বঙ্গ রাখাল
নির্দ্বিধায় বলতে হয় আমাদের শিকড় মূলের প্রাণপুরুষ। যাকে আমরা আমাদের পাথর মনকে বিগলিত করার মন্ত্রণায় পেয়ে থাকি। তিনি বাঙলা মায়ের প্রসিদ্ধ গ্রামীণ জনপদের আধ্যাত্মিকবোধের মানবিক মানুষ– লালন ফকির। আমাদের শিকড় অর্থে যা বোঝায় তিনি আমাদের চেতনা আর মন কাঠামোকে মজবুদ করার কৌশল আয়ত্ব করার শিক্ষা বা মন্ত্রণা দিয়ে থাকেন। পশ্চাৎপদ এদেশের মানুষকে প্রভাবিত করেছেন নতুন এক বেগমান পথের দিকে। যেখানে আমাদের মুক্তি মেলে। লালন ফকির এক বিষ্ময়কর প্রতিভা। যার যাপিত জীবন আর সমাজের চালচিত্রের নিটোল সন্ধান মেলে তাঁর গানে। সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। তিনি তাঁর সব গানেই প্রায় প্রতিবাদী ভাষা ব্যবহার করেছেন । তবে অনেকটা বিদ্রুপাত্মকভাবে যা স্বার্থলোভী ভেকধারীদের হৃদয়ে গিয়ে লেগেছে । যে কারণে তাকে কাঠমোল্লারা ন্যাড়ার ফকির, ধর্মহীন ফকির বলে আখ্যায়িত করেছে। জীবদ্দশায় তিনি ছিলেন এক উদাসিন ফকির তবে সমাজ সচেতনহীন ছিলেন একথা বলা যায় না। গানই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র আরাধনার বিষয়। এই গানের ধ্যানময় উপাসনা থেকে ধর্মের নামধারী কট্টরপন্থিরা তাঁকে বিরত রাখার চেষ্টা করেও তাঁর জায়গা থেকে সামান্যতমও স্থানচূত করতে পারেননি। সমাজে যার প্রতিরুপ আজও দেখা মেলে। বিভিন্ন জায়গাতে বাউলদের চুল, দাঁড়ি কেটে দেওয়া হচ্ছে। বিতাড়িত করা হচ্ছে সমাজ থেকে। ইসলামের ধোঁয়াশা তুলে তাদের এই সাধনার পথ থেকে সরিয়ে আনা কিংবা লালনের মাজারের জমি দখল নিয়েও ফকিরদেও উপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মানুষ চড়াও হয়েছে। যা আমাদের সমাজে এখনো চলমান। গাঁজা খাওয়ার মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তাদের হেয়প্রতিপন্ন করারও চেষ্টা চালিযে যাওয়া হচ্ছে। যে লালনের সৃষ্টি আজ পৃথিবী ব্যাপ্তি প্রচার হচ্ছে, আমরা এখনও তাকে ধর্মের বেড়াজালে আবদ্ধ করে রেখেছি যা আমাদের জন্য সত্যিই লজ্জাকর ।
বর্তমান অবক্ষয় মানবতার হাহাকারের যুগে লালনের মানবতার বাণী সর্বাধিক প্রচারিত ও প্রসারিত। এই বাণীর ছায়া তলে সবাই আশ্রয় পেতে চাই। কিসের ভয় এইসব স্বার্থলোভী মানুষদের ? লালন আমাদের নিজস্ব, আমাদের শিকড় ঐতিহ্যের প্রতীক। একটা দেশের মূল তার দেশের ঐতিহ্য আর লালন সেই আমাদের ঐতিহ্যের বা প্রত্মের প্রতীক হিসেবেই পরিগণিত। নিজস্ব সাধনা বলেই তিনি মহা সমারোহে পৃথিবী পাড়ায় প্রচারিত। যখন শুনি-
’মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি
নয় খ্যাপারে তুই মূল হারাবী ’।
তখন মনে হয় এই মানবজনম কি বিফলেই গেল ? সাধন ভজন কিই বা করলাম । মানুষকে বুঝতে হবে তাকে জানতে হবে। তবেই না এই জীবন স্বার্থক ।
লালন আমাদের আদি প্রতীক। যে আমাদের চিনিয়ে দেয় চিরায়িত আমাদের অর্ন্তআত্মাকে। স্মরণ করিয়ে দেয় শিকড়ের কথা। লালন ফকির ছিল আত্মমর্যাদা সম্পন্ন এক বিদ্রোহী পুরুষ। যে সমাজের জাত-পাত, ছুৎমার্গ আর ধর্মাধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন। পূর্বসূরীদের প্রভাব লালনকে আরও বেশি বেগমান করে দিয়েছে এবং তাদের প্রভাবে তিনি প্রভাবিত হয়ে নিজের কাজকে একান্তই নিজস্বতার মধ্য দিয়ে তার বহি:প্রকাশ ঘটিয়েছেন । সন্ত কবীরের প্রভাব কিভাবে লালনকে প্রভাবিত করেছে তা একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক –
ধর্মাধর্ম আর সমাজের আকীর্ণতার বিরুদ্ধে এবং পরসত্তাকে অনুসন্ধান করাই ছিল সন্ত কবীরের একান্ত ধ্যান আর সাধনা। যে সময় এই কবীর জন্মগ্রহণ করেছিলেন সে সময় ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমানের দ্ব›দ্ব বা লড়াই তীব্রতার সাথে চলছে। কেউ এই ধর্মাধর্মকে বাদ দিয়ে যে মানুষ, মানবিক হয়ে উঠবে এবং সকলে মিলিত হওয়ার আশা ব্যক্ত করবে তা নয়, তারা ব্যকুল নিজেদের ধর্ম আর আচার আচরণের মধ্যে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে। নানা নিয়মনিষ্ঠা তৈরি করে এ সময় মানুষেরা খোদা/ ঈশ্বর যা কিছুই বলি না কেন তার প্রেমকে করেছিল খণ্ডিত। কিন্তু একজন নিজের চিন্তা-চেতনা আর আত্মসাধনা দ্বারা এই দ্ব›দ্বকে কিছুটা মানবিক করে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। চরম এই মুহূর্তে সর্বধর্মের মিলিত চেষ্টায় অন্তরজগতের মহিমায় এক নতুন দর্শন সৃজন এবং এই মানবিক শিক্ষাকে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছিলেন যারা তাদের মধ্যে তন্তুবায় কবীর ছিলেন অন্যতম। তিনি তাঁর সহজ সরল ভাষা আর অকৃত্রিম যৌক্তিকতার মাধ্যমে মানুষের বিভেদকায়া দুর্বুদ্ধিতাকে গভীর ভাবে সমালোচনা করেছেন এবং মানুষের অন্তরনিহিত ঘুমন্ত সত্তাকে জাগ্রত করার সর্বদা চেষ্টা করেছেন। কবীরের বাণী সমাজের সেই সব অনাচারগুলোর বিরুদ্ধে যেন মানুষের শাশ্বত বিদ্রোহ। এ কবীরের জীবন মৃত্যু নিয়েও রয়েছে নানা ধোঁয়াশা আর পরস্পর বিরোধি মতবাদ এবং বিরোধি উপাদান উপস্থাপনের প্রবণতা। ইতিহাসকে আশ্রয় করে অনুসন্ধানে নামলে সত্য না পেলেও কিছুটা সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া যায়। সন্ত কবীরের ভক্তদের ভক্তির ফলে যে মনজগত গঠিত হয়ে ওঠে সেই মনজগতে এক কবীরী জীবনের বর্ণনা পাওয়া যায় ।
বিখ্যাত পণ্ডিত ক্ষিতিমোহনের ভাষ্য ১৩৯৮খ্রি. জ্যৈষ্ঠ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে কবীর সোমবার কাশীস্থ লহরতালাব নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেণ এবং ১৫১৮ খ্রি. মাঘ মাসে কাশীর নিকটবর্তী বস্তী মগহর গ্রামে দেহাবসান ঘটে। তবে একটা বিষয়কে সবাই মান্যবলে চিহ্নিত করেছেন যে দিল্লীতে সিকান্দার লোদীর শাসন কালে কবীর জীবিত ছিলেন।
এবার আসা যাক অন্য প্রসঙ্গে–- তথ্যানুসন্ধানের ক্ষেত্রে কিংবদন্তীর ভূমিকা অপরিসীম। কিংবদন্তী বলতে আমরা বুঝি অতীত কালের কোন বীরত্বপূর্ণ পুরুষ,জনপ্রিয় সম্রাট,রাজা-বাদশা,গায়ক,কবি,দরবেশ বা অত্যাচারিত কোন রাজার নিয়েও একাধিক কাহিনি বর্ণিত হতে পারে। এই কিংবদন্তী এক দিনে সৃষ্টি হয় না, এটা ঐতিহ্যিক এর প্রধান বাহক হিসেবেও পরিগণিত হয়। এটি ইতিহাস নয় কিন্তু তথ্যানুসন্ধানের ক্ষেত্রে ইতিহাসের উৎস হিসেবেও কাজ করে। কবীরের জীবনেও সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য কিংবদন্তী। এ কিংবদন্তী অনুসারে জানা যায় রাজা সিকান্দার লোদীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। দেখা যাচ্ছে–লোদীর রাজ্যত্বকালসীমা ছিল(১৪৮৯-১৫১৯)। এই সময়ের মধ্যে ১৪৯৪ সালে তিনি কাশীতে এসেছিলেন। আবার ম্যাকমিলান প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের অনুবাদকৃত কবীরের শতদোহার ভূমিকায় দেখা যায় কবীর ১৪৪০ সালে বেনারসে জন্মগ্রহণ করেণ এবং ১৫১৮ সালে দেহত্যাগ করেণ।
কবীরের গুরুর নিয়েও পরস্পর বিরোধি মতবাদ রয়েছে। যেমন: কেউ কেউ বলেন- রামানন্দ কবীরের গুরু ছিলেন কিন্তু গিয়ার্সন রামানন্দের জন্ম সাল ১২৯৮ বলে ধারণা করেণ যা কবীরের গুরু হওয়া সম্ভব না। ভোডভিল প্রমাণ করেণ— কবীরের সাথে তার নাম জড়িত হয় প্রায় একশত বছর পর। কিন্তু কবীর তাঁর রচনায় তাঁর গুরু জয়দেব এবং নামদেবের নাম উল্লেখ করেছেন ।
কবীরের ধর্ম নিয়েও নানাবিধ বিতর্ক বিদ্ধমান। তবে তিনি মুসলমান ঘরে জন্মগ্রহণ করেণ বা লালিত পালিত হয়ে থাকেন যারা জাতিতে জোলা ছিল। কাপড়বয়ন এবং বেচাকেনা ছিল তাদের প্রধান পেশা। এই জায়গা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে লালন যার আশ্রয়ে জীবিত হয়ে ওঠেন তিনিও ছিলেন একজন মুসলমান তন্তুবায়। যাদের আমরা জোলা বলে ডাকি এবং এই জোলারা সমাজের অনেক নিচুতলার মানুষ বলে তাদের সমাজে ছোট চোখে দেখা হয়। তাহলে দেখা যায় যে এসব সাধন জগতের মানুষগুলোর সম্পর্ক কোন না কোনভাবে ঐ সমাজের অবহেলিত আর নিষ্পেশিত মানুষদের মধ্য থেকেই সৃষ্টি হয়েছে আর তারা নিজেদের জীবন দিয়ে বাস্তবতাকে বুঝতে শিখেছে। যে কারণে তারা পরবর্তীতে সমাজ সংস্কার করার কিংবা সমাজের স্বার্থের নিয়মনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে।
আমরা আমাদের দীর্ঘ ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখতে পাই–বৌদ্ধ অনুসারীদের চর্যার কাল (৬৫০-১২০০) থেকে শুরু করে নার্থধর্মের সাধনা,সুফি সাধনা,বৈষ্ণব সাধনা এবং সর্বাধিক প্রাচীন তান্ত্রিক সাধনার যে সব যোগাচার ও দেহকেন্দ্রিক সাধনার পথ অতিক্রম করে এগিয়ে আসা এবং বিট্রিশদের শাসনব্যস্থার প্রবর্তন কালে এ বাঙালিদের মধ্যে নিজস্ব সংস্কৃতির বা নিজেদের লালিত সমাজের মধ্যে সৃষ্টি হয় নানা দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। আর এ সময়ই মানুষের কামনা ছিল নিজস্ব সমাজে বা চিরায়ত গ্রামীণ জীবনে একজন সংস্কারকের। এ সংস্কারময় মুহূর্তে জন্মেও ছিলেন একজন বীরপুরুষ সমাজ সংস্কারক তিনি আর কেউ নন। তিনি আমাদের লালন ফকির । লালন যে সময় জন্মগ্রহণ করেছিলেন সে সময় সমাজের জাত-বিজাতের লড়াই ছিল প্রকট। শুধুমাত্র এসময়ই নয় আগে বর্ণনা করেছি কবীরের ভারতবর্ষে ধর্মাধর্মের জাতÑপাতের আকীর্ণ সমাজ ব্যবস্থা মধ্যে তিনি অনুসন্ধান করেছিলেন এক মহান সমাজ। যে সমাজ সৃজনের মাধ্যমে মানুষের মঙ্গলসাধিত হবে।
আজ আমরা যারা লালনকে প্রথম বাউল বলে অবিহিত করার চেষ্টা করেছি তারা হয়তো জানেন না , লালনের পূর্বেও বাউল ছিল এবং তারাও সমাজের আকীর্ণময়তা নিয়ে গান রচেছেন। তারাও ভোগ করেছেন বিভীষিকাময় জীবন আর এ কারণেই সমাজের এই নিচুতলার মানুষের ক্ষোভ অভিমান থেকে তারা রচনা করে গেছেন গান। তারা যেহেতু এই নানা কোনঠাশার জীবনযাপন করেছেন। সেহেতু তাদের সঙ্গীতসাধনার মধ্যে সমাজ সংস্কার এবং বিদ্রোহীর পরিচয় বিদ্যমান। লালন যে প্রথম বাউলধর্মের প্রবর্তন করেণ তা কিন্তু না। শুধুমাত্র তিনি একটি ধারাকে গতিময় এবং পূর্ণাঙ্গরুপদান করেছেন। এই তথ্যটি বোঝার ক্ষেত্রে শ্রী সনৎকুমার মিত্রের ভাষ্যের কিছু অংশবিশেষ তুলে দিচ্ছি–
লালনই প্রথম বাউল নয়,তাঁর আগেও অনেক বাউল জন্মগ্রহণ করেছে,পরেও। অতএব লালনের মৌল যে ধর্মমত তাঁর মধ্যে অভিনবত্ব-নেই- সেটি বাউল সম্প্রদায়েরই মৌল ধর্ম মতের রকমফের মাত্র। সাধু-সন্ন্যাসী-ফকির প্রমুখের পূর্বাশ্রম গ্রাহ্য নয় অর্থ্যাৎ সে পূর্ব আশ্রমে হিন্দু মা মুসলমান ছিল তা দিয়ে তার সন্ন্যাস বা ফকিরীজীবন আদৌ প্রভাবিত হয় না, হওয়া উচিত নয়। লালনের ক্ষেত্রেও তা হয়নি? যেভাবেই হোক লালনের গান সর্বাধিক গান পাওয়া গেছে অন্য বাউলও হয়তো এর চেয়ে আরও অনেক বেশি গান রচে ছিলেন কিন্তু তাদের গান লিখে রাখার তেমন কেউ ছিল না যা লালনের ছিলো । মনের মানুষের আরাধনা শুধু লালনের একচেটিয়া নয়-বাউল,সহজিয়াদের ঐটিই সাধ্য–সাধকপুরুষ নামেও ইনি কারো কারো আরাধ্য । মানবতাবাদের ছাঁচটা মোটামোটিভাবে বিংশ শতাব্দীরতে তৈরি হয়েছে সবকিছু এই ছাঁচে ঢালাই করায় বর্তমানে মহা আনন্দ। মধ্যভারতের বিখ্যাত সন্ত কবীরের রচনার একটি অনুবাদ করে সনৎকুমার মিত্র দেখিয়েছেন–
কাজী, দিন রাত্তির বক বক করে
তুমি কোন পুঁথি আওড়ে চলেছো ।
তোমার কি কোন নিজস্ব চিন্তা ছিল না ?
তুমি ক্ষমতার দম্ভে সুন্নত দিলে
আমি কিন্তু অতদূর যেতে নারাজ ।
যদি সুন্নতই ঈশ্বরের অভিপ্রেত হয়
তবে ঐ অবস্থাতেই তোমাদের জন্ম হলো না কেন ?
যদি সুন্নত দিলে হয় মুসলমান
নারী তবে কি হয় বিধান ?
যেহেতু বলছো নারী, অর্ধাঙ্গিনী
হিন্দুও হতে পারে তোমার ।
গলায় পৈতে দিয়ে বামুন হলে
তোমাদের স্ত্রীরা তবে কি পরবে ?
ওহে পণ্ডিত শূদ্র তোমাদের অন্ন ছুঁলে কেমন করে খাও তুমি ?
হিন্দু ও মুসলমান তোমরা কোথা থেকে এলে ?
এই পথ তোমাদের কে দেখিয়েছে?
তোমার হৃদয়ের দিকে না তাকিয়ে
কোথায় স্বর্গ তা খুঁজিতে চর পাঠাও ?
এখন তুমি গায়ের জোরে পথ করে নাও,
কবীর বলে ভাই, আসবে যখন শেষের সময়,
তখন রামের আশ্রয় ছাড়া কেঁদে কেঁদেই হবে সারা।
এবার লালন রচিত গান:
সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে
লালন বলে জাতের কি রুপ
দেখলাম না এই নজরে।
কেউ মালা কেউ তসবি গলে
তাই তোরে জাত ভিন্ন বলে ।
যাওয়া কিংবা আসার বেলায়
জাতের চিহ্ন রয় কাররে ?
সুন্নত দিলে হয় মুসলমান
নারীর তবে কি হয় বিধান
বামুন চিনি পৈতেপ্রমাণ
বামনী চিনি কিসেরে ?
জগৎ বেড়ে জাতির কথা
লোকে গল্প করে যথাতথা
লালন বলে জাতির ফাতা
ডুবিয়ে দে সাধ বাজারে।
তাহলে আমরা দেখতে পাই কবীরের গানের প্রায় অনুস্মরণ করা লালনের এই গানটি সমধিক প্রচারিত। এমনিভাবে যদি খুঁজে দেখা যায় তাহলে দেখতে পাওয়া যাবে যে মধ্যযুগের অনেক ভক্তিযোগী,সন্ন্যাসীর পদ-দোহার সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব লালনের গান কেউ প্রভাবিত করেছে। এটা দোষের কিছু না। প্রভাব পড়তেই পারে। লালন পূর্বসূরীদের কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে যা প্রকাশ করেছে এটা একান্তই তাঁর নিজস্বতা এবং স্বতন্ত্র্য। যা লালনকে এক ধনবান হিসেবেই পরিচিত করে তোলে। লালনকে আমরা বিশ্লেষণ করলে একজন খোদ বাঙলা মায়ের সন্তানকেই খুঁজে পাই। তিনি আমাদের বাঙালিদের যে আত্মবোধ, সেইবোধকেই সর্বদা জাগ্রত করে তোলেন। কবীর, দাদু, রজবের মত তিনিও লড়াই করেছেন এই লোলুপ সমাজের জাত-পাত আর অনাচারী স্বার্থলোভী মানুষদের বিরুদ্ধে। সামাজিক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক শোষণ আর দুশাসনের বিরুদ্ধে আমরণ তিনি লড়ে গেছেন। হিন্দু, বৌদ্ধ,খ্রিস্টান ও মুসলমান কোন ধর্মের মধ্যেই তিনি নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি এজন্যই তিনি বাঙ্গালির এক স্বপ্নদ্রষ্টা হতে পেরেছেন। গ্রামীণ সংস্কৃতি অন্তরে ধারণ করেই তিনি শতবছর ধরে সৃজন করে গেছেন সমাজসচেতন এবং বিদ্রোহী গান যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় তিনিই আমাদের বাঙ্গালিদের আধুনিক প্রাণপুরুষ। যার আধুনিক চিন্তাÑভাবনা পরিমিতবোধই একজন আধুনিক কবি হিসেবে তাকে পরিচিত করে তোলে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বুঝে ছিলেন লালনের প্রতিভার শক্তি। যে কারণে তিনি লালনের কিছু গান প্রকাশ করার ব্যবস্থা করেণ এবংতাঁর বক্তৃতায় উল্লেখ করেছিলেন লালন, হাসনের নাম। এখান থেকেই লালন পরিচিতি পেতে শুরু করে। কোন গোষ্ঠীর মধ্যেই আজ লালনকে আবদ্ধ করা যায় না। তিনি আজ হয়ে উঠেছেন সারা পৃথিবীর মানবতার মূর্তপ্রতীক। একসময় চর্যাপদের মূলমন্ত্র সাধারণের আরাধ্য ছিল । সময়ের পরিক্রমায় আজ আর তা আরাধ্য না হলেও তা প্রোথিত হয়ে আছে বাঙালির মননে,ঐতিহ্যে, শেকড়ে। লালনও তেমনই ভেদবুদ্ধিহীন সারা জীবন মানবতার জয়গান করে গেছেন। তাঁর দর্শন আমাদের পাশ্চাত্যের পাশবিকতা থেকে বারংবার সাবধান করে দেয়। কেননা তাঁর গানই আমাদের শেকড়, সংস্কৃতিকে আকড়ে বাঁচতে শেখায়। যা মানবতার শক্তিতে বলিয়ান হয়ে নিজেদের স্বজাতি, মাতৃভূমিকে বর্ণভেদের উর্ব্ধে উঠে এক মানবতার চমৎকারিত্বের সারিতে দাঁড় করিয়ে দেয়। যে কারণেই একজন দুদ্দু শাহ লালন ফকিরকে বলতে পারেন লালন পতিতজনের বন্ধু ।