আবু তাহের সরফরাজ
ছোট ছোট বাক্য। শব্দগুলো আটপৌরে। প্রতিদিনের জীবনযাপনে এসব শব্দ ঘামের মতো আমাদের ঘিরে থাকে। প্রতিটি শব্দই যেন এক একটি ছবি। অসংখ্য ছবি একটার পর আরেকটা সাজিয়ে দৃশ্যকাহিনি নির্মাণ করে। শাহেদ সাদ উল্লাহর কবিতা পড়তে গেলেই আমার মনে হয়, যেন গল্প পড়ছি। তবে কথাসাহিত্যের গল্প নয়, কবিতার গল্প। কবিতার ভেতর দিয়ে ইঙ্গিতময় টুকরো টুকরো গল্প অনেক কবির কবিতাতেই আমাদের চোখে পড়ে। এ ধরনের কবিতাকে দৃশ্যকবিতাও বলা যায়। আমার ধারণা, বেশিরভাগ পাঠক এই জাতীয় কবিতা পড়তেই পছন্দ করে। এ কারণে বিখ্যাত সকল কবিতাই দৃশ্যকবিতা। ছবির ভেরত দিয়ে পাঠক কবিতার অভিব্যক্তি উপলব্ধি করতে পারে। কবিতা আসলে নানা রকমের হয়। ফলে, নানা উপায়েই কবিতার সাথে পাঠকের হৃদ্য যোগাযোগ তৈরি হয়। এখানেই কবিতা ও সাহিত্যের গল্পের প্রভেদ। কবিতার গল্প কী রকম হয় তার একটি নমুনা হতে পারে শাহেদ সাদ উল্লাহর ‘জন্মান্ধ চোখ’ কবিতাটি। শাহেদ লিখছেন,
কাঠ ঠুকরো পাখিদের মতো
আমি গোটা আকাশটাকে ঠুকরে যাচ্ছি।
একটি ভিডিওচিত্র যেন দেখছি আমরা। কাঠঠোকরা পাখিদের মতো কবি আকাশটাকে ঠুকরে যাচ্ছেন। এও কী সম্ভব? মানুষ কি পারে আকাশ ঠোকরাতে? সকলেই বলবেন, না, পারে না। কিন্তু আমি বলবো, পারে। পারে কারণ, ওটাই তার কল্পনা। এই কল্পনাশক্তি আছে বলেই মানুষ পৃথিবীর শাসনকর্তা। সম্ভবত আইনস্টাইন বলেছিলেন, যার যত কল্পনাশক্তি সে তত বেশি জ্ঞানী। এরচে বড় কথা আর কী থাকতে পারে! এই যে চিত্রটি দেখছি, এই ছবির আগের ও পরের ছবিগুলো দেখতে পাঠক উৎসাহী হয়ে ওঠে। কারণ পাঠক জানে, এই ছবি খণ্ডচিত্র। এই ছবির আগে ও পরে গল্পের আরো অনেক ছবি রয়ে গেছে। এরপর আমরা পড়ি,
মেঘ ঝরে পড়ছে,
বৃষ্টি ঝরে পড়ছে,
কাদা মাটিতে এসব টুকরো জমছে।
এখানেও তাই। দৃশ্যের পর দৃশ্য নির্মাণ। এসব দৃশ্য গল্প বহন করে চলেছে। একটা পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে এগোচ্ছে। ফলে, পুরো কবিতাটি না পড়ে থাকা যায় না। একইভাবে, শাহেদ সাদ উল্লাহর কবিতা বুঝতে গেলে তার পুরো কবিতাটি পাঠককে পড়তে হবে। এজন্য কবিতার মাঝখান থেকে দু’এক টুকরো বাক্য উদ্ধৃত করে শাহেদের কবিতার পাঠ-অভিজ্ঞতা লেখা মুশকিল। কল্পনার কত যে বিচিত্র ছায়াপথে শাহেদের প্রমাণ, সেসব চিত্ররূপ নির্মিত হয়ে আছে তার কবিতায়। কবিতার অনুভূতিও নানা বর্ণের, নানা ঢেউয়ের। কী রকম? তাহলে পড়া যাক শাহেদের ‘মাছ’কবিতাটি।
একটি পোস্টারে আমি প্রতিদিন লিখছি— মানুষ।
তারপর, এইসব মানুষ নিয়ে
আমি যখন একটা নদী পেরিয়ে যেতে চাইলাম,
একটি মাছ ডুব দিয়ে উঠেছিল।
শ্যাওলায় জমেছিল কাদাজল অনাদরে।
মাছ নীরবেই ছিল ওখানে।
খড়কুটো, ধুমোমেঘও ছিল ভ্রুক্ষেপহীন।
আমি মানুষগুলোকে ফিরিয়ে নিলাম
হোয়াইট-আউট দিয়ে একটি একটি করে মুছলাম।
মাছ শুধু বলল, কাগজের ভেতরে
যে রেখাগুলো রয়ে গেছে,
তুমি কিভাবে মুছবে তাকে?
এখন আমার ঘরে শুধু সাদা কাগজের স্তূপ;
জমতে জমতে আকাশ হয়ে যাচ্ছে!
নিপাট একটি গল্প আমরা পড়ে এলাম। একইসাথে, একটি কবিতাও আমরা পড়ে এলাম। গল্পটা কী, তা বুঝতে একটু চেষ্টা করা যাক। পোস্টার মানে প্রচারপত্রে কবি প্রতিদিন লিখছেন, মানুষ। লেখার পরপরই ঘটে ম্যাজিক। যতবার লেখেন ততবার এক-একজন মানুষ তৈরি হয়ে যায়। এসব মানুষ নিয়ে একদিন কবি নদী পেরিয়ে ওপারে যেতে চেষ্টা করলেন। তখন দেখলেন, একটা মাছ ডুব দিয়ে ওপরে উঠে এলো। মাছটা যেখানে ছিল সেই জায়গার বর্ণনায় কবি লিখছেন, শ্যাওয়ার বুকে অনাদরে কাদাজল জমেছিল। চুপচাপ ওখানেই মাছটি ছিল। সেখানে সংসার ছিল। খড়কুটো দিয়ে তৈরি করা ঘর ছিল। এই ঘরের ওপর ছিল ধুলোমেঘও। সুখের সংসারের পরোয়া সে করতো না। কবি বুঝলেন, অনিশ্চিত সেই আশ্রয় ছেড়ে মাছ পালাচ্ছে। নিশ্চিত আশ্রয় তাহলে কোথাও নেই? মানুষগুলোকে কবি আবার কাগজের লেখায় ফিরিয়ে নিয়ে এলেন। এরপর কাগজের ওপর সেই লেখাকে হোয়াউট-আউট দিয়ে একটি একটি করে মুছলেন। এই দেখে বিজ্ঞ মাছ কবিকে বললো, কাগজের ওপরের রেখাগুলো মুছতে পারলেও কাগজের ভেতরে যেসব রেখা রয়ে গেছে, সেসব রেখা কিভাবে মুছবে? আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না যে, এখানে রেখা মানে ভাগ্যরেখা। ইসলামি আক্বিদার প্রথম পাঁচটি স্তম্ভের একটি। কবি উপলব্ধি করেন, কতই না ক্ষুদ্র তিনি! কেবল সৃষ্টি করলেই হয় না, সেই সৃষ্টির নিয়তির নির্ধারকও হয়ে উঠতে হয়। সেই ক্ষমতা কোনো মানুষের নেই। মানুষসহ এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যিনি সৃষ্টি করেছেন, সকল ক্ষমতা একমাত্র সেই মহান সত্তার। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আজকাল বেশ আলোচনা হচ্ছে। বিজ্ঞানের আশ্চর্য উদ্ভাবন এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সত্যি যে, মানুষ সকল সৃষ্টিই অপূর্ণ। সৃষ্টির সকল পূর্ণতা সৃষ্টিকর্তার নিয়ন্ত্রণে। এই সত্যি উপলব্ধি করে কবি কাগজে আর ‘মানুষ’ লেখেন না। কিন্তু তার ভেতর সৃষ্টির প্রেরণা সবসময় তড়পায়। এরপরও কবি নীরব। ফলে, তার ঘরে সাদা কাগজের স্তূপ জমতে জমতে আকাশ হয়ে যাচ্ছে। এখানে একটু খেয়াল করা যাক, অসংখ্য কাগজ জমতে জমতে খোলা আকাশ হয়ে গেল। লেখার স্পেস বিস্তৃত হয়ে গেল। এবার কি কবি আকাশের গায়ে লিখবেন ‘মানুষ’ শব্দটি? এখন থেকেই আরেকটি গল্প শুরু হয়ে গেল। এর মানে, শাহেদ সাদ উল্লাহর কবিতা যেখানে শেষ হয়, সেখান থেকেই আরেক কবিতা শুরু হয়।
বেশিরভাগ কবিতায় শাহেদ সাদ উল্লাহ জাদুকর হিসেবে উপস্থিত থাকেন। জাদুবাস্তবতার আবহ ঘিরে থাকে সেসব কবিতা। পাঠককে বিচিত্র সব দৃশ্যকল্পের ভেতর দিয়ে তিনি নিয়ে যেতেন থাকেন। যেতে যেতে পাঠকের মনে হয়, এই যে ছবিগুলো যিনি আঁকছেন তিনি নিশ্চয়ই একজন জাদুকর। না-হলে এতসব আশ্চর্য চিত্ররূপ শব্দে চিত্রিত করা সম্ভব হতো না। ‘অক্ষমতা’ কবিতায় শাহেদ লিখছেন,
একটি আকাশ টেনে নামিয়ে দুই প্রান্ত সেলাই করে রাখি
আমার অক্ষমতাকে তবুও একটি পিঁপড়ে এসে খেয়ে ফেলে।
আকাশকে টেনে নামিয়ে এনে তার দুই প্রান্ত সেলাই করছে একজন মানুষ। এই ভিডিওচিত্রটা একটু কল্পনা করা যাক। এহেন অসম্ভব কর্ম যে মানুষ করতে পারে সে নিশ্চয়ই অনেক বড় জাদুকর। অবশ্যি, কোনো জাদুকরের পক্ষেই এই কাজটি করা সম্ভব নয়। এটা আমাদের বাস্তবের অভিজ্ঞতা। কিন্তু আমরা যখন কল্পনা করবো তখন ওই মানুষকে জাদুকর হিসেবে ভাবলেই ছবিটি আমাদের মনোজগতে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। অনেক কবিতাকেই শাহেদকে আমরা এরকম বিশ্বাসযোগ্য জাদুকর হিসেবে দেখতে পাই। হয়তো সেই জাদুকর শাহেদ নয়, শাহেদের সৃষ্ট কোনো একটি চরিত্র। কিন্তু সে যেই হোক, সে যে একজন জাদুকর এ বিষয়ে পাঠকের ভাবনা আর কোনোদিকে ছোটে না।
কবিতায় যেসব উপমা শাহেদ ব্যবহার করেন, সেসব উপমায় আশ্চর্য জাদু রয়েছে। রয়েছে অনুভূতির বহুবর্ণিল কারুকাজ। একটি জিনিসকে আরেকটি জিনিসের সাথে তুলনা করে আগের জিনিসটাকে বিশিষ্ট্যতা বোঝাতে উপমা ব্যবহৃত হয়। কেবল বিশিষ্ট্যতাই নয়, উপমার মধ্য দিয়ে আরও অনেক কিছুই প্রকাশ ঘটে। সেসব বিষয় নির্ভর করে উপমা ব্যবহারের কৌশলের ওপর। শাহেদের কবিতায় উপমার কারুকাজ কী রকম, তার কয়েকটি নমুনা পড়া যাক।
ক. শার্টের কালো দাগের মতো কেউ যেন দাগ দিয়ে রেখেছে মেঘে।
খ. এ জীবন কিছু নয়
তৃষ্ণার্ত কাকের ডাকের মতো।
গ. মানুষের ডাক অন্ধ নক্ষত্রের মতো চোখ বুজে থাকে।
ঘ. রোজ দরজায় কড়ানাড়া রোদের ছায়া।
ঙ. প্রতিটি রাতের ভেতর যেন এক একটি দুঃখ শামুক হয়ে থাকে।
ওপরের উপমাগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়লে আমরা বুঝতে পারবো, কল্পনাকে যত রকমভাবে শিল্পের মোড়কে সৌন্দর্যমণ্ডিত করা যায় সব রকমের কৌশল সেখানে রয়েছে। শার্টের কালো দাগের মতো মেঘের গায়ে দাগ! কোথায় শার্ট আর কোথায় আকাশের মেঘ। অথচ কী সাবলীল মেলবন্ধন শাহেদ ঘটিয়েছেন দুটো জিনিসের ভেতর। কবি বলছেন, জীবন কিছু নয়, তৃষ্ণার্ত কাকের ডাকের মতো। জীবনকে তৃষ্ণার্ত কাকের ডাকের সাথে তুলনা করে কবি জীবনের স্বরূপ উদ্ঘাটনের একটি প্রয়াস এখানে দেখিয়েছেন। তৃষ্ণা পেলে কাক কা-কা স্বরে ডেকে যেতেই থাকে। মানুষের জীবনও তাই। আত্মচিৎকার দিতে দিতেই একটা জীবন ফুরিয়ে যায় মানুষের। দিন শেষে কোনো হিসাবই আর মেলে না। এরপরও জীবনকে ভালোবাসা প্রত্যেক মানুষের জন্যই জরুরি। জীবনকে ভালো না বাসলে বেঁচে থাকা খুবই মুশকিল হয়ে পড়ে। কিন্তু যাপিতজীবনে কেউ সুখি নয়। এজন্য শিল্প জীবনকে সৌন্দর্যের দীপ্তিতে রাঙিয়ে তোলে। কবিকে তাই কবিতার মধ্যদিয়ে জীবনসৌন্দর্যের ব্যূহ নির্মাণ করতে হয়। বেঁচে থাকার এই যে রঙ, মানুষের মুখ, প্রাত্যহিক ঘটে যাওয়া কত যে তুচ্ছ ঘটনা— এইসব মিলিয়ে একটা জীবন কী যে সাংঘাতিক মূল্যবান পাওয়া! খুবই সাদামাটা আটপৌরে ভাষায় প্রতিদিনের নানা অনুষঙ্গ নিয়ে কবিতা এক একটি চলমান জীবন হয়ে যেতে পারে। হেঁটে বেড়াতে পারে আমাদের চারপাশে, গেরস্তজীবনের ছায়া হয়ে। সকালে ঘুম ভেঙে জানলার দিকে চেয়ে যদি দেখা যায়, ঝকঝকে রোদ উঠেছে কিংবা বারান্দার রেলিঙের ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে একটি শালিক, মুহূর্তে তখন এক প্রকার ভালো লাগা স্পর্শ করে যায় আমাদের। জুগিয়ে যায় কিছু সাহস। মনে হয়, এই রকমে আরো কিছু দিন বেঁচে থাকা যায়। ব্যবহারিক যাপিত জীবনের এইসব টুকরো টকুরো দৃশ্যময়তা কী উপায়ে কবিতায় শব্দপুঞ্জিত করতে হয়, সেই কৃৎকৌশল জানেন শাহেদ সাদ উল্লাহ। এই পৃথিবীরই আমাদের চেনাজানা সাংসারিক খুঁটিনাটি বিষয়গুলোকে নিয়ে আলাদা মানে খুঁজে বের করার এক প্রকার কৌশল হচ্ছে কবিতা। এই মানে খুঁজে নেয়ার পর পাঠকের ভেতর এক প্রকার সান্ত্বনা তৈরি হয় জীবনবোধ বিষয়ে।
এই তো জীবন!
জীবন মানে একটি স্মৃতি।
স্মৃতি মানে একটি স্কেচ, তার ভেতরে অনেকগুলো রেখা।
‘স্মৃতি’ কবিতার এই চারটি বাক্য জীবনের অনেক রকম ইঙ্গিত বহন করছে। গভীরতর জীবনবোধ না থাকলে এসব ইঙ্গিত শাহেদ কবিতায় ধারণ করতে পারতেন না। স্মৃতি খুবই আশ্চর্য একটি অভিজ্ঞান মানুষের। ছোট্ট কোনো সামান্য একটা স্মৃতি নিয়ে অনেক মানুষের গোটা একটা জীবন কেটে যায়। এরকম মানুষের হদিস কমবেশি আমরা অনেকেই জানি। সূর্যের ঝলমল আলোয় টলটল করছে দিঘির জল। এই দৃশ্য দেখার পর কোনো মানুষকে যদি সারা জীবন কারাগারের অন্ধকারে বন্দি করে রাখা যায়, এরপরও তার ভেতর সূর্যের আলোর স্মৃতি সতেজ থাকবে। আলোর সেই স্মৃতি নিয়েই বন্দি মানুষটি আলোকে আস্বাদ করতে পারবে। শাহেদের কাছে স্মৃতি হচ্ছে একটি স্কেচ, যে স্কেচ অসংখ্য রেখা দিয়ে আঁকা। মানে, স্মৃতি কেবল এক টুকরো দৃশ্য কিংবা ঘটনা নয়, ওই দৃশ্য কিংবা ঘটনার ভেতর লুকিয়ে থাকে আরও আরও দৃশ্য কিংবা ঘটনা।
আমরা জেনে গেছি, শিল্পের সারকথা নিরন্তর সৌন্দর্য। কবিতা সেই সৌন্দর্যকে যাপিত জীবনের সৌষ্ঠবে নির্মাণ করে। কল্পনাপ্রবণতা একজন কবির স্বাভাবিক নিয়তি। তবে সেই কল্পপরিধি কবির আন্তঃঅভিজ্ঞতারই সারাৎসার। কবিকে পৃথিবীর কাছ থেকেই পাঠ নিতে হয়। এবং সত্যিকার অর্থেই তাকে মেনে নিতে হয় যে, সময়ের চূড়ান্ত কোনো ব্যাখ্যা নেই। যাপিত জীবনের নানা অনুষঙ্গে মানুষের শ্বাশত অনুভূতিকে টোকা দিয়ে যাওয়াই কী একটি কবিতার আন্তরিক আয়োজন নয়? সৃষ্টির আরম্ভ থেকে মানুষের যাপিত জীবন কিংবা প্রাত্যহিক উপকরণ একজন কবি টেক্সট পড়ে জেনে নিতে পারেন। কিন্তু কেবল শক্তিশালী কবিই তার অভিজ্ঞতায় ধারণ করতে পারেন, ওই সময়ের কোনো প্রেমিক তার প্রেমিকার খোলা নাভির দিকে চেয়ে কী তাড়নায় মাতাল হয়ে উঠতে পারে।
কবিতা আত্মদর্শন। একজন কবি মূলত তার সারা জীবনে একটি কবিতাই লিখতে চেষ্টা করেন। যা তার সত্তাকে ভেঙে ভেঙে একটি মডেল হিসেবে দাঁড়ায় করায়। সময়ের প্রারম্ভিক সরল রেখাটি ধরে পৃথিবীর বুকে আজ পর্যন্ত এই যে মানুষের যাত্রা— এই পথেই তো কবিতা তার শরীর শরীর ও অভিব্যক্তি নিয়ে হেঁটে আসছে আমাদের সাথে সাথে। কল্পনা বলে অদৃশ্য যে একটা জগৎ আছে সেই জগৎ মোটেও অদৃশ্য নয়, বরং অনেক বেশি গ্রাহ্য। অনেক বেশি ইন্দ্রিয় সচেতন। মানুষ, এই প্রাণীটি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক, সময়ের যে ব্যবধানেই তার জীবনযাপন হোক, শেষ পর্যন্ত সে কিন্তু মানুষ। সকল মানুষের রাসায়নিক গঠন একই রকম। দুঃখ পেলে সে কাঁদে, খিদে পেলে খাবার খায়। এমন তো কখনো শোনা যায়নি, দুঃখ পেলে কেউ হাসছে। কিংবা, রাতে উঠেছে সূর্য আর দিনের বেলা চাঁদ। যে জীবন মানুষ যাপন করছে তাও আলাদা কোনো জীবনপদ্ধতি নয়। আলাদা কেবল এটুকুই, সময়ের প্রেক্ষিত আর ব্যবহারিক উপকরণ।
মৌলিকত্বের প্রশ্নে সব মানুষই মূলত একটা জীবন কাঁধে নিয়ে সময়ের একটি রেখা ধরে আদি-অন্ত-স্থিতি এই তিনটে স্তরের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। মিশরীয় সভ্যতার মানুষ সম্বন্ধে আমরা ধারণা পাই টেক্সট পড়ে। কিন্তু আমাদের থেকে তাদের পার্থক্য খুব বেশি ছিল না। পার্থক্য কেবল সময়ের প্রেক্ষিত আর প্রাত্যহিক জীবনযাপনে ব্যবহৃত উপকরণ। জীবনানন্দ দাশ যখন তার কবিতায় মিশরীয় সভ্যতার কথা বলেন তখন আমাদের থেকে আলাদা কোনো মানুষ বলে তাদেরকে মনে হয় না। আমরা সেই সময়কে কল্পনা করে নিতে পারি। আমাদের আত্ম-অভিজ্ঞতার সারাৎসার ছাড়া কল্পনা আর কিছুই নয়। পৃথিবীর শুরুতে একজন মানুষ প্রবল বৃষ্টির ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যে অনুভূতি দ্বারা তাড়িত হতো, সেই তাড়না প্রত্যেক সময়ে প্রত্যেক মানুষের ভেতরই আছে। এই তো সময়ের সরলরেখা ধরে এগিয়ে যাওয়া। এটাই অভিজ্ঞতার প্রকৃত চেহারা। তবে এর ভেতরও একটা কথা থেকে যায়। এক একজন মানুষ এক এক রকম। বৈচিত্র্য মূলত মানুষের আদিম কাঠামো। একজন কবি তার আত্ম-অভিজ্ঞতার কবিতাশিল্প নির্মাণ করবেন। সেটা পৃথিবীতে আর কেউ লেখেননি এরকম দিব্যি কেউ দিতে পারে না। লেখার প্রভাব বলে যে কথা প্রচলিত আছে তা নেয়ায়েত কথার কথা। লেখালেখির বিষয় যখন এই পৃথিবী আর তার অঙ্গসৌষ্ঠব, তখন তো আলাদা রকমের কোনো কথাও আর বলার থাকে না। কবিতার সৌন্দর্য হচ্ছে, পুরনো কথাকেই নতুন মোড়কে বলা। শাহেদ সাদ উল্লাহর কবিতা তাই কল্পনা ও জীবনের মেলবন্ধন।