spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

লিখেছেন : কাজী জহিরুল ইসলাম

রঙ্গশালা

কাজী জহিরুল ইসলাম 

আপনি তো স্যার একটা মস্ত বড়ো ভুল করে ফেলেছেন। ভুল অবশ্য আরো আছে, এই “রঙ্গশালা”য় কত কিছু ঘটে, তার সব কী আর শুদ্ধ হয়, কিছু ভুল তো মানুষ করেই। তবে কিছু কিছু ভুল আমরা হজম করতে পারি না। দেখামাত্রই তা উগড়ে দিতে ইচ্ছে হয়। কী ভুল? বলছি স্যার। সেটা বলার জন্যই তো লিখতে বসেছি। আপনি তো স্যার জ্ঞানীগুণী মানুষ, বাস্তব অভিজ্ঞতাও ঢের হয়েছে। কৈবর্ত পরিবারে জন্ম, গাও-গেরামের কাদা-পানি ঘেঁটেই বড়ো হয়েছেন। বনে-বাদাড়েও ঘুরেছেন ঢের। বাংলাদেশের বোদ্ধা পাঠক সমাজ এবং গুণী সাহিত্য-সমালোচকেরা আপনাকে যথেষ্ঠ সম্মান করে শুধু এ-কারণে নয় যে আপনি একজন অধ্যাপক এবং পিএইচডি ডিগ্রিধারী, মূলত আপনার প্রতি বাংলা ভাষার পাঠকদের পক্ষপাতিত্বটা বেশ আবেগী, সকলের অন্তরে একটা আদরের হাহাকার বেজে ওঠে, আহারে জেলের ছেলেটা লেখক হয়েছে। উচ্চমাধ্যমিকে এসে না হয় চট্টগ্রাম শহরে চলে এসেছেন, এরপর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য বইপত্রে মুখ গুঁজে ছিলেন, হয়ত আর গাঁও-গেরামের বন-বাদারে যাননি, বাঁশঝাড়ে বকের ছাও খুঁজতে বের হননি। অবশ্য আপনি আমার নমস্য এজন্য যে কৈবর্ত-জীবনের মায়াটা আজও ছায়ার মতো ধরে রেখেছেন। এই বিষয়েই পিএইচডি করেছেন, গল্প, উপন্যাসও প্রায় সবই এই বিষয়ে লিখেছেন। কিন্তু এই ভুলটা আপনি কী করে করলেন স্যার? আপনি কি কখনো কাকপক্ষীদের দেখেননি জেলেদের জাল থেকে ছোঁ মেরে মাছ তুলে নিতে? কী বললেন? দেখেছেন স্যার। জেনে আশ্বস্ত হলাম। এবার বুঝতে পারছি, তাহলে হয়ত কাক আর কোকিল বিষয়ে আপনার মাথা আউলা হয়ে গিয়েছিল। হবেই বা না কেন? রিক্সায় স্ত্রীকে পাশে বসিয়ে কোনো এক বসন্ত বিকেলে যখন রাস্তায় বের হন তখন ফুটপাতে সুন্দরী তরুণীর মেদহীন দেহবল্লরীর উন্মুক্ত বাঁক দেখে এই বয়সেও ভেতরে বসন্তের হাওয়া কেমন চনমনিয়ে ওঠে, তখন কী আর কাক চোখে পড়ে স্যার, সবই কোকিল মনে হয়। ছি ছি কী যে বলেন, আপনার চরিত্রে কালিমা লেপন করছি? একদম না স্যার। ওই যে আপনার রঙ্গশালায় ভিক্ষুক ছদ্মবেশী খুনিকে দিয়ে এই কথাটিই তো অধ্যাপককে বলালেন, তাই বলছিলাম আর কী। আপনি নিজেই কি সেই অধ্যাপক নন? অবশ্য এক অধ্যাপক ক্রমশ বিলীন হয়ে মিশে গেছে হাজারো অধ্যাপকে। আধ্যাত্মিকতার চর্চা যারা করেন তারা তো এই কথাই বলেন, আমরা সকলেই যুক্ত। রঙ্গশালা উপন্যাসে দুটি চরিত্রের মধ্য দিয়ে আপনি কী চমৎকারভাবে পুরো বাঙালি সমাজটাকেই তুলে এনেছেন। শুধু বাঙালিই বা বলছি কেন, পুরো উপমহাদেশটাই কি এই রঙ্গশালায় উঠে আসেনি? কি বললেন? আপনাকে বারবার স্যার বলছি কেন? আপনি অধ্যাপক মানুষ, তার ওপর একজন বড়ো লেখক, আপনাকে সম্মান দেখানোর জন্য তো স্যার বলাই যায়, যায় না কি? অবশ্য আপনি তো আবার এই স্যার বলার ভীষণ বিরোধী। আমাদের দেশের কয়েকজন অধ্যাপক-লেখককে লোকেরা যেভাবে স্যার স্যার করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলে সেই কথা আপনি বেশ ভালোভাবেই তুলে ধরেছেন। “স্যার” বিষয়ে আমার জীবনের গল্পটা এই সুযোগে আপনাকে বলেই ফেলি। আমি নিজেও শিশুকাল থেকেই এই শব্দটির প্রতি বীতশ্রদ্ধ ছিলাম। কাউকে “স্যার” বলতে হবে শুধু এই কারণে ভেবেছিলাম চাকরি-বাকরিই করবো না। পরে বড়ো হয়ে জেনেছি, বাংলাদেশে অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে উর্ধতনকে স্যার বলতে হয় না। সেই সেক্টরটিকেই বেছে নিয়েছিলাম, এনজিও সেক্টর। কিন্তু কর্মজীবনের প্রায় শুরুর দিকে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আমাকে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। প্রতিষ্ঠানের বড়ো কর্তাকে আমি স্যার বলতাম না। লেখালেখি-সূত্রে তিনি আমার পূর্ব পরিচিত ছিলেন বলে “ভাই” বলতে শুরু করি। এতে তিনি রেগে যান, বলেন, সরকারি অফিসে “ভাই” চলবে না। তখন ভাববাচ্যে কথা বলা শুরু করলাম। আমার জিহ্বাটা স্যার খুব বেয়াদব, কিছুতেই স্যার উচ্চারণ করতে চাইছিল না। বড়োকর্তা তার সহকারীকে দিয়ে আমাকে হুমকি-ধামকি দিচ্ছিলেন। আমার কাছে মনে হচ্ছিল “স্যার” বলানোর মধ্য দিয়ে তিনি আমার স্বাধীন এবং উঁচু মাথাটাকে তার পায়ে নোয়াতে চাইছিলেন। অবশেষে আমার পরাজয় হল। না, না, স্যার বলিনি, চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে বেরিয়ে যাই সরকারি অফিসের বিশাল চত্বর থেকে। এরপরে যোগ দেই ব্র‍্যাকে। ব্র‍্যাকের প্রধান ফজলে হাসান আবেদকে আমরা ডাকতাম আবেদ ভাই। কিন্তু কী আশ্চর্য স্যার দেখেন, সেই আবেদ ভাইও একদিন স্যার হয়ে গেলেন। ব্রিটিশরা আমাদের ছাড়লোই না।

ঠিক আছে, ঠিক আছে৷ আমরা যেহেতু লেখক হিসেবে সতীর্থ, অবশ্য আমি লেখক হতে পেরেছি কি-না তা নিয়ে আমার এখনও কিছুটা সন্দেহ রয়ে গেছে, তবুও, আপনাকে ভাই বা দাদা বলে সম্বোধন করা যায়। আমার কিন্তু আরো একটা সমস্যা আছে। আমি লক্ষ করে দেখেছি উপমহাদেশের বাঙালি হিন্দুরা বড়োদের দাদা বলেন। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সব বড়ো ভাইকেই তারা দাদা বলে ডাকেন কিন্তু মুসলমানেরা যদি হিন্দু বড়ো ভাইদের ভাই বলে ডাকেন তারা সেটা মেনে নিতে চান না, তারা চান আমরা তাদেরকে দাদা বলি। এর প্রতিবাদেই আমি অনেক হিন্দু বড়ো ভাইকে ইচ্ছে করেই ভাই বলি। কী বললেন, আপনার তাতে আপত্তি নেই? আপনি একজন প্রকৃত উদার লেখক, এইজন্যই তো আপনাকে এতো পছন্দ করি। ঠিক আছে এখন থেকে আপনাকে ভাই বলেই সম্বোধন করবো। শুধু বাঙালিদের মধ্যে না পৃথিবীর সব দেশের মানুষের মধ্যেই নাম সংক্ষেপ করে ডাকার প্রচলন আছে। এই যেমন এলিজাবেথ হলো লিজ, উইলিয়াম হলো বিল, মার্গারেট হলো পেগি, রিচার্ড হলো ডিক, এমন আরো আছে। আমাকে একদিন এক বাঙালি বন্ধু বলেন, দেখো ওরা মানুষের নাম রাখে ডিক, কী বিচ্ছিরি। কিন্তু আমার সেই বাঙালি বন্ধু হয়ত ভুলেই গেছেন, আমরাও তো “সোনা মিয়া” নাম রাখি। আমি যখন কসোভোতে কাজ করতাম, আমার স্থানীয় সহকর্মীরা আমার অতি সংক্ষিপ্ত কাজী নামটাকেও আরো সংক্ষেপ করে ডাকত কাজ। ভয়ে ভয়ে থাকতাম কখন না আবার ‘কা’ ডাকতে শুরু করে। এই দেখেন আবার সেই কাকপক্ষীর ডাকের মধ্যে চলে এলাম। তো আপনাকে হরিশংকর ভাই না বলে বরং শংকর ভাই বলি, কী বলেন? মাইন্ড করবেন না বলছেন? যাক আশ্বস্ত হলাম। 

আপনি খুব উদার মানুষ শংকর ভাই, আর এ-কারণেই সাহস পাচ্ছি আপনার ভুলগুলো নিয়ে কথা বলার। একদিন বাংলাদেশের এক জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকের একটি উপন্যাস নিয়ে “পাঠকের পাতা” য় আলোচনা করেছিলাম। পাঠকের পাতা কী জিনিস? দেখো দেখি কাণ্ড, আমারই অপরাধ, পাঠকের পাতা কী জিনিস এটা না বলেই আলোচনা শুরু করে দিয়েছি। পাঠকের পাতা হচ্ছে শংকর ভাই একটি বুক ক্লাব। আমেরিকার সরকারি পাঠাগার কুইন্স লাইব্রেরির একটি বাংলা বুক ক্লাব। এই ক্লাবটি, কিছু বাঙালি পাঠককে নিয়ে, আমিই গড়ে তুলেছিলাম। প্রতি মাসে আমরা একটি বাংলা বই নির্বাচন করি। লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ সেই বইটি সংগ্রহ করে (বা কিনে নিয়ে) এক জায়গায় রাখে। ক্লাবের সদস্যরা বইটি লাইব্রেরি থেকে তাদের লাইব্রেরি কার্ড দিয়ে তুলে নেয়। মাসের একটি নির্দিষ্ট দিনে আমরা লাইব্রেরির অডিটোরিয়ামে একত্রিত হয়ে বইটি নিয়ে আমাদের পাঠ-প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করি। আমরা যেহেতু আলোচনার মধ্য দিয়ে বইটার নাড়িভুড়ি ছিঁড়ে-টিরে ফেলি, তাই এই আলোচনা পর্বটিকে বলি বই-ব্যবচ্ছেদ। এ-নিয়ে বোদ্ধা মহল আমাদের বেশ সমালোচনাও করেন। শব্দটা নাকি তাদের খুব অপছন্দ। এই মে মাসেই আমরা আপনার “রঙ্গশালা” গ্রন্থটিরও ব্যবচ্ছেদ করেছি। পাঠকের পাতার কারণেই আপনার বইটি আমার পড়া হলো। আমি পাঠকের পাতার কাছে কৃতজ্ঞ যে এমন ভালো একটি বই আমাকে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছে।

তো যে কথা বলছিলাম শংকর ভাই। সেই জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকের একটি বইয়েরও আমরা ব্যবচ্ছেদ করি। সেই বইটির নাকি শ’খানেক মুদ্রণ বেরিয়ে গেছে এবং নানান ভাষায় তা অনুদিতও হয়েছে। দুর্ভাগ্যক্রমে বইটির লেখক সেদিন আমাদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন। আমার আলোচনা শুনে তিনি খুব ক্ষিপ্ত হন। ক্ষিপ্ত যে হন তখন কিছুটা টের পেলেও ভেবেছিলাম পরে ঠাণ্ডা হয়ে যাবেন। কিন্তু ভদ্রলোক ঠাণ্ডা হননি। আমি কিন্তু লেখক হিসেবে তাকে বেশ সম্মান করি। তিনি আপনার মতোই বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন, আগামী বছর হয়ত একুশে পদকও পেয়ে যাবেন। তিনি সেই বই-ব্যবচ্ছেদে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যার, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার এই বইটির অনেক প্রশংসা করেছেন। আপনিই বলেন শংকর ভাই, বিখ্যাত স্যারেরা প্রশংসা করলেই কি আমাকেও প্রশংসা করতে হবে? স্যারেরা তো নানান কারণে প্রশংসা করেন, সেটা কী আমরা জানি না? তো কিছুদিন পরে সেই জনপ্রিয় লেখক ফেইসবুকে আমাকে ব্লক করে দেন। তখন বুঝলাম তার রাগ বুঝি পড়েনি। অবশ্য সম্প্রতি তার সঙ্গে একটি অনুষ্ঠানে আমার দেখা হয়েছে এবং তিনি আমার সঙ্গে আন্তরিক এবং সৌজন্যমূলক ব্যবহার করেছেন। শুধু তাই না মাইক্রোফোনেও আগের মতোই আমার সম্পর্কে প্রশংসাসুচক কথা বলেছেন। আমি কিন্তু তাকে খুব পছন্দ করি, তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হোক এবং তা যুগ যুগ টিকে থাক তা আমি চাই।

শংকর ভাই, আপনার রঙ্গশালা আমি অতি আনন্দের সঙ্গে পাঠ করেছি। আমি অতীতে আর কোনো মনোলগ উপন্যাস পাঠ করিনি। নাটক দেখেছি, সিনেমা দেখেছি, মনোলগ কবিতাও পড়েছি কিন্তু এই প্রথম উপন্যাস পড়লাম। বইটা যে আমার খুব ভালো লেগেছে তা নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে পারছেন আমার এই মনোলগ বুক রিভিউ শুনেই। আপনি কী দারুণ দক্ষতায় নিজের ভেতর থেকে একটি সত্বাকে বের করে এনে তাকে দিয়ে খুন করালেন, এবং ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে বসিয়ে দিলেন রমনা পার্কে। আবার নিজেই রোজ তার কাছে যাচ্ছেন তার গল্প শুনতে, মূলত নিজের সারা জীবনের অর্জিত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ ভিক্ষুককে দিয়ে বলালেন নিজেকেই এবং তা শোনালেন পৃথিবীকে। মনোলগের প্রধান যে বৈশিষ্ট্য মানুষের ভেতরের অন্তর্গত হাহাকারের একটি নিবিড় পর্যবেক্ষণ উপস্থাপন করা তা আপনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন। মনোলগের সবচেয়ে বড়ো ঝুঁকি যেটা তা হচ্ছে বিরক্তিকর বিবৃতি হয়ে ওঠা। সেটিও আপনি হতে দেননি। একজন দক্ষ ঔপন্যাসিকের মতো নানান গল্প এবং নবরসের জারকে ভিজিয়ে বক্তব্যকে রসালো, মানে সুখপাঠ্য করে তুলেছেন। আপনাকে স্যালুট শংকর ভাই। পৌরাণিক কাহিনী, রামায়ন-মহাভারত, বেদ-গীতায় যে আপনার অসামান্য দখল আছে তাও প্রমাণ করেছেন। আপনি একজন নমস্য কথাসাহিত্যিক শংকর ভাই। 

আপনি কৈবর্ত মানুষ, মাছ ও জলের প্রতি আপনার টান থাকবেই। বিষ্ণুর প্রথম অবতার মৎস্য প্রসঙ্গ টেনে যে কথাগুলো বলেছেন তা আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। তবে আপনি যদি হিন্দুদের দশ অবতার না বলে আরো সুনির্দিষ্ট করে বিষ্ণুর দশ অবতার বলতেন তাহলে আমি বিভ্রান্তি এড়াতে পারতাম। 

অনেকক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখেছি? হ্যাঁ তাই তো। আপনি সত্তর ছুঁই ছুঁই একজন মানুষ, আমি না হয় মধ্য-পঞ্চাশের তরুণ, এক-দেড় ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকা কোনো বিষয়ই না। আসেন একটু হেঁটে ওই চায়ের দোকানটাতে যাই। কী বললেন? চা নেই কোথাও? সব চায়ের দোকানে এখন কফি বিক্রি করে? কফিতে আমার অবশ্য কিছুটা অসুবিধা হয়। গ্যাস বেড়ে যায়, ঘুম হয় না। ঠিক আছে আপনার সৌজন্যে আজ না হয় সহ্য করে নেব। চলুন বসা যাক।

হ্যাঁ, বলছি। যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম সেখানেই আসছি। আপনি সত্যিই খুব উদার মানুষ। বাংলাদেশের অনেক বিখ্যাত লেখকের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে, বন্ধুত্ব আছে, তাদের লেখায় ভুল আছে এই কথা মুখ দিয়ে বের করলেই আমার কাছ থেকে এক’শ হাত দূরে চলে যায়। ওই যে ট্রাকের পেছনে লেখা থাকে না, একশ হাত দূরে থাকুন। সেইরকম, আমাকে হয়ত তারা একটি ঘাতক ট্রাক ভাবে। 

শংকর ভাই, আপনি তো বললেন কাকপক্ষীর সন্ত্রাস আপনি দেখেছেন, গ্রামের বনে-জঙ্গলে অনেক ঘুরেছেন কিন্তু এটা কী করে সম্ভব হলো যে আপনি কখনো কাকের বাসা দেখেননি? ছোটো বেলা বইপত্রে পড়েছি কোকিল নিজে বাসা বানাতে জানে না, সে কাকের বাসায় ডিম পারে। কিন্তু আমি নিজে কখনোই কোকিলকে কাকের বাসায় ডিম পাড়তে দেখিনি। তবে একথা নিশ্চিত করে বলতে পারি, হাজার হাজার কাকের বাসা দেখেছি। কাকস্য ত্রাসে অতীষ্ঠ হয়ে মাঝে মাঝে বরই গাছে, আম গাছে তৈরি করা কাকের বিচ্ছিরি এবং বেশ শক্ত বাসাগুলো ভেঙে দিয়েছি। নিজ হাতে বাসা ভাঙতে গিয়ে অনেক সময় কাকের আক্রমণেরও শিকার হয়েছি। অথচ আপনি কেন ‘বাসস্থান’ অধ্যায়ের ৫৫ পৃষ্ঠায় ঠিক তার উল্টোটা লিখলেন আমার তা বোধগম্য হলো না। 

কী বললেন, পড়ে শোনাবো? হ্যাঁ শংকর ভাই, তাও শোনাতে পারব। প্রকৃতপক্ষে আমার এটা আগেই সন্দেহ হয়েছিল যে আপনি আমার কথা বিশ্বাস করবেন না। তাই আমি বইটা সঙ্গে করে নিয়েই এসেছি। একটু দাঁড়ান। ব্যাকপ্যাক থেকে বইটা বের করে আপনাকে দেখাচ্ছি। কী ব্যাপার হাসছেন যে? ওহ, দাঁড়ান বলেছি, সেজন্য? বাঙালিরা এমন অনেক কিছুই ভুল বলে। সব কথাকে আক্ষরিক অর্থে নিতে হয় না। আপনিতো পণ্ডিত মানুষ, এই বিষয়গুলোকে কী আমরা সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি বলতে পারি? পারি বলছেন? ‘একটু দাড়ান’ বললে তো আর কেউ দাঁড়ায় না, একটু অপেক্ষা করে। কাজেই এটা চলতে পারে। এই যে পেয়েছি। পড়তে বলছেন? পড়ছি।

“কাকের সংসারের কথা ধরেন। বাসা বাঁধতে জানে না সে। কিন্তু তার সংসার করা চাই। কাকের শরীরে বসন্ত এলে কাকিনীকে খুঁজে নেয়। ফুর্তিফার্তার পরে কাকিনী গর্ভবতী হয়ে পড়ে। কাক তো ফুর্তি করেই চম্পট। পেটে ডিম নিয়ে এগাছে-ওগাছে কাকিনীর ঘুরে বেড়ানো। কোকিলের বাসায় টুপটাপ ডিম পারে। বাসায় তো আগে থেকেই কোকিলের ডিম। কী করা? কাকিনী ঠোঁট দিয়ে গুতিয়ে, ঠ্যাং দিয়ে আঁচড়িয়ে কোকিলের ডিমগুলো নিচে ফেলে দেয়। ফেলে দিয়েই উড়াল। কোকিল তো আর বুঝতে পারে না। কাকিনীর ডিমে তা, বাচ্চা ফোটানো, লালনপালন – সবই নিজ বাচ্চা ভেবে কোকিল করে যায়। মুশকিল হয় তখনই, কাউয়ার বাচ্চাগুলো কা করে ওঠে। তখন কোকিলের রাগ ওঠে মাথায়। কামড়াতে, ঝাপটাতে থাকে কাউয়ার বাচ্চাদের। ততদিনে কাউয়ার বাচ্চারা উড়তে শিখে গেছে।”

কী ব্যাপার গম্ভীর হয়ে গেলেন যে? প্রিন্টিং মিস্টেক? আমার কিন্তু তা মনে হয় না। শংকর ভাই আপনি গভীরভাবেই বিশ্বাস করেন কাক বাসা বানাতে জানে না, সে কোকিলের বাসায় ডিম পারে। আমি কীভাবে নিশ্চিত হলাম? বলছি। ১০৯ পৃষ্ঠাতে যাই, এই যে দেখেন, এখানে লিখেছেন, “শাস্ত্র বলেছে, পাখিদের মধ্যে কাক, পশুদের মধ্যে শেয়াল আর মানুষের মধ্যে নাপিত সবচেয়ে ধূর্ত। কোকিলের বাসায় কাকের ডিম পাড়ার কথা, শেয়ালের কাছে কুমিরের বাচ্চা পড়তে দেওয়ার গল্প তো আপনার জানা। এবার নাপিতের গল্প শুনুন স্যার”।  এখানেও কিন্তু আপনি আপনার পর্যবেক্ষণ বা জ্ঞান নিশ্চিত করেছেন, কোকিল নয় কাকই বাসা বানাতে জানে না। 

কী ব্যাপার শংকর ভাই উঠছেন যে? মাথাটা ঝিমঝিম করছে? আরেকটু বসবেন না, আরো কিছু কথা ছিল যে…

নোট: হরিশংকর জলদাসের মনোলগ উপন্যাস ‘রঙ্গশালা’ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে ভাবলাম তার মনোলগ ফর্মেই লিখি। হয়ত এই স্টাইলটি আপনাদের খারাপ লাগেনি। 

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

পথিক মোস্তফা on সাক্ষাৎকার : নয়ন আহমেদ
সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা