spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যরাশিচক্র, না-কি রাশি-চক্রান্ত!

লিখেছেন : মুহাম্মদ নিযামুদ্দীন

রাশিচক্র, না-কি রাশি-চক্রান্ত!


মুহাম্মদ নিযামুদ্দীন

দুর্ভাগ্য দুনিায়ার, কিছু লোক আছে, ভাগ্য গণনায় যতটা বিশ্বাস করে, ভাগ্য বদলে ততটা বিশ্বাস করেনা। তাই তারা জ্যোতিষী বা গণকের কাছে যায়, হাত দেখায়, কিন্তু সেই হাতকে কাজে লাগিয়ে ভাগ্য বদলের চেষ্টা করেনা। এই শ্রেণির লোকেরা অধিকাংশই হয় অলস, কিংবা অকাজের। কাজের কোনো ধারেনা ধার – অলসতাই তাদের অলংকার ও অহংকার! না করলেও কাজ, জারি রাখে মুখের রাজ। মুখ থাকে সদা সচল। যেন নদীর ধারা কল কল ছল ছল। কে হারায় তাদেরে! নিজেরাই ঘুরতে থাকে নিজেদের চারিধারে। কাজ না করলেও নেই স্বপ্ন দেখার শেষ। স্বপ্নের মাঝে পায় খুঁজে তারা রঙিন যত রেশ। স্বপ্নের মাঝে দেখায় যত যোশ। তারি ফলে যত স্বপ্নদোষ! জীবনকে মনে করে ইজি। কাজ না করেও থাকে সেকি বিজি! বিজি ফর নাথিং যাকে বলে। ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে এই ভূগোলে। ছড়াকার লুৎফুর রহমান রিটন তাঁর ‘এক অলসের গল্প’ শীর্ষক ছড়ায় তাদের পরিচয় প্রদান করতে গিয়ে লিখেছেন —

ব্যস্ত থাকি ব্যস্ত ভীষণ, নইলে সময় পেলে
হতে পারতাম ম্যারাডোনা বেকহ্যাম বা পেলে।
একটু যদি সময় পেতাম লেখালেখি করার
বই লিখতাম উপন্যাসের কবিতা আর ছড়ার।
রবীন্দ্রনাথ-নজরুলেরই মতো আমার গুণ
নিদেনপক্ষে হতে পারতাম সুনীল-হুমায়ূন।

ক্রিকেট খেলায় একটু যদি গড়ে নিতাম ভিত
শচীন কিংবা ব্রায়ান লারা হতাম তা নিশ্চিত।

এসব কিছুই হই নি কারণ আমার সময় কম
নাওয়া-খাওয়ার ফুরসত নেই ঘুমেরও একদম…

কথায় আছে — নেই কাজ, খই ভাজ। যারা ‘বিজি ফর নাথিং’, তাদের চিন্তা-চরিত্রও সেরকম। কাজ নেই, হয়েছে কি? সমাধান ইজি – থাকতে হবে বিজি। অর্থাৎ কাজকে বিদায় দিয়ে, থাকতে হবে আকাজ নিয়ে। সেই আকাজ আবার একটি নয় – অনেকগুলো। সেখান থেকে কয়েকটি তার, চেষ্টা করবো আলোচনায় আনার।তার মধ্যে আরম্ভেই আসে টিয়া পাখি, বানর ও লটারির মাধ্যমে লাক তথা ভাগ্য পরিবর্তনের দুর্ভাগ্যজনক প্রচেষ্টা। মানুষকে বলা হয় শ্রেষ্ঠ প্রাণী। সেই শ্রেষ্ঠতা শুধু অবয়বেই নয়, আকলেও। একজন ব্যক্তি কতটা বেআক্কেল হলে পরে নিজের সেই শ্রেষ্ঠতা ভুলে গিয়ে ট্রেনিং প্রাপ্ত টিয়া পাখিকে টিচার মেনে ভাগ্যের দিক নির্দেশনা বা জ্ঞান নিতে পারে! যে নয় নর, লোকে তাকে বলে বানর ; কাজ না করে, খায় সে চুরি বা ছিনতাই করে ; তার কাছ থেকেও হায়, নিজের ভাগ্যলিপি জানতে চায়! কারো মাথার খুলি যদি থাকে খালি, সে-ই শুধু পারে এভাবে নিজের বিদ্যা ও বদনে লাগাতে চুনকালি! কেউ কেউ আছে শূণ্য থাকলেও পকেট, ধার করে হলেও কিনে ফেলে লটারির টিকেট। লক্ষ্য থাকে এই আশায় – যদি লাইগ্যা যায়! লাগলে বনে যায় আধা লাট, দু’দিন যেতে না যেতেই ভেঙে পড়ে খাট! ভেঙে না পড়ে নেইও উপায়। বসে বসে আর ক’দিন খাওয়া যায়! যদি না লাগে লটারি দেয় কপালের দোষ – এমনই গোপাল তারা, কিংবা নন্দঘোষ! এরপর আছে আরো চমৎকার – তা হলো গণৎকার! হাওলাদার, জাব্বার, কত কি নামের বাহার! কেউ কেউ তাদেরকে জ্যোতিষী, ভাগ্যগণনাকারী হিসেবেও চেনে। বড় চমৎকার এই ব্যবসা। কোনো পুঁজিপাটা লাগেনা। কথার মধু আর কৌশলের যাদু – এ দু’টো হলে কিছুই লাগেনা সাধু। অন্যের পকেট থেকে যায়, আর তাদের হয় আয়! বনফুলের একটি কবিতাংশেও পাওয়া যায় এই গণৎকারদের কথা। তিনি লিখেছেন–

হস্ত-লিখন বিচার করিছে গণৎকার
টং টং টং উঠিছে টাকার টনৎকার
সমরাঙ্গনে বাজিছে অসির ঝনৎকার
চমৎকার!

এই যে গণৎকার, হস্তরেখার কথা বলে মানুষের পয়সা হাতানোই তাদের কারবার। অধিকাংশ মানুষ যেহেতু আন্ধা, সেই সূযোগ বুঝে তারাও চালায় বিনা পুঁজির ধান্দা। সুকুমার বড়ুয়া তাঁর ‘ভাগ্য ভালো’ শীর্ষক ছড়ায় তাদের কর্মকান্ডকে তুলে ধরেছেন যত্নকরে ও যথাযথভাবে। তিনি লিখেছেন–

ভাগ্য ভালো কপাল ভালো
মন্দ শুধু বরাত–
হাতটা দেখে গণক বলেন–
পয়সা ফেলো ঝড়াৎ।
কাল ভালো যে বর্তমান,
কপাল ভালো মর্তমান,
ফাড়া-দশা পড়বে কাটা
থাকলে লোহার করাত।
মন্দ শুধু বরাত।
শনির দশা বুধের দশা
এখন তোমার মাথায় বসা,
সেই কারণে রাখতে হবে
ডজনখানেক মাদুলি–
রাহুর সাথে দুষ্ট গ্রহ
নষ্ট করে অহরহ
পূর্ণিমাতে খরচ করো
গণ্ডা দশেক আধুলি।

এই ভাগ্যগণনাকারীদের কাজ হচ্ছে ভাগ্যরাশির দুর্ভাগ্যের কথা বলে মানুষের মনে ভয় সৃষ্টি করা। যদি যায় ভয় সৃষ্টি করা, উদ্দেশ্য তাদের হয় পুরা। বিশ্বাস না হলে সুকুমার রায়ের ‘হাত গণনা’ শীর্ষক ছড়ার নন্দ খুড়োর নিরানন্দ জীবনটাকে একটু দেখুন –

ও পাড়ার নন্দ গোঁসাই, আমাদের নন্দ খুড়ো,
স্বভাবেতে সরল সোজা অমায়িক শান্ত বুড়ো।
ছিলো না তার অসুখ বিসুখ, ছিল সে যে মনের সুখে,
দেখা যেত সদাই তারে হুঁকোহাতে হাস্যমুখে।
হঠাৎ কি তার খেয়াল হ’ল, চলল সে তার হাত দেখাতে-
ফিরে এল শুকনো সরু, ঠকাঠক্ কাঁপছে দাঁতে!
শুধালে সে কয়না কথা, আকাশেতে রয় সে চেয়ে,
মাঝে মাঝে শিউরে উঠে, পড়ে জল চক্ষু বেয়ে।
শুনে লোক দৌড়ে এল, ছুটে এলেন বদ্যিমশাই,
সবাই বলে, ‘কাঁদছ কেন? কি হয়েছে নন্দ গোঁসাই?’
খুড়ো বলে, “বলব কি আর, হাতে আমার পষ্ট লেখা।
আমার ঘাড়ে আছেন শনি, ফাঁড়ায় ভরা আয়ুর রেখা।
এতদিন যায়নি জানা ফিরছি কত গ্রহের ফেরে–
হঠাৎ আমার প্রাণটা গেলে তখন আমায় রাখবে কে
রে?
ষাটটা বছর পার হয়েছি বাপদাদাদের পুণ্যফলে–
ওরে তোদের নন্দ খুড়ো এবার বুঝি পটোল তোলে।
কবে যে কি ঘটবে বিপদ কিছু হায় যায় না বলা”–
এই ব’লে সে উঠল কেঁদে ছেড়ে ভীষণ উচ্চ গলা।
দেখে এলাম আজ সকালে গিয়ে ওদের পাড়ার মুখো,
বুড়ো আছে নেই কো হাসি, হাতে তার নেই কো হুঁকো।

দুঃশ্চিন্তায় ও ভয়ে বুড়ো খুড়োর কি ভয়াবহ অবস্থা তা তো বোঝা গেলো, কিন্তু নজরুলের ‘ভূমিকম্প’ কবিতায় সবাই এদিক-ওদিক ছুটছে কেন, তাও জানা দরকার। ভয়ে নয় তো! দেখি কবি কি বলেন —

রসিক জ্যোতিষী করেছে গণনা
পৃথিবী টলিবে তেসরা মার্চ,
আল্লাহ, হরি, যিশুকে ডাকিছে
মসজিদ, মন্দির ও চার্চ।
ভয়ে আর কেহ রয় না বাড়িতে
লরিতে মোটরে ছ্যাকড়া গাড়িতে
বোঁচকা পোঁটলা হাঁড়িতে কুঁড়িতে
ছেলেতে মেয়েতে বুড়োতে বুড়িতে
কাঁপিতে কাঁপিতে রাত্রি যাপিতে
চলিছে সকলে গড়ের মাঠ।
কাছা কোঁচা খুলে বাঙালি ছুটিছে
গায়ের উড়ুনি ধুলায় লুটিছে
তারো আগে ছুটে লইয়া খাটিয়া
মাড়োয়ারি আর উড়িয়া ভাটিয়া
বাঙালির পায়ে হারাইয়া দিয়া
বন্ধ করিয়া দোকান পাট।
পগগড় খুলে বদন মেলিয়া
দোক্তা –খৈনি বটুয়া ফেলিয়া
ছুটিছে পথের ষাঁড়েরে ঠেলিয়া
তাঁরো আগে চলে ভুঁড়ি বিশাল।

এই যে জ্যোতিষী বা গণৎকার, নেই মিল তাদের বলার সাথে বাস্তবতার। তারপরও কথার কি বাহার, বলে কিনা — বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে মেলা ভার! যেমন এক লোক নিজের ভাগ্য জানার জন্য গিয়েছিলেন এক জ্যোতিষীর কাছে। বড় জ্যোতিষী, তাই তার ফি বেশি। ফি দিয়ে লোকটি হস্ত প্রসারণ করলেন জ্যোতিষীর দিকে। পেয়ে ফি তাকান জ্যোতিষী তীক্ষ্ণ চোখে। তারপর হস্তরেখা পর্যবেক্ষণ করে – যান ধ্যানের বেশে জ্ঞান বিতরণ করে – “ফাঁড়া আপনার কেটে গেছে, এ বছর আপনি পুত্র সন্তানের পিতা হবার সম্ভাবনা আছে।” লোকটি জ্যোতিষীর কথার জবাব না দিয়ে, নবাবের মতো সোজা ফিরে এলেন আপন আলয়ে । তারপর তিনি আগের মতো, হয়ে পড়লেন জীবন-যাপনে রত। এভাবে দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায়, আসে বছর ; কিন্তু জ্যোতিষীর ভবিষ্যৎবাণীর নেই খবর! লোকটি জ্যোতিষীর কাছে যান আবার, বলেন কথা ভবিষ্যৎবাণী না ফলার। ব্যর্থতার কথা শুনে জ্যোতিষী বিব্রত হয়ে পড়েন, দ্রুত নিজেকে সামলে নেন। তারপর যথানিয়মে ফি নেন, ফের হাত দেখেন। দেখে ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়েন। ভেঙে গেলে ধ্যান, দেওয়া আরম্ভ করেন জ্ঞান — ‘দেখতে পাচ্ছি আমি নিশ্চিত জনাব, এ বছর আপনি হচ্ছেনই পুত্রসন্তানের বাপ।’ সে বছরও গেলো, কিন্তু রাশিফল, হলো বিফল। লোকটি তৃতীয়বার জ্যোতিষীর কাছে যান, ভবিষ্যৎবাণী না ফলার কথা করেন বয়ান। শুনে জ্যোতিষীর তো মাথা ঘোরায় – দুঃশ্চিন্তা দ্রুত বেড়ে যায়। তিনি জ্যোতির্বিদ্যার বড় কেতাবখানি বের করে, চশমা চোখে ঘন্টাখানেক পড়েন ধীরে ধীরে । তারপর লোকটির জন্ম তারিখ ও হস্তরেখা বইটির সাথে মিলালেন। সবকিছুই তো ঠিক আছে দেখা যায়, তবুও কেন তার পুত্র সন্তান হয়না হায়! জ্যোতিষী পড়ে যান মহাভাবনায়, যদি মানুষ জেনে যায় – ভবিষ্যৎবাণী তার হয়েছে ব্যর্থ, তাহলে তো নষ্ট হবে স্বার্থ! খেতে হবে ধরা, এখন যায় কি করা! হঠাৎ চিন্তা খেলে তার মাথায়, চিন্তাকে রূপ দেন জিজ্ঞাসায়। জিজ্ঞেস করেন- জনাব বিয়ে করেছেন? লোকটি দেন জবাব – বললে হবে পাপ ; সেই সৌভাগ্যের দ্বার, আজো খুলেনি আমার। শুনে জ্যোতিষী রেগে কয় – বিয়ে না করলে কি কেউ বাপ হয়? লোকটিও যায় সাথে সাথে রেগে – সেকথা কেন জানা হয়নি আগে? করবেন মাফ, মাইর খেলে সবাই ডাকে বাপ!

১৯৯৫ সালের ৮ ডিসেম্বর প্রকাশিত দৈনিক জনকণ্ঠ-এর প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে জ্যোতিষীদের জারিজুরির কথা। কয়েকটি প্রতিবেদনের একটির শিরোনামই ছিলো ‘প্রতারণা’। প্রতিবেদনে পরিষ্কার তুলে ধরা হয়েছে ভাগ্য গণনার নামে কিভাবে মানুষের সাথে প্রতারণা করে জ্যোতিষীরা। উক্ত প্রতিবেদনের ‘সব জ্যোতিষ ভুয়া’ শীর্ষক উপশিরোনামে লেখা হয়েছে, “প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত জ্যোতিষীদের বিজ্ঞাপনের ভাষা লক্ষ্য করুন। জ্যোতিষী জীবন চৌধুরী বলছেন, আপনি যদি কোন হাকিম, কবিরাজ, জ্যোতিষীর কাছে প্রতারিত হয়ে থাকেন তারপরও অনুরোধ একবার আমার কাছে শেষ বারের মতো প্রতারিত হোন। সুফিয়া আহমেদ বলছেন, যারা, বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন তাদের কাছে আমার চ্যালেঞ্জ…..। রাজধানীর যে কোন একজন জ্যোতিষীর কাছে গেলেই জানা যাবে, তিনি ছাড়া আর সব জ্যোতিষী ভুয়া। এরা সবাই আবার এক একটি জ্যোতিষ সংগঠনের সভাপতি বা চেয়ারম্যান। প্রফেসর হাওলাদার ওয়ার্ল্ড এস্ট্রলজি সোসাইটির চেয়ারম্যান। তিনি ছাড়া বাংলাদেশের আর কোন উল্লেখযোগ্য জ্যোতিষী এই সংগঠনের সদস্য নন। জ্যোতিষ টি আহমেদ বাংলাদেশ এস্ট্রলজিক্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট। ন্যাশনাল কলেজ অব অকাল্ট স্টাডিজ নামে একটি কলেজের আবার তিনি অধ্যক্ষ। মহাজাতক হচ্ছেন ওয়ার্ল্ড এস্ট্রলজিক্যাল এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান। স্বঘোষিত নানা ধরণের নাম ও পদবী ব্যবহার করেন জ্যোতিষীরা। বিদেশের এমন সব প্রতিষ্ঠান থেকে স্বর্ণপদক, ডিগ্রী বা পুরস্কার পান যার অস্তিত্ব নির্ণয় করা সম্ভব নয়।…পৃথিবীর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন এই শাস্ত্র পড়ানো হয়না – এর কোন সদুত্তর জ্যোতিষীরা দিতে পারেননি। কারণ আর কিছু নয়, জ্যোতিষ শাস্ত্র বলে কোন শাস্ত্র পড়ানোর যুক্তি বিজ্ঞানের এই অগ্রগতির যুগে খুঁজে পাওয়া যায় না।” উক্ত পত্রিকায় উক্ত তারিখে প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিলো ‘ভাগ্য গণনাঃ চিচিং ফাঁক’। শিরোনামের ‘চিচিং ফাঁক’ শব্দটি যে চিটিংবাজিকে তুলে ধরে, সেকথা বলাই বাহুল্য। প্রতিবেদনটিতে দেখানো হয়েছে, কিভাবে ‘জনকণ্ঠ’ প্রতিবেদক মোয়াজ্জেম হোসেনের রাশিফল তিনজন জ্যোতিষীর নিকট তিনরকম প্রতিভাত হয়েছে। অর্থাৎ নেই ঐক্য – পরিলক্ষিত হয়েছে পার্থক্য। মোয়াজ্জেম হোসেন যে তিন জ্যোতিষীর কাছে গিয়েছিলেন, তারা হলেন, টি আহমেদ, যিনি গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান অনুসারে ; প্রফেসর হাওলাদার, যিনি হাত দেখে এবং প্রফেসর এম এ মান্নান, যিনি নিউমারোলজির ভিত্তিতে তাঁর ভাগ্য গণনা করেন! কিন্তু দুর্ভাগ্য, কেউ তাঁর ভাগ্য সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারেননি। তার মানে মানুষকে বানিয়ে বোকা – দেন তারা সবসময় ধোকা।

জ্যোতিষীদেরকে নিয়ে সমাজে বহু কিচ্ছা-কাহিনী প্রচলিত আছে। যেমন–

জ্যোতিষীঃ আপনি কমসে-কম আশি বছর বাঁচবেন।
কেউ এ বাঁচা ঠেকাতে পারবেনা।

ব্যক্তিঃ যদি না বাঁচি?

জ্যোতিষীঃ তাহলে এসে আমার দু’গালে চড় মেরে
ফিসটা ফেরত নিবেন!

দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলংকার রাজনীতিবিদরা জ্যোতিষশাস্ত্রে গভীর আস্থা রাখেন। তাঁদের অনেকের ব্যক্তিগত জ্যোতিষী আছে, যাঁদের পরামর্শ অনেক সময় জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগীদের চেয়েও অধিক গুরুত্ব পায়। একবার হয়েছিলো কি, এক জ্যোতিষী সে দেশের সরকার সংকটের মুখে- এই ভবিষ্যতবাণী করে কি বিপদেই না পড়েছিলেন! কিন্তু কথা হচ্ছে নিজের বিপদের কথা যদি আগে জানতেন, তাহলে কি এমন ভবিষ্যতবাণী তিনি করতেন? এ সংক্রান্ত এক সংবাদে লেখা হয়েছে, “ভবিষ্যতবাণী করে ফেঁসে গেলেন শ্রীলংকার এক জ্যোতিষী। প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষের সরকার মারাত্মক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের মুখে- এই ভবিষ্যতবাণী করার পর ওই জ্যোতিষীকে গ্রেফতার করা হয়।”(দৈনিক প্রথম আলো, ২৭ জুন ২০০৯)। উল্লেখ্য, জ্যোতিষীর নাম চন্দ্রসিঁড়ি বান্দারা। ২০১৭ সালেও একটি ভবিষ্যতবাণী করে বিপদে পড়ে গিয়েছিলেন সে দেশের এক জ্যোতিষী। সংবাদে প্রকাশ, “প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা মারা যাবেন- এমন ভবিষ্যতবাণী বিফলে গেছে। তিনি তো দিব্যি বেঁচে-বর্তে আছেন। সেই জ্যোতিষী এবার ফ্যাসাদে পড়েছেন। শ্রীলংকার পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করেছে। ব্যর্থ জ্যোতিষীর নাম ভিজিথামুনি রোহানা ডি সিলভা।…পুলিশ গত বুধবার কলম্বোর আদালতে ওই জ্যোতিষীকে হাজির করেন। তিনি ২০ লাখ রুপি বা ১৩ হাজার ৩০০ মার্কিন ডলারের মুচলেকা দিয়ে জামিন পেয়েছেন।”(দৈনিক প্রথম আলো, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭)।

জ্যোতিষীরা অন্যের মৃত্যুর ভবিষ্যতবাণী যেভাবে করেন, সেভাবে নিজের মৃত্যুর ভবিষ্যতবাণী কেন করেননা, সেটা একটি সাধারণ প্রশ্ন সাধারণ মানুষের কাছে। মহীবুল আজীজের একটি গল্পের কিছু সংলাপেও সেই কথাসমূহ উঠে এসেছে সুন্দরভাবে। গল্পটির নাম ‘আত্মসচেতনতার পরিপ্রেক্ষিত’। সংলাপসমূহ এই-

: এই যে বাক্সপেটরা নিয়ে এক জ্যোতিষ যাচ্ছেন। একে
জিজ্ঞেস করে দেখি ট্রেন ছাড়বে কি না।
: কী করে বুঝলেন জ্যোতিষ?
: বাক্সের ওপর একটি হাতের ছবি আঁকা।
: আরে, জ্যোতিষের নিজের ট্রেনই কখন ছাড়ে সে
জানে না, আমার আপনার ট্রেনের খবর জানবে কি
করে! ওই গল্প শোনেননি?
: কোন গল্প?
: মানুষের হাত গণা শেষে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে
বাসচাপা পড়ে মরল জ্যোতিষ। প্রতিবেশীরা বউটাকে
প্রশ্ন করে, আগে জানতে পারল না? কাঁদতে কাঁদতে
বউ বলে, মরে গেছে যে! নইলে জিজ্ঞেস করতান!
(দৈনিক প্রথম আলো, ১৬ ডিসেম্বর ২০০২)

জ্যোতিষীদের হয়তো ধান্দা, কিন্তু জনগণ কেন এতটা আন্ধা? মানুষ নাকি ঠেকিয়া ও ঠকিয়া শেখে, কিন্তু এদের শেখার শেষ কোথায় কে দেখে! নেবে একহাত কোথায়, উল্টো তাদেরকে হাত দেখায়! হাত দেখানোর কারণ, রাশিফল অনুধাবন। জ্যোতিষীরা ভাগ্যগণনার ক্ষেত্রে যে শাস্ত্রের দাবি করেন, তার অন্যতম প্রধান পদ্ধতি হলো হাত দেখা। হাতের তালুতে ছোট-বড় সূক্ষ্ম-স্থূল যে অসংখ্য রেখা রয়েছে, সেগুলোকেই জ্যোতিষীরা নাম দিয়েছেন হৃদয়রেখা, শিররেখা, আয়ুরেখা প্রভৃতি। হাতের তালুকে তাঁরা বৃহস্পতি, শুক্র, শনি প্রভৃতি এলাকাতেও ভাগ করেন। সেখানে তাঁরা তারকা, চতুর্ভুজ প্রভৃতিও খুঁজে নেন। রেখা, তারকা প্রভৃতির আকার, দৈর্ঘ্য, অবস্থান, গভীরতা প্রভৃতির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে মানুষের ভবিষ্যত জানা যায় বলে তাদের দাবি। তবে এ বিষয়ে বিজ্ঞানের বক্তব্য বিপরীত। হাসনাইন খুরশেদ তাঁর ‘রহস্যাবৃত জ্যোতিষশাস্ত্র যেভাবে বিকশিত’ শীর্ষক গবেষণামূলক লেখার একস্থানে প্রসঙ্গক্রমে লিখেছেন, “বিজ্ঞান জ্যোতিষীদের এ দাবিকে সরাসরি নাকচ করে বলেছে, হাতের তালুতে ভাঁজ বা রেখা একইভাবে তৈরি হয়। এগুলো দেহে গঠনতান্ত্রিক বা এ্যানাটমিক্যাল খাঁজ ছাড়া কিছুই নয়। মাতৃগর্ভে যখন ভ্রূণ তৈরি হতে থাকে, তখন হাতের বিভিন্ন হাড়ের জয়েন্ট বরাবর তালু ও আঙ্গুলের চামড়া ভাঁজ হয়ে বিভিন্ন দাগ তৈরি করে। শিশু মায়ের গর্ভে হাত মুঠো করে থাকে বলে চামড়ায় ভাঁজের রেখা তৈরি হয়।”(দৈনিক জনকণ্ঠ, ৮ ডিসেম্বর ১৯৯৫)।

জ্যোতিষীদের হস্তরেখা বিচার, কত যে ভূয়া ও অসার, তা মির্জা গালিবের কবিতা পাঠ করেও উপলব্ধি করা যায়। যারা উপলব্ধি করতে অক্ষম বা থাকেন অজ্ঞতায়, তাদের জন্য কেবল হায়! হায়! গালিব তাঁর উর্দু কবিতায় লিখেছেন-
হাথো কি লাকিরো পে
মত জা গালিব,
কিসমত উনকি ভি হোতি হ্যায়,
জিনকে হাত নেহি হোতে।

অর্থাৎ-

হাতের রেখায় কখনো
করোনা বিশ্বাস গালিব,
ভাগ্য তারও থাকে-
যার নেই হাত।

দুনিয়াখ্যাত দার্শনিক কবি ইকবাল কিন্তু আসল কথাটিই বলে দিয়েছেন এ সম্পর্কে। যাকে বলে সোজা ছক্কা! তিনি তাঁর এক কবিতায় লিখেছেন-

খুদীকো কর্ বুলন্দ ইতনা কি
হর্ তকদীরসে পহ্ লে
খুদা বান্দেসে খোদ পুছে
বাতা তেরী রিযা কিয়া হায়্?

অর্থাৎ-

জ্বালো, জ্বালো জ্বালো নর! তব সুপ্ত আত্মশক্তি-শিখা,
যেন তকদীর বিতরণ আগে
স্বয়ং বিধাতা কহে অনুরাগে
বলতো বান্দা, বল কিবা চাও তোমার ললাট-লিখা?
(অনুবাদ- প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ)

এপ্রসঙ্গে এক আরবি কবির কবিতাও উদ্ধৃতির উপযোগীতা রাখে। কবি লিখেছেন-

বি-ক্বদরি-ল্ কদ্দি তাকতাসিবুল্ মা’আলী,
ওয়া মন্ ত্বলবা-ল্ ‘উলা সহরা-ল্ লয়ালী।
ইয়াগূসু-ল্ বহ্ রা মন্ ত্বলবা-ল্ লাআলী,
ওয়াইয়ুহ্ যা বি-স্ সিয়াদতি ওয়া-ন্ নওয়ালী।
ওয়া মন্ ত্বলবা-ল্ ‘উলা বি-গয়রি কদ্দিন্,
আধা’আ-ল্ ‘উমরা বি-ত্বলবিল্ মুহালী।।

অর্থাৎ-

-শ্রম-অনুপাতে কর উন্নতি সাধন,
যে চায় উন্নতি করে রাত্রি জাগরণ।
যে জন মুকুতা চায় ডুবে সাগর-জলে,
তবে ত সৌভাগ্য লাভ ভাগ্যে তার ফলে।
শ্রম বিনা উন্নতি যে করে আকিঞ্চন,
অসম্ভব আশা তার, বিফল জীবন।
(অনুবাদ- ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্)

এ প্রসঙ্গে যে কথাটি সবচেয়ে সত্য ও সার, তা হচ্ছে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার। সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং স্বীয় পবিত্র পুস্তকে বলেছেন, “আল্লাহ্ কোনো জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা নিজেরা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে সচেষ্ট হয়।”


২৫/০৪/২০২৪
ইমেইলঃ upama.nizam@gmail.

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ