শাহিদ হাসান
তিনি ঐতিহ্যগত ধারায় আধুনিকতা সূত্র প্রয়োগ করে গ্রন্থের প্রবন্ধগুলো উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু এ আধুনিকতার উপাদান, উপকরণ ও প্রকরণ কৌশল সম্পূর্ণরূপে দেশজ। তিনি অতীত ও বর্তমানকে দেশজ আধুনিকতার সূত্রে ব্যাখ্যা করেছেন। উদাহরণ হিশেবে বলা যায় আফ্রিকা ও ল্যাতিন আমেরিকার আধুনিকতার সঙ্গে ইউরোপের আধুনিকতা এক নয়। অনুরূপভাবে বাংলাদেশের আধুনিক প্রক্রিয়ার সাথে অন্য দেশে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিও এক নয়। এদেশে আধুনিকতার বিন্যাস নিজেদের মাটিজাত এবং সর্বোপরি এ অঞ্চলীয়।
মাঈন উদ্দিন জাহেদ গত শতাব্দীর নব্বই দশকে কবিতা ও প্রবন্ধ লেখা শুরু করেন। কবিতা রচনার প্রতি অদম্য আগ্রহী থাকাতে দিনের পর দিন কবিতার সংখ্যা বাড়তে থাকে। এ প্রেক্ষিতে ২০০৫ সালে ‘সেপ্টেম্বরের ইল্শে রোদ ঘিরে বিষ্টি’, ২০১৭ সালে ‘নিখিলেশ কেমন আছো’ এবং ২০১৯ সালে ‘অলৌকিক প্রণোদনা’ নামে তার তিনটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
২০২৩ সালে অমর ২১ বই মেলায় প্রকাশিত হয়েছে সব্যসাচী লেখক আবদুল মান্নান সৈয়দকে উৎসর্গকৃত মাঈন উদ্দিন জাহেদের প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থ ‘মনন মৌমাছি’। মাঈন উদ্দিন জাহেদ মূলত কবি হলেও সমানতালে সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ রচনা করেছেন। রচনাকৃত প্রবন্ধ থেকে ১২টি প্রবন্ধ নিয়ে আলোচ্য গ্রন্থটি সাজিয়েছেন।
গ্রন্থভুক্ত প্রবন্ধগুলো হচ্ছে ‘সৈয়দ আলী আহসানের কবিতা : শব্দের কারুভাষ্যথ, ‘ড. কাজী দীন মুহম্মদ : সূর্যকরোজ্জ্বল দিন, ‘আল মাহমুদ : কুহলি পাখির পিছু পিছু, শিল্প এস এম সুলতান : আপন আলোয় অনন্য’, ‘আবদুল মান্নান সৈয়দ : আত্মস্মৃতি ও ব্যক্তিগত, ‘বহুমাত্রিক ড. মনিরুজ্জামান এবং তাঁর ভাষাকেন্দ্রিক ভাবনাগুচ্ছ, ময়ুখ চৌধুরী: ‘প্যারিসের নীল রুটি ‘ ও অনুধাবনা, ‘অ্যাংলো খ্রিস্টান আখ্যান কিংবা ‘ফুটোর ভেতর পৃথিবী, ‘সুসমাচার : মিথের পুনঃনির্মাণ কিংবা কবিতা ফিউশন; মাকে নিয়ে চিরায়ত উপন্যাস ইত্যাদি।
‘মনন মৌমাছি’ প্রবন্ধগ্রন্থের শুরুতে পাঠকের সমীপে প্রবন্ধকার একটি কৈফিয়ত উপস্থাপন করেছেন ‘শিল্পের দায় ছাড়া সমাজ ও রাজনীতির বেনোজলে সাহিত্যচর্চায় আগ্রহী ছিলাম না বলে জনপ্রিয় সাহিত্যধারায় গা ভাসাইনি। এখানে প্রাবন্ধিক মাঈন উদ্দিন জাহেদ তার চিন্তন প্রক্রিয়াটি পরিষ্কার করেছেন যে, সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতির প্রতি দায় বোধ থেকে তিনি সাহিত্যচর্চায় আগ্রহী হয়েছেন। এর সারাংশটি হচ্ছে ‘শিল্পের জন্য শিল্প নয়, জনগণের জন্য শিল্প।’ জনগণের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রতিচ্ছবির নির্যাসটুকু সাহিত্যের জন্য অপরিহার্য।
সাহিত্য বিশ্লেষণে বিভিন্ন ধারা রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম- ১. ঐতিহ্যিক বা ঐতিহ্যগত ধারা, ২. আধুনিক ও বিজ্ঞান মনস্ক ধারা এবং ৩. তুলনামূলক সাহিত্যের আধুনিক ও বিজ্ঞান মনস্ক ধারা।
এ গ্রন্থে প্রবন্ধকার আলোচনার জন্য বেছে নিয়েছেন ঐতিহ্যিক বা ঐতিহ্যগত ধারাটি। ঐতিহ্যগত ধারার সূত্র হচ্ছে, আলোচ্য লেখকের রচনা কালের সঙ্গে তার অতীতকালের চিন্তার প্রক্রিয়ার সমন্বয় সাধন করে নিজে পথ খুঁজে বের করা। যে কোনো লেখকের রচনাকালে বা উত্থানকালে দুটি ধারা চলমান থাকে, প্রচলিত ধারা বা প্রথাগত ধারা যা দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। অন্যটি প্রচলিত ধারার সম্পূর্ণ বিপরীতে অগ্রগামী ধারা যা লেখকের সমকালে সংগঠিত। প্রবন্ধকার মাঈন উদ্দিন জাহেদ ‘মনন মৌমাছি’ প্রবন্ধগ্রন্থে উপস্থাপিত লেখকদের রচনা সমূহ ঐতিহ্যগত ধারায় বিশ্লেষণ করেছেন। এবার প্রবন্ধকারের উপস্থাপিত প্রবন্ধের বিশ্লেষণের কটি ধারা উদাহরণ হিশেবে দেয়া যাক–
১. ‘আল মাহমুদের কবিতায় চিরকালের অনন্য চরিত্র হচ্ছে তাঁর দেশজতা, মাটি ও মানুষ এক সাথে যূথবদ্ধ সমন্বয় সাধন।’[আল মাহমুদ : কুহলি পাখির পিছু পিছু, মনন মৌমাছি, পৃ.৩৫]
২. ‘সৈয়দ আলী আহসান কবিতার শব্দের তাৎপর্যেক বাংলা কবিতার সময়ের গ্রাহ্য দাবিতে বিকশিত করতে প্রাণিত করেছেন। তাই তাঁর উচ্চারণ, আধুনিককালে বিশিষ্টতা হচ্ছে শব্দের সম্ভাবনাকে সম্প্রসারিত করা, তার ঐতিহ্য সন্ধান করা, তার বর্তমান পরিসরকে আবিষ্কার করা এবং তার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সম্পর্কে কৌতূহল জাগ্রত করা, কেননা শিল্পী এখন আর বস্তুপুঞ্জের সমষ্টিকে গ্রহণ করছেন না অথবা কোনো গোত্র-প্রকৃতির সাধারণ পরিচয় দিচ্ছে না। [সৈয়দ আলী আহসানের কবিতা : শব্দের কারুভাষা, মনন মৌমাছি পৃ. ১১]
৩. ‘মূলত শিল্পী সুলতান ইচ্ছাকৃতভাবে বাস্তবকে ঠেলে কল্পনাকে সামনে আনতে চেয়েছেন। তাঁর মাঝে এক ধরনের রোমান্টিক আদর্শবাদ প্রাণিত হয়েছিল। তাই তাঁকে সম্পূর্ণভাবে বাস্তববাদী শিল্পীও বলা যায় না।থ [ শিল্পী এস এম সুলতান : আপন আলোয় অনন্য; ঐ. পৃ.৩৯)–প্রবন্ধকারের উল্লেখিত মন্তব্যগুলো পাঠ থেকে সহজে বোঝা যায়, তিনি ঐতিহ্যগত ধারায় আধুনিকতা সূত্র প্রয়োগ করে গ্রন্থের প্রবন্ধগুলো উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু এ আধুনিকতার উপাদান, উপকরণ ও প্রকরণ কৌশল সম্পূর্ণরূপে দেশজ। তিনি অতীত ও বর্তমানকে দেশজ আধুনিকতার সূত্রে ব্যাখ্যা করেছে। উদাহরণ হিশেবে বলা যায় আফ্রিকা ও ল্যাতিন আমেরিকার আধুনিকতার সঙ্গে ইউরোপের আধুনিকতা এক নয়। অনুরূপভাবে বাংলাদেশের আধুনিক প্রক্রিয়ার সাথে অন্য দেশে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিও এক নয়। এদেশে আধুনিকতার বিন্যাস নিজেদের মাটিজাত এবং সর্বোপরি এ অঞ্চলীয়। প্রবন্ধকার মাঈন উদ্দিন জাহেদ উল্লেখিত প্রক্রিয়ায় বিশ্লেষণ করেছেন। ‘মনন মৌমাছি’ গ্রন্থটি তরুণ লেখকদের লেখালেখির ক্ষেত্রে সহায়ক হিশেবে কাজ করবে। দ্বিমত প্রকাশনা থেকে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে। এর প্রচ্ছদ এঁকেছেন প্রবন্ধকারে বড় ভাই বিখ্যাত শিল্পী মোমিন উদ্দীন খালেদ। আশা করি বইটি সাহিত্যপ্রেমী পাঠকের কাছে সমাদৃত হবে।
শাহিদ হাসান : কবি-কথাশিল্পী-শিল্প সমালোচক। সহকারী সম্পাদক, দৈনিক পূর্বকোণ । চট্টগ্রাম।