মুহাম্মদ নিযামুদ্দীন
একটি কবিতা সম্মেলন। অনেক কবির উপস্থিতিতে বড় আনন্দঘন সেই পরিবেশ। কিন্তু সেই আনন্দ বিষাদে পরিণত হতে বেশিক্ষণ লাগলোনা, যখন মাঝবয়সী এক কবি কবিতা পড়ার জন্য মঞ্চে উঠলেন — এবং মাইকের সামনে মুখ রাখলেন। কবিরা তো আবার আবেগের ঠিকাদার। কবিতা পড়তে গিয়ে বেশিরভাগ কবিরই থাকেনা হুঁশ আর। পড়তে উঠে একটি কবিতা, কয়েকটি না পড়ে নামেননা মঞ্চ থেকে। তাদেরকে আবার কিছু বলাও বিপদ, যদি যান বেঁকে। দর্শক-শ্রোতাদের হাল হয় কতটা বেহাল, তা করেননা চিন্তা তাঁরা। কবিতা পড়ার জন্যই থাকেন পাগলপারা। মঞ্চে উঠতে পারলে তাদেরকে আর পায় কে! কবিতার পর কবিতা পড়তে থাকেন একে একে। অবস্থা এমনও হয় কখনো কখনো – স্লিপের পর স্লিপ দিয়েও যায়না নামানো। তখন মাইকের সাউন্ড বন্ধ করে দিতে হয় বাধ্য হয়ে। যদিও কয়েকটি কবিতা তখনো পড়ার বাকি যায় রয়ে। মাঝবয়সী কবিটি ছিলেন চালাক খুব। মাইকের সামনে রেখে মুখ, তিনি বললেন, কয়েকটি কবিতা পড়বোনা আমি। পড়বো একটিমাত্র কবিতা, যা খুব দামী । দর্শক-শ্রোতারা ভাবলেন, এবার হয়তো যাবে বাঁচা! কিন্তু কবি কি অতটা কাঁচা? বাঁচা বা মরার ব্যাপারটা তো তখন বোঝা যাবে, মাঝবয়েসী কবি তার কবিতা পাঠ শুরু করবেন যবে। কবির হাতে বড় একটি খাতা। খাতার ভেতর লেখা তাঁর মাথা। মাথা মানে নয় যা তা — মাথা মানে কবিতা। কবি সেই খাতা দেখে মাথা নেড়ে নেড়ে – যাচ্ছিলেন স্বকন্ঠে কবিতা পড়ে। এমনভাবে পড়ে যাচ্ছিলেন – নদীর কলকল স্রোত যেনো। কবে শেষ হবে লক্ষণ তার দেখা যাচ্ছেনা কোনো। এদিকে দর্শক-শ্রোতাদের অবস্থাও সঙ্গিন — যাকে বলে একেবারে কেরোসিন! ভাবতেই পারেননি তারা আসবে এমন দুঃসহ দিন। কবির এই লম্বা কবিতা শুনে হলো কি – লম্বা হয়ে গেলেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি। এ নিয়ে সৃষ্টি হয় সেখানে প্রতিকূল পরিস্থিতি। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে ভীতি! পরে তা কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। বিচারক লম্বা কবিতা পড়ে প্রধান অতিথিকে মারার দায়ে কবির ওপর করেন প্রদান ফাঁসির রায়। ফাঁসির রায় শুনে হাঁসি নেই কবির মুখে। কবিতাই কিনা ফেললো তাঁকে এই দুঃখে! রায় ঘোষণার পর বিচারক জানতে চান কবির কাছে – ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পূর্বে তাঁর কি কোনো অন্তিম ইচ্ছা আছে? থাকলে তিনি বলতে পারেন সেকথা, যা পূরণে করা হবেনা অন্যথা। কবি তাঁর অন্তিম ইচ্ছের কথা জানাতে গিয়ে বলেন, “মহামান্য হুযুর, যদি হয়ে থাকে কোনো কসুর — করবেন ক্ষমা নিজগুণে — ক্ষমা মহত্ত্বের লক্ষণ সবাই জানে। যে লম্বা কবিতাটির অর্ধেক শুনে গেছেন মারা অনুষ্ঠানের প্রধান মেহমান – তার বাকি অর্ধেক যদি শোনাতে আপনাকে করেন অনুমতি দান ! বিচারক বলেন– ‘তোমার অন্তিম ইচ্ছে যদি যাই করতে পূরণ, তাহলে আমারও কি হবেনা মরণ! তখন আবারও তো তুমি দণ্ডিত হবে একইরকম অপরাধে – পতিত হবে মৃত্যুর মহা খাদে।’ শুনে কবি কহেন, ‘একইরকম অপরাধের হয় যদি দু’বার বিচার – মহামান্য, তা কি হবেনা আমার ওপর অনেক অবিচার?’ তারপর কি হয়েছিলো যায়না জানা। গেলেও জানা বলতে মানা!
লম্বা কবিতা শোনার জন্য প্রয়োজন লম্বা সময়ের । কিন্তু অত বেকার সময় কই মানুষের? তাছাড়া অমন বোকাও কোথায় পাওয়া যাবে — নিজের বৈষয়িক কাজ ফেলে বেকার সময় কাটাবে! সেজনই হয়তো কবিরা বাদ দিয়ে লম্বা কবিতাকে — লঘু, মানে ছোট কবিতা লেখায় মনোনিবেশ করতে থাকে। ছোটগল্প যদি লেখা যায়, তাহলে ছোটকবিতা হতে দোষ কোথায়! আমরা যেভাবে কাউকে ছোটলোক বলে করার চেষ্টা করি ছোট — ছোটকবিতা কিন্তু নয় সেরকম কিছু ছোট । প্রতিভার বদৌলতে বিন্দুও থাকেনা বিন্দু – তার মাঝেও দেখা মেলে সিন্ধু। ছোটকবিতা প্রথমে আসে কি করে? প্রথমে বোধ হয় লিমেরিক নামে – পঞ্চপদী নামেও তোলে ঢেউ বুকের বামে। তারপর আসে রুবাঈয়ের রূপ ধরে। সেই রূপ অপরূপ – যে দেখে সে মরে! ওমর খৈয়ামের রুবাঈ পড়লে যায় বোঝা — রুবাঈ লেখা নয় সোজা। যদি সোজা হতো, সবাই ওমর খৈয়াম হয়ে যেতো। কিন্তু ওমর খৈয়াম একজনই শুধু – বাকি সব যদু, মধু…। এরপর তো হয়ে যায় কবিতায় ক্যু – নিজের স্বত্বা নিয়ে সামনে দাঁড়ায় তিন পঙক্তির জাপানি হাইকু। তারপর কবিতা আরো ছোট হয়ে যায় – তিন লাইনের তাল ছেড়ে চলে আসে দু’লাইনের দোঁহা’য়।
কেবল কবিতা নয়, কখনো কখনো কথা তথা শব্দকেও বিকিনি পরাতে হয় বাধ্য হয়ে। বাধ্য হয়ে এইজন্য যে, নইলে যে বাদ্য বাজবে পিঠের ওপরে। কার সাধ্য সেই বাদ্য বাজানো বন্ধ করে! যেমন ভরা এক মজলিশে এক মহিলা তার স্বামী নামক আসামীকে — ‘জান’ বলে ডাকে। শুনে স্বামী জিজ্ঞেস করে, হঠাৎ ‘জান’ কেন? এমন তো দেখিনি আগে কখনো! স্ত্রী বলে, ‘জানোয়ার’ বললে যায় লম্বা হয়ে, তাই ডাকলাম ছোট করে ‘জান’ বলে! প্রিয় ‘জান’, তুমি কি করেছো অভিমান? স্বামীও যাননা কম। একটু ফেলে দম, বলেন- ‘থাকলেই তো মান, করতাম অভিমান! বেইজ্জতির কিছুই কি রেখেছ বাকি? ভালোবাসার নামে শুধুই ফাঁকি!’ তারপর স্বামীও স্ত্রীকে ঐ ভরা মজলিশে — ‘রাণী’ বলে ডাকেন হেসে হেসে। শুনে স্ত্রীরও একই রকম প্রশ্ন– হঠাৎ ‘রাণী’ বলে ডাকলে কেন? স্বামীর তড়িৎ জবাব — ‘চাকরানী’ বলতে শোনায় খারাপ, তাই ছোট করে ডাকলাম ‘রাণী’! তোমার কি পছন্দ হয়নি? স্ত্রী বলেন– হয়েছে পছন্দ, আহা কি আনন্দ! বাঁচিনা আনন্দের ঠেলায়! ইচ্ছে করে নাচতে থাকি যতক্ষণ না পায় তন্দ্রায়!
দু’লাইনে নিয়ে আসার পর কবিরা কোশেশ করতে থাকেন কবিতাকে কিভাবে আরো কম শব্দে লেখা যায়, আরো ছোট করা যায়। ছোট করার এধরনের চেষ্টার কথা আমি প্রথম শুনতে পাই দু’দশক আগে — অগ্রজ কবি জহুর-উশ-শহীদের(জন্ম: ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪০ — মৃত্যু: ৫ মার্চ ২০১৭) কাছ থেকে। জহুর ভাই ছিলেন সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের একজন কর্মকর্তা। উত্তর আগ্রাবাদের কর্ণফুলী মার্কেটের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে এগার তলা যে ভবন, সেখানেই তিনি চাকুরির সুবাদে করতেন দিনযাপন। আমার বাসার খুব কাছে হওয়ায় প্রায়ই যেতাম তাঁর অফিসে। যখনই যেতাম, বেশিরভাগই দেখতাম, তিনি দৈনিক ইনকিলাব কিংবা দৈনিক ইত্তেফাক পাঠে নিমগ্ন। মনে হতো, তিনি বিজ্ঞাপন পড়াও বাদ দিতেননা। অর্থাৎ ইত্তেফাক-এর ‘ই’ দিয়ে প্রবেশ করে সংবাদপত্রটির সম্পাদক মঈনুল হোসেন-এর ‘ন’ দিয়ে বের হতেন। তিনি ছিলেন অলসতায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তবে মানুষটি ছিলেন ভালো ও সহজ-সরল কিসিমের। কৌতুক অভিনেতা না হলেও তাঁর কথাবার্তায় ও কাজকর্মে এমন সব উপাদান উপস্থিত থাকতো, যাতে থাকতো অন্যদের জন্য প্রচুর আনন্দ ও হাসির খোরাক। যেমন প্রতিটি কথা কিংবা কাজকর্মে তাঁর, ‘ছোট’র প্রাধান্য ছিলো চমৎকার! তিনি যখন কথা বলতেন, খুব ‘ছোট’ আওয়াজে কথা বলতেন। সেই কথা দূরের মানুষ তো দূরের কথা, কাছের মানুষও কখনো কখনো শুনতে পেতেন না, কিংবা শুনলেও কি বলেছেন, সেটা বোঝা সম্ভব হতোনা। কিংবা যখন লিখতেন, যত ‘ছোট’ বাক্যে লেখা সম্ভব, তা-ই করতেন। শুধু তাই নয়, যে কাগজটিতে তিনি লিখতেন, সেই কাগজটিও হতো খুব ‘ছোট’। শহর এলাকার বাসের মধ্যে অনেকগুলো মানুষ একসাথে গাদাগাদি করে অবস্থান নিলে যে অবস্থা হয়, তেমনি অবস্থা! কাগজটি দেখে মনে হতো, এ বুঝি হোমিওপ্যাথিক ঔষধের ‘পুইরা’ বানানোর জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। শুধু কাগজ ‘ছোট’ হলে কথা ছিলো, কাগজে লেখা অক্ষরগুলোও ছিলো ‘ছোট’ ‘ছোট’। দেখে মনে হতো পিঁপড়েদের মার্চপাস্ট বা মিছিল! তিনি যখন পথ চলতেন, তাঁর পদক্ষেপও হতো ‘ছোট’ ‘ছোট’। তিনি দুপুরে অফিসে যে খাওয়ার খেতেন, তা বাসা থেকে নিয়ে আসতেন। টিফিনবক্স মাত্র একটি, এবং ছোট ছিলো সেটি। এত অল্প আহারে কিভাবে খিদে মিটতো তাঁর — তা ছিলো আমার কাছে অবাক হওয়ার! একবার তাঁর অফিসে গেলে পিপাসা লেগেছে তাই — তাঁর কাছে আমি পানি চাই। আমার প্রত্যাশা বা পিপাসা পূরণ করতে যা করলেন জহুর ভাই, দেখে আমি রীতিমতো অবাক হয়ে যাই! বলেন তিনি– বোতলে করে নিয়ে এসেছি পানি, নয় একটুখানি। বেগ থেকে বের করলে দেখি বোতল নয়, শিশি বললেই সঠিক হয়। একজন শিশুর জন্য হলে সেই শিশির পানি – সঠিক বলে জানি, কিন্তু একজন পরিণত বয়সের পুরুষের জন্য হলে কিভাবে সঠিক বলে মানি! তাছাড়া যে কাপড়ের বেগে ভরে, টিফিন ও শিশিটি এনেছিলেন বহন করে, তাকে বড় বললে বড়র হবে বদনাম — ছোট বললেই সুরক্ষিত থাকবে সুনাম! এভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, ‘ছোট’র প্রতি প্রীতি তাঁর স্বভাবে। তাই হয়তো কবিতাকেও কত ছোট লেখা যায় সেদিকে ছিলো তাঁর প্রয়াস – যৌবনে করেছিলেনও নাকি সেরকম কবিতার চাষ। এক লাইনের সেই কবিতার নাম দিয়েছিলেন তিনি ‘একাই’। এ-ই ছিলেন আমাদের জহুর ভাই। এরকম কয়েকটি ‘একাই’ একা পেয়ে একদিন শুনিয়েছিলেনও আমাকে। খুঁজলে হয়তো পাওয়াও যাবে আমার পুরনো দিনলিপিতে। তাঁর চিন্তা ও চরিত্রের সাথে এসব হয়তো খাপ খায়। কেননা তাঁকে হারানো অসম্ভব ছিলো অলসতায়! ছোট কবিতা লিখতে লাগেনা বেশি সময়। তা পাঠে পাঠকেরও হয়না সময়ের অপচয়। বিন্দুর মাঝে সিন্ধুকে করা যায় যদি ধারণ, তেমন কবিতা লিখতে কেউ তো করেনি বারণ। তবে লিখলেই তো হবেনা, তাকে কবিতাও হওয়া চাই। যেমন লিখেছিলেন প্রিয় শ্রদ্ধেয় জহুর ভাই। সত্যি তাঁর ‘ছোট’ ‘ছোট’ চিন্তা বা কর্মসমূহের কোনো তুলনা নাই।
এতদিন আমি ভেবে আসছিলাম ‘একাই’ বুঝি একাই লিখেছেন জহুর ভাই – সে ক্ষেত্রে আর কেউ বুঝি নাই। এখন দেখি নন তিনি একাই। সে ক্ষেত্রে আরো একজনকে পাই। উভয় বাংলায় ব্যাপক পরিচিতি আছে তাঁর। নামটি তাঁর বিনয় মজুমদার। তাঁর সৃষ্টি একই কিছিমের হলেও নামে আছে ভিন্নতা, যাকে তিনি নাম দিয়েছেন ‘এক পঙক্তির কবিতা’। এই নামে একটি কাব্যগ্রন্থও আছে তাঁর, যেখানে পরিচয় মেলে তাঁর কাব্যপ্রতিভার। এহেন কাব্যকর্মের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভূমিকায় কবি জানান যে, গদ্য-পদ্য কবিতা লেখার অভ্যেস ছিলোনা তাঁর। কেননা গদ্য-কবিতা মনে রাখা এক দুরূহ ব্যাপার। সুতরাং মনে রাখার জন্য মনস্থ করেন কিছু গদ্য-কবিতা লেখার। সাথে এও মনে ছিলো তাঁর — কবিতাগুলোর আকার – ছোট হওয়া দরকার। মনে রাখার ব্যাপারটি মাথায় রেখে তিনি তিন লাইনের একটি জাপানি গদ্য-কবিতার উদাহরণ প্রদান করেন এবং লিখেন, “আমি একবার মাত্র পড়ে এই জাপানি গদ্য-কবিতাটি মনে রেখেছি। আরো নানান কথা চিন্তা করে আমি ভাবলাম যে, আমি যদি গদ্য-কবিতা লিখি তবে একেকটি গদ্য-কবিতা ‘এক পঙক্তি’ বিশিষ্ট হবে। এই ভেবে আমি ‘এক পঙক্তি’র কবিতার পরিকল্পনা করেছিলাম এবং সে অনুসারে এই ‘এক পঙক্তির কবিতা’ বইখানা লিখেছি। এইখানাই আমার একমাত্র গদ্য-কবিতার বই।”(দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০০১ ; প্রকাশনায়- নৌকো প্রকাশনী, ঠাকুরনগর, উত্তর চব্বিশ পরগনা, ভারত)। যাদের সময়ের সংকট, কিংবা ধৈর্য কম — তাদের জন্য এমন কবিতা উত্তম। সেরকম কয়েকটি কবিতা উদ্বৃতি দিচ্ছি এখানে, পাঠক হয়তো মনের খোরাক পাবেন সেখানে। যেমন–
১.
কবিতা লিখলেই মানুষ, গণিত আবিষ্কার করলেই
বিশ্বের মালিক
২.
যা ঘটে তাই স্বাভাবিক
৩.
পাহাড় ও নদীর মালিক সরকার
৪.
বলো তো কী নেই অথচ তার মালিক আছে – আকাশ
৫.
ঘিও জাল দেবার সময় দুর্গন্ধ
৬.
একটি ধান থেকে মোটামুটি চুরাশিটা ধান হয়
ছোট কবিতা লেখার ক্ষেত্রে শরৎচন্দ্র পণ্ডিত ওরফে দাদাঠাকুর ছিলেন আরো এককাঠি সরেস। তাঁর সৃষ্টিতে স্যাটায়ার ছিলো একটি প্রধান উপাদান, যা পাঠককে প্রদান করতো অশেষ আনন্দ দান। সে জন্য সমকালে রম্যলেখক হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন তিনি। তাঁর প্রতিটি লেখাই ছিলো এতোই মননশীল ও মজাদার যে, যেন চায়ের কাপে চিনি। তাঁর সেন্স অব হিউমার – উদাহরণ ছিলো সুক্ষ্মতার ও সরসতার। নজরুল তাঁকে বলেছিলেন ‘হাসির অবতার’। নিজের হাসির গানের বই ‘চন্দ্রবিন্দু’ উৎসর্গ করেছিলেন তাঁকে। উৎসর্গপত্রে লিখেছিলেন — ‘পরম শ্রদ্ধেয় শ্রীমদ্দাঠাকুর শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র পণ্ডিত মহাশয়ের শ্রীচরণকমলে–
‘হে হাসির অবতার
লহ চরণে ভক্তিপ্রণত কবির নমস্কার।’
নজরুল ছিলেন তাঁর নিকটের মানুষ। বিমলভূষণ লিখেছেন, “সেদিন রেডিওতে (১নং গারস্টিন প্লেস) কাজীদার প্রোগ্রামের রিহার্সাল চলছিল। হঠাৎ দাদাঠাকুর অর্থাৎ শরৎ পণ্ডিত মশাই সে ঘরে এলেন। বললেন, ‘শুনলুম তুমি আছ এখানে। তাই চলে এলুম, মানে ‘কান’ টানল আর কি!’ বলে মিটিমিটি হাসতে লাগলেন তিনি। কাজীদা কিন্তু মিটিমিটি নয়, তাঁর সেই অট্টহাস্যে ঘরদোর কাঁপিয়ে দিলেন। আমরাও হাসছিলাম। সবার হাসি শেষ হতে না হতে আমাদের মধ্যের এক মহিলা শিল্পীকে চুপচাপ চেয়ে থাকতে দেখে কাজীদা তাঁকে বললেন, ‘কি গো, তুমি নিশ্চয় আমাদের হাসবার কারণটা ধরতে পারোনি?’ মহিলাটি কবুল করলেন, না, তিনি ধরতে পারেননি। কাজীদা তাঁকে বললেন, মানে ‘কান’ হলুম আমি। অর্থাৎ কাজীর ‘কা’ এবং নজরুল-এর ‘ন’ এবার বুঝেছ?”(উদ্ধৃতি- শারদীয় ‘দেশ’, ১৩৯৭)। এভাবে এক শব্দে ব্যক্ত করতে পারেন যিনি অধিক ব্যঞ্জনা – তিনি শরৎচন্দ্র পণ্ডিত ব্যতীত আর কেউনা। কেবল কম শব্দেই নয়, কম অক্ষর করেও এস্তেমাল – কবিতা লেখার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন কামাল ও বেমেসাল। তাঁর বন্ধুদের মধ্যে একজন উদীয়মান কবি ছিলো। তাকে লক্ষ্য করে বললেন, এক অক্ষরে মিল দেওয়া কবিতা লিখতে পারিস? পারিস না? কিসের কবিরে তুই! তবে শোন–
–ঝি?
–কি!
–ঘি
–দি!
(উদ্ধৃতি- শারদীয় ‘দেশ’, ১৩৯৭)
আধুনিক হতে হতে ফ্যাশনের নামে নর-নারীর, বিশেষ করে নারীর কাপড় যেমন দিনদিন ছোট হয়ে আসছে, তেমনি কবিতাও কেন জানি দিনদিন ছোট হয়ে যাচ্ছে! ছোট হতে হতে নিয়েছে এখন অক্ষরের অবয়ব। পাঠকরা হয়তো অবাক হয়ে বলবে – কি হচ্ছে এসব! এমন একদিনও হয়তো আসবে – কবিতা হাওয়ায় লেখা হবে! তারপর কি হবে? কিছু একটা তো হবে! হৃদয়ের কথা হৃদয়েই রয়ে যাবে! প্রশ্ন হতে পারে- যদি হৃদয়ের কথা হৃদয়েই রয়, তাহলে কবিতা কিভাবে হয়? হয়, হয়, হয় – আছে কি সংশয়! ভালোবাসার আবেগে প্রেমিকা প্রেমিককে বলেনা, ওগো জান, কতো ভালোবাসি তোমায় তা করতে পারবোনা শব্দে বয়ান। তেমনি হয়তো একদিন কবিতাকেও শব্দে বয়ানের দিন হবে শেষ – শব্দ ছাড়াই কবিরা করবে কবিতা লেখার কোশেশ! কিছু কিছু কথা আছে, শব্দও যাকে করতে পারেনা ধারণ। বৃক্ষ কেন বোবা থাকে তার পেছনেও আছে কারণ। বোবা থেকেও কি সে বলেনা কতো কথা? ভাবুকদের কাছে তাও যে কবিতা!
০৮/০১/২০২৪