কবিতা ভিন্ন আমার কোনো বেদনা নেই
( কেন লিখি কবিতা )
কবি হবার উদ্দেশ্যে আমি কবিতা লিখতে আসিনি। বেঁচে থাকার তীব্র আকাঙ্ক্ষা
এবং মৃত্যুর পরম স্বাদ থেকে আমার ভেতরে জন্ম নেয় কবিতা এবং কবিতা এবং
কবিতা।
কবিতার প্রতি আমার যে গভীর সৌন্দর্যবোধ সে সৌন্দর্যবোধের প্রতি আস্তা
রেখে বলছি— কবিতা দিয়ে পৃথিবীতে একটা স্বর্গ রচনা করার কথা ভাবছি।
কবিতা আমি লিখি না। আমার ভেতরে যে একজন মানুষ এবং প্রকৃতপক্ষে মানুষ বাস
করেন তিনিই লিখে ফেলেন কবিতা। তাই সম্পূর্ণ আমি কখনো কবি হয়ে উঠতে
পারিনি। যখন তিনি জেগে ওঠেন— তখনি আমি হয়ে উঠি কবি। আমি চাই আমার ভেতরের
কবি মানুষটির আত্মা দীর্ঘজীবী হোক।
কবিতাকে প্রেমিকা-ই ভেবে গেছি চিরকাল। তার মতো মহৎ হৃদয় আমি আজও দেখিনি।
যা কিছু ভেসে গেছে জলে ডুবে গেছে অবেলায়, চলে গেছে ফাগুনে এসেছে বেদনায়;
কবিতায় লিখে রাখি আমি তাহাদের নাম। কবিতাই আমার শেষ গন্তব্য।
আমাকে আঘাত করলে ঝরে পড়ে কবিতা
ভালোবাসলে আমাকে ঝরে পড়ে কবিতা
যেহেতু,
কবিতা ভিন্ন আমার কোনো বেদনা নেই
কবিতা ভিন্ন আমার কোনো উল্লাস নেই ;
কবিতা-ই আমার অদ্বিতীয় উপাসনা ৷
অনুরোধ,
শেষ ঘুমের আগে চিৎকার করবেন না, একটা ব্যথাহত কবিতার পঙক্তির সাথে
প্রেমিকার নরম কণ্ঠ মিশিয়ে আমাকে খেতে দিন আমি ফের জেগে উঠব।
আপনি আমাকে ঘৃণা করুন
বাসুন ভালো
রাষ্ট্র আমাকে নির্বাসন দিক
করুক সম্মানিত;
কবিতার শপথ আমি দুঃখ করব না, বড় জোর অহংকারে কেঁদে উঠতে পারি।
কবিতা নিষিদ্ধ হলেই আমি মরে যাব!
আমি কেবল কবিতার রাজ্য চেয়েছি
যেখানে জন্ম নেন কবি এবং কবিতা
কয়েক গুচ্ছ সুন্দর শব্দ দিয়ে আমাকে পাঠিয়ে দিতে পারো
হিংস্র অরণ্যে কিংবা উত্তপ্ত মরুর দেশে
আমাকে তুমি খুন করতে পারো সহজ সরল একটি কবিতা দিয়ে
আমার মুমূর্ষু অবস্থায় ফুল নয় অশ্রু নয় এমন কী অক্সিজেন
কেবল কবিতা নিয়ে এসো
আমি ফিরে আসবো আত্মহ্যতার দুয়ার হতে
কবিতা লিখতে গিয়ে সৌন্দর্যকে আমি এড়িয়ে যেতে পারিনি। তাই অবলীলায় এসে
গেছে যৌনতা এবং আত্মহত্যা। এসব আমার কাছে একটা চমৎকার শিল্প; যদি সেখানে
লেখা থাকে প্রেম। আমার সমস্ত শিল্পের দায় একান্ত সেই জাগ্রত কবি
মানুষটির। যিনি কবিতা লিখতে গিয়ে জেগে ওঠেন। জেগে উঠে যিনি লিখতে বসেন
কবিতা। এর অপরাধে তাঁর ফাঁসি হোলে হোক।
আমার মৃত্যু হোক সে কবি মানুষটির চোখ খোলা থাকাকালীন সময়ে
আমার মৃত্যুর চারপাশে আবৃত্তি করা হোক কবিতা
আমার মৃতদেহের উপর গড়ে উঠুক রাশি রাশি কবিতার স্তূপ
আমাকে পোড়ানো হোক গুচ্ছ গুচ্ছ কবিতা দিয়ে
আমার বিষণ্ন এপিটাফে লেখা হোক জীবনের কবিতা
রিকেলের ১০টি কবিতা
১।পথের মতো গম্ভীর দীর্ঘজীবী হও
তোমার দুঃখগুলো তিন ভাগ করে প্রত্যহ পান করো
মাতাল হও গাও এবং নাচো
কিন্তু ঘুমিয়ে পড়ো না
যে ররফ খণ্ড বহুকাল ঘুমিয়ে কাটায় প্রশান্ত মহাসাগরে
তুমি তার মতো শান্ত শুভ্র কঠিন হও
তুমি অরণ্যের মতো সবুজ পাহাড়ের মতো মহৎ
গৌতমের মতো অপ্রমত্ত হও
পাথরের মতো বিনয়ী গোলাপের মতো সহজ
নদীর মতো নরম নরম সন্ধ্যা হও
তুমি সে পথের মতো গম্ভীর দীর্ঘজীবী হও
যে পথে হাঁটলে মানুষ হয়ে ওঠেন ঈশ্বর
২৷ বিদায় পথে কবিতা
তোমাকে আমার জিজ্ঞাসা ছিলো দক্ষিণী—
জগতে সন্ধ্যা নামার আগে আমাকে অন্ধ করে কেনো তুমি চলে যাচ্ছ উজ্জ্বল মুখ করে
তোমাকে ভালোবাসতে গিয়ে একটা নির্দয়
পথকে ভালোবাসলাম
তোমাকে ভুলতে গিয়ে একটা কোমল জীবনকে
ঘৃণা করতে লাগলাম
তোমাকে লিখতে গিয়ে দ্যাখি— একটা নিখুঁত মুখোশ তোমার
কী নির্ভুলতম হাসি অপরূপ প্রতারণা ছড়াচ্ছে
একপাত্র দুঃখ পানের পর যখন আমি ক্লান্ত পায়ে হেঁটে যাব নদীর কাছে
যখন মাতাল চোখে দাঁড়াব শীতকালের মুখোমুখি
তোমাকে মনে পড়বে
মনে পড়বে— তোমার ষোড়শী তরুণী মুখ
ক্যামন নিষ্ঠুরতম চোখে কী অপরূপ দ্রুত পায়ে
তুমি হেঁটে যাচ্ছো দক্ষিণ দিকে
বড় সাধ ছিলো দক্ষিণী—
তোমার বিদায় পথে একটা কবিতা বিছিয়ে দেব
যেটা তোমাকে ফিরিয়ে আনবে আমার কাছে
৩৷ অনোমা
জেনেছে হৃদয় সূর্য অস্ত যাবার কালে তোমাকে সে ভুলে যাবে
তোমার সাথে কবিতার যে মহৎ সাদৃশ্য
যে মহান নদী তোমার চোখে প্রবহমাণ
যে অপূর্ব সন্ধ্যা কপালে তোমার খেলা করে
সে কেবল তোমার নয় অনোমা
এ সব আমার প্রেমের রমণীয় সৃষ্টি
পৃথিবীর কাছে তোমার যে রঙিন বিদায়
প্রথম জীবন
আমার কাছে সে তোমার মলিন শেষ সম্মান
যেদিন তুমি দাঁড়াবে অষ্টাদশী হেমন্তের সম্মুখে
তোমার তখন সমুদ্ররুপী মুখ নদীপথ ঠোঁট পাহাড় সদৃশ হৃদয়
দৃষ্টি জুড়ে করুণ আর্তনাদ তোমার বেদনাহত স্তন
তোমাকে মনে করিয়ে দেবে আমাদের শহরভ্রমণ
শীতার্ত আঙুল শরৎ পৃথিবী
একদিন আমিও বিদায়য় নেব ভেবে
তুমি হাসবে মুখের হাসি
কাঁদবে চোখের ভাষা
আমিতো ফুরোবার নয় অনোমা
আমি বেঁচে থাকার জন্য এসেছি
আমার হৃদয় জুড়ে কবিতা
কবিতার কণ্ঠে প্রেমের গান
আমি কি ফুরোতে পারি অনোমা?
আমি কি ফুরোতে পারি!
৪৷ হে আমার বিষণ্ন প্রেমিকাগণ
আমাকে দ্বিতীয় তৃতীয় আরও হাজার বার বিরহ দাও
তোমাদের নাম লিখে রাখি বিষাদের কবিতায়
হে আমার বিষণ্ণ প্রেমিকাগণ,
যদি কবিতায় তোমাদের ডুবিয়ে মদের সাথে পান করতে পারতাম
পৃথিবী জেনে যেতো কবিতার চেয়ে তোমরাই মহৎ
তোমাদের খোঁপায় আমার দুঃখগুলো গেঁথে দিয়ে আমি সুখী হ’তে চাই
তোমাদের হাতে আমার ভুলগুলো তুলে দিয়ে আমি শুদ্ধ হ’তে চাই
হে আমার সুন্দরী দুঃখী সংসারী প্রেমিকাগণ,
এর বহু বছর পর একদিন জানবে আমি তোমাদের ব্যথায় মরে গেছি
ক্লান্ত হৃদয়ে তোমরা কথা বোলো আমার এপিটাফের সাথে
৫৷ গভীরতম একটি সন্ধ্যা
তোমার সে স্তন— মূলত যেটা পুরুষকে ব্যথা দেবার যোগ্য
সে রুপ কোমল পাহাড় নিয়ে তুমি সমুদ্রের দিকে হাঁটছো
এক লক্ষ উৎসুক চোখ তোমাকে প্রদক্ষিণ করছে
তোমার বাম হাতে একটা তাজা নরক আর
ডান হাতে একটা গভীর স্বর্গ নিয়ে
তুমি হেঁটে আসছো পৃথিবীর বেদনাদায়ক সন্ধ্যার দিকে
এক কোটি ধর্মান্ধ দৃষ্টি তোমাকে প্রদক্ষিণ করছে
একটা মহৎ হৃদয় আমি তোমার দিকে ছুঁড়ে দিলাম
আমি একটা নরম কবিতা ছুঁড়ে দিলাম তোমার দিকে
তোমার হাত থেকে খসে পড়ল স্বর্গীয় আনন্দ এবং নারকীয় দুঃখ
দু’টি বিষাদাক্রান্ত পাহাড় এবং রমণীর একটি সহজ হৃদয় নিয়ে
স্থির দাঁড়িয়ে আছো সম্মুখে
আমি তোমার দিকে একটা প্রেম ছুঁড়ে দিলাম
তোমার দিকে ছুঁড়ে দিলাম নরম নরম একুশটি ভায়োলিন
তুমি হয়ে ওঠলে হেমন্তের গভীরতম একটি সন্ধ্যা
তুমি হয়ে ওঠলে পৃথিবীর সুন্দর একটি দুঃখ
৬৷ কেউ কি এখন
কেউ কি এখন পত্র পোড়ে?
আগুন দিয়ে অন্ধকারে বন্ধ ঘরে
পত্রপোড়া চিতার মতো
কেউ কি এখন অশ্রু ফেলে?
দুঃখ পেয়ে মধ্যরাতে অঝোর ধারায়
অশ্রুঝরা মেঘের মতো
কেউ কি এখন গরল গিলে?
ব্যর্থ হয়ে হাতের মুঠোয় স্মারকলিপি
আটকে ধরে
গরল খাওয়া নারীর মতো
কেউ কি এখন পত্র পোড়ে চিতার মতো
কেউ কি এখন অশ্রু ফেলে মেঘের মতো
কেউ কি এখন গরল গিলে গরল খাওয়া নারীর মতো
কেউ কি এখন দুঃখ পোষে?
খেলার ছলে গভীরভাবে
ভালোবেসে
দুঃখপোষা নীলের মতো
কেউ কি এখন ঝরে পড়ে?
দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যা এলে
মলিন হওয়া ফুলের মতো
কেউ কি এখন পদ্য লিখে?
গদ্য ভুলে গভীররাতে একা একা
বিষাদ খাওয়া কবির মতো
কেউ কি এখন দুঃখ পোষে নীলের মতো
কেউ কি এখন ঝরে পড়ে ফুলের মতো
কেউ কি এখন পদ্য লিখে বিষাদ
খাওয়া কবির মতো
৭৷ একটি কবিতা লিখো
বিষ পানের আগে একটি কবিতা
লিখো
ফাঁসিতে ঝুলতে ঝুলতে একটি কবিতা লিখো
একটি কবিতা লিখো চাপাতির আঘাত সহ্য করতে করতে
কবিতা লিখতে কাগজ লাগে না
কবিতা লিখতে কলম লাগে না
কী-বোর্ড লাগে না কবিতা লিখতে
কবিতা লিখতে হয় না
কবিতা লেখা হয়ে যায় পথে
পথে
চলতে চলতে বলতে বলতে
কবিতা কথা বলে প্রচন্ড যন্ত্রণার
কবিতা কথা বলে বিষাদের
কবিতা কথা বলে সকল ব্যর্থতার
কবিতা কথা বলে স্বাধীনতার
বিষ পান— একটি স্বাধীনতার কবিতা
ফাঁসিতে ঝোলা— একটি স্বাধীনতার
কবিতা
চাপাতির আঘাতে মৃত্যু— স্বাধীনতার
কবিতা
এঁরা শহিদ
শহিদ এঁরা
শহিদের অনেক প্রকার রয়েছে
আমি মরে যেতে চাই কাউকে খুব
ভালোবেসে
আমি মরে যেতে চাই কাউকে ভীষণ
ঘৃণা করে
আমি মরে যেতে চাই একটি কবিতা লিখে
বিষ খাও
ফাঁসিতে ঝোলো
চাপাতির চোখায় প্রাণ দাও
কবিতা বিসর্জন দিও না
৮৷ কেউ এলো না
কেউ এলো না, কেউ এলো না
বুকের কাছে ছিল যারা বুক ছেড়ে সব দূরে গেল
কেউ এলো না, কেউ এলো না
কেউ এলো না বুকের কাছে, কেউ এলো না নতুন করে
হাত বাড়িয়ে বলল না কেউ হাতটা আমার ধরো দেখি
মন বাড়িয়ে বলল না কেউ মনটা আমার ছোঁওত দেখি
নাম ধরে কেউ ডাকল বটে একটা বিষের কৌটা নিতে
বলল আমায় দুঃখ পেলে হুক লাগিয়ে গিলে খেতে
সবার নাকি গোলাপ আছে আমার আছে বাগান গোলাপ
সবার নাকি দুঃখ আছে আমার আছে দুঃখ বাগান
সবার নাকি বিষাদ আছে আমার আছে বিষাদ মেলা
সবার নাকি কান্না আছে আমার আছে মেলা কান্না
সবার বুকে জোনাক পোকা, ফড়িং ওড়ে সবার বুকে
আমার বুকে কেউ এলো না, কেউ এলো না ফড়িং হয়ে
সবার বুকে সবাই গেল আমার বুকে কেউ এলো না
কেউ এলো না, কেউ এলো না
কেউ এলো না বুকের কাছে, কেউ এলো না দুঃখ হয়ে
৯৷ পৃথিবীর শেষ পথে
তোর নীরব অহংকারী চোখের দিকে তাকালে
ভীষণ বোলশূণ্য হয়ে পড়ি
ইচ্ছে করে মরে যাই
ভালোবাসি গভীর উৎসাহে
দুঃখ নিয়ে সমুদ্রে গড়িয়ে পড়লো একটি কালো পাথর
স্রোত কিংবা স্থিরকে সামনে রেখে প্রার্থনা করা মঙ্গল
জড়িয়ে ধরা উত্তম
নেশা চমৎকার
ভুলে যাবার আকাঙ্ক্ষা অপরাধ
প্রেম নিয়ে সমুদ্রে ডুবে গেল একটি লাল গোলাপ
মিথ্যা এবংসত্য বুকে ধীর পায়ে হেঁটে চলা মৃত্যুর দিকে
কী এক বিষণ্ণ ভ্রমণ
করুণ বিদায়
পৃথিবীর শেষ পথে কবিতা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন একজন কবি
১০৷ দুঃখ তুমি পড়ে নিলে দুঃখ দিয়ে
শোকমেলায় আমাকে বেচতে বসেছিল এক অশ্রু বিক্রেতা
তোমাকে মুগ্ধ করেছিল আমাকে মোড়ানো প্রচ্ছদ
প্রচ্ছদের পরতে পরতে রঙের তুলিতে আঁকা নীল মেঘ
তোমাকে স্পর্শ করেছিল আমার নাম ‘এক খন্ড মেঘ, দুফোঁটা বৃষ্টি’
বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায় নীল রঙের দুঃখ।
এখনতো কেউ দুঃখ নেয় না, বুকের চাপা কষ্ট ছোঁয় না
চোখের কথা কেউ বোঝে না, দুঃখের কোন সঙ্গি হয় না ;
কিন্তু তুমি চেয়েছিলে
একটু দুঃখ ছোঁয়ে দেখতে – চোখের কথা একটু বুঝতে
চেয়েছিলে আমায় তুমি উল্টে পাল্টে পড়তে।
কেউ আমাকে ছোঁতে চেয়ে ছোঁল না
কিনতে চেয়ে কিনল না
পড়তে চেয়ে পড়ল না আমায় কেউ ;
আমায় তুমি কিনে নিলে দুঃখ দিয়ে
দুঃখ তুমি পড়ে নিলে দুঃখ দিয়ে।
আমাকে কেউ কাব্য নামে ডাকল না
গল্প বলে পড়ল না
আমার মত বোঝল না আমায় কেউ ;
আমায় তুমি বোঝে নিলে দুঃখ দিয়ে
দুঃখ তুমি পড়ে নিলে দুঃখ দিয়ে।
কেউ আমাকে খুলে খুলে দেখল না
হৃদয় ছিঁড়ে পড়ল না
আমার মত জানল না আমায় কেউ ;
আমায় তুমি জেনে নিলে দুঃখ দিয়ে
দুঃখ তুমি পড়ে নিলে দুঃখ দিয়ে।