spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদবই নিয়েশান্ত নিরীহ অনুচ্চ স্বরের কবিতায় এক সুবেদী আলোকসঞ্চার

লিখেছেন : তৈমুর খান

শান্ত নিরীহ অনুচ্চ স্বরের কবিতায় এক সুবেদী আলোকসঞ্চার

তৈমুর খান

নয়ের দশক থেকে যে ক’জন কবি নিরলসভাবে সাহিত্য চর্চা করে চলেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়। অরিন্দম বরাবরই সহজ মনের, সহজভাবের জীবনরসায়নের কবি । সমস্ত জটিলতাকে দূরে সরিয়ে রেখে কবিতায় তিনি হৃদয়ের আবেদনকেই প্রশ্রয় দিয়ে আসছেন। তাই তাঁর কবিতার মধ্যে আমাদের জীবন,সময়কাল, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অনুবর্তন ঘটে। আমাদের ভাষার, আমাদের চেতনার আবেগীয় পারম্পর্যকে সেখানে ফিরে পাই। তাই তাঁর কবিতা এক বৃহত্তর মানবীয় ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধ। ব্যক্তির হয়েও সমগ্র মানুষের তথা জীবনের পরিচয়। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘উজান স্রোত’(সেপ্টেম্বর ২০২৪) কাব্যটিও এর ব্যতিক্রম নয়।
মোট ৫৪টি কবিতা নিয়ে এই কাব্য সংকলনটির ঝরঝরে ও মনোরম প্রকাশ প্রথম দর্শনেই পাঠককে মুগ্ধ করবে। সব কবিতাগুলিতেই আছে একটা সুর নস্টালজিক হৃদয় বেদনার মর্মসঞ্চারী আবেগ। কবি বলেছেন:
“পথ চলতে চলতে ঘাড় ঘুরিয়ে
যখন রাঙাভূমি দেখি
তখন উড়ন্ত মেঘ আসে মনোভূমিতে
আর এসে ধরা দেয় এক নির্বাচিত অবয়ব”
তখন সহজেই বুঝতে পারি কবির জন্মভূমি রাঙামাটির কথা। যেখানে কবির শৈশব ও কৈশোর, সৃষ্টি ও কল্পনার অমোঘ আশ্রয়। প্রকৃতির সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ। সেইসবকে মনে করেই কবির অন্তর্গত অভিঘাত শুরু হয়। আকাশ মাটি নদী গাছ ফুল পাখি দুপুরবেলা ঘুরে ঘুরে আসে। জন্মভূমি ভারতভূমির অন্তর্গত হয়ে শুরু করে আলোড়ন:
“একটা ইতিহাসে বারবার আলোড়িত ভূমিতলে
আর সেখানেই এসে মাঝে মাঝে দাঁড়াই”
তখন সমগ্র দেশটাই কবির দেশ, হৃদয়ে মনে মস্তিষ্কে ভাবনার সমস্ত দিগন্ত জুড়ে আসমুদ্র হিমাচল ভারতবর্ষ হয়ে যায়। তখন পৌরাণিক-গল্প কাহিনিও অতীত গৌরবের প্রান্তভূমি থেকে বর্তমানের প্রেক্ষাপটে জীবন্ত হয়ে ওঠে। কবি নিজের মধ্যেই তার টের পান:
“পাণ্ডুর হৃদয়ে দুরন্ত সমুদ্র ঢেউ
যেন তীর ভেঙে যেতে চায়
মাদ্রির চোখও দ্বিধান্বিত
শরীরে দু’জনের তরঙ্গায়িত জলস্রোত
আর এই জলরাশির তীব্র স্রোতে
ভাসতে থাকে দু’জন…”
চোখের সামনে উন্মুক্ত হয় ভারতবর্ষ বা মহাভারত, যা আমাদের জন্মান্তর। প্রকৃতির সম্মোহন থেকে জারিত প্রাণস্পন্দনের নিমেষগুলি আমাদের চেতনাকেও আন্দোলিত করে। জলসাঘরের স্নিগ্ধ সংরাগে জেগে ওঠে ঐতিহ্যের সেই সুর।
কিন্তু এই সুর যখন হারিয়ে যায়। ক্ষুণ্ণ হয় জীবন। ভাগ হয় ভূখণ্ড। ছিন্ন হয় সম্পর্ক । তখনই জন্ম হয় হৃদয়ের টানাপোড়েন। দেখা দেয় মানবিক সংকটও। আর তখনই লিখতে হয় ‘উজানস্রোত’। আমরা এগিয়ে এসেছি ঠিকই, কিন্তু ঐতিহ্যহারা নিঃস্ব বিবর্ণ দিশেহারা হয়ে। সভ্যতার বর্বর লোভ হিংসার কাছে তাহলে কি আমরা পরাজিত? আমাদের মানবিক পরিচয় কি ধূলি-ধূসরিত? আমাদের আত্মশক্তি কি ম্লান? এইসব প্রশ্ন কবির মনে দেখা দিয়েছে। তাই কাব্যের নাম কবিতাতে লিখেছেন:
“এখন এক অনুভূতির ভেতর
যেন হারিয়ে যাওয়া ঝুমঝুমি
ক্রমাগত বেজে চলে
সবকিছুই দৃশ্যহীন”
এই বেদনামথিত নিঃস্ব জীবনের স্রোত যে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে কবি তা জানেন। আমরা কোথায় চলেছি, কোন্ জীবনকে ধারণ ক’রছি, সভ্যতা কোথায় নিয়ে যাবে আমাদের— স্বাভাবিকভাবেই এইসব প্রশ্ন এসে ধরা দিয়েছে। তাই স্রোত বা ট্রেন্ডকে উল্লেখ করেই কবি বলেছেন:
“এখন জীবন জুড়ে জলপথ
এখানে কোনও নৌকা নেই
ভিজতে ভিজতে হেঁটে যাই
এক সীমাহীন সীমার দিকে
পথ জুড়ে শুধু স্রোত আর স্রোত
রাত্রি দিন, মাস বছর…”
এই ক্লান্তিহীন চলার মধ্যদিয়েই আমাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ বিরাজ করছে। হয়তো ধ্বংস, হয়তো আমাদের আত্মবিনাশ এর ভিতরেই লুকিয়ে আছে। তাই ‘উজানস্রোত’-এর প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। জীবন অন্বেষণের গভীরে নিজেকে চেনার জন্য, নিজের ঐতিহ্যকে সম্মান করার জন্য। কবি বারবার এই পথেরই সন্ধান করে চলেছেন:
“আর সন্ধ্যারাতে রূপকের মতো
বিছিয়ে থাকে হাসনুহানা
তার ভেতরে রয়ে গেছে
বিগত জীবনের যত গল্পকথা
আসলে এসবই ভাঙা জীবনের
কোনও অলিখিত উপাখ্যান”
ভাঙা জীবনের অলিখিত উপাখ্যান প্রকৃতির সঙ্গে হৃদয়গত যেমন সম্পর্ককে তুলে ধরে, তেমনি অতীতের সঙ্গে সংলাপেও তা জানিয়ে দেয়। সেখানে দেশভাগের ক্ষতটিও প্রবল হয়ে ওঠে। পারিবারিক, সামাজিক জীবনের সঙ্গে বাল্য-কৈশোরও মূল্যবোধকে ধারণ করে উঠে আসে। ছড়িয়ে থাকা আগমনীর গল্পগুলি আনন্দরাগে অনুরণিত হয়। স্বপ্নমেঘে জীবনের মাধুর্যকে মেলে ধরে।
অরিন্দম চট্টোপাধ্যায় সমগ্র কাব্যটিতেই হৃদয়ের নির্জলা উপলব্ধিকেই সমাদৃত করেছেন।সেখান থেকেই নরম এক মায়াবীতলের অনুভূমিতে এসে পৌঁছেছেন। জীবনের ভাঙাগড়া স্পর্শাতুর বিষয়গুলি পরম মমতার সঙ্গে তিনি ধারণ করেছেন। কবিতাকে আজও যাঁরা হৃদয়ের উষ্ণতায় মাপতে চান, তাঁদের মধ্যেই অরিন্দমকে পাওয়া যাবে।শান্ত নিরীহ অনুচ্চ স্বরে তাঁর কবিতা এক সুবেদী আলোকসঞ্চার করেছে। বাঙালি জীবনের মরমিয়া সত্তায় তা গভীর অনুব্যঞ্জক।


উজানস্রোত:অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়, প্রচ্ছদ ভাবনা: ধীমান পাল, রা প্রকাশন, ১৫ শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট,কলকাতা ৭৩, মূল্য ১৯৯ টাকা।
আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

পথিক মোস্তফা on সাক্ষাৎকার : নয়ন আহমেদ
সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা