spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদবই নিয়েমধুসূদনের ইংরেজি কবিতা

লিখেছেন : ড. ফজলুল হক তুহিন

মধুসূদনের ইংরেজি কবিতা

ড. ফজলুল হক তুহিন

ঊনিশ শতক বঙ্গীয় সমাজ-রাজনীতি ও শিল্প-সাহিত্যের জন্যে পুনর্জন্মের কাল হিসেবে ধরা হয়। বাঙালির মনন ও সৃজন জগতে, বিশেষত শিল্প-সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় উপবিপ্লব ঘটে এই সময়ে। সমাজের বড় অংশের কোন পরিবর্তন ছাড়াই বুদ্ধিজীবী শ্রেণী একে নবজাগৃতি বা রেনেসাঁসরূপে চিহ্নিত করে তৃপ্তি পান। রেনেসাঁসের প্রকৃত ধর্ম সমাজে দৃশ্যমান না হলেও বাংলা সাহিত্য সবচেয়ে বেশি সৃষ্টিশীলতায় মুখর হয়ে ওঠে এই শতকে। পাশ্চাত্য ভাবনা, দর্শন ও সাহিত্যাদর্শ এ সময়ে বাঙালি লেখকের কাছে হয়ে ওঠে অনুসরণীয়। একে আয়ত্ত করেই আধুনিক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর বাঙালি তরুণ কবি-শিল্পী। পরাধীন ভারতে বৃটিশ শাসকগোষ্ঠীর সাহিত্যই আদর্শরূপে গৃহীত হয়। মধুসূদন সেই নবজাগৃতির মানস সন্তান-মিল্টন হবার স্বপ্নে বিভোর প্রত্যাগত কবিপুরুষ। ইয়ং বেঙ্গলের অন্যতম সদস্য-যারা বাঙালি পরিচয়-সংস্কৃতিকে ঘৃণা করতেন। মধুসূদন তাই মাতৃভাষা বাংলাতে কবিতা না লিখে লিখেছেন স্বপ্নের ভাষা ইংরেজিতে। তাঁর ধ্যান-জ্ঞান-চিন্তা-প্রকাশ সবকিছুই সম্পন্ন হয়েছে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যাদর্শে। তার কবিজীবনের সূচনা হয়েছে তারুণ্যে উচ্ছ্বল ও উজ্জ্বল কবিতা সৃজনের মধ্য দিয়ে;  সেইসব কবিতা সৃষ্টি করেন ইংরেজিতেই। নারীপ্রেম, যৌবনের চঞ্চলতা, হাহাকার অনুরাগ, ব্যর্থতা ইত্যাদি ভাবনাচেতনা সেইসব কবিতায় প্রতিফলিত। 

ব্যক্তিজীবনের মতো কবিতায়ও কবি বিপ্লবী ও দুঃসাহসী। তারুণ্যের সেই পঙক্তিমালা ঊনিশ শতকের বঙ্গীয় চিন্তাচেতনায় এক ধরনের বিপ্লব বলতে হবে।  কেননা বাঙালির সমাজমানস ও সাহিত্যচর্চা তখন পর্যন্ত ঈশ্বর গুপ্তের মত-মেজাজ কাটিয়ে ওঠেনি। তাই ঐতিহাসিক দায়বোধ, সঙ্গে সঙ্গে শৈল্পিক বিচার প্রভৃতি দিক দিয়ে মধুসূদনের ইংরেজি কবিতার তাৎপর্য নিশ্চয় আছে। এক কথায়, বঙ্গীয় নবজাগৃতিকারে ইয়ং বেঙ্গলের একজন সদস্যের সৃজনকর্ম হিসেবে তা মূল্যবান। মধুসূদন সত্যিকার অর্থে ‘মধুসূদন’ হয়ে ওঠার সূচনাপর্বে কবিতার আবাদে কতটা সফল-বিফল তা জেনে নেয়া বাংলা কবিতার পাঠক মাত্রেরই প্রয়োজন। ছন্দ, মহাকাব্য, সনেট, নাটক ইত্যাদি ক্ষেত্রে মধুসূদনের যে কৃতিত্ব ও নতুনত্ব, সে সম্পর্কে বাঙালি পাঠক অবগত। তিনি যে বাংলা সাহিত্যে প্রথম আধুনিক কবি, তাও সবারই জানা। কিন্তু তাঁর ইংরেজি কবিতার খোঁজ বা পরিচয় এতদিন পর্যন্ত  কেউ আমাদের সামনে উপস্থাপন করেননি, সে সম্পর্কে কিছু আলোচনাও করেননি– সেটা ভাবতেই ভীষণ কষ্ট হয়। নোবেল বিজয়ী বা খ্যাতিমান পরিচয়ের  লেখকদের গাদা গাদা সাহিত্য  প্রতি বছর বাংলা ভাষায় অনুবাদ হয় কিন্তু বাংলাভাষার প্রথম আধুনিক কবির ইংরেজি কবিতার বাংলা অনুবাদ কেন করেননি, এই প্রশ্নের উত্তর মনে হয় আমাদের জাতিসত্তার হীনমন্যতার মাঝে ক্রিয়াশীল। সুখবর বলতে হয় সেই হীনমন্যতা ও লজ্জার অবসান ঘটিয়েছেন কবি ও অনুবাদক সায়ীদ আবুবকর। ভূমিকায় তিনিও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন এতদিন অনুবাদ না হওয়ায়। কপোতাক্ষ নদের পাড়ে বাড়ি এবং ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হওয়ায় তিনি সেইসব কবিতার বাংলা অনুবাদে অনুরাগের কথা জানিয়েছেন।

মধুসূদনের সমস্ত ইংরেজি কবিতার বাংলা অনুবাদক হিসেবে তিনি অবশ্যই কৃতিত্বের দাবিদার। একটা ভীষণ দরকারী ও ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন, দায়শোধ এই কাজের মাধ্যমে। এই অনুবাদকর্মে বেশ কিছু বিশেষত্ব লক্ষণীয়।  যেমন: ক. মধুসূদনের নিজস্ব কাব্যভাষায় অনূদিত হওয়ায় কবিতাপাঠে মধু-কাব্যের নতুন স্বাদের অনুভব খ. ছন্দ ও অন্ত্যমিলের বিন্যাসসহ অনুবাদ, গ. মূলভাবের অনুসরণ, ঘ. কোনরকম বিকৃতি বা পরিবর্তন না ঘটা, ঙ. মূল কবিতার আবেগ, স্পন্দন, তারুণ্য ও ভাবের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। কবিতার অনুবাদে এতসব গুণের উপস্থিতি মানে তাকে সফল অনুবাদ বলা যায় অনায়াসে। এই কাজটি সম্পন্ন হবার ফলে বাংলাভাষী পাঠক সমাজ মধুসূদনকে আবারো নতুনভাবে জানতে, বুঝতে ও চিনতে পারবে। কারণ তরুণ কবি মধুসূদন যে পরিণত মহাকবির কাছে ধূসর বা ফেলনা নয় তা প্রমাণিত হবে, তার মূল্যায়নে নতুন মাত্রা যুক্ত হবে। আমরা ওমর খৈয়ামের কবিতার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি নজরুলের সফল অনুবাদের মাধ্যমে। বোদলেয়ারকে চিনতে পেরেছি বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে, নাজিম হিকমতকে আপন করে নিয়েছি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদে, শামসুর রাহমানের অনুবাদে উপলব্ধি করেছি রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা। অর্থাৎ বিদেশি কবিদের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা হয়েছে অনুবাদের মাধ্যমে। কিন্তু প্রত্যাগত বঙ্গজ সন্তান মধূসূদনের ইংরেজি কবিতার বাংলা অনুবাদে আমরা এই প্রথম নতুন স্বাদ পাবো, তিনি মৃত্যুর এতকাল পরেও আবারো আমাদের এই উপহার দেয়ায় আমরা আনন্দিত ও পুলকিত। কবিতার অনুবাদ কবিরা করলেই সফল হবার সম্ভাবনা থাকে। আমার বিবেচনায় মধুসূদনের ইংরেজি কবিতার বাংলা তরজমার ক্ষেত্রে কবি সায়ীদ আবুবকর সফল হয়েছেন নিজ কাব্যগুণ, পরিশ্রম ও মেধার সমন্বয়ে। বাংলাভাষী পাঠকের পক্ষ থেকে তাকে অভিনন্দন। বইটির বহুল প্রচার কামনা করছি। 

মধুসূদনের ইংরেজি কবিতা।। সায়ীদ আবুবকর অনূদিত প্রকাশক: ভূমিকা, ঢাকা ২১ শে বইমেলা ২০০৯ মূল্য: ৭০ টাকা

মধুসূদনের ইংরেজি সনেট।। অনুবাদ ও ভূমিকা: সায়ীদ আবুবকর।। প্রকাশক: কবিতীর্থ ৫০/৩, কবিতীর্থ সরণি, কলকাতা-২৩ প্রথম প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ২০২৩

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

পথিক মোস্তফা on সাক্ষাৎকার : নয়ন আহমেদ
সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা