তানিম ইশতিয়াক
মুসা আল হাফিজের ‘১০০ কবিতা’ হাতে পেয়েছিলাম গতবছরের রমজানের আগে আগে। রোজায় ভিন্ন শিডিউল থাকায় বইটি চাপা পড়ে যায়। কিন্তু কবিতা তার পাঠককে নিজেই খুঁজে নেয়। সেভাবে একদিন ডুবে যেতে হয় মুসার কাব্যে।
মুসা আল হাফিজের অনেক পরিচয় আছে। তবে আজ তাকে আবিষ্কার করব ‘কবি’ হিসেবে। তার কাব্য পরিচয় করিয়ে দেবে তার দর্শনকে। তার শব্দ পরিচয় করাবে তার কণ্ঠস্বরকে। তার ভাষা তুলে আনবে লেখকসত্তা। তার ভঙ্গি বলে দেবে তার শক্তিমত্তা।
কবি মুসা আল হাফিজের এই কাব্যগ্রন্থ সম্ভবত তার কবিতাগুলোর বাছাইকৃত সংকলন। এর পঙক্তিগুলো নিছক উদাসীন ভাবনার এলেমেলো আস্ফালন নয়। বরং একটা উন্মুক্ত লাগামহীন মনের দুরন্ত চিন্তাচাঞ্চল্যকে উদ্দেশ্যপূর্ণ শৃঙ্খলায় এনে শিল্পের তাকে সাজিয়েছেন। আর তা হয়ে উঠেছে দার্শনিক স্ফুলিঙ্গ। একেকটি পঙক্তি ভাবনার একটি নতুন ভুবন উন্মোচন করতে চায়। আমার কাছে মনে হয়েছে, পুরো কাব্যগ্রন্থে ঘুরেফিরে তিনটি বিষয়ের অবতারণা ঘটেছে। সেগুলো হচ্ছে আত্ম-আবিষ্কার, প্রেমের সৌন্দর্য ও মানবিক বিপ্লব। নানামুখী অনুসন্ধানে, বিবিধ প্রশ্নে, ভিন্নতর ভঙ্গিতে মুসা আল হাফিজ আঁকতে চেয়েছেন অন্যরকম দুনিয়া। এতে ফুটে উঠেছে তার নিজস্ব দার্শনিকতা। একাকার হয়ে গেছে আধুনিকতার সাথে আধ্যাত্মিকতা, সভ্যতার সাথে মানবিকতা।
২.
চলুন, দেখা যাক, মুসা আল হাফিজ নিজেকে খুঁজতে গিয়ে কীভাবে ছুটেছেন কবিতার কাছে, শব্দের কাছে, চিন্তার কাছে। ‘টিউমার’ কবিতায় দেখতে পাই, কবি সীমান্তের উঁচু পাহাড় থেকে দুনিয়া দেখতে গিয়ে পড়ে গেছেন আরেক প্রদেশে। হয়ে উঠেছেন আন্তর্জাতিক। কিন্তু হায়! এই দুনিয়ায় সবাই একচোখা! কবির দুটো চোখ দেখে শঙ্কিত হয়। এ কোন অসুস্থতা! সেদেশের সেনাপতি বুদ্ধিজীবী বিচারপতি সবার ঐকমত্যের আলোকে কবি বলছেন,
আমি এক রোগী
কারণ, আমার চোখ দুটি!
একটি চোখ, আরেকটি টিউমার।
…সদাশয় মন্ত্রিপরিষদ আমার টিউমার অপারেশনের নির্দেশ দিয়েছেন।
এভাবে কবি দেখিয়ে দিচ্ছেন, দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষ তাদের দুই চোখ কাজে লাগাতে পারছে না। দুটো চোখ একটা কাজই করছে, শুধু দেখছে। তারা হয়ে গেছে একদেশদর্শী। তাদের আছে কেবল দৃষ্টি, কোনো দৃষ্টিভঙ্গি নেই। দৃষ্টির সাথে চিন্তার যোগ নেই, দৃষ্টি পৌঁছাতে পারে না দৃশ্যের গভীরে। এই গল্পকাব্যে এই চিত্রকল্পে মুসা আল হাফিজ নির্মাণ করছেন নতুন দর্শন। অবয়বের সাথে অন্তরের মিশ্রণ।
কিন্তু দৃশ্যের গভীরে গিয়ে মুসা আল হাফিজ কী দেখতে পান? সেই অদৃশ্য দৃশ্যগুলো তার হৃদয়ে কেমন প্রভাব ফেলে? ‘সত্যের চাটি’ কবিতায় কবি লিখছেন,
আজকাল আমার কী হলো?
নদীকে গিয়ে বলি, থামো, বাতাসকে শুনো, পাহাড়কে জাগো, বৃক্ষকে এসো
লোহিত সাগর, নায়াগ্রা, আফ্রিকা আর হাজার বছরের ঘোড়ার দাপটে
সারারাত ঘুমাতে পারি না।
আমি শব্দের সাথে শব্দের জোড়া লাগালেই
ঝনঝন করে ওঠে গোলার্ধের সমস্ত কাসা,
কিষাণের হাতে নেমে আসে ঈদের প্রেয়সী চাঁদ,
থরথর ছুটন্ত বিমান তোমার রানওয়েতে কাত হয়ে যায়!
তারপরে ‘পরম প্রান্তরে’ কবি জানাচ্ছেন,
জিজ্ঞাসার দংশনে চেতনার চাদর ছিঁড়ে গেলে
জ্যোৎস্নার দিগন্তে লুটিয়ে পড়লাম
কামনার মস্তকে পা রেখে আমার ভেতর থেকে
জেগে উঠল চিরায়ু আরেক আমি।
এই জেগে উঠার ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট হয় ‘সিজদা’ কবিতায়। এতে কবি নিজেকে নিয়ে লিপ্ত হয়েছেন দর্শনতর্কে। কল্পনায় নিজেকে নিয়ে গেছেন অন্য মহাজগতে, যেখানে সময়, স্থান আকারের ধারণা ভিন্ন। কবিকে বলা হচ্ছে, ‘তুমি কে? প্রমাণ করো তোমার অস্তিত্ব।’ কবি বলছেন, ‘আমাকে যে প্রমাণ করতে হচ্ছে আমার থাকা, এটাই আমার থাকার প্রমাণ।’ কিন্তু এই যুক্তি ও পাল্টা যুক্তির ভেতর দিয়ে, বাহ্যিকতা দিয়ে বাস্তবতার সারবস্তু প্রমাণ হয় না। তাই কবি লুটিয়ে পড়ছেন সিজদায়। তাতে সারসত্তার আরও গভীরে জন্ম নিচ্ছে নতুন অস্তিত্বদর্শন, তাতে সকল প্রমাণ, অস্তিত্ব ও হর্ষধ্বনিকে তুচ্ছ মনে হয়।
আত্ম-আবিষ্কারের নেশায় নিজেকে নিয়ে নানারকম নিরীক্ষা করেছেন মুসা আল হাফিজ। মুহূর্তে মুহূর্তে একেকটি দৃশ্যের অবতারণা করে সেই গল্পের ভেতরে খুঁজেছেন নতুন দার্শনিকতা। চরিত্রের পর চরিত্রে স্থলাভিষিক্ত হয়ে জানতে চেয়েছেন নিজের পরিচয়। জন্ম দিয়েছেন নতুন পৃথিবীও। কবি বলছেন,
আমি সাপ হয়ে দংশন করলাম আমাকে
ওঝা ওঝা বলে চিৎকার করলাম
বলা হলো, তুমিই ওঝা হয়ে যাও।
৩.
মুসা আল হাফিজের এই আত্মআবিষ্কারের সাথে আবার মিশে যাচ্ছে প্রেমের চেতনা। নিজের ভেতরে বুঁদ হয়ে থাকতে থাকতে, আত্মনিমগ্নতায় পরম সত্তার সাথে মিলিত হতে হতে কবি মত্ত হচ্ছেন প্রবল প্রেমে।
নিজেকে যখন শরাব বানিয়ে পান করি হরদম
কেউ দেখেনি কভু
দেখল যখন হাতে নিলাম কাচের পেয়ালা
কবি জানাচ্ছেন, বাতাসের চেয়েও গোপন রহস্যের ভেতর নিজের সাথে তিনি কথা বলে চলেছেন। সকল লৌকিকতার ভেতর তিনি নিজেকে মিশিয়ে দিচ্ছেন অলৌকিকতায়। ’রুহ যখন জাগে’ কবিতায় তিনি বলছেন,
কিন্তু না, মুসা আল হাফিজকে টুকরো করে দিলেও তার মদ্যপান শেষ হবে না
তার পানপাত্র ছিনিয়ে নিতে পারবে না কোনো দুঃশাসন
কবি তার ক্ষ্যাপাটে একরোখা অবস্থান তুলে ধরে আবার মিনতিও করছেন তার প্রেমচেতনাকে উপলব্ধি করার জন্য, যেন প্রেমের জন্য তার লড়াই আত্মত্যাগ বৃথা না যায়।
হত্যা করো যেভাবেই চাও
শুধু আমার চিৎকারকে করো শুদ্ধ
শুধু আমার রোদনকে করো প্রেম
মুসা আল হাফিজ প্রেমাস্পদের আচরণ অনুবাদ করছেন ভিন্নমাত্রায়। যেন প্রেম সমস্ত শক্তির উৎস। সকল বিপন্নতা ভরে উঠছে প্রসন্নতায়। তিনি বলছেন,
তোমার দেওয়া বিষই আমার বিষনাশক
তোমার দেওয়া তীব্র আঘাতগুলো আমাকে আগুন বানালো বলে
কোনো আগুন আমাকে আর পোড়াতে পারছে না।
এই প্রেম কবিকে কোন স্তরে পৌঁছে দিচ্ছে সেটা বোঝার জন্য ‘তিয়াস’ কবিতাটি দেখা যাক। এখানে আমরা দেখি প্রেমের সারবস্তু আলাদা। প্রেমিকের অবয়ব ভিন্ন; যা কবির নিজস্ব দ্যোতনায় ধীরে ও ধ্যানে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। বলা হচ্ছে,
হে চন্দ্র, যাকে আকাশ স্বপ্নেও দেখেনি, এসো।
হে আগুন, যাকে পানি নেভাতে পারে না, জ্বলো।
হে রক্ত, পরিণত হও মদে!
হে হৃদয়, কাবাব হয়ে যাও!”
এই যে প্রমিক তার অবয়ব সাজিয়ে নিচ্ছে পছন্দমতো উপকরণে, যা তার প্রেমকে করে তুলছে আরও তীব্র, আরও সুন্দর, আরও ঝলকানো, আরও গভীর। সব সৌন্দর্য ও সুষমাকে ধারণ করে প্রেমিক মেতে উঠছে আনন্দের শরাব উপভোগে। এমন প্রেমিকের জন্য পিপাসার্ত হয়ে আছে স্বয়ং জান্নাত। সেই মুহূর্তের আকুতি কবি ফুটিয়ে তুলছেন এভাবে,
এবং সজাগ হবো প্রেমের তন্তুতে।
জান্নাতের তিয়াসে কত কেটেছে রাতদিন,
কিন্তু প্রেমিকের তন্তুর লাগি তিয়াসী জান্নাত।
‘প্রেমিকের তন্তু’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে তা অবশ্য আমার কাছে পরিষ্কার নয়। কবিতার ভাবের ধারাবাহিকতায় মনে হয়, এ হয়ত প্রেমিকের হৃদয়, কিংবা হৃদয়ের চেয়ে বেশি কিছু! আমি জানি না, ‘তন্তু’ শব্দচয়ন কি ইচ্ছাকৃত কোনো রহস্যময় ইঙ্গিত? নাকি শব্দটি এখানে ভাবের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে?
যাহোক, কবি তার প্রেমানুভূতিকে নতুন দর্শনে রূপ দিচ্ছেন মানবীয় শরীরবৃত্তীয় প্রেমের ঊর্ধ্বে তুলে ধরে। তিনি স্পষ্টত জানিয়ে দিচ্ছেন, বিকৃত নেশাগ্রস্ত মাদকাসক্ত ভারসাম্যহীন মাতাল তিনি নন, তিনি ডুবে আছেন পরম প্রেমের নেশায়।
তোমার পেয়ালার মদ পান করব বলে
পৃথিবীর মদ্যকে মেনেছি হারাম
এই অনুভূতির প্রতিধ্বনি হচ্ছে অন্য কবিতায়:
আমাতে তলিয়ে আমি তারে শুধু পাই
তার গানে সুর দিলে আমি আর নাই
৪.
আত্ম-আবিষ্কার আর প্রেম-চেতনার মধ্যে কবি এবার উন্মুখ হন মানবিক বিপ্লবে। হৃদয় দিয়ে, প্রেম দিয়ে, জ্ঞান দিয়ে, সাহস দিয়ে পুরনো প্রতিষ্ঠিত অচলায়তন ধসিয়ে নির্মাণ করতে চান আগামীর অনিবার্য সোনালী সভ্যতা। ’ভালোবাসার রাত’ কবিতায় তিনি বলছেন,
এসো
রাত্রির ব্যাকরণ ভেঙে ফেলি
নিদ্রার অরণ্যকে একটি উত্তাল সমুদ্র বানিয়ে দিই
প্রমতত্ত্ব কবিতায় তারই প্রতিধ্বনি আরও জোরেশোরে শুনতে পাই
ওহে মৃত, প্রাণ চাও প্রাণ?
স্বার্থের শকুন, লোভের শেয়াল আর ক্রোধের কুকুর থেকে মুক্ত মহাপ্রাণ?
প্রেমের সমুদ্রে তবে সঁপে দাও জীবন মরণ!
বিপ্লবের এই ইঙ্গিত তিনি প্রকৃতিতে দেখতে পান। মাটি-বায়ু-বৃক্ষ-পাখি সবাই যেন তেমন কিছুর ইশারা দেয়।
ডানদিকে সূর্যোদয় আর বামদিকে সূর্যাস্ত নিয়ে
পাখিটি চঞ্চু ঘষে মেঘের মিনারে (আজ)
আগামীর এই ইশতেহারে মুসা আল হাফিজ উপাদান খুঁজে নেন ঐতিহ্য থেকে। উদ্ভাস কবিতায় তিনি বলছেন,
অতীত সুন্দর, সুস্পষ্ট, সৌম্য, ব্যাপ্ত, কাল তার অকাশে
মেখে নিয়েছে দাড়ির ধবল। আগামী আবৃত মেঘের আড়াল থেকে
সহসা আক্রমণে রাতের তেপান্তরে সূর্যের নাড়ায় ভ্রুণাভাস,
দাঁড়ায় মৃত্যু এসে করজোড়ে গম্বুজের নিচে (উদ্ভাস)
কিন্তু নতুন বিপ্লবের পথে বহু ভ্রান্তির স্লোগান দেখা যায়। সভ্যতার নামে, রাষ্ট্রের নামে, আধুনিকতার নামে ভিন্ন ভিন্ন কারাগার ওঁৎ পেতে থাকে। মুসা আল হাফিজ সেসব ফাঁদ উন্মোচন করে দেন। ‘আজ কার জন্ম হয়েছিল’ কবিতায় আমরা দেখি সেই চিত্রের দারুণ উপস্থাপন:
যখন বলো, ’হে প্রিয় জনগণ’
তখন আসলে বলো, ’হে তুচ্ছ তৃণলতা’
যখন বলো, ’সেবা করতে চাই’
তখন আসলে বলো, ’পদদলিত করতে চাই’
যখন বলো, ’স্বদেশ স্বদেশ’
তখন আসলে বলো, ’মুরগি মুরগি’
যাকে জবাই বা বিক্রি করা ছাড়া তোমাদের কোনো অভিপ্রায় নেই।
এই ফাঁদে পড়ে বাস্তবে যে আধুনিক দাসত্ব তৈরি হয়েছে, মুসা আল হাফিজ তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন ’শ্রমিক’ কবিতায়
শ্রমিকের রুটি নেই, শ্রমিকই রুটি
রুটি খাওয়ার এক তরিকার নাম অমেরিকা!
আরও মজাদার নাম শিল্পবিপ্লব
কালো-ধলো কারখানা ও মস্ত মস্ত মাস্তির শহর
আধুনিক সভ্যতা যে মানুষের ধর্মীয় চেতনা বিলুপ্ত করে, তাদের খোদাকে সরিয়ে নিজেই প্রভু হয়ে বসতে চায়, তার স্বরূপ তুলে ধরেন ‘আধুনিক ঈশ্বর’ কবিতায়। দীর্ঘ কবিতা থেকে কিছু অংশ এখানে না তুলে ধরলেই নয়:
হে আধুনিকতা, তুমি আমাকে থিয়েটার দিয়েছো
যেখানে ছবি যন্ত্র অভিনয়
আমি কি ছবির জন্য তোমাতে বিনীত হবো,
যখন তুমি প্রাণকে উপেক্ষা করেছো?
আমি কি যন্ত্রের জন্য কৃতজ্ঞ হবো,
যখন তুমি আমাকে এর অধীন করে দিচ্ছো?
তুমি আমাদের ইচ্ছের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য
আল্লাহর থেকে আলাদা হবার প্ররোচনা দিচ্ছো
কিন্তু ইচ্ছেকে দাস বানিয়ে দিচ্ছো প্রবৃত্তির
তাহলে তুমি ঈশ্বরকে সরিয়ে দিয়ে হতে চাও বিকল্প ঈশ্বর?
এসো ঈশ্বর, তোমার কান মলে দিচ্ছি!
আসন্ন বিপ্লবে সবাই প্রত্যাশী বটে, কিন্তু কতটা প্রস্তুত সেই বিপ্লবের বাঙনিষ্ঠায়? কোথায় সেই শক্তি? সজ্জায় নাকি সাহসে, হুজুগে নাকি সাধনায়- সেই সূক্ষ্ম সংকটের কথা তুলেছেন মুসা আল হাফিজ।
আমি দৃশ্যমান ফেনার বদলে অদৃশ্য মুক্তো কুড়াতে বলেছিলাম!
বলেছিলাম, ঘোড়র শক্তি কেশরে নয়, কলিজা ও খুরে
কিন্তু তোমার দরকার ফেনা, যা ঢেকে ফেলে উপকূল
তোমার চাহিদা কেশর, যা দেখে বলা হবে, এই দেখো পৌরুষ!
৫.
এভাবে অনেক উদ্ধৃতি দেওয়া যাবে। কিন্তু তার সবই দেখা যাবে, একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে ধাবিত হচ্ছে। মুসা আল হাফিজের এই পঙক্তিমালা কোনো উদাস কবির সিগারেটের ধোঁয়ায় ওড়ানো বিভ্রান্তিকর গুঞ্জন নয়, বরং সুচিন্তিত দিগন্ত বিস্তৃত জাল ফেলে কুড়িয়ে আনা একঝাক সত্য সুন্দর মণিমুক্তার সমাহার। যেখানে কবি হয়ে উঠেছেন সাধক, শব্দ হয়ে উঠেছে ধ্যান, উপমা-গল্প-চিত্রকল্পে নিপুণ দক্ষতায় বুনেছেন নান্দনিক দোলনা। যাতে আরোহণ করলে পাঠক মনে দোলা দিয়ে যায়, চিন্তায় তৈরি হয় আলোড়ন। এখানে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, মুসা আল হাফিজ ধর্মীয় কবিতা লেখেননি, ধর্মীয় শব্দ ও চেতনাকে তিনি পুঁজি করেননি, বরং ধর্মীয় ঐতিহ্য থেকে শক্তি খুঁজেছেন, আধুনিক সভ্যতার সঙ্কটে সমাধান খুঁজেছেন, আবিষ্কার করেছেন বিশ্বমানবতার জন্য অনিবার্য আদর্শ। আর সেটাকে প্রমাণ করে গেছেন দার্শনিক আলাপচারিতায়।
মুসার কবিতায় শব্দের ব্যবহারে অর্থের দ্যোতনা ও আলঙ্করিক ব্যাঞ্জনা বেশ দৃশ্যমান। এতে তার কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে আরও জোরালো, প্রকাশভঙ্গি হয়ে উঠেছে চুম্বকীয় বাঙময়। সাহিত্যের পাঠক মাত্রই উপলব্ধি করতে পারবেন, যে বক্তব্য তিনি প্রকাশ করতে চাচ্ছেন, তার জন্য ওই শব্দটাই যথার্থ ছিল। তার শব্দচয়ন কেবল সমৃদ্ধ শব্দভাণ্ডারের খোঁজ দেয় না, একইসাথে অর্থ ও অলঙ্কারকে প্রাধান্য দেয়। খেয়াল করলে দেখা যাবে, সেসব শব্দই কাঁধে নিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছে প্রকৃত ভাব, আর বুকে আছে আস্ত ইতিহাস। আরও একটি খেয়াল করার বিষয় কবির বাক্যবিন্যাস। বাক্যের গাঁথুনিতে আছে ঝঞ্ঝা হাওয়ার মতো দোল, যেন নির্দিষ্ট পরিক্রমায় ইচ্ছা করে শব্দ নিয়ে খেলছেন তিনি। ব্যাপারগুলো বোঝার জন্য দুয়েকটা উদাহরণ দেই।
তুমি ইতোমধ্যে ন্যাংটো হয়ে গেছো- সাক্ষী বধ্যভূমি
তোমার নিঃশ্বাসে মৃত্যু মারি ও মড়ক- সাক্ষী উপনিবেশ (আধুনিক ঈশ্বর)
বজ্রপাত বলেছে, তাকে মারার জন্যই বজ্রপতন হয়নি!
বজ্রপতনের মধ্যে সে এসে পড়েছিল!
তাহলে মরণের কারণ অরণ্যে যাওয়া?
কিন্তু অরণ্যে যাওয়ার কারণে যদি মৃত্যু এসেছে বলি,
তাহলে, সেই কারণের কী হবে, যেজন্য তুমি অরণ্যে গিয়েছিলে?
তাহলে তোমার মৃত্যুর কারণ হারানো প্রশান্তি?
কিন্তু প্রশান্তির জন্য তুমি অন্যত্র না গিয়ে
অরণ্যে কেন গেলে প্রিয়?
তাহলে কি সবুজ আর নির্জনতার জন্য গিয়েছিলে? (প্রশ্ন)
তবে এখানে একটি সতর্কবার্তা দিতে হয়: ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে যাদের ধারণা নেই, কালের গর্ভে লুকিয়ে থাকা মহান সাধক ও চিন্তকদের সাথে যাদের পরিচয় নেই; তাদের জন্য মুসা আল হাফিজের কবিতা দুর্বোধ্য ঠেকবে। তার শব্দচয়ন ও বাক্য বিন্যাসের খেলা বুঝতে হলেও সাহিত্যের ধ্যানী পাঠক হতে হবে। উপমার সাথে পথ হেঁটে কল্পনায় ভিন্ন জগত দেখার সক্ষমতা থাকতে হবে। কোনো কোনো কবিতায় একেকটি শব্দের আড়ালে আছে একেক ইতিহাস, একেকটি নামের মানে একেকটি মতবাদ, একেকটি ইঙ্গিতে আছে একেকটি দর্শন। উদাহরণস্বরূপ ’পাঠ’ কবিতার কিছু শব্দ তুলে আনা যাক: গ্যেটে, আফ্রোদিতি, পার্সিফোন, ইডিপাস, রুমী, কামধেনু। কিছু কিছু কবিতায় এমনকিছু দৃশ্য অঙ্কন করেছেন, যেই ছবিটা পুরোটা দেখতে গেলে কয়েকবার আওড়াতে হবে পঙক্তিগুলো, আর গণিতের মতো সমীকরণ মেলাতে হবে।
আবার অনেকসময় একেবারে আটপৌরে শব্দচয়নে ছোট কবিতায় অনেক বড় দর্শন হাজির করেছেন। সহজ সাবলীল ভঙ্গিতে বলে দিয়েছেন কঠিন কথা। যেমন, ‘একদা বৃক্ষতলে’ কবিতায় তিনি লিখেছেন, ’সৃষ্টির কল্যাণ চেয়ে তুমি মূলত চেয়ে বসেছো বন্ধুত্ব আল্লাহর’। আবার ‘চিঠি’ কবিতায় বলছেন,
আমি তো অবাক!
আহা এ কেমন মরণ?
বুকে তার জীবনেরও বেশি আয়োজন!
৬.
মুসা আল হাফিজ তার কবিতায় দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। শব্দ ও উপমায় খেলতে চেয়েছেন। যাই তিনি প্রকাশ করুন না কেন, খেয়াল রাখতে চেয়েছেন কাব্যের স্বাদ ও সৌন্দর্য থেকে যেন বিচ্যূত না হন। সতর্ক দৃষ্টি রেখেছেন যেন, বক্তব্যের ভারে শিল্পগুণ নষ্ট না হয়। তবুও আমার মনে হয়েছে, শব্দের গুরুগম্ভীরতায় মাঝেমাঝে কিছু কবিতা কাব্যের পথ ছেড়ে প্রবন্ধের দিকে ধাবিত হয়েছে। কখনো কখনো বড় হয়ে উঠেছে স্লোগান। উদাহরণস্বরূপ ’প্রশ্ন’ কবিতাটি দেখা যেতে পারে। আমার কাছে এতে কবিতার গীতিময়তার চেয়ে দৃশ্যবর্ণনা বড় হয়ে উঠেছে। উপমার ভারে তা অলঙ্কারের পরিবর্তে কংক্রিট হয়ে উঠেছে। একইভাবে ’অন্ধগলির কবিতা’টি চিন্তা ও যুক্তি পাশ কাটিয়ে কিছুটা স্লোগানসর্বস্বতায় রূপ নিয়েছে। কিছু কিছু কবিতায় সঙ্কটের বিবরণ এত বেশি ডালপালা ছড়িয়েছে, সেই তুলনায় পরিণতি পেয়েছে আকস্মিকভাবে এবং নামমাত্র ভাবপ্রকাশে, যা পাঞ্চ লাইনের মতো শক্তিশালী নয়।
৭.
মুসা আল হাফিজ কিছু কিছু কবিতা ও পঙক্তি লিখেছেন যা ঈর্ষণীয়। সেগুলো এই কাব্যগ্রন্থকে বাঁচিয়ে রাখবে দীর্ঘকাল। সব ধরনের পাঠককে করবে আলোড়িত। সেখানে তারা নিজেদের একান্ত বেদনা খুঁজে পায়, পায় আশা ও ভরসার ঝিলিক। আবার খুব সহজে বুঝে ফেলে জীবনের নতুন দর্শন, দেখতে পায় চিন্তার নতুন দিক। এসব কবিতায় ভারী ভারী শব্দের উল্লম্ফন নেই, জটিল কোনো তাত্ত্বিক তর্ক নেই। কিন্তু তবুও তা অসম্ভব শক্তিশালী। যেমন, বইয়ের প্রথম কবিতা ’অনিবার্য’। একটা সময় আসবে, বেদনা সঙ্গ দেবে এত বেশি/ মৃত্যুও কাছে আসবে না!/ …কিন্তু একটা দিন আসবে, যা ভুলিয়ে দেবে/ সেই সব দিনের কথা/ যেন তারা আসে নাই কোনোদিন।
আবার ’গণিত’ কবিতাটার কথা না বললেই নয়। এটি একটি অমর কবিতা। কবিতাটি সম্পূর্ণ তুলে দিয়ে পাঠপ্রতিক্রিয়া শেষ করি।
আমি তো গণিতের সমাধান বের করি
কিন্তু গণিতবিদরা আমাকেই একটি সমস্যা মনে করেন।
কারণ যখন খাতা হাজির করা হয়,আমি হাজির করি জীবন!
বলা হয়, যোগ করো! আমি যোগ করি আত্মশক্তিকে।
বলা হয়, বিয়োগ করো! আমি বিয়োগ করি পরাজয়কে।
বলা হয় গুণ করো! আমি গুণ করি ভালোবাসাকে।
বলা হয়,ভাগ করো! আমি ভাগ করি দুঃখকে।
বলা হয় সমীকরণ দাও! আমি দিই নিজের মধ্যে সবাইকে।
বলা হয় মান প্রকাশ করো! আমি প্রকাশ করি সফলতাকে।
তারা বলে, এটি আদৌ কোনো গণিত হয়নি,
তুমি অঙ্কের ব্যাকরণ জানো না!
আমি বলি, এটিই মহোত্তম অঙ্ক এবং
এ জন্য ব্যাকরণ লঙ্ঘন করে আমিই হয়ে উঠি নতুন ব্যাকরণ!