spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদপ্রবন্ধবোধের দরজায় কান পেতে থাকা কবি মাহবুব হাসান

লিখেছেন : আবু তাহের সরফরাজ

বোধের দরজায় কান পেতে থাকা কবি মাহবুব হাসান

আবু তাহের সরফরাজ

সিস্টেমের এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকার দরকারে নানা জাতীয় অপকর্ম আমরা প্রত্যেকেই কমবেশি করে থাকি। এরই পাশাপাশি হঠাৎ হঠাৎ খুব চকিতে দু’একটা এমন কর্মও করে থাকি, যা আর সব অপকর্মের গ্লানিকে মহিমার চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়। আবার দেখা গেছে, সৃষ্টিকর্তা নির্ধারিত রীতিবদ্ধ কিছু আনুষ্ঠানিকতা আমাদেরকে পালন করতেই হয়। এতে আমাদের আত্মার ওপর থেকে কালিমা মুছে যায়। হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন, “প্রত্যেক মানব-শিশুই তার স্বভাবজাত ধর্ম নিয়ে জন্মগ্রহণ করে।” মানুষের স্বভাবজাত ধর্ম সৃষ্টিকর্তার স্বভাব থেকেই পাওয়া। জন্মের সময় মানুষের আত্মা থাকে শাদা কাগজের মতো। এরপর যত সে প্রকৃতিবিরুদ্ধ কর্মগুলো করতে থাকে, তত বেশি আত্মারূপ শাদা খাতার ওপর কালিমা পড়তে থাকে। রমজান মাস এলে সিয়াম মানে সংযম পালন এরকম একটি আনুষ্ঠানিকতা। শরীর খাবার না পেয়ে দুর্বল হয়ে ওঠে। ফলে এই সময়ে আত্মার অনুভূতি মানুষ লাভ করতে পারে। আত্মার কালিমাগুলো উপলব্ধি করতে পারে। উপলব্ধির পর অনুতপ্ত হয়ে মানুষ যেন আত্মার শুদ্ধতাচর্চা করে, সিয়াম-সাধনার আসল উদ্দেশ্য এটাই। এর মধ্য দিয়ে মানুষ যে মহিমা অর্জন করে সেই মহিমাই আসলে প্রকৃতির সন্তান হিসেবে মানুষের শক্তি।

মহিমাকে নিয়ে একমাস সাধনার পর
পুলসিরাত এসে টোকা দেয়— অত সহজ নয়,
আমি জানি,
সিয়াম শেষে চিকন বাঁকা চাঁদ দেখা দেয়
ভাবি, এই তো আঙুলে শরতের ছেঁড়া মেঘ পাড়ি দিয়ে
আমি পৌঁছে গেলাম খোলা বাজারে।

মাহবুব হাসানের ‘মহিমাগুলো’ কবিতার পঙক্তি এগুলো। অবশ্যি, আমি বলার আগেই পাঠক জেনে গেছেন যে, এগুলো কবিতার বাক্য। ‘কবিতার বাক্য’ আসলে কী রকম? এর জবাব হচ্ছে, কবিতার বাক্য কবিতার মতোই। গদ্যের বাক্য যেমন গদ্যের মতো। ওপরের লাইনগুলো ভেঙে না লিখে গদ্যের মতো পাশাপাশি রাখলে কী রকম দেখাতো? কী রকম মানে তারা প্রকাশ করতো? দেখা যাবে, বাক্যগুলো খাপছাড়া মনে হচ্ছে। যা ঠিক গদ্যের মতো নয়। কিন্তু কবিতার মতো বাক্য বিন্যাসে শব্দের ভেতর দিয়ে কিছু ইঙ্গিত টের পাবে পাঠক, যে ইঙ্গিত কবিতার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। যে শব্দগুলো বিন্যাস্ত হয়ে তৈরি হয়েছে বাক্য সেসব শব্দের ইঙ্গিত ধরতে খুব বেশি বেগ পাঠককে পেতে হয় না। তবে সেই ইঙ্গিত একরৈখিক নয়, বহুরৈখিক। গোটা রমজান মাসে মুসলমানরা সিয়াম সাধনা করে। অথচ সিয়ামের অন্তর্গত গূঢ় তাৎপর্য তারা কখনোই উপলব্ধি করে না। আল্লাহর কাছে তাদের এই সাধনা কেবলমাত্র না-খেয়ে থাকার চেয়ে বেশি কিছু নয়। কবি বলছেন, সিয়াম সাধনার একমাস পেরিয়ে গেলে পুলসিরাত এসে জানিয়ে দেয়, বাপু রে, তুমি শুধু না-খেয়েই থেকেছো, আত্মার শুদ্ধতাকে উপলব্দি করোনি। এমনকি উপলব্ধি করার চেষ্টাও করোনি। আমি তো রয়েছি তোমার সামনে। দেখি সাধ্য কি, পার হও তো আমার সাঁকো! পুলসিরাত ইসলামি আক্বিদার গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষজ্ঞ। সুতরাং, পুলসিরাতের এই আহ্বান সিয়াম পালনকারীর প্রতি কটাক্ষ নয়, উপদেশ। পুলসিরাত ও সিয়াম সাধনার প্রসঙ্গ এই কবিতায় প্রতীকী অর্থে ধরে নিলে শব্দগুলো অর্থময়তা বিস্তৃত হয়ে যায়। সেই বিস্তৃতির মূল কেন্দ্রে অবস্থান করে মহিমা শব্দটি। মাহবুব হাসানের কবিতায় এই বিষয়টি বিশেষভাবে চোখে পড়ার মতো। শব্দকে শব্দের নিজস্ব মানে থেকে বের করে এনে মাহবুব হাসান ছড়িয়ে দেন বিশেষ কয়েকটি ব্যঞ্জনায়। পাঠক তার বোধ ও রুচি অনুযায়ী ওইসব ব্যঞ্জনা উপলব্ধি করার সুযোগ পায়। কবি বলছেন, সিয়াম শেষে ঈদের চাঁদ দেখা যায়। আর, ঈদ মানেই উৎসব, খোলা বাজারের রাজনীতি, ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট। এসব অবশ্য বৃত্তের পরিধি। এর মাঝখানে স্থির নক্ষত্রের মতো অবস্থান করছে ‘মহিমা’। মানুষ যতই জাগতিক স্বার্থচক্রে ঘুরতে থাকুক না কেন, তার ভেতর আত্মারূপ মহিমা সবসময়ই অপেক্ষায় থাকে মানুষ কখন উপলব্ধি করবে তার মহিমার সৌন্দর্য। মহিমাকে এইভাবে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে মাহবুব হাসান আসলে তার কবিতাকেই সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তুলেছেন। এ ধরনের শিল্প-কুশলতা তার বেশিরভাগ কবিতাতেই চোখে পড়বে।
বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাসে সত্তর দশকটি ছিল সবচেয়ে সঙ্কটপূর্ণ সময়। একাত্তরের শেষদিকে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান গঠন করলেন নতুন দেশের সরকার। পুনর্গঠন করতে শুরু করলেন পাকিস্তানিদের ধ্বংস করে দিয়ে যাওয়া সোনার স্বদেশ। কেবল রাষ্ট্রই নয়, রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতর যা যা আছে, সবই এই সময়ে নতুনভাবে নতুন স্বপ্নের রেশ নিয়ে উজ্জীবিত হতে শুরু করলো। কবিতাও এর বাইরে ছিল না। চোখের সামনে মৃত্যুর মিছিল দেখতে দেখতে কবিসম্প্রদায় আরদশটা সাধারণ মানুষের মতোই শিহরিত। তবে কবিরা একটু বেশিই। কারণ, সাধারণ মানুষ থেকে তারা বেশি সংবেদনশীল। স্বাধীনতার পরপরই দেশের অর্থনীতিতে নেমে এলো চরম ধস। পঁচাত্তরে দেখা দিল দুর্ভিক্ষ। একমুঠো খাবারের জন্য মানুষের হাহাকার। দেশের মানুষের ভেতর এই সময়ে তৈরি হচ্ছে হতাশা আর ক্ষোভ। সত্তরের দশকটা আসলে নানা অভিঘাতে টালমাটাল একটি সময়। বোধের অতলান্তিক অবগাহন এই সময়ের কবিতায় স্বাভাবিকভাবেই তেমন একটা উঠে আসেনি। যেমনটি উঠে এসেছে প্রতিদিনের গ্লানিময় জীবনের টুকরো টুকরো ছবি। মানুষের বেঁচে থাকার দরকারে জটিল ও সঙ্কটময় যে পরিস্থিতি সে সময়ে সৃষ্টি হয়েছিল, ওই পরিস্থিতির অগ্নিবলয় কবিদেরকেও ঘিরে ছিল। গণমানুষের ক্ষোভের আগুন ঝলছে দিতো কবিতার শব্দগুচ্ছকে। আর এ কারণেই সত্তরের কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ক্ষোভের সঙ্গেই উচ্চারণ, ‘ধর্ষিতা বোনের শাড়ির আঁচল আমার জাতির পতাকা।’ এই উচ্চারণ আসলে সময়ের উচ্চারণ। যাপিত সময়কে ধারণ করে এই উচ্চারণ শিল্পের মোড়কে নিষ্পেষণের মর্মযাতনা। সংবেদনশীল সত্তা হিসেবে সমকালীন একজন কবির আত্মোপলব্ধি। কেউ কেউ বলবে, কবিতায় এসব স্লোগান কবিতার সৌন্দর্যকে ম্লান করে দেয়। আমি বলবো, তারা কবিতা বোঝে না। কবিতা সর্বগ্রাসী। কবিতা সর্বভূতে বিরাজমান। সবকিছুই কবিতা। অন্তর্জগতের গূঢ় অনুভূতি থেকে শুরু করে সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতি— সবকিছুই কবিতার শৈল্পিক নিগড়ে বাঁধা পড়তে পারে। তবে তার জন্য কবিকে জানতে হয় শিল্পকৌশল।
সত্তরের দশকের কবি মাহবুব হাসান। সমকালীন কবিদের মতোই তার কবিতাতেও সময়ের রক্তক্ষরণ স্পন্দিত হয়। তবে সেই রক্তক্ষরণ তার কবিতাকে রক্তাক্ত করেনি, করেছে ভোরের সূর্যের মতো উজ্জ্বল। কবিতার ভেতর উঁকি দিয়েছে সম্ভাবনার দীপ্তি। মাহবুব হাসান এক সাক্ষাৎকারে বলছেন, “গোটা সাতের দশকের, মুক্তিযুদ্ধের অবদান কি করে লুট হয়ে যাচ্ছে তার কিছু ছবি তো আমার কবিতায় উঠে এসেছে। সেটা ডাইরেক্ট প্রতিবাদের রাজনৈতিক স্লোগানের মতো করে নয়, কাব্যিক ব্যঞ্জনায় উঠে এসেছে। আমি কিন্তু সেই কবি যার ভেতরে আছে অসাধারণ সব উপাদান উপকরণ। আমি বুঝে কবিতা লিখি। ভাব নিয়ে লিখি না। ভাব ধরে থাকি না।” নিজের বিষয়ে এ ধরনের সোজাসাপ্টা কথা হয়তো আত্মম্ভরী। এ ধরনের ঔদ্ধত্য আজকাল অনেক চ্যাংড়া কবি-সাহিত্যিক দেখিয়ে থাকে। কিন্তু আমাদেরকে মাথায় রাখতে হবে, মাহবুব হাসান এখন বয়োঃজ্যোষ্ঠ। তার মেধা যথেষ্ট সংহত ও ঋদ্ধ। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৫০। তার কৃত সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ এরই মধ্যে স্বীকৃত। এর মধ্যে রয়েছে, বাংলা কবিতায় লোকজ উপাদান এবং মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের কবিতা। গণমাধ্যমে নানা সঙ্কট নিয়ে তিনি নিয়মিত কলাম লিখে থাকেন। ফলে, চ্যাংড়ামি তিনি অবশ্যই করবেন না। আমার বিষয়ে সবচেয়ে বেশি জানি আমি, আর কেউ তা জানে না। একথা প্রত্যেক মানুষের ক্ষেত্রেই সত্যি। মাহবুব হাসান নিজের ভেতরকার শিল্পবোধ প্রকাশ করে দিয়ে আসলে পাঠকের সুবিধেই করে দিয়েছেন। তার কবিতা ও আর সব শিল্পকর্ম বুঝতে তার মন্তব্য আমাদেরকে একটি প্রশস্ত সড়ক দেখিয়ে দেয়। শিল্পের সেই সড়কে হাঁটতে হাঁটতে আমরা এবার মিলিয়ে নিতে থাকবো নিজের সম্বন্ধে বলা তার কথাগুলোর সার্থকতা।
তিনি যে বুঝে কবিতা লেখেন তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি এই গদ্যের শুরুতেই। বলেছিলাম, কবিতার বাক্য কী রকম হয় সেই নমুনা তিনি দেখিয়েছেন ‘মহিমাগুলো’ কবিতায়। এলোমেলো কিছু শব্দ পরপর বুনে গেলে যদি কবিতার বাক্য তৈরি হতো তাহলে হরেদরে সকলেই কবিতা লিখে কবি হয়ে উঠতো। অবশ্যি আজকাল এরকম উদাহরণও আমাদের চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু কবিতার প্রকৃত পাঠক সেইসব বাক্য পড়ে ঠিকই ধরে ফেলেন, এসব মোটেও কবিতার বাক্য নয়। মাহবুব হাসান বলছেন, ‘আমি সেই কবি যার ভেতরে আছে অসাধারণ সব উপাদান।”

আমার চোখের ভেতরে কালো চক্রে ডুবে যাচ্ছে একটি কোয়েসার!
তুমি কি তারও চেয়ে শতকোটি গুণ বড়
আর কোয়েসারের চেয়েও বিপুল ভর ধরে আছ হে আমার মন?
বিস্ময় আর বিমুগ্ধ হওয়া ছাড়া তো আমাদের চিন্তার ভাঁজে কিছুই ঢুকছে না।
‘আমার চোখে কৃষ্ণচূড়া’

সক্রিয় ছায়াপথগুলোর জ্বলন্ত কেন্দ্র হচ্ছে কোয়েসার। সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল দ্বারা কোয়েসার চালিত হয়। এসব অবশ্যি জ্যোর্তিবিজ্ঞানের গলিঘুঁজি। কিন্তু কবিতায় যখন বৈজ্ঞানিক কোনো শব্দ ব্যবহৃত হয় তখন ওই শব্দের ওপর বিশেষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে হয়। কারণ, বিজ্ঞানের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা ছাড়িয়ে শব্দটি মানবীয় বোধের বিশেষ কোনো অনুভূতির প্রতীক হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে শব্দটি নতুন মাত্রা পায়। মাহবুব হাসানের অনেক কবিতায় বিজ্ঞানের শব্দের দেখা আমরা পাই। বৈজ্ঞানিক সত্যকে তিনি জীবনের সত্যের সাথে মিলিয়ে জীবনকে নতুন উপলব্ধির জায়গায় নিয়ে যান। ওপরের কবিতাংশের প্রথম বাক্যে কোয়েসার এরকম একটি শব্দ। কবি অনুভব করছেন, তার চোখের ভেতর একটি কোয়েসার ঢুকে যাচ্ছে। আমরা বুঝতে পারি, যে কোনো মানুষের জন্য এই অনুভূতি খুবই অসহ্যের। নিদারুণ। চোখ খুবই ক্ষুদ্র একটি বিন্দু। কিন্তু কোয়েসার? কত যে বৃহত্তর, তা আমাদের কল্পনায় কখনোই আসবে না। কবি বলছেন, কোয়েসারের চেয়েও আমাদের মন শতকোটি গুণ বড়। এখানে মন শব্দটির প্রতি অভিনিবেশ করা যাক। খুবই সাধারণ একটি শব্দ মন। প্রতিদিনের জীবনযাপনে এমনভাবে শব্দটি ব্যবহৃত হয় যে, মন নিয়ে আলাদাভাবে কখনো আমাদের ভেবে ওঠার অবসর হয় না। কিন্তু এখানে যখন কবি মনকে কোয়েসারের চেয়েও শতকোটি গুণ বৃহৎ বলছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে মন নিয়ে আমাদের প্রচলিত ধারণা বদলে যাচ্ছে। মন দর্শনের আলোচনার বিষয়। আর কোয়েসার বিজ্ঞানের আলোচনার বিষয়। জ্ঞানের দুটি শাখার আলোচনার একটি বিষয়কে মাহবুব হাসান সাহিত্যে একটি নতুন মাত্রা দিচ্ছেন। ফলে, মন শব্দটি প্রতিদিনের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে নিঃসীম মহাবিশ্বের মতো ব্যঞ্জনায় আমাদেরকে ভাবিয়ে তুলছে। আর এই ভাবনা থেকেই কবির সাথে সাথে আমরাও বিস্মিত হয়ে উঠি। কবির মতো আমাদের চিন্তার ভাঁজেও মনের বিস্তৃতির বিষয়ে কোনো ধারণাই জায়গা করে নিতে পারে না। সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি, মাহবুব হাসান যথার্থই বলেছেন যে, ‘আমি সেই কবি যার ভেতরে আছে অসাধারণ সব উপাদান।” এখানে একটি কবিতা থেকে একটুকরো পঙক্তি খামচি দিয়ে তুলে এনে তার কথার সত্যতা আমরা বুঝে নিতে চেষ্টা করেছি। সত্যিই যে তার ভেতর শিল্পের অসাধারণ সব উপাদান রয়েছে তা যদি আরও খুঁজতে যাই তাহলে তার যে কোনো কবিতা পাঠেই পেয়ে যাব। তিনি শিল্পের স্বতঃস্ফূর্ত জাদুকর। যখনই বোধের গহনে কোনো ইঙ্গিত তিনি পান তা ভাষায় রূপ দিতে খুব বেশি বেগ তাকে পেতে হয় না। কারণ, সেই শিল্পকৌশল তার ভেতর সবসময়েই থাকে। বোধের মরমে যা তিনি উপলব্ধি করেন তা স্বতঃস্ফূত উপায়েই কবিতার বাক্যে বিন্যাস্ত করে তোলেন। ঠিক বাবুই পাখির মতো। বাবুই পাখির বাসা বোনার শিল্পকৌশল কমবেশি আমরা সকলেই জানি। কেউ কেউ সেই বাসাও দেখেছি। এই কৌশল বাবুইয়ের ভেতর সবসময়েই থাকে। কবিতার কৃৎকৌশল যেমন থাকে মাহবুব হাসানের ভেতর।
তিনি বলছেন, “ভাব নিয়ে লিখি না। ভাব ধরে থাকি না।” তার কবিতা পড়তে পড়তে এ কথার সত্যতা হরেদরে মিলবে। আসলেই তিনি ভাবের ওপর কবিতার শব্দকে বসান না। ভাব যা থাকে তা আসলে শব্দের প্রলেপ হিসেবে থাকে। তার কবিতার ভাষায় শব্দগুলো বেশ কাট-কাট। মনোলোভা পেলব শব্দের ব্যবহার খুব বেশি চোখে পড়ে না। যা পড়ে সেসব শব্দ কাট-কাট শব্দের ভাঁজে ভাঁজে বসে পেলব আর থাকে না। পেলবতা ছাড়িয়ে শব্দগুলো দৃঢ় টানটান হয়ে ওঠে। ‘চিনি রোগীর দেশ’ কবিতা থেকে কয়েক পঙক্তি পড়া যাক:

চিনি রোগে আক্রান্ত হয়েছে দেশ
আবেশে মুগ্ধ তাই ব্যবসা বাজারের ননীখোর
এখানে বাতাস খুব ঘন
ধূলিবালি আর ধোঁয়াশায়
নিশ্বাস নেবার জন্য অপেক্ষাকৃত নেবুলাইজার ভোর
তবু খাবি খায়
উপুড় আকাশ।
পঙক্তিগুচ্ছের শব্দগুলো কাট-কাট। যা বলার, পষ্ট করেই তা বলা হচ্ছে। পষ্টভাবে বলা শব্দের ভেতরই আবার আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রতীকের চমৎকার প্রয়োগ। পাঠকের ভাবনার কিছু উপকরণ। মানে, প্রতীকের মধ্য দিয়ে কবি পাঠককে কবিতার সাথে আরও বেশি সম্পৃক্ত করে নিচ্ছেন। প্রথম ও দ্বিতীয় লাইনের শব্দগুলো কাট-কাট ভঙ্গিতে পড়ে যাওয়ার পর পাঠক একটু মোলায়েম ভাবেই তৃতীয় ও চতুর্থ লাইন পড়েন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তৃতীয় ও চতুর্থ লাইনের শব্দগুলো আগের ও পরের লাইনগুলোর ভাঁজে পড়ে কাট-কাট ভঙ্গিমা ধরে রেখেছে। ধুলোবালি আর ধোঁয়াশায় বাতাস খুব ঘন পড়ার পর পাঠক হাঁসফাঁস করতে থাকে। যেন মনে হয়, নিশ্বাসে টান পড়ছে। আবার, শেষ লাইনে উপুড় হয়ে থাকা আকাশের দৃশ্যময়তাও পাঠককে স্বস্তি দেয় না। অথচ আকাশ শব্দটা উচ্চারণের সাথে সাথেই আমাদের ভেতরটা বিস্তৃত হয়ে যায়। উদারতার ডানা পাখির মতো উড়তে থাকে। কিন্তু আকাশকে উপুড় অবস্থায় দেখে আমরা ভীত হয়ে উঠি। কেন এই প্রেক্ষাপট? তার জবাব আমরা পেয়ে যাচ্ছি প্রতীকের মাধ্যমে। ব্যবসা বাজারের ননীখোর। ননী এখানে প্রতীক। সহজভাবে আমরা ধরে নিতে পারি, মুনাফাখোর। বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করে নিজে মহাসুখে ননী খাচ্ছে, আর সাধারণ মানুষের নিশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম।
বাংলাদেশের কবিতার আলোচনায় কোনো কোনো আলোচক সত্তর দশকের কবিতাকে ‘আবেগের তারল্যে অকবিতা’ বলে চিহ্নিত করেছেন। বলেছেন যে, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত আবেগ ছাড়া ওই দশকের কবিতা শিল্প-মনস্কতায় উত্তীর্ণ নয়। কিন্তু মাহবুব হাসানের স্বীকারোক্তি, ভাব (আবেগ) নিয়ে তিনি কবিতা লেখেন না। তা যে লেখেন না তার প্রমাণ এরই মধ্যে আমরা পেয়ে গেছি তার শব্দের কাট-কাট বুনন ভঙ্গি দেখে। এই ভঙ্গি অবশ্যই সত্তর দশকের ভঙ্গি, যখন চারপাশটাতে কোমলতার খুবই অভাব। অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে মানুষ বিপর্যস্ত। ওই সময়টাতে সব মানুষর ভেতরই কাট-কাট স্বভাবটা গড়ে উঠেছিল। ফলে সেই আবহ তো কবিতায় থাকবেই। তবে সত্যি যে, সত্তর দশকের সব কবির কবিতায় এই ভঙ্গি যে আছে, তা নয়। যেমন আবিদ আজাদ ও মহাদেব সাহা। খুব ঘরোয়া, নৈসর্গিক আবহে মধ্যবিত্ত জীবনযাপনের খুটিনাটি ছাপচিত্র তাদের কবিতায় আমরা পাই। মাহবুব হাসান বলছেন, ডাইরেক্ট প্রতিবাদের রাজনৈতিক স্লোগানের মতো করে নয়, কাব্যিক ব্যঞ্জনায় প্রতিবেশ তার কবিতায় উঠে এসেছে। মিথ্যে যে তিনি বলেননি তা তার কবিতা পাঠে যে কোনো পাঠকই বুঝতে পারবে। তার কবিতার এক ধরনের ব্যঞ্জনা আছে। যেমন আছে কবিতার বাক্য। সময়ের মর্মযাতনা ধারণ করা নিশ্চয়ই অশিল্প নয়। কিন্তু তাকে শিল্পের ব্যঞ্জনা দিতে না পারলে অবশ্যই তা অশিল্প। সেক্ষেত্রে মাহবুব হাসানের কবিতাকে অশিল্প বলার সুযোগ আপাতত আমাদের হাতে নেই। শিল্প-মনস্কতা বলতে আসলে আমরা কী বুঝি? শিল্প তো জীবনেরই প্রতিরূপ। ওই রূপকে নানাভাবে নানা কৌশলে নির্মাণ করা যায়। আর শিল্পবোধ না থাকলে একজন কবি কিভাবে শব্দের ভেতর দিয়ে শিল্পবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটাবেন? তবে হ্যাঁ, এই বোধ কারো ক্ষেত্রে বেশি, কারো ক্ষেত্রে কম। আলোচকরা যে বলেন, সত্তরের কবিতায় তারল্য বেশি, এ কথা একেবারে ফেলে দেয়া যায় না। সত্তর ও আশির দশক পর্যন্ত বাংলা কবিতা প্রাঞ্জল ছিল, প্রকাশভঙ্গি ছিল পাঠকের পরিচিত। শব্দের ব্যবহারও ছিল পাঠকঘনিষ্ট। কিন্তু এরপর নব্বইয়ের দশকের কোনো কোনো কবির কবিতায় দেখা গেল খটোমটো শব্দ। শব্দ প্রাঞ্জলতা হারালো। ফলে তারল্য হারিয়ে তাদের কবিতা কাঠিন্য রূপ ধারণ করলো। আবার, নব্বইয়ের কোনো কোনো কবির কবিতা থেকে গেল প্রাঞ্জল। তারা কবিতার বহিরাঙ্গ সাজানোর চেয়ে মনোযোগ দিলেন বোধের সূক্ষ্ম নির্মিতির দিকে। কামরুজ্জামান কামু ও মাহবুব কবির এরকম কবিদের উদাহরণ।
মাহবুব হাসান কবিতার বহিরাঙ্গের সৌন্দর্য বাড়ানোর চেয়ে বোধের দরজায় কান পেতে থাকতেই বেশি আগ্রহী। কেননা সাক্ষাৎকারে তিনি বলছেন, “কবির চিন্তার রাজপথ গলিপথ আর উপগলি পথ ছাড়াও তো বিশাল স্বপ্নরাজ্য রয়ে গেছে। সৃষ্টি চেতনা সেইসব এলাকায় এক লহমায় ঘুরে আসতে পারে। ব্যবহার করতে পারে তার একটুখানি কোণা বা ঝরে পড়া উপাদান। কবির চেতনাকে সহজেই ভাষায় আটকানো যায় না। সে ক্ষমতা ভাষার নেই। আমি আমার ভাবনারাজির কিয়দংশই কেবল ভাষায় অনুবাদ করতে পারি। সেটুকুই তো আমরা বুঝতে পারি না।” তো, আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না যে, বোধের দরজায় কান পেতে যে ইঙ্গিত তিনি পান তা-ই পরম যত্নে কবিতায় তুলে আনেন। ইঙ্গিতকে ভাষায় প্রকাশের চেষ্টা করেন। যে কোনো কবিই আসলে এই চেষ্টাই করেন। যার শিল্পবোধ যত সূ² তার চেষ্টা বেশি সফল হয়, আর যার শিল্পবোধ যত স্থূল তার চেষ্টা তত বেশি ব্যর্থ হয়। মাহবুব হাসানের কবিতা পড়তে পড়তে তার শিল্পবোধের সূক্ষ্ম উপলব্ধি পাঠকেরও উপলব্ধ হবে। পাঠক বুঝতে পারবে, তার কবিতা স্বতঃস্ফূর্ত। তার কবিতা নিজের থেকেই উৎসারিত হয়ে প্রকাশ ঘটায় কবিসত্তার শিল্পবোধ। শিল্পবোধের অভিব্যক্তি নানামাত্রিক। আর তাই, তার কবিতা বিষয়-প্রকরণে, প্রকাশভঙ্গিতে, এমনকি শব্দবুননে নানামাত্রিক হয়ে ওঠে। তবে কোনো কবিতাই অকবিতা হয়ে ওঠে না। কেননা, শিল্পের মাত্রাজ্ঞান যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে মাহবুব হাসানের।

আরও পড়তে পারেন

2 COMMENTS

  1. ‘মাহবুব হাসান কবিতার বহিরাঙ্গের সৌন্দর্য বাড়ানোর চেয়ে বোধের দরজায় কান পেতে থাকতেই বেশি আগ্রহী।’ এ বাক্য যেন মাহবুব ভাইয়ের পুরা কবিতা-যাপনের ইসেন্সকে আমাদের সামনে তুলে ধরলো। সুন্দর, পরিশ্রমী, স্মার্ট আলোচনা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ