টুটুল রহমান
ব্যাপারটা খুবই তাজ্জব। নেতা বলছেন এক রকম আর মাইকে শোনা যাচ্ছে অন্য রকম। সমাবেশে উপস্থিত লোকজন এর ওর দিকে তাকায়। লিডার কি পাগল হয়ে গেলো? কথাটা ততক্ষণে লিডারের কানেও তুলে দিয়েছে এক পাতিনেতা। ‘লিডার কি কচ্ছেন এসব। বলছেন, তোগেরে ভোট দেয়া লাগবেন না। তোরা সব বোকাচোঁদা। বাইনচোৎ, বাড়িত চইলে যা। মুড়ি খা। রাতেই ভোটের সব কাম করে রাখবানে আমার পোলাপান। যা শালারা বাড়িত যা?
লিডার তো অবাক। ‘আমি কি তাই বলতিছি নাকি? ও কথা কখন কলাম। আমি তো বল্লাম তোরা নিজের ভোটটা নিজে দিবি। রাইতদিন মাঠে থাকবি। ইলেকশনের সময় বাড়িত থাকলিতো হবেন না। মাঠে থাক। চা খা। কেন্দ্র পাহাড়া দেয়া লাগবেনে। আল্লা আল্লা তালিতে সব্বনাশরে।’
ততক্ষণে সমাবেশে হুলুস্থ’ল বেঁধে গেছে। তিনবারের পরপর নির্বাচিত চেয়ারম্যান। একটা ইলেকশন নয় বাদ দিলাম। আগের দুইটায় তো তাকে ভোট করেই জিততে হয়েছে। আজ এই ভরা জনসভায় উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী সাবেক তিনবারের চেয়ারম্যান বলে কি? ভোট দেয়া লাগবে না। বাড়িতে চলে যাও। গালমন্দ করছে। তার মাথা কি খারাপ হয়ে গেলো?
চেয়ারম্যানের মাথা কি আসলেই খারাপ হয়ে গেলো? জনগনকে সুন্দর-সুন্দর শব্দে সম্মোধন করছে আর মুখ দিয়ে বের হচ্ছে কি সব বিশ্রি শব্দ। লোকে শোনে আর হাতে মুখ ঢাকে। কপাল চাপড়ায়। চেয়ারম্যানকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। এভাবে চলতে থাকলে তো গুনে গুনে ভোট পাবে তিনটা।
সবাই খুব চিন্তিত হয়ে পড়লো। নেতা নিজেও। এখন তো ঘরে গিয়ে বউয়ের সাথে কথা বলতে ভয় পায়। ছেলেটা বিদেশে পড়ালেখা করে। সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপাড় থেকে ইন্টারনেটে কল করে, ভিডিও কল। তার তো মুখ খোলা দূরে থাক, মুখ দেখাতেও এখন ভয় লাগে। আবার মুখের কথা উল্টে যায়। ভাবে, আল্লাহ না জানি আবার কি ঘটাও। চেহারাটাও কি আবার উল্টায়ে দেখাবা নাকি?
লিডারের তখন খুব খারাপ অবস্থা। বাড়িতে পানি চাইতে ‘মুত’ চায় এই শংকায় নিজের মধ্যে ঢুকে থাকে। মুখে আওয়াজ করে না।
হাজার হাজার মানুষ, ভোটার সবার থেকে বিচ্ছিন্ন আর নিরব-নি:সঙ্গ হতে থাকে। মিটিংয়ে জনতার জন সমুদ্র- বিরানভূমিতে পরিণত হয়। দু‘একটা গরু-বাছুর, ছাগল ভেড়া ঘাস,পাতা খুঁজে বেড়ায় সেই মাঠে।
সময় তো বসে থাকে না। নির্বাচনের দিন উপস্থিত। লিডারের শরীর ভালো না সেটা সবাই জানে। লোকে তাকে মাঠেও দেখে কম। কদাচিৎ বের হলে কথাও বলেন না। ডাক্তারের নিষেধ। লোকে বোঝে। ভোটের সময় নানা টেনশন লিডারের মাথায়। লিডার নিজের মধ্যে ঘাপটি মেরে নির্বাচনের কৌশল নিয়ে ভাবছে।
ইতিমধ্যে চাউড় হয়ে গেছে, লিডারের নাকি ঘুমটুম কম হওয়ার কারণে মানসিক ব্যাধি ধরেছে। কথা উল্টো-পাল্টা হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তার তাকে রেস্টে থাকতে বলেছে। রেস্ট কি আর হয় রে। ভোটের সময়। লোকজনকে তো সালাম আদাব দিতে হয়। বুকে জড়িয়ে ধরতে হয়। রাস্তার মানুষের মুখের গন্ধ, বিড়ির গন্ধ, পানের গন্ধ, ঘামের বটকা গন্ধ হজম করতে হয়। বাড়ি এসে না হয় সেভলন নিয়ে ঘষে-ঘষে ধুঁয়ে ফেলবে হাত। ভোটের আগে তো মানুষের কাছে যাওয়া চাই।
কিন্তু এবার তো তা পারছে না। মুখ থেকে উল্টা কথা বের হওয়ার অদ্ভুত অসুখ হয়েছে তার। ভয়ে আছে মানুষ তাকে কি চেহারায় দেখছে। তাকে কুকুর বেড়াল আর শেয়ালের মতো লাগছে না তো? এই নির্বাক, শংকা আর সাপের মতো কুন্ডলী পাকানো অনুভূতি নিয়ে লিডার মানুষের কাছে যায়। কথা বলতে পারে না। মুচকি হাসে। হাতের ইশারায় সালাম-কালাম দেয়। অসুখ উপেক্ষা করে হাঁটে। মসজিদে মোনাজাত ধরে। মন্দিরে ঢোলে বারি দেয়। ভাবে কথা না বলুক। এতেই চলবে।
লিডারের এই রহস্যজনক আচরণে লোকজন বিরক্ত। নাহ। এবার আর ভোট দেয়া হবেন না। আর যেভাবে ভোট হচ্ছে দিয়েই বা লাভ কি? কার ভোট কে দিচ্ছে তার কি ঠিক আছে?
তবু ভোট হলো। লিডার ৮৫ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতলো। লিডার শুনলো ভোটের রেজাল্ট। তবুও তার মুখ ভার। তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলো, বানচোৎ জনগন এতো ভোট দিছে আমাক? কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার বা তাজ্জব কান্ড। সমবেত সবাই শুনলো লিডার এই অভূতপূর্ব বিজয়ের জন্য জনগনকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন।