জোবায়ের মিলন
মৃধা আলাউদ্দিনের তৃতীয় কবিতার বই ‘প্রজাপতি হয়ে গ্যাছে কোনো কোনো মাছ’। নামের মধ্যেই অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুমেয়। মলাট উল্টালে প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা অবধি একেকটি কবিতা সামনে এসে দাঁড়ায়– নিজস্ব অধিকার নিয়ে। ডিঙ্গিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা থাকলেও চয়ে যাওয়া যায় না। কয়েক লাইন পড়ে বাদ দেয়া যায় না একটি কবিতাও। ‘প্রজাপতি হয়ে গ্যাছে কোনো কোনো মাছ’– বইটিতে চৌষট্টিটি কবিতা সন্নিবেশিত হয়েছে। চৌষট্টিটি কবিতাই যে সুবিবেচিত গ্রন্থিত তা পাঠোত্তর স্বীকার না করে পারা যায় না। কবিতা যদি বাক্যপরিধি আর বাক্যসংখ্যার ওপর নির্ভর না করে তবে বলা যায়, মৃধা আলাউদ্দিনের ছোট ছোট পরিসরের কবিতাগুলো স্বল্প কথায় বৃহৎ ভাবের এক পরিচ্ছন্ন প্রকাশ। উপমায়, উৎপ্রেক্ষা এবং পরিস্কার, ঝরঝরে-সুন্দর চিত্রকল্পের ছোঁয়া আছে। আছে একটি নান্দনিক বক্তব্য। বিষয়ের স্বচ্ছতা আছে কয়েক লাইনের ভেতরেই। ‘ফিনিক্স পাখির মতো উড়তে শিখেছি/ আগুন-আকাশ ও নীল দিগন্তে।/এবঙ আমি আগুনে হাত রেখে দেখেছি/ কিছুই পোড়ে না, হৃদয় ছাড়া. . ./যুদ্ধের ময়দানে আমি অশ্বারোহী আপেল/নরম নদীর মতো ঝাপটে ধরেছি বন্দুকের বাট, আগুনের ঢেউ।’– (আগুনের ঢেউ)।
জীবন, যুদ্ধ, যাপিত প্রেম, বিষণ্ণতা ইত্যাদি স্পর্শ করে আছে কবি মৃধা আলাউদ্দিনের মনোজগত। কবি সংসার কিংবা বাস্তবতা এড়িয়ে কবি হয়ে ওঠেননি তার এই কাব্যগ্রন্থে। সত্য জীবনকে লুকাননি। প্রকাশ করেছেন পয়ারে পয়ারে। বাঁধা ছন্দে নিজেকে বাঁধেননি তিনি। মুক্ত ছন্দে এঁকেছেন কবিতার শরীর, মেজাজ। আপন মনন রসে ধরতে চেয়েছেন প্রচল সত্য আবার দেখতে চেয়েছেন প্রবাহমানতার নিগূঢ়তা। ধরা ও দেখায় তিনি সার্থক হয়ে ওঠেছেন। যখন তার কবিতাগুলো ব্যঞ্জনা তৈরি করে পাঠক ভাবনায়, মনে দোলা দিয়ে আন্দোলিত করে কাব্যপ্রেমিক মন। কোথাও কোথাও যদিও মনে হয়েছে কবি একটু তাড়াহুড়ো করে গ্রন্থটি রচনা করেছেন বা প্রকাশ করেছেন। তবে মোটা দাগে তা ব্যাঘাত ঘটায় না পাঠক মনে। কবিতার রসাস্বাদনে ধরাও পড়ে না তেমন। অতলের ঝঙ্কার কাটিয়ে নেয় সামান্য ছায়া। ‘নদী আর নারীর মাংস খেয়ে দেখি, আহা/ উড়ে যায় শীতের পাখি;/ ঘাস-মাটি, হিজল ফুল, ঝরা মেপল পাতা/ রাস্তা পড়ে থাকে রাস্তায়. . ./নদী আর নারীর মাংস খেয়ে দেখি, আহা/ প্রজাপতি হয়ে গ্যাছে কোনো কোনো মাছ/ ইলিশ, বেলে, বাইম. . . সমুদ্র-সাগর/এবঙ আপেলগুলো বদলে যায়–/নীল ঢেউ, পাখির গুঞ্জন-কাফকার আকাশ/এবঙ হরিণ হয় কোনো কোনো আপেল. . .’– (প্রজাপতি হয়ে গ্যাছে কোনো কোনো মাছ)।
অতলের ঝঙ্কার, প্রেম ও দ্রোহ, সমাজ চিন্তা এবং সমাজের ঘুমিয়ে থাকা মানুষগুলোকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন নব্বইয়ের নিভৃতচারী, একা পথচলা কবি মৃধা আলাউদ্দিন। তিনি তার কবিতা ভেতর দিয়ে এই পৃথিবীর সকল মানুষকে জাগাতে চেয়েছেন। ভালোবাসতে চেয়েছেন। স্বপ্ন দেখাতে চেয়েছেন। তোমরা আর এভাবে ঘুমিয়ে না থেকে হাঁটতে থাকো রাত ও রোদ্দুরে। দুটি হাত বাড়িয়ে দাও সামনের শীতে তাহলেই জীবনে সফলতা আসবে। সজীবতা আসবে। আমরা বলবো কবি মৃধা আলাউদ্দিন কবিতাকে কবিতা হিসেবে দেখেননি, দেখেছেন জীবনের সফলতা হিসেবে। সঘন সৌন্দর্য– ষড়ৈশ্বর্য হিসেবে। মৃধা আলাউদ্দিনের কবিতায় প্রেম ও দ্রোহ–
১ ‘বীক্ষ্যমাণ বশরাই গোলাপের আশীর্বাদে আমি পৌঁছে যাবো আমার গন্তব্যে
অমীমাংসিত কোনো সৌন্দর্যেও ভেতর আমি পৌঁছে যাবো
আমার ব্যথার বিড়ম্বনাসহ…
আমি গলে গলে যাব কোনো এক শান্ত-শুভ্র শ্রাবণ সন্ধ্যায়
আমাকে আর পাবে না
আমি গলে গলে যাবো
গলে গলে…’
২. ‘এখন কি কিছুই করতে পারে না ওআইসি আরব লিগ অথবা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন?
ওরা কি বোবা, নিথর, নিস্তব্ধ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা স্টাচু অব লিবার্টি?
হাস্যকর লেনিনের মূর্তি?
নাকি ওরা পেন্টাগন ও টুইন টাওয়ারের মতো ধ্বংসের ধোঁয়া
যা বরাবরই মিশে যেতে পছন্দ করে বৈষম্যময় নিষ্ঠুর পর্দার আড়ালে।
তবে ধ্বংস হোক জাতিসংঘ, তার সমস্ত অনুচর।
ব্যাঙের ছাতার মতো ধ্বংস হোক ওদের সভ্যতা
হেরে যাক বসরাই গোলাপের কাছে লাল, শাদা, প্রাচুর্যময় সবুজ গোলাপ…
প্রতারক পিতার মতো ধ্বংস হোক পৃথিবীর পচা ডিম অথবা এই জাতিসংঘ।
বুশ-ব্লেয়ার-শ্যারন কি একেকজন পিতা?
না, পিতা নয় ওরা ধ্বংসের প্রাচুর্য এবং অবশ্যই ওরা নিমিজ্জত হবে হুতামায়।
তুমি জানো হুতামা কি? হুতামা আল্লাহর প্রজ্বলিত অগ্নি;
যা জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে এবঙ লাগামাত্রই হৃৎপিণ্ড পর্যন্ত পৌঁছে যায়।’
মৃধা আলাউদ্দিনকে পাঠ করে আনন্দ এই, তার কবিতায় নেই সেই ঘোর-প্যাঁচ– যা পাঠকের বোধকে দ্বিধায় ফেলে তিক্ততায় ভরিয়ে তোলে সর্বাঙ্গ কবিতা থেকে বিমুখ করিয়ে দেয়। মৃধার কবিতা, গ্রন্থের বাহিরেও বিভিন্ন মাধ্যমে পাঠের জ্ঞান থেকে বলছি, তার কবিতা প্রতারণা করে না। সুন্দর মলাটের আকর্ষণে মনগড়া হাবিজাবি পড়তে বাধ্য করে না ও কবিতার সাথে তিনি অসততা করেননি কখনো। আর এর জন্যই তাকে পাঠে তৃপ্তি আসে। ‘প্রজাপতি হয়ে গ্যাছে কোনো কোনো মাছ’ গ্রন্থটির কবিতাগুলো কবিতার চেয়েও কী যেন একটা প্রকাশ করে। কী যেন একটা বলতে চায় তার ভাষা। ভাষার ব্যবহার, শব্দের গাঁথুনি মাত্র দুই লাইনের কোনো কোনো কবিতাকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। দর্শনও উপস্থাপিত হয়েছে কোনো কোনো কথায়। ‘বিধাতা এমন করেই আমাকে নির্মাণ করেছেন– তোমার ঘুম ভাঙলে, ভাঙে আমারও ঘুম।’– (সংযোগ)। আরেকটি কবিতা, ‘আমারে জড়াও বাহুযুগলে/উর্বর করো ভূমি–/চাষির কর্ষণ ছাড়া দেশ সুজলা, সুফলা হয় না।’–( চাষি)।
জীবন ও জাগতিকতাকে আবিষ্কার করতে গিয়ে মৃধা আলাউদ্দিন তার কাব্যগ্রন্থটিতে বিচিত্র কৌশল অবলম্বন করেছেন। একটি কবিতা থেকে আরেকটি কবিতাতে যেতে রূপ বদলিয়েছেন, রঙের ব্যবহার বদলিয়েছেন, অল্পবিস্তর দেখার অভিজ্ঞতাকে প্রজ্ঞায় হাজির করেছেন কবিতায়। মৃধা যা দেখেছেন, যা বুঝেছেন তার জীবদ্দশায় পৃথিবীর দিকে প্রগাঢ় তাকিয়ে তাই চোখের গহিন গাঙ থেকে তুলে এনে তুলিতে এঁকেছেন তার কর্মের নাম কবিতা। হাঁটতে হাঁটতে নয়, বেড়াতে যাবার পথে বা বিশ্রামে নয়, এক ধ্যানে কবিতার মাঝে ডুব দিলে অদেখা এক দেখা ভেসে ওঠে ‘প্রজাপতি হয়ে গ্যাছে কোনো কোনো মাছ’-এর শরীর থেকে। আপাত সহজ মনে হলেও অধিকাংশ কবিতায় একটা দর্শন, একটা অভিজ্ঞান, একটা মতপ্রকাশ করেছেন এই কবি। কিছু একটা বলতে চেয়েছেন। দেখাতে চেয়েছেন। আঁকতে চেয়েছেন। যে চেষ্টাটা কবি মাত্রই করে থাকেন কিন্তু সবাই পেরে ওঠেন না। মৃধা তা পেরেছেন কবিতার প্রতি তার একগ্রতার কারণে। শেষাংশে বলা যায়, মৃধা যে দায় হাতে তুলে নিয়েছেন ও কর্তব্য পালন করছেন কবিতায় তা একদিন তাকে শিল্পসম্মত কবির উপমা থেকে দূরে রাখবে না। পাঠকই তার কবিতা খুঁজে নেবে কবিতার আকর্ষণে। পোড় খাওয়া, যন্ত্রণাকাতর, অর্ধেক জবেহ হওয়া কবি মৃধা আলাউদ্দিন ও তার ‘প্রজাপতি হয়ে গেছে কোনো কোনো মাছ’ গ্রন্থটির জন্য নিত্য শুভকামনা করছি। সব ঠিক থাকলে অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২১ শে গ্রন্থটি প্রকাশ পাওয়া যাবে ‘স্টুডেন্ট ওয়েজ’ পাবলিকেশন থেকে। এর মূল্যমান রাখা হয়েছে ২০০ টাকা। গ্রন্থটির প্রচ্ছদ করেছেন–‘নির্ঝর নৈঃশব্দ্য। মৃধা এই কাব্যগ্রন্থটি আপনার সংগ্রহকে আরো সমৃদ্ধ করবে বলেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। আমরা বইটির সাফল্য কামনা করছি।