কাজী জহিরুল ইসলাম
ভার্চুয়াল আড্ডারও মূল্য আছে এবং এই মূল্য ও স্বীকৃতি ক্রমশ বাড়ছে। তবে ধুমায়িত চায়ের কাপ হাতে নিয়ে প্রিয় কোনো মানুষের মুখোমুখি রেস্টুরেন্টে বসে আড্ডা দেবার মজাই আলাদা। পশ্চিমাদের কাছে গ্রীষ্ম খুব প্রিয় ঋতু কিন্তু আমার কাছে এইরকম হাড়কাঁপানো শীতের দুপুরে রেস্টুরেন্টে বসে আড্ডা দিতেই বরং বেশি ভালো লাগে। আজও যথারীতি বসেছি আমি এবং সৈয়দ কামরুল। অনেকবারই ভেবেছি আড্ডার কলেবর বাড়াব, কিন্তু আলোচনার স্ট্যান্ডার্ড না পড়ে যায় এই ভীতির কারণে তা আর হয়ে উঠছে না। আমরা দুজন সপ্তাহে একদিন বসি শ্রেফ বিনোদনের জন্য নয়, নিজেদের জ্ঞানানুসন্ধানের দরোজা-জানালাগুলো ঠিকমত খোলা হচ্ছে কি-না তা কিছুটা যাচাই করে নেবার জন্যই। লেখক/কবিরা আড্ডাপ্রিয় এ-কথা আমরা সবাই জানি কিন্তু এ-কথা হয়ত অনেকেই ভেবে দেখি না এই আড্ডা বাস্তব পৃথিবী থেকে কিছুটা সময় মুখ ফিরিয়ে নেয়ার জন্যে নয়, এই আড্ডা সৃজনতাড়নাকে উস্কে দেবার জন্যে, মননশীলতা শাণিত করবার জন্যে। আরবী সাহিত্যের নোবেলজয়ী লেখক নাগিব মাহফুজ রোজ বিকেলে আড্ডা দিতেন এবং তার আড্ডা ছিল মূলত রেস্টুরেন্ট কেন্দ্রিক। তিনি কখনোই কোনো বিখ্যাত ব্যক্তি, সাংবাদিক, লেখকের বাড়িতে যেতেন না। ক্যাফে নাইল ছিল তার প্রিয় আড্ডাস্থল। নাগিবের আড্ডার আরো একটি বড়ো বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি সবসময় আড্ডার টেবিলে তরুণদের চাইতেন। নিজের বয়সীদের সঙ্গে কখনোই আড্ডা দিতে পছন্দ করতেন না।
আমি ব্যক্তিগতভাবে ঠিক তার উল্টো, সব সময় বয়স্কদের সঙ্গে আড্ডা দিতে পছন্দ করি। যখন আমি ষোলো/সতেরো বছরের টগবগে তরুণ তখন আমি ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিতাম ষাট/সত্তরে উপনীত বুড়োদের সঙ্গে। এ-নিয়ে আমার সমবয়সী বন্ধুরা আমাকে ক্ষেপাতে ছাড়ত না। হয়ত এ কারণেই চল্লিশ/পঞ্চাশের দশকের বাঙালিদের জীবন-যাপন আমার নিজের যাপিত জীবনের মতোই স্পষ্ট মনে হয়।
মুক্ত আড্ডা কখনোই স্ট্রাকচারাল হয় না। এখানে প্রচুর উল্লম্ফন থাকে। গল্পেরা শাখা-গল্প, উপ-গল্পে বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে মননভূমির বিস্তীর্ণ সমতল জুড়ে। এবং মাঝে মাঝেই শাখা-গল্প কিংবা উপ-গল্পেরা প্রধান গল্প হয়ে ওঠে।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ওপর সম্প্রতি একটি প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে তার জীবন স্টাডি করেছি। সেই কথাই হচ্ছিল। যে ধর্মান্ধ গ্রামীন জীবন তিনি লিখেছেন তার সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা কতটুকু ছিল এই প্রশ্ন স্বয়ং তার ফরাসী স্ত্রী আন মারিই তুলেছিলেন। এই প্রসঙ্গে আমরা গোর্কির জীবন নিয়ে আলোচনা করি। আল মাহমুদের জীবন নিয়ে আলোচনা করি।
এক দুপুরের এই নাতিদীর্ঘ আড্ডা থেকে আজ আমি যে বিষয়টি এই রচনার জন্য তুলে আনতে চাই তা হচ্ছে একজন লেখকের ব্যক্তিজীবনের আদর্শ দিয়ে আমরা তার সাহিত্য-জীবনকে বিবেচনা করবো কিনা। বাংলা সাহিত্যে এই প্রসঙ্গটি বারবারই উঠে আসে আল মাহমুদ প্রসঙ্গে। ১৯৭৪ সালে সরকার তাকে কারাবন্দি করে বামপন্থী রাজনৈতিক আদর্শের সক্রিয় ইন্টেলেকচুয়াল হবার কারণে কিন্তু জেল থেকে বেরিয়েই তিনি সরকারের উপহার দেয়া শিল্পকলা একাডেমির একটি এন্ট্রি লেভেল অফিসারের পদ গ্রহণ করে আপোষকামীতার পরিচয় দেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল যে রাজনৈতিক শক্তি জীবনের একটি পর্যায়ে এসে তিনি সেই রাজনৈতিক শক্তির ব্যানারে অনুষ্ঠিত সভা-সমাবেশে অংশগ্রহণ করেন। এসব প্রসঙ্গে আমি আল মাহমুদের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে অনেক কঠিন প্রশ্ন করেছি। সেই সব প্রশ্নের উত্তরে তিনি নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা, কর্মী বা উপদেষ্টা/পরামর্শক নন। তবে তিনি ধার্মিক। ইসলাম ধর্মই তার আদর্শ। “মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো” কাব্যগ্রন্থটি রচনার পর থেকেই তার মধ্যে এই পরিবর্তন ঘটে। যে কোনো রাজনৈতিক প্লাটফর্ম তাকে সম্মানের সঙ্গে আমন্ত্রণ জানালে তিনি সেখানেই যাবেন। তিনি একজন কবি। তার দেশের মানুষকে তিনি স্বপ্ন দেখাতে চান। যে কোনো মঞ্চ থেকেই এই স্বপ্ন তিনি দেখাতে পারেন। কেন জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় লেখেন? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি তাদের কাছে ঋণী। লিখে সেই ঋণ শোধ করছি। আল মাহমুদ বলেন, এদেশের নষ্ট প্রশাসন প্রেম করে অভিভাবকের অমতে বিয়ে করার অপরাধে তার পুত্রকে গ্রেফতার করে। তাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য ২৫ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। সেই টাকার জন্য তিনি তার প্রগতিশীল বন্ধুদের দ্বারস্থ হয়েছিলেন, কেউ তাকে সাহায্য করেনি। সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল দৈনিক সংগ্রাম। লিখে তিনি সেই ঋণ শোধ করেছেন। মূলত অনেকগুলো সন্তান-সন্ততি সমেত এক বৃহৎ সংসারের ভরণপোষণের জন্যই বারবার তাকে বিভিন্ন শক্তির সঙ্গে আপোষ করতে হয়েছে।
এ-প্রসঙ্গে সৈয়দ কামরুল মার্কিন কবি এজরা পাউন্ড এবং আর্জেন্টাইন কবি হোর্হে লুইস বোর্হেসের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। যে দোষে আমরা আল মাহমুদকে বাতিল করে দিতে চাই সেই একই দোষে অভিযুক্ত হওয়া সত্বেও পাউন্ড কিংবা বোর্হেসকে তাদের দেশের মানুষ বাতিল করে দেয়নি। আমাদের কি তাহলে লেখক এবং লেখা এই দুটিকে আলাদা করেই বিবেচনা করতে হবে? জনাথন ওয়েলস একজন আমেরিকান কবি। বছর দুয়েক আগে আমি তার দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেই। বলাই বাহুল্য যে কথাটা এজরা পাউন্ড প্রসঙ্গেই উঠেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার মুসোলিনির হয়ে কাজ করার কারণে পাউন্ডের সাহিত্য কি নিষিদ্ধ করা উচিত? জনাথন বলেন, ঘটনাটি যদি আজকের দিনে ঘটত তাহলে হয়ত পাউন্ডের সাহিত্য কেউ পড়ত না। এখন ব্যক্তি এবং তার কাজকে আলাদা করে দেখা খুব কঠিন। এত দ্রুত সব কিছু মানুষের কাছে পৌঁছে যায় ব্যক্তিজীবন দিয়ে ব্যক্তির সব কাজই মহিমান্বিত বা কলুষিত হয়। সেকালে ঘটেছে বলে পাউন্ড পার পেয়ে গেছেন।
এবং এই যে আজকের দিনে ব্যক্তি ও তার কাজ একসঙ্গে বিবেচিত হয় জনাথন ওয়েলস এটাকে সঠিকই মনে করেন।
আমরাও চাই একজন লেখক ব্যক্তিজীবনেও আদর্শ চরিত্রের মানুষ হবেন। এটিই প্রত্যাশা। কিন্তু কেউ যদি ব্যক্তিজীবনে কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে থাকেন, ভুল পথে পরিচালিত হয়ে থাকেন, মৃত্যুর পরে তার কাজগুলো শুধুই কাজের মান দিয়ে বিবেচনা করা ভালো। জীবদ্দশায় ব্যক্তিজীবনের অশুভ ছায়া দিয়ে কাজ ঢেকে রাখার পক্ষে আমিও, এতে করে ব্যক্তির শুদ্ধ হবার সুযোগ তৈরি হয় কিন্তু তার মৃত্যুর পরে ব্যক্তি মূল্যহীন হয়ে পড়ে, মূল্যবান হয় তার ভালো কাজ। সৈয়দ কামরুলও এ-প্রসঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, নাহলে তো সাহিত্যের ভাণ্ডারে শূন্যতা তৈরি হবে, সমগ্র সাহিত্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ঠিক এ-কারণেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিজ দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া সত্বেও পাউন্ডের সাহিত্যকে আমেরিকানরা মাথায় তুলে নিয়েছে। আর্জেন্টিনার বিস্ময়কর সাহিত্য প্রতিভা হোর্হে লুইস বোর্হেসকে নিয়েও একই রকম বিতর্ক আছে। তিনি চিলির সামরিক জান্তা জেলারেল অগাস্তো পিনোশেকে সমর্থন দিয়েছিলেন। পিনোশে ১৯৭৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত চিলির ক্ষমতায় ছিলেন। মার্কিন কবি এজরা পাউন্ড এবং আর্জেন্টাইন লেখক ও কবি হোর্হে লুইস বোর্হেস শুধু তাদের নিজ দেশেই না সারা পৃথিবীতে বহুল পঠিত। এই দুজন লেখক শুধু যে জনপ্রিয় ছিলেন তা-ই নয়, সাহিত্যকর্মের গুণগত মানের দিক থেকেও তারা ছিলেন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দুজন লেখক/কবি। কিন্তু তা সত্বেও কেন এই দুজন লেখক নোবেল পুরস্কার পেলেন না? কারণ তারা জীবনের কোনো এক পর্যায়ে মানবতার বিরুদ্ধে, শান্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। বোর্হেসকে নোবেল পুরস্কার না দেবার কারণে নোবেল কমিটিকে ব্যাখ্যা পর্যন্ত দিতে হয়েছে। তারা অবশ্য প্রকৃত সত্য আড়াল করে তার ছোটোগল্পে “কৃত্রিমতা” বেশি এই দোহাই দিয়েছেন। আমি মনে করি নোবেলের মতো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি (জীবদ্দশায়) না দেওয়াটা যথার্থই হয়েছে এবং এই যে নিজ দেশের এবং পৃথিবীর কোটি কোটি সাহিত্যপ্রেমী মানুষ তাদের সাহিত্যকর্মকে মাথায় তুলে নিয়েছেন, এটিও যথার্থ।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ৩ জানুয়ারি ২০২৩।