আমান আব্দুহু
কেউ কেউ বলতেছে, “আইনী বাধ্যবাধকতা”র কারণে। যদি তাই হয়, তাহলে বাংলাদেশের আইনী বাধ্যবাধকতা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে অশ্লীল ও নোংরা শব্দবন্ধ। মাহমুদুর রহমানের সমস্যা হলো তার মেরুদন্ড বাঙুদের মতো নমনীয় না। বাংলাদের সাথে মানানসই না। একটু ঘাড়ত্যাড়া লোক। ইচ্ছা করলে এবং তদবির করলেই দেশটির আইনী বাধ্যবাধকতা সরে যেতো। এই গোলামদের দেশে গোলামপন্থার সাথে মানিয়ে না চললে এবং ভিক্ষাবৃত্তিতে গৌরব খুঁজে না পেলে, নিজের মতো করে স্বাধীনভাবে থাকা অসম্ভব।
মাহমুদুর রহমানকে জেলে যেতে হওয়ার মাধ্যমে বরং বুঝা যায় বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসলে কারা আছে। গোলামদের দেশে বড় ভাই ভারতের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে সমস্যায় পড়তে হবেই। হাসিনা পালিয়েছে, কিন্তু তাই বলে গোলামরা বদলে যায় নাই। বায়ান্ন বছরের অভ্যাস কি এতো সহজে বদলায়?
২
একাত্তরে পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর ভারতীয় সেনাবাহিনীর লুটপাটের বিরোধীতা করায়, মতান্তরে তৎকালীন সরকারী কর্মকর্তার ভাষ্য অনুযায়ী নিজেই নৈরাজ্য শুরু করায়, মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলকে স্বাধীন বাংলাদেশে গ্রেফতার করা হয়েছিলো। সেই ঘটনার খেদে মেজর জলিল লিখেছিলেন, “আমার সাধের বাংলাদেশে আমিই প্রথম রাজবন্দী।” মাহমুদুর রহমানের জেলে যাওয়ার ঘটনাকে সেই ঘটনার সাথে কিছু দিক থেকে তুলনা করা যায়। হাসিনার ফ্যাসিবাদ-উত্তর বাংলাদেশে হাসিনাবিরোধীদের মাঝে প্রথম গ্রেফতার হলেন বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সবার আগে আওয়াজ তোলা মানুষটি।
কয়েকদিন আগেও এক ভিডিও আলোচনায় মাহমুদুর রহমান বলেছিলেন আপাতত বাংলাদেশে যাওয়ার পরিকল্পনা নেই। ওখানে দেখেছিলাম অন্য আলোচকরা তাকে বাংলাদেশে যেতে বলছিলো। কিন্তু তার এমন কোন পরিকল্পনা ছিলো না। কিন্তু তারপরও কেন গেলেন? কারণ তার অনেক বয়স্কা বৃদ্ধা মা সিরিয়াস অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। একমাত্র সন্তান হিসেবে তাই দ্রুত বাংলাদেশে গেলেন। তারপরও তার মায়ের পাশে থাকার এবং সময় কাটানোর সুযোগ না দিয়ে ইউনুস-নজরুল-ওয়াকার সরকার তাকে কারাগারে পাঠালো।
মাহমুদুর রহমান জানতেন আইনী প্রক্রিয়ায় গেলে তাকে জেলে যেতে হবে। কারণ তার নামে শেখ মুজিবের নাতিকে হত্যার তথাকথিত ষড়যন্ত্রের মামলায় কারাদন্ডের রায় আছে। কিন্তু তিনি কোন প্রেফারেনশিয়াল ট্রিটমেন্ট চান নাই। এমন অবস্থায় যে কোন সাধারণ মানুষের যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করার কথা, তিনি সে প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছেন। বরং উনি চাইলে আরো অনেক বড় বড় মানুষদের মতো আদালতকে এড়িয়ে নিজের মতো স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতে পারতেন এখন। কিন্তু তাও তিনি করেন নাই। এজন্যই তাকে নিয়ে আমাদেরকে কথা বলতে হবে।
তারপর এখন এলএলবি পাশ করা কিছু ছোকরা এসে আমাদেরকে আইন গাইন ফা ক্বাফ এরকম অনেক হরফ শেখাবে। আমি আপনি বেশিরভাগ মানুষই আইনের ছাত্র না। কিন্তু বাংলাদেশে আইন কিভাবে চলে এবং কিভাবে তার বাস্তবায়ন হয় তা আমরা সবাই খুব ভালোভাবেই জানি। ব্যক্তি মাহমুদুর রহমানের ভূমিকা এবং অবদানের কারণে রাষ্ট্রের উচিত ছিলো তাকে প্রেফারেনশিয়াল ট্রিটমেন্ট দেয়া। মাহমুদুর রহমানের কাছে বাংলাদেশের মানুষের ঋণের পরিমাণ এরচেয়ে বেশি। সরকার এই প্রেফারেনশিয়াল ট্রিটমেন্ট বেগম খালেদা জিয়াকে দিয়েছে। উপদেষ্টা আদিলুরকেও দিয়েছে। মাহমুদুর রহমানকে কেন দেবে না?
কারণ মাহমুদুর রহমানকে নিয়ে আসিফ নজরুলদের অস্বস্তি আছে। অধিকতার উচ্চতার মানুষদেরকে ছোটখাটো মানুষরা এড়িয়ে চলে। ভাড়তীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে মাহমুদুর রহমানের যে অবস্থান, তাকে একোমোডেট করার মতো পরিসর বাঙু প্রগতিশীলদের মগজে কোনকালেই নেই।
ব্যক্তি মাহমুদুর রহমানের তেমন অসুবিধা হবে না হাসিনা-উত্তর বাংলাদেশে। হয়তো দ্রুতই জামিন পাবেন। কিন্তু এই গ্রেফতারের ঘটনায় বাংলাদেশের মানুষদের জন্য বড় একটা অশনি সংকেত আছে। চোখে আঙ্গুল দিয়ে পরিস্কার বুঝানো হচ্ছে, বাংলাদেশে আইন আগে যেমন “নিজের গতিতে চলতো”, এখনও তেমন “নিজের গতিতে চলবে”। আইনের নেপথ্যে অধিকার ও নায্যতার যে দার্শনিক ভিত্তি থাকার কথা, এলএলবি উকিল যা চিন্তা করার সামর্থ্য রাখে না, সেই চিন্তার নাগাল পাওয়ার অধিকার বাংলাদেশের মানুষকে এখনো দেয়া হবে না। সুতরাং বৃহৎ ও কার্যকর পরিবর্তনের আশা শিকেয় তুলে রেখে মুড়ি খেতে পারেন। সংবিধান পরিবর্তন? নাগরিকদের অধিকার ও যোগ্যতাভিত্তিক সমাজের সহায়ক রাষ্ট্রপদ্ধতির প্রচলন? ভাই, বালের আলাপ করেন কেন? ঘোড়ায় ভি হাসবো। তারচাইতে বরং এলএলবি ছোকরাদের সাথে বসে আইনের আলাপ দেন। আপনাদের জন্য ওটাই উপযুক্ত।
৩.
মাহমুদুর রহমান জেলে যাওয়ার ঘটনায় বাঙুরা এখন আইন বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছে। যেমনভাবে বিভিন্ন সময় তারা সংবিধান বিশেষজ্ঞ হয়, শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ হয়, মানসিক বিশেষজ্ঞ হয়। আরো যা যা যখন দরকার, তখনই তার বিশেষজ্ঞ হয়। আইনের প্রতি চরম শ্রদ্ধাশীল বাঙুদেরকে অবশ্য কেন তারা আইন ভেঙে দেশের সর্বোচ্চ নির্বাহী এবং আইনের রক্ষক প্রধানমন্ত্রী হাসিনার বিরোধীতা করেছিলো, সেই প্রশ্ন করলে তাদের ঠোঁট দুইটা জোড়া লেগে যাবে। আর শব্দ হবে না।
তাহলে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যারা মারা গেছে সবাই আইন ভঙ্গকারী। আইন ভঙ্গকারীদের মৃত্যুতে কেন সমব্যাথী হবেন? যারা আহত হয়েছে তারাও আইন ভঙ্গকারী। তাহলে তো বাংলাদেশের নিয়ম অনুযায়ী তাদের চিকিৎসা নয়, বরং শাস্তির খোঁজ নেয়া দরকার। মাহমুদুর রহমানকে যদি আইনের কারণে জেলে যেতে হয় তাহলে হাসিনাকে সরিয়ে দিয়ে যারা ক্ষমতায় বসেছে সবাই আরো অনেক মারাত্মক মাত্রার বেআইনী কাজ করেছে। দেশদ্রোহিতার দায়ে তাহলে আইন অনুযায়ী এদের সবার বিচার হওযার দরকার। আইন তো আইনই।
বাংলাদেশে যারা আইনের দোহাই দেয়, তারা শুধু বেকুবই না, বরং ক্ষেত্রবিশেষে নির্লজ্জ্ব ও ধূর্ত। তাহলে আদিলুর রহমান শুভ্রকে জেলে যেতে হয় নাই কেন? কেন হাইকোর্ট তার সাজা বাতিল করেছে অথচ মাহমুদুর রহমানের সাজা বাতিল করেনাই? কারণ আদিলুর উপদেষ্টা এবং প্রগতিশীল। আইন দেখায়েন না। সরকার চাইলে কি হয় তা সবাই মোটামুটি বুঝে। আইন দেখালে নিজের ধান্দাবাজিই প্রকাশ করবেন কেবলমাত্র।