায়িত্ব লাভ করেছে তা বলাই বাহুল্য। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সামাজিক জীবনচক্রকেও প্রভাবিত করে চলেছে। লোকজ কাহিনি বা উপকাহিনির প্রচলিত ধারায় এগুলির কিংবদন্তিও আমাদের বিশ্বাস অর্জন করেছে। তাই জাদুবাস্তবতার সঙ্গে জীবন ও সভ্যতার সামঞ্জস্য ঘটেছে। চাঁদের আলোয় প্রস্তর যুগ কেঁপে উঠেছে। প্রেমিকা হতে চেয়ে মেয়েটি কৃষ্ণচূড়া গাছ হয়ে গেছে। কিংবা প্রেমিক হবার বাসনায় লোকটি শাল কিংবা গজারি। অর্থাৎ ব্যক্তিগত ভাবনাতেও সহজেই এগুলি প্রবেশ করেছে। কবি সুকৌশলে সমগ্র মানবজীবনের সঙ্গেই তার মিল খুঁজে পেয়েছেন। এই সঙ্গে এসেছে প্রকৃতির অনুষঙ্গ। নারী, নদী, ফুল, পাখি, আকাশ, চন্দ্র-সূর্য, ফসলের মাঠ যা সভ্যতারই নির্মিতিতে ও সৌন্দর্যে মিশে আছে। কোনওকিছুকেই আমরা আলাদা করে দেখতে পারি না। ১৫টি কাব্যগ্রন্থেই আছে এই প্রবাহ। উত্থান ও ব্যাপ্তির সংরাগ।
মানবজীবন এবং মানবসভ্যতাকে কবি যখন দেখলেন, তখন কী পেলেন সেখানে?
মানবসভ্যতায় কী দেখলেন?
এ বিষয়ে জাতিসংঘ সচিবালয়ের একজন প্রাক্তন ইন্টার্ন এবং আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক জার্নাল অফ ইস্যুর বর্তমান সম্পাদক, গবেষণা এবং ইন্ডি লেখক প্রচার কেন্দ্রের চেয়ারম্যান এমএফ মুনজাজার বলেছেন:
“The human civilization has gone extremely so far; that in return, we have lost the line between stupidity and spirituality.”
(M.F. Moonzajer, LOVE, HATRED AND MADNESS)
অর্থাৎ মানবসভ্যতা এতদূর এগিয়ে গেছে; যে বিনিময়ে, আমরা মূর্খতা এবং আধ্যাত্মিকতার মধ্যে লাইন হারিয়ে ফেলেছি।
জফির সেতু ‘তিন ভাগ রক্ত’ কাব্যে লিখলেন:
“যুদ্ধ শেষ না আসন্ন?
কুরুক্ষেত্রে এই সংলাপ ছিল রাজা ধৃতরাষ্ট্রের
তিনি অন্ধ ছিলেন
এখন জগৎ সুদ্ধ অন্ধ”
রক্তে ভেসে যাওয়া উপত্যকার মাটি, অক্ষৌহিণী সেনাদল চিৎকার করছে: ‘জিতেছি জিতেছি’!
“অন্ধেরা প্রশ্নও করছে,
যুদ্ধ শেষ না আসন্ন!”
কুরুক্ষেত্রের বিস্তার সর্বত্রই। কাশ্মীরের আবদুল হামিদ শেখের গল্পে বোনকে তুলে নিয়ে যাওয়া, ভাই স্কুল গিয়ে না ফিরতে পারা এ গল্প আজ সকলেরই গল্প হয়ে যায়। যাযাবরদেরও সেভাবেই মার খেতে হয়। মৃত্যু নিয়ে জীবনের ঘরকন্না। খুন-ধর্ষণ, শোষণ-পীড়ন, ধর্মীয় কুসংস্কার, দাঙ্গা, বিভেদ, সাম্প্রদায়িক প্রতিহিংসা, রাজনীতির কূটকচালি ইত্যাদি এসবই মানবসভ্যতার অবদান। এক বিমূঢ় মূর্খতায় আমরা দিশেহারা। তাই আজ জগৎ সুদ্ধ অন্ধ। যুদ্ধ শেষ না শুরু সেই বোধও হারিয়ে গেছে। আগুনে সেঁকে রুটি খেতে শেখাটাই সভ্যতা নয়। বসে বসে হিসি করতে পারাও সভ্যতা নয়। সভ্যতা কী তাহলে?
আলবার্ট কামু মনে করেন:”The purpose of a writer is to keep civilization from destroying itself.”
অর্থাৎ একজন লেখকের উদ্দেশ্য হল সভ্যতাকে ধ্বংস করা থেকে নিজেকে বিরত রাখা। কিন্তু মানুষের পক্ষে এটা কি সম্ভব?
প্রতিমুহূর্তেই মানুষ চক্র রচনা করছে। আর এই চক্র ধ্বংসচক্র। তাই নিত্যনতুন অস্ত্র বানাচ্ছে। ‘তাঁবুর নিচে দূতাবাস’ কাব্য লিখেছেন:
“মানুষ অস্ত্র বানাতে ও চালাতে পারে এটাও তার
একটা সফলতা— এটা মানতেই হবে।”
এই সফলতার প্রয়োগ বিশ্বইতিহাসকে প্রতিমুহূর্তে পাল্টে দিচ্ছে। কবি যে প্রেম অন্বেষণ করেছেন তা খুঁজে পাননি। এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েই এমএফ মুনজাজার লিখেছিলেন অ্যান্টি প্রেমের কবিতা:
“Fuck the world and never tell them I love you.”
জফির সেতুও প্রেমকে খুঁজলেন। ‘সহস্ত্র ভোল্টের বাঘ’ কাব্যে আদি উৎসের মধ্যেই নিজের সভ্যতাচারী রূপটি দেখতে পেলেন। বসন্তদিনে গ্রীস-রোম-ব্যাবিলন হয়ে হরপ্পা পর্যন্ত কবির পর্যটনের বীক্ষণ। টাইগ্রিস-উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে সংঘামিত্রাকেও পেয়ে যান অশোকের যুগে। কিন্তু রক্তাক্ত সভ্যতার বিবমিষা ছড়ানো পথে প্রেম কি সেই সংঘাতেরই পরিচয় দেয়? সাদা ঘোড়ার প্রবাহ দেখা গেলেও সাদা বাঘেরও দেখা মেলে যা অভিকল মানুষ মুখো। বাঘকে নিয়ে বাজারি মেয়েদের নাচানাচিও শুরু হয়। আবার বাঘকে নিয়ে কান্নাও। বাগদি তবে রাজনীতির লোক? আসলে বাঘ যে প্রতারক, ঘাতক, ছদ্মবেশী প্রেমহীন পুরুষ তা বোঝা যায়।
অনেক হলুদ জেব্রারও দেখা পাওয়া যায়। শেফার্ডের তাড়া করার জন্য মালিকদের চর্বির গুহায় তারা আত্মগোপন করেছে। ধনতান্ত্রিক মজুমদার সভ্যতার চিত্রের প্রতি কবির এই রূপকাত্মক ইঙ্গিত। রক্তমুখো হিসহিসে জানোয়ারদের সঙ্গম পিপাসাও জ্বলে উঠেছে। দোয়েলের শিস ও বাঘিনির চুমু খাওয়াতেও রুটির প্রকাশ ঘটে। ম্যাজিক রিয়ালিজমেরও জন্ম হয় তখন। খড় ছড়িয়ে দিলে তা বাতাসে পাখি হয়ে উড়ে যায়। ধোঁয়ার কুণ্ডলী হয় লাল রঙের মেঘ। অবদমিত যৌন ইচ্ছাগুলিই সাদা ঘোড়া। প্রেম তাগড়া ষাঁড়। ফসলের মধ্যেও যৌনইচ্ছার প্রকাশ ঘটে। কবি দেখতে পান:
“সকল পুরুষের মধ্যে বাস করে এক টিয়েরং নারী
সকল নারীর ভেতরেই পুঁজিবাদী শাসন”
সৌন্দর্যের সঙ্গে অর্থ,ভোগের সঙ্গে কামনার যোগ-সাদৃশ্য এভাবেই নির্ণিত হয়। যদিও রাষ্ট্রবিপ্লবে কামার্ত রমণীরা বীরপ্রসূ হতে পারে না। হাতের কাছে শঙ্খ স্তন, কস্তুরী নাভি, ভেজা ঠোঁট থাকলেও মাঝে মাঝে পুরুষও নপুংসক হয়ে যায়।
যুগান্তরের অনন্তচারী প্রজ্ঞা
🗣️
সভ্যতার কথা এলেই জফির সেতুকে পুরাণ-ইতিহাসের আলোকে প্রত্নগামী হতে দেখা যায়। সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকীর সওয়ারী হয়ে তিনি যে পরিক্রমণ চক্র রচনা করেছেন যুগান্তরের অনন্তচারী প্রজ্ঞারই দৃষ্টান্ত। সেখানে সভ্যতার আদি উৎসে নারীর রমণীরমণই মূল বিষয়। কবিও সিন্ধুদ্রাবিড়ের কন্যাকে অন্বেষণ করেছেন। সভ্যতাও ক্রমান্বয়ে গ্রিস-রোম-ব্যাবিলন-মায়া-আজটেক একে একে এই চক্রে শামিল হয়েছে। রমণী বা প্রেমিকাকে লাভ করা তো বীরপুরুষের কাজ। স্বাভাবিকভাবেই এই কাজে বাধারও সম্মুখীন হতে হয়। সৃষ্টি হয় সংঘাত বা যুদ্ধ। এই সংঘাত পুরাণ ও ইতিহাসখ্যাত নানা আখ্যানেই লিপিবদ্ধ হয়েছে। কবি শুধু কাহিনির বহিরঙ্গ তুলে ধরতে চাননি। অন্তরঙ্গকেও কাব্যের গীতল শব্দ-তরঙ্গে তুলে ধরেছেন। হৃদয়ের ক্ষত গভীর হয়েছে যেমন, তেমনি মনেরও দাহ প্রজ্জ্বলিত হয়েছে। এই ‘রমণী’ আদিম সভ্যতারই প্রতীকী চরিত্র যা সমূহ রমণীরই প্রতিনিধি, যাকে কবি ‘সিন্ধুঘোটকী’ হিসেবেই উল্লেখ করেছেন। কবি সত্তাটি সমূহ প্রেমিক সত্তারই স্বরূপ। কবি ‘সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী’ কাব্যে লিখেছেন:
“আমাকে ভুলে গেছ তুমি? এ আমি বিশ্বাস করি না!
একদা তোমার কপালে পরিয়ে দিয়েছিলাম সূর্যের টিপ
তখন থেকে লোকে তোমাকে বলত টোনাটিয়ু মেয়ে!
আজ আমাকে দেখো তুমি! তোমার সামনে দণ্ডায়মান,দৃঢ়পেশি
আমার দেহবর্ণ বাদামি লাল আর দুহাতে উঁচিয়ে ধরেছি দুই
প্রস্ফুটিত পদ্ম!হে ঘোটকী রূপিনী সংজ্ঞা, সত্যি ভুলে গেছ আমাকে?”
প্রেমিকপুরুষের দৈহিক বর্ণনার সঙ্গে পৃথিবীর যাবতীয় প্রেমিকের মিল ফিরে আসে। প্রেমিক বলেছেন:
“এখন যা বলতে পারি, অথবা আগে যা বলতে পারতাম,
তুমি তা জানো?”
এই পরিচয়তো আবহমান প্রেমিকেরই। আদিকাল থেকেই চলে আসছে। কবি নতুন করে মনে করিয়ে দিয়েছেন। জার্মানিতে জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত কবি ও চিত্রকর, যিনি পরবর্তিতে সুইজারল্যান্ডীয় নাগরিক হন। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত সাহিত্যকর্মগুলির মধ্যে রয়েছে: স্টেপেনউলফ, সিদ্ধার্থ, এবং দ্য গ্লাস বিড গেম । তিনি ১৯৪৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। সেই কবি ও চিত্রকর
হারম্যান হেসে(১৮৭৭-১৯৬২) এই কারণেই বলেছিলেন:
“If I know what love is, it is because of you.” (–Hermann Hesse)
অর্থাৎ যদিও আমি জানি ভালোবাসা কী, এটা তোমার কারণেই। ‘তুমি’ বা ‘তোমার’ সর্বনামটি পৃথিবীর সমূহ প্রেমিক-প্রেমিকারই সর্বনাম। কবি এই সর্বনামে পৌরাণিক থেকে ঐতিহাসিক সর্বকালের প্রেমিকাদেরই সম্বোধন করেছেন। খুব সাধারণ বিষয় থেকে অসাধারণ বিষয়ের দিকেও আমাদের নিয়ে গেছেন। তাই লিখেছেন ভূমিধ্বসের রাতে যার কোমর জড়িয়ে ধরে নদী পেরিয়ে এসেছে। গৌতমের গৃহত্যাগের মধ্যেও এই প্রেমিক জীবিত। প্রেমিকাকে গৌতমীও ভেবেছেন। সহস্র বছর পরিভ্রমণ করে বসন্তের রাতে মোমবাতি শিখার মতোই নিভে যাবেন তবে? যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন তা কখনোই বৃথা যাবে না। যে শোণিতধারা শরীরে বহমান তা অশ্ব ও মানবের সম্মিলিত পুনরুত্থান মাত্র। এই প্রেমিকা কি তবে আম্রপালিও ছিল? প্রত্নইতিহাসেও তার অনুসন্ধান করেছেন। কবি বলেছেন:
“যতবার তোমাকে দেখেছি আর বিদায় নিয়েছি
তোমার চোখ কেঁপে উঠেছে আর তুমি
মৃত্যু ও বিচ্ছেদ আমার দিকে ছুড়ে দিয়েছ।”
তাহলে প্রেম কি শুধু বিচ্ছেদ?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত উপন্যাসিক এলিজাবেথ বার্গ(১৯৪৮) এরই উত্তর খুঁজতে গিয়ে লিখেছিলেন:”There is love in holding and there is love in letting go.”
(Elizabeth Berg, The Year of Pleasures)
অর্থাৎ ধারণ করার মধ্যে ভালোবাসা আছে এবং ছেড়ে দেওয়ার মধ্যেও ভালোবাসা আছে। সুতরাং ভালোবাসার মৃত্যু নেই। যুদ্ধ-মৃত্যু, পুরাণ-ইতিহাস, নারী-পুরুষ সব কিছুর মধ্যেই ভালোবাসা থেকে যায়। এই ভালোবাসার জন্যই কত সংঘাত চলেছে এবং আজও চলছে। বিবর্ণতা, হাহাকার, ধ্বংস এইসব পরিণতিতে পর্যবসিত করেছে। ট্রয় ধ্বংস হয়েছে এই কারণেই। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ হয়েছে। লংকা ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু সবকিছু ধ্বংস হলেও প্রেম ধ্বংস হয়নি। ঘোটকীর সাড়া পাওয়া যায়নি। মৃত্যু ও বিচ্ছেদের ভার বহন করছে আজও এই সভ্যতা। প্রেম কি তবে বর্বরতাকে জয় করতে পারেনি? নিশ্চয়ই পারেনি বলেই কবিকে লিখতে হয়েছে ‘প্রস্তরলিখিত’ কাব্য:
“সিয়েরা স্টেটন, তোমার নামের রঙ লাল। আমারও।
তুমি সমাধির এপিটাফ, আমি তাতে একের পর এক খোদাই
করে যাচ্ছি আমার অনুভূতিগুলো।
তুমি এসব কোনোদিন জানতেও পারবে না, কারণ আমি মৃত।
আজকের দুপুরটা খুব বিষণ্ন ছিল,
আর আমি হারিয়ে ফেলেছি আমার স্বপ্ন।
আমি এখন মধু আর লেবু সমেত পান করছি সবুজ চা
তুমি ক্যালিফোর্নিয়ায় বসে পান করছ বিশ্রী রকমের কালো কফি
চিনি ছাড়াই। তাতে কিছু যায় আসে না।
আমরা দুজনই মৃত্যুর সমবয়েসী। আমরা বসে আছি মুখোমুখি
আমাদের কোনোকালেই দেখা হবে না, সিয়েরা স্টেটন।”
এই সমাধির এপিটাফ খোদাই করা-ই নিয়তি হয়ে উঠেছে প্রেমিকের। দিনযাপনের বিষণ্নতা ও শূন্যতা আত্মস্থ করেই প্রাত্যহিকে মগ্ন হতে হয়েছে। চিরন্তন বিচ্ছেদ জেনেও স্মৃতির ভার বহন করে চলেছে এপিটাফ। আর্য-অনার্যের দুহিতা, মৎস্যগন্ধা, সুজাতা, সুতনুকা কত রূপেই না ঘোটকী এসেছে। আবার বেহুলা, দ্রৌপদী, জানকীর রূপেও দেখা দিয়েছে। ট্রয়সুন্দরীর নর্মসহচরী হিসেবেও বিহার করেছে। স্মৃতির ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, অস্তিত্বে শিউরে ওঠা ভাবনাকে লালন করতে করতে বহু জন্মান্তরের পথ পাড়ি দিয়েছেন। চোখের স্বচ্ছ জল থেকে জন্ম নিয়েছে পাথর। একখণ্ড হীরক উত্তপ্ত হতে হতে নক্ষত্র হয়ে খসে পড়েছে। নক্ষত্রের নিঃশ্বাস শুষে নিতে নিতে ফসিল হয়ে ঘুমিয়ে পড়ার মধ্য দিয়েই উৎসর্গ রচনা করেছেন। এই উৎসর্গ মৃত্তিকা শয্যা থেকে মিলনের পূর্ণতায় আবার জেগে উঠেছে। প্রেমের এই অনন্ত রূপ পুরুষ ইচ্ছার এই ব্যাপ্তি ‘এখন মৃগয়া’ কাব্যে ফিরে পাই:
“এই লিঙ্গমুণ্ড, আদিম দেবতা
গ্রহণ করো গ্রহণ করো বলে
পুরুষ কাঁপাচ্ছিল রক্তিম প্রদোষ!
এই যোনিচক্র, মন্দির-তোরণ
ব্রহ্মাস্ত্র নিয়ে প্রবিষ্ঠ হও বলে
নারীও উৎসুক হলো কম্পিতা!
তখন থেকে ভূমি ভেদ করে
জেগে ওঠে ফুলশয্যার গাছ।”
এই ফুলশয্যার গাছকেই পুজো করে চলেছে অনন্তকালের নারীরা। সবাই তাদের কুমারিত্ব সমর্পণ করতে চায়। কবি বারবার উল্লেখ করেছেন:
“এতটা বিষাদ ভালো লাগে না
এতটা বিষাদ ভালো লাগে না”
অবশেষে কবি পরাবাস্তবতায় পৌঁছে গেছেন এই প্রেমকে মুক্তি দিতেই। অথবা মৃত্যুতেই এই প্রেমের মুক্তি নাকি? দুঃখ ও অনুতাপে শুধুই হাহাকার বিবমিষা। প্রার্থনা অধরাই থেকে গেছে। মেসোপটেমিয়া সভ্যতার ইনান্না আকাঙ্ক্ষার ফলবতী মাটি হয়ে উঠেছে। তারমধ্যে দ্রৌপদী,সীতা অথবা সুজাতা দেখা গেলেও পাথরে উৎকীর্ণ হয়েছেন কবি নিজেই। মন্দিরগাত্রে কবির রক্ত ও আনন্দ লেগে আছে।
প্রজ্ঞাপ্রবাহ
🗣️
‘ডুমুরের গোপন ইশারা’ কাব্যেও মিথ-পুরাণে সভ্যতার প্রভাব আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। স্বর্গচ্যুত আদি মানব-মানবীর পৃথিবীতে আগমন এবং বংশবিস্তার নিয়তিবাদী পথে অগ্রসর হওয়ার কাহিনি আছে। গ্রিকপুরাণের কাহিনিতে দেখা যায় অন্ধ ইডিপাস ও আন্তিগোনির শোকার্ত ধ্বনির প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে সভ্যতায়। সময়ের পথ ধরেই তা বাহিত হয় প্রযুক্তিবিদ্যার উন্নত দেশগুলিতেও। প্রেমের গোলাপ তখন এ কে ৪৭-এ রূপ বদল করে। প্রেম ঘাতকের অস্ত্র হয়ে ওঠে। প্রেমহীন নৃশংস সভ্যতায় দেখা যায় ভ্রূণ হত্যার কর্মকাণ্ড। ‘মৃত মায়ের জরায়ুতে কান্না করছে শিশু।’ কে এই শিশুকে পৃথিবীর আলো দেখতে দিল না? কবি দেখালেন: ফ্রাঙ্কের ধারালো দাঁত, চসেস্কুর ঘোলাটে বীর্য, হিটলারের গোঁফ, বাতকো স্মাদিচের থুতু, নিয়াজির লালা সবই স্বৈরশাসকের প্রতীকী রূপ। পরবর্তীতে যেমন আরও দেখি ইজরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার। ডুমুরের গোপন ইশারায় নিয়তিতাড়িত সভ্যতায় মানবজীবনের অসহায়তাই ঘুরপাক খায় বারবার। সাম্রাজ্যবাদী অমানবিক চক্রে বারবার একই ইতিহাস আবর্তিত হতে থাকে। প্রেমকে ধ্বংস করার কৌশল চলতে থাকে। সভ্যতা তখন একটা সার্কাস। রক্তপিপাসু ছাড়া সেখানে আর কোনও চরিত্র নেই। পরাজিত মানুষের ভিড়। পুতুল হয়ে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা। কবি লিখেছেন:
“কিন্তু ওই শোনো বাতাসে কাঁপছে ফলের পক্ব বোঁটা
লোভাতুর গন্ধে জেগে উঠছে
আমার ইন্দ্রিয়গুলোর শিকড়
আর আমি দৃষ্টি ফিরে পেতে চাই”
এই দৃষ্টি ফিরে পাওয়ার মধ্যেই জগৎকে দেখার আকাঙ্ক্ষা নিহিত। ডেলফির মন্দিরে পুনঃ উচ্চারিত হবার আকাঙ্ক্ষা আবার পুনর্জন্মের আকুতি।
এই আকুতির প্রস্তুতি ‘বহুবর্ণ রক্তবীজ’ কাব্য থেকেই শুরু হয়েছিল। যে আত্মজ্ঞানের সমিধ সংগ্রহ করেছিলেন তারই পরিচয় দিয়েছেন এই কাব্যে:
“আমাকে আমি একবার বহুবার হাতের মুঠোয় নিয়েছি
আর থেঁতলেও দিয়েছি”
নিজেই নিজেকে সমিধ করে তুলেছেন। দৃশ্য-দৃশ্যান্তরে হয়েছেন শব ও গোলাপি শিশু। ঝলসানো মাংস। গোলাপের চেয়ে রাঙা প্রেমিকের রাঙা রক্ত দেখেছেন। সঙ্গম পিপাসার সঙ্গে ফিরে এসেছে বুনো মহিষের নির্জন শিঙের বিষাদ ও আনন্দ। যৌন ঝড়ে কম্পিত হয়েছেন। মৃত্তিকার মেহগনি স্তন, পাখিজন্মের ফ্রাই ইত্যাদি অবচেতনের ক্রিয়াগুলিও জেগে উঠেছে। পিঙ্গল চুলে ফেনার উত্থান থেকে হরিৎ বল্কল সবই আদি উৎসের নিভৃতে নিয়ে যায় আমাদের। কবিতার নাম হয় তখন ‘মিস্টিক’। সেখানে বর্মে ও ফলায় গাঁথা হয়েও আবার উঠে দাঁড়াতে চান:
”আমাকে টেনে তুলুক উদগিরণ নিয়ত ঠিকরে পড়া বিস্মৃতি
অতিপ্রাকৃতিক কম্পন, শোনো
ডানাঅলা প্রহরে আমি দেখি
পাখির চঞ্চুর মতো কাঁপছে একজোড়া ঠোঁট—না, না, না
মিহিন কাঠের মেধাবী জ্যোৎস্না
আর ঝরনাজল লুণ্ঠিত,ভাবি, কী গান গাও তবে ঝাউপাতা
মৃত্যু বিস্মৃত, বলো তুমি কঙ্কাল হবে না?”
এই অতিপ্রাকৃতিক কম্পন সমগ্র কাব্য জুড়ে বিরাজ করেছে যা পোস্টমডার্ন ভাবনাতেই সম্ভব। মিহিন কণ্ঠের মেধাবী জ্যোৎস্না আর আদিম উপত্যকায় জিরাফগুলো দেখা যায়। মাটির মর্ম থেকে কুয়াশা-গন্ধ মুহূর্ত উদ্ভিদ। দেহ সহজিয়া হয়ে উঠলে আত্মার গভীর থেকে গানও উঠে আসে। শরীর গলে গলে রাজহাঁস হলে ‘তাদের নিরন্তর চলা কেবল আদি উৎসের দিকে।’ পোস্টমডার্ন ভাবনা থেকেই তা জাত। জৈবিক ক্রিয়ায় রাজহাঁসগুলি মেতে উঠলে নিজের ভেতর ‘অপরিজ্ঞাত দিব্যজ্ঞানের আগুন’ লালন করেন। তাদের লাস্যে লোকায়ত নৃত্যকলা, তাদের গ্রীবায় গ্রিসের রমণীদের ঈর্ষা ও উজ্জ্বলতা, তাদের অভীপ্সায় প্রাচ্য-প্রতীচ্য জীবনের গভীরতর ধ্বনি। নিজের মধ্যে এই বৈশ্বিকচেতনা এবং সভ্যতার ব্যাপ্তিময় ঐশ্বর্যের মহিমা এভাবেই উপলব্ধ হয় কবির। শুধু মানুষই নয়, বাঘ ও চিতার সঙ্গে নিজের সাদৃশ্যও আবিষ্কার করেন। উদ্ভিদ হয়ে শরীরে চন্দনের ঘ্রাণ পান। হাড় যে মৃত্তিকা ছিল তাও টের পান। আঙুলগুলি ছিল শেকড়। ‘মৃতের গান’ লিখে কবি বুঝলেন চেতনাপ্রবাহ কীভাবে বিস্তৃত হয়েছে প্রত্নউপলব্ধিতে। তখন নিজের মনুষ্য চেতনাও ধ্বংস হয়ে গেছে:
“জোছনায় ধোঁয়াটে সবুজ বনছায়া আমাকে আবৃত করল
অন্যসব মৃতের মতন
আমি জানলাম আমি জানলাম
আমি আর মানুষ নই।”
‘মানুষ নই’ জানার পরেই তো প্রকৃতির সমূহ উপাদানেই কবির প্রজ্ঞা ফিরে গেছে। যে প্রজ্ঞা কবিকে গাছ হতে শিখিয়েছে তার উৎসমূলে যে পিতা-মাতার-ই অবদান তা ‘তাঁবুর নিচে দূতাবাস’ কাব্যের ‘দুধগাছ’ কবিতায় স্পষ্ট করেছেন:
“দুধগাছ আমার মা
না-হলে বাবা কী করে আমাদের
এই বনের ভেতর পেলে-পুষে মানুষ করলেন
নাঙ্গা সময়ের নিচে শিশুদের ভাতের জোগাড় ছিল না
জন্মেছি রোগা-পটকা আমরা ন’ ভাই-বোন
মা ছিল হাড়-জিরজিরে কিন্তু বুকভরা দুধ
আমরা ন’ ভাই-বোন স্তন চুষে স্তন্য খেয়ে
দুধের ফেনায় পুড়ে পুড়ে মা আমার ধনুক আর
শস্যের দেবী হয়ে গমখেতে সূর্যালোক হয়ে জ্বলে
ফলবতী মাটিতে বিষণ্ন লাল ফুল হয়ে ঝরে
মা আমার চিরহরিৎ, অন্নপূর্ণা; বাবা বিষগাছ-করুণ ওষধি!”
নিজের জীবনকাহিনির সঙ্গে ‘গাছ’ হয়ে ওঠার চৈতন্যলাভ খুব মরমি এবং মননশীল এক দার্শনিকের উপলব্ধিতে আমাদের পৌঁছে দেয়। এ বিষয়ে আমেরিকান উপন্যাসিক, কবি ও প্রকৃতিবিদ ওয়েন্ডেল বেরি(১৯৩৪) একটি প্রবন্ধে বলেছেন :”The care of the Earth is our most ancient and most worthy, and after all, our most pleasing responsibility.”(― Wendell Berry)
অর্থাৎ পৃথিবীর যত্ন আমাদের সবচেয়ে প্রাচীন এবং সবচেয়ে যোগ্য, এবং সর্বোপরি, আমাদের সবচেয়ে আনন্দদায়ক দায়িত্ব। এই দায়িত্বেরই সমবর্তী করে তুলেছেন আমাদেরও। সবচেয়ে প্রাচীন এবং সবচেয়ে যোগ্য এই ভাবনা যে মানবসভ্যতার সঙ্গেই যুক্ত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। জফির সেতুর কাব্যের বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই এটি একটি অবধারিত এবং উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। এই কাব্যে ‘ডুমুর’ কবিতায় দিব্যদৃষ্টি আরও প্রখর হয়ে উঠেছে। যুদ্ধবাজ, রক্তখেকো শৃঙ্গার, শীত, মজ্জাবীর্য, ক্ষুৎপিপাসা, চিৎকার সবই কবি দেখতে পেয়েছেন। ‘ডুমুর’ আসলে এই শরীর। ডুমুরের বীজগুলিই উচ্চারিত হয়েছে কবিতায়। প্রেম কবন্ধ, মৃত্যু বাদাম গাছ, মানুষের জন্য শেষ চিরকুট লিখে কবি দার্শনিক চেতনার আরও বিমোহিনী আলোকে আমাদের নিয়ে গেছেন।
প্রাণচেতনা
🗣️
‘স্যানাটোরিয়াম’ কাব্যেও ‘বিষাদবীজে’র ধূসর গাছগুলিকে মেয়েদের চোখের ভেতর দেখতে পাই। রতিযুদ্ধে বেপরোয়া ঈর্ষা আর প্রতিহিংসায় নির্বোধের বীভৎস হাসি ঝরে। যদিও ভেজাবাগানের সুগন্ধি নারী উপস্থিত হয়েছে তবু প্রেম নেই। কামের প্রগলভ বাতাবরণে ঢাকা পড়েছে যা কৃত্রিম বিলাস। শরীরে যৌনাত্মার রক্তমাখা উট। রণহিংসা ভুলে সেলুনে ঢুকেও বিষণ্ন মানুষ। বোদলেয়ারের জন্ম হয় তাদের মধ্যেই। নিৎসের চোখ দিয়ে তখন দেখতে হয় জীবনকে। র্যাঁবোর নরকের রাতে আমরা বিষণ্ন ষাঁড় হই। পরাবাস্তব ঘোড়া হয়ে কিংবা মাতাল ফুলগাছ হয়ে অন্ধউপত্যকায় পরিত্যক্ত জীবনের মুহূর্তগুলি কাটে। তুতেনখামেনের সমাধির মুখোশ, সম্রাটের কালো মমির কফিনে লেপ্টে থাকা সত্তা, শরীর থেকে বের হয় গূঢ় তেজপাতা ও লুপ্ত নাশপাতির গন্ধ। “এক লালশয়তান মেয়েটিকে হাসির বিনিময়ে কিনে ফেলে। মেয়েটি ঠিক তখনও জানে না তার যোনিগহ্বরের দিকে বৃদ্ধ গরিলা ধর্মজিজ্ঞাসার মতো ওত পেতে আছে।” নারী শরীর থেকে কামভাবনার নানা বর্ণনা একান্ত মগ্নতায় উঠে এসেছে। তবে কিছু লোকজ শব্দ ব্যবহারও এমন যা খুব সচেতনভাবে কবি তুলে ধরেছেন: “মানুষগুলো যেন বোকাচুদা, মাস্টারবেট জানে না এমনটাই সরল।” গ্রামের মানুষদের শরীর পিয়ানো হলেও রাষ্ট্রের ধারণাহীন এক একটা গাছের মতো। কিন্তু এত রঙ্ ছড়ানো ব্যস্তজীবনও নাথিংনেস্ বলেই কবি মনে করেন: “জীবন হচ্ছে গিয়ে একটা অতিকায় অশ্বডিম্ব—তাকে নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করা যায়।” এই অশ্বডিম্বের ভ্রমকেই প্রাণচেতনার প্রবৃত্তিমুখীন নানা রূপকের আড়ালে বর্ণনা করলেন।
প্রাণচেতনা বা প্রাণপ্রবাহ কখনোই নিঃশেষ হয়ে যায় না। রূপান্তরের মধ্য দিয়ে তা সঞ্চারিত হয় বিভিন্ন উপাদানে। ব্যক্তিপ্রাণ একজন হলেও তার স্রোতের বহু অন্বয় খুঁজে পাওয়া যায়। এ বিষয়ে নাইজেরিয়ার তরুণ কবি মাইকেল বাসসে জনসন(১৯৯৪) একটি কবিতায় লিখেছেন:
“In the stream of life, you row your boat alone.”
(Michael Bassey Johnson, Song of a Nature Lover)
অর্থাৎ জীবনের স্রোতে, তুমি একা তোমার নৌকা সারি। এই নৌকা এক একটি প্রাণ যা আকাঙ্ক্ষার তরণী জীবন-প্রবাহে ভাসমান। জফির সেতু এই জীবনপ্রবাহে তাঁর আকাঙ্ক্ষাগুলিকেও জারিত করেছেন। ‘সুতো দিয়ে বানানো সূর্যেরা’ কাব্য লিখেছেন:
“এবারকার গ্রীষ্ম আমার আকাঙ্ক্ষা বাড়িয়ে দিয়েছে”
গ্রীষ্ম যে ‘সু-আকৃতি ককপিটে বসা লাস্যময়ী নারী’ প্রাণচেতনার জাগরণ ঘটিয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মৃত্যুর পরও কোনও কামনারই ধ্বংস হবে না কবি তা জানেন:
“আমি জানি আমার কামনাগুলো
শেষ হবার নয়”
মৃত্যুর পর তা কবরের ঘাস হয়ে জৈবিক পল্লব হয়ে উঠবে। আকাঙ্ক্ষার তরণীগুলি জীবনস্রোতে ভাসতে ভাসতে কখনও পোতাশ্রয়ের খোঁজও করে। জীবনের সেই পোতাশ্রয় হলো নারী। কবি বলেন:
“প্রতিটি নারী এক একটি পোতাশ্রয়”
এখানেই অবস্থান করা যায়। প্রেমকে উপভোগ করা যায়। বিচ্ছেদকে যাপন করা যায়। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা যায়। আবার নীরবতাকেও উপলব্ধি করা যায়। কবি তাঁর অভিজ্ঞতায় জীবনদর্শনের অনপনেয় বার্তাগুলি এভাবেই উপস্থাপন করেছেন:
১) প্রেম অথবা বিচ্ছেদযাপন:
“প্রত্যেকটি পুরোনো প্রেম
এক-একটি মদে ভেজা রুটি”
২) নীরবতা অথবা মৃত্যুযাপন:
“তোমার স্তনের চূড়ায়
এক গভীর নীরবতা আছে”
৩) রূপান্তর অথবা প্রত্যাবর্তন:
“আমাদের মৃত সন্তানগুলো চড়ুই হয়ে ফিরে আসে”
মদেভেজা রুটির মধ্যে জৈবিক প্রবৃত্তি নিবারণের শক্তি আছে, তেমনি প্রেমের নেশাও আছে।
স্তনের চূড়া অনন্ত যৌবনের প্রতীক যাতে মোহিত হওয়া যায়, লালিত হওয়া যায়। জেগে ওঠা যায় আবার নীরবতায় মৃত্যুর কাছে পৌঁছানো যায়।
মৃতসন্তান অধরা আকাঙ্ক্ষারই প্রতিরূপ। তারা চড়ুইয়ের মধ্যে প্রত্যাবর্তন করে। অভিপ্রায় পূর্ণ করার সামর্থ্য লাভ করে। কখনও অন্যভাবেও রূপান্তরিত হয়।
প্রত্যাবর্তনচক্র
🗣️
এই প্রত্যাবর্তন বিন্যাসের উপলব্ধি কবি ছড়িয়ে দিয়েছেন ‘ময়ূর উজানে ভাসো’ কাব্যের কবিতাতেও। ‘বিম্ব থেকে প্রতিবিম্ব হয়ে ওঠা’ অদ্ভুত চক্রে জন্মের বিন্যাসকে এক গতিময়তায় দেখেছেন। এখানেও ‘তুমি’ সত্তার ভেতর সর্বময় ‘অনন্ত’-এর দর্শনই ফুটে উঠেছে। এই অনন্ত উদ্ভিদ-পাখি-আকাশ-প্রকৃতির মধ্যে স্বয়ংক্রিয় অভিযাপনের পরিচয় দেয়। কবির বর্ণনায় উঠে আসে:
“তোমার রামধনুমোড়া কোমরে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে
একটি আদিম বালক বেয়াড়া মোষ হয়ে উঠলে
লাঙলের ফাল মৃত্তিকার রক্তে ভিজে গেল
তখন তোমার ছোট্ট শরীরে শিকারির আশ্চর্য ব্যূহ
আর খাড়া দুটি স্তনে গ্রামভাঙার শব্দ
গাঢ় পরিচয়ের তুমি ঘাসের গন্ধ
ফুলের পরিচয়ে তীব্র নাচ”
দিগন্ত থেকে আশ্চর্য ব্যূহ, খাড়া স্তন এবং ঘাসের গন্ধসহ ‘অর্ধলিঙ্গ প্রেমিকাকথা’ বলেন কবি। সাপের পেটে যাওয়া মেয়েটি নিজেই সাপ হয়ে দোয়েল গিলে মৃত্যুকে চিবুতে চিবুতে অশান্ত আত্মা নিয়ে পুরুষ খোঁজে। তার সামনেই অশ্বমেধ হন কবি। post-modern ভাবনা থেকে magic-realism পর্যন্ত এক আশ্চর্য বাতাবরণ তৈরি হয়। আমাদের মনে পড়ে মন্তরঞ্জোত মাঙ্গত ‘প্লটলেস’ নামক একটি উপন্যাসে আমাদের সময়ের মানসিক এবং নৈতিক বিশৃঙ্খলাকে উদ্যমীভাবে ধারণ করে একটি সংখ্যালঘু মানুষের গল্প লিখেছেন, যে বুদ্ধিগতভাবে চটপটে, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এবং নৈতিকভাবে ভেঙে পড়েছে—তার এলোমেলো জীবন এবং একটি অস্থির জগতের বিবেকের পরিচয় আছে। সেখানে একটি কথা আছে এমন:
“The magic realist confuses love, life, letters, and location.”
(Mantaranjot Mangat, Plotless)
অর্থাৎ জাদুবাস্তব প্রেম, জীবন, চিঠি এবং অবস্থানকে বিভ্রান্ত করে। এই জাদুবাস্তবই হোক, অথবা সুরিয়ালিজমই হোক, অথবা পোস্টমডার্নিজমই হোক, কিংবা মেটাফিজিকসেরই প্রয়োগ ঘটুক না কেন, তা যে শিল্পকে একটি ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছে দিতে পারে—এখানে সেই দৃষ্টান্তই স্থাপন করেছেন জফির সেতু—যা বাংলা কবিতা জগতে এক সাহসী পদক্ষেপ। যে সনাতন ধারায় কাব্যের পাঠক ও সমালোচক অভ্যস্ত—এখানে এসে তাঁরা সেই পথকে পরিহার করতে বাধ্য হবেন। শব্দ এবং ইমেজ কীভাবে ভেঙে প্রসঙ্গচ্যুতির মধ্য দিয়ে অনেকটা বিরতি বজায় রেখেই কবি অগ্রসর হন তা পাঠক ভাবতেই পারেন না। সান্তাক্রুজের কবি ও অধ্যাপক Alberto Ríos (1952)’When There Were Ghosts’ নামে একটি কবিতার শেষ অংশে লিখেছেন:
“Smoke in the air, gum on the floor—
Those Saturday nights, we ourselves
Were the story and the stuff and the stars.
We ourselves were alive in the dance of the dream.”
এর বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় :
বাতাসে ধোঁয়া, মেঝেতে আঠা—
সেই শনিবারের রাতে, আমরা নিজেরাই।
যেখানে গল্প এবং উপাদান এবং তারা ছিল।
স্বপ্নের নাচে আমরা নিজেরাই বেঁচে ছিলাম।
কবিতাটিতে ভূত সম্পর্কে ধারণা দিলেও কবি নিজেই বলেছেন রহস্য এবং বাস্তবতার মিলিত রূপকেই তিনি এখানে প্রয়োগ করেছেন। কিন্তু কবির যে এটা নিজস্ব জীবনেরই উপলব্ধি তা তাঁর উক্তিতেই বোঝা যায়: ” Yes,I realized, drawing on my own life. Yes and easily.”
অর্থাৎ কবি সম্মতি জানিয়েছেন, তিনি বুঝতে পেরেছেন। এটা নিজের জীবনের উপরই আঁকা এবং তা সহজেই।
জফির সেতু এই রহস্যের কাছে শুধু ‘অশ্বমেধ’ হয়েই থেমে থাকেননি। চুল হয়েছে ক্ষুধার্ত বিড়াল, ছদ্মবেশে হাতে উঠে এসেছে রক্তমাখা ছুরি। নিজেই নিজের মৃতদেহ হয়ে গেছেন। জাদুবাস্তবের ভেতর সর্বদা চলেছে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি। তাই উপলব্ধির ক্ষেত্রও বিস্তৃত হয়েছে। কাঠবাদামের অনন্তরাত্রির ভেতর চাঁদের ক্ষুধার্ত চিবুকের কাছে জীবনের রোমাঞ্চমাখা, আশ্চর্য নীরবতায় ময়ূরের পাখামেলা সবই ঘটে চলেছে। সময়কে বেদানার দানার মতো মনে হয়েছে:
“টেবিলের উপর পড়ে আছে বেদানার ছড়ানো-ছিটানো দানা
আমরা ভাবছি আমাদের অসতর্ক মুহূর্তগুলো ওই ফলের মতো”
মুহূর্তরা বেদানার দানা হলেও তা ছড়ানো আছে টেবিলে, স্বাদ গ্রহণের জন্য নয়। এখানেই বিষাদ এবং এলোমেলো জীবনাচার ও ভাঙনকালেরই নির্দেশ প্রত্যয়িত হয়েছে।
বিনির্মাণ
🗣️
নব্বই দশকে এসেই বাংলা কবিতার নির্মিতি পর্বে যে পরিবর্তনগুলো সূচিত হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো বিনির্মাণ তত্ত্ব। যে শব্দগুলি এবং যে পাঠ্যগুলি যে বিষয় ও অর্থ এতদিন বহন করে আসছিল—এই সময়ে এসে তা পরিবর্তিত হতে শুরু করে। একমুখী থেকে হয় বহুমুখী প্রজ্ঞার ধারক ও বাহক। সুতরাং অর্থ ও উদ্দেশ্য পাল্টে যায়। পাঠক এবং লেখকের ব্যাখ্যায় বিস্তর ফারাক দেখা দেয়। এক পরিবর্তনশীল শিল্পকর্মের জন্ম হয়। এই বিনির্মাণ তত্ত্বের প্রধান প্রবক্তা হলেন জ্যাক দেরিদা। তাঁর লেখার মধ্যে এক জায়গায় তিনি উল্লেখ করেন: “A text is not a text unless it hides from the first comer, from the first glance, the law of its composition and the rules of its game. A text remains, moreover, forever imperceptible. Its laws and rules are not, however, harbored in the inaccessibility of a secret; it is simply that they can never be booked, in the present, into anything that could rigorously be called a perception.”
(Jacques Derrida, Dissemination)
অর্থাৎ একটি পাঠ্য শুধু একটি পাঠ্য নয়, যদি না এটি প্রথম আসা থেকে, প্রথম নজরে পড়া, এর রচনার আইন এবং এর খেলার নিয়মগুলি থেকে লুকিয়ে না থাকে।একটি পাঠ্য রয়ে গেছে, তদুপরি তা চিরকালের জন্য অদৃশ্য। যদিও এর আইন ও নিয়মগুলি গোপনের অপ্রাপ্যতায় আশ্রয় পায় না;এটা সহজভাবে যে, তাদেরকে কখনোই, বর্তমান সময়ে, এমন কিছুতে কাজে লাগানো যাবে না, যাকে কঠোরভাবে একটি উপলব্ধি বলা যেতে পারে। এই বিনির্মাণের দার্শনিক ভাবনা থেকেই জফির সেতু অগ্রসর হতে চেয়েছেন। যে প্রাচীন কাব্যগুলি একই মূল্যবোধ ধারণ করে তাদের প্রাচীনত্ব নিয়ে বিরাজ করছে, সেগুলির বিনির্মাণ করার প্রয়োজন আছে। তাই ‘আবার শবর’ কাব্যটি বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ও মধ্যযুগের বিষয়গুলিকে বিনির্মাণের আলোয় নিয়ে এলেন। সেখানে দেখতে পাই: মহুয়া, চন্দ্রাবতী, বেহুলা, বিষ্ণুপ্রিয়া, চণ্ডী, মনসা, ফুল্লরা, খুল্লনা, শুকপক্ষী, রাধাবিরহ, ফরহাদের উক্তি,জোলেখা, লাইলির প্রতি, অন্নদামঙ্গল, নবিবংশ, গোপীচন্দ্রের গান, রাধা, দেওয়ানা মদিনা, ভুসুকু, নির্বাণ, শবর ইত্যাদি নিয়ে তাদের চরিত্র, বিষয়-আশয়, উক্তি-প্রত্যুক্তিতে নতুন ভাবনা ও আকাঙ্ক্ষার প্রয়োগ ঘটালেন। ধর্মীয় বাতাবরণ ভেদ করে মানবিক ও প্রবৃত্তিমুখীন সাম্প্রতিক সময়ের উপযোগী হয়ে উঠল। তাদের চাহিদা স্বপ্ন ও জীবন যাপনে এল বর্তমানের অনুষঙ্গ। প্রাচীন খোলসকে নবীনের চাকচিক্য দিলেন। জোলেখার শেষ উক্তিতে তাই শুধু ইউসোফ নয়, সমগ্র পুরুষকেই উল্লেখ করা হলো:
“নারীর অব্যক্ত প্রেম কোনওদিন তুমি বুঝবে না নির্বোধ পুরুষ?”
জোলেখা যেন আজকের দিনেরই যে কোনও নারী।
জ্যাক দেরিদা তাঁর রচনায় আরএক জায়গায় লিখেছেন: “I always dream of a pen that would be a syringe.”
অর্থাৎ আমি সবসময় একটি কলমের স্বপ্ন দেখি যা একটি সিরিঞ্জ হবে।
এই কলম যে ইনজেকশনের সিরিঞ্জ হবে জফির সেতু এ কথা জানতেন বলেই ‘ইয়েস ইউ ব্লাডি বাস্টার্ডস’ কাব্যটির মধ্য দিয়ে তাঁর মনের ক্রোধ প্রকাশ করেছেন। সমাজের অভিজাত শ্রেণির মানুষকেই কবি এই ক্ষোভ ও ঘৃণা জানিয়েছেন। যে মানুষগুলির হৃদয় নেই, মমতা নেই, প্রেম নেই—শুধু শোষণ করার কৌশল, তাদের প্রতিই কবির প্রশ্নবাণ—
“তুমি কি একটা ব্যক্তি?
তুমি একটা গোষ্ঠী? তুমি কি একটা আদর্শ?
তুমি কি একটা চক্র?
নাকি তুমি খোদ রাষ্ট্র?
তোমার জিহ্বা আছে?
চোখ আছে দুইটা? নথ আছে?
আছে গোপনাঙ্গ? লিকলিকে শিরদাঁড়া?”
এই ‘তুমি’কে বোঝাতে কবি যে শব্দ ব্যবহার করেছেন অর্থাৎ বিশেষণ এনেছেন তাও তীব্রভাবেই নাড়া দেয়। পুরুষালি স্তন, নাভিকুণ্ড, কুঞ্চিত কালো চুল, স্ফীত বুক, কম্পিত ঠোঁট, তীব্র আঙুল, লৌহকঠিন লিঙ্গ ইত্যাদি সবগুলিই সভ্যতার ভোগাকাঙ্ক্ষার যন্ত্র। দৈহিক কামনারই প্রকাশ। এই রূপ বহুকাল থেকেই চলে আসছে সভ্যতায়। তাই সক্রেটিস, কোপার্নিকাস, ব্রুনো, গ্যালিলিও, হুমায়ুন আজাদ প্রমুখ সকলেরই স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে। কেড়ে নেওয়া হয়েছে বাঁচার অধিকারও।
এই ‘তুমি’ কারা?
কবি উত্তর দিয়েছেন: অজ্ঞাতকুলশীল, একিলিস, দূর্যোধন, তৈমুর লং, নেপোলিয়ন, মুসোলিনি, হিটলার, ইয়াহহিয়া প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। ইতিহাস-পুরাণের সড়ক বেয়ে তাঁরা চলে এসেছে যুগে যুগে। সুতরাং সেইসব ঐতিহাসিক এবং পৌরাণিক চরিত্ররাও বিনির্মিত হয়েছে বহু মানুষের মধ্যে এবং বহু শাসকের মধ্যেও। কবির কলম সিরিঞ্জ হয়ে পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক রক্তকে সাম্প্রতিকের দেহে সঞ্চারিত করেছে।
জফির সেতু যেমন বাস্তববাদী কবি, কেমন পরাবাস্তববাদী কবিও। ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক দ্রবণকে সমসাময়িক চেতনায় সার্থকভাবে প্রয়োগ করতে পেরেছেন। বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে অতিবাস্তবের রহস্যময় মহাকাশে সহজেই পাড়ি দিয়েছেন। তাই তাঁর বোধ কালোত্তীর্ণ শিল্পনৈপুণ্যের সমীহ আদায় করে নিতে পেরেছে। ক্লাসিক বিষয়কেও তিনি গীতল মূর্ছনায় বাষ্পময় করে তুলেছেন। শব্দতরঙ্গের বিন্দু বিন্দু অভিঘাতে তা মহাকাশ রচনা করেছে। সময়ের সঙ্গে আত্মক্ষরণের ব্যাপ্তিও অকপট হয়ে উঠেছে। আছে বিদ্রোহ, আছে সুষমা, আছে উত্তরণ এবং সর্বোপরি এক গতিময়তায় নিবিড় আত্মঅন্বেষণ। নব্বই দশকের বহুমুখী আলোক স্তম্ভে তিনি যে একজন দক্ষ স্থপতি তা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না।