তাজ ইসলাম
যাপিত জীবনে মানুষ একটু আনন্দ খোঁজে। আনন্দকে যাপন করে সংঘবদ্ধ হয়ে। নাম দেয় উৎসব। উৎসবকে উপলক্ষ্য করে উৎসবমুখর হয় উপস্থিত সবাই। কবি বা লেখকেরাও উৎযাপন করে জীবনের কিছু মুহূর্ত। তারা লেখালেখিকে উপলক্ষ্য করে আয়োজন করে উৎসবের। আনন্দকে স্থায়ী করতে, উৎসবকে স্মরণীয় করে রাখতে সম্পাদন করে বিশেষ সংখ্যা। সাহিত্যের ছোট কাগজ “শীতলপাটি ” প্রকাশ করেছে উৎসব সংখ্যা।
শ্লোগান তাদের ” শিল্প ভাবনার ছোটকাগজ”।
সাহিত্যের এই কাগজগুলো মূলত সাহিত্য ও সাহিত্যিকের সেবক হিসেবে আবির্ভূত হয়। ছোট কাগজ প্রসিদ্ধ লেখকের সাথে তরুণ নবীন লেখকদের পরিচিত করায় লেখক সমাজে। শীতলপাটির উৎসব সংখ্যায় আছে একঝাঁক লিখিয়ের লেখা। তারা কেউ পরিচিত,কেউ তরুণ। আমরা শীতলপাটির কল্যাণে তাদের সবার লেখার সাথে হতে পারলাম পরিচিত।
সূচীর প্রতি নজর দিলে আমরা দেখতে পাই এতে গ্রন্থিত হয়েছে দুটি গদ্য,তিনটি ছোটগল্প,আর শতাধিক কবিতা।
ছোটগল্প লিখেছেন লতিফ জোয়ার্দার, ফয়েজ আহমেদ ও তাহমিনা কোরাইশী।
ছোটকাগজের প্রধান বৈশিষ্ট্যই বলা যায় লেখক ও লেখকের লেখাকে পরিচিত করানো। একজন নিভৃতে কাজ করা আত্মপ্রত্যয়ী কিন্তু আত্মপ্রচারক নয় এবং প্রতিভাবান– তারর লেখা ছাপা–তাকে ও তার সৃজনশীলতাকে জাতীর সামনে পেশ করা। লিটলম্যাগ উল্লেখিত বিষয়গুলোকে নেয় দায়িত্ব হিসেবে।
আমরাও পারি লিটলম্যাগের সেইসব লেখকদের পরিচিত করাতে পাঠকের সামনে। শত লেখকের সব লেখা এখানে উপস্থাপন করলে এটি আরেকটি লিটলম্যাগই হয়। আমরা তা করব না। তবে সম্পাদকের সূচীকে মান্য করে আমরা এক থেকে এগারতম কবির কবিতাংশ পেশ করছি পাঠক সমীপে।
১.
মানুষই এ বিশ্বের আদিতম বই
(খৈয়াম কাদের)।
২.
মায়াবী জ্যোস্না গায়ে মেখে
পাড়ে এসে দোলা দেয় সামুদ্রিক ঢেউ
ঝাউ বনের উদাসীন আলো অন্ধকারে
বিরহী প্রেমিক সেজে বসে আছে কেউ
( আবু রাইহান)।
৩.
ফুলের প্রতীকে থাকে কাম-গন্ধ!
তোমার ক্যানভাসে তাকে কতটা মান্যতা দেয়?
( শিবলী মোকতাদির)।
৪.
যুদ্ধের দামামা মানুষের পক্ষে যায় না কখনও
(কামরুল বাহার আরিফ)।
৫.
খসে পড়া পাতার আড়ালে অনন্ত থাকে যে রং
তার নাম দিতে পারো জন্মদিন
(তাজিমুর রহমান)।
৬.
বসে আছি মহামান্য আমি আর আমার পৃথিবী/
চলেছি তো নিজে রাস্তা খুঁড়ে কে আমার পা বান্ধিবি।
(অরুণ পাঠক)।
৭.
ওয়াটগঞ্জের দিকে এখন আর কোনও ট্রাম যায় না/
যৌনতারও নেই কোন পিতৃদত্ত নাম
(নাগ সেন)।
৮.
যদি বেঁচে থাকি পৃথিবী মানুষের বাসযোগ্য আশ্বাসে…
(রোকেয়া ইসলাম)।
৯.
নতুন প্রেমে কেবল মানুষ-ই নয়
সকল প্রাণী মজে থাকে প্রেমে
(জোবায়েদ সুমন)।
১০.
অথচ রাত্রি পার হলেই দেখি
ঘুটঘুটে এক অন্ধকার সকাল
(সরওয়ার জাহান)।
১১.
আমার মায়ের প্রকৃত নাম জন্মভূমি বাংলাদেশ।
(সুমন শামস)।
একটি লিটলম্যাগ প্রকাশে ব্যয় হয় অর্থ,শ্রম,সময়। সব বহন করতে ত্যাগ স্বীকার করতে হয় সম্পাদক ও তার সহচরদের। উদ্দেশ্য যখন সাহিত্য ও সাহিত্যিক সেবা। তখন তাদের উচিত মানের প্রশ্নে আপোষহীন হওয়া। প্রকাশ করা উচিৎ মানোত্তীর্ণ লেখা। কবিতা অকবিতা ঢালাও প্রকাশ না করাই ভালো। আমরা ‘শীতলপাটি’র কবিতা অকবিতার বিশ্লেষণে যাচ্ছি না। শত কবির কবিতা ছাপা হয়েছে। এগারজন কবির, যাদের কবিতা পত্রিকার শুরুর দিকে গ্রন্থিত, তাদের কবিতার আংশিক পেশ করেছি।
এমন উল্লেখ করার মতো আরও কিছু কবিতা আছে। যেমন, “গতকাল ছিল ফড়িং ফড়িং দিন/ অথচ তোমাকে দেখেছি হৃদয়হীন/( নুরুল ইসলাম বাবুল)।
শুরুতে ‘ লাভ- বাইট’ আড়াল করতে চাইতো না মেয়েটা;( শোয়েব আব্দুল্লাহ আল – মামুন)।
এইচ আলমের জলপথের পথিক,’অসময়ে প্রেম’ ফারহানা আক্তার, বঙ্গ রাখালের ‘ সকাল’, কথা হাসনাতের ‘প্রতিদিন ফিলিস্তিন’,কিংবা এম. আব্দুল হালীম বাচ্চুর “মৃতের মতো বাঁচা” কবিতাগুলো শীতলপাটিতে গ্রন্থিত ভালো কবিতার কবিগণ শর্ত পূরণ করতে কসুর করেনি।
“তাই তোমাকে ভাত নিয়ে আসতে বারণ হরছিলাম। ” বাক্যাংশের যে গল্প সে গল্পের পটভূমি ১৯৭১ সালের। গল্পের চরিত্র জসীম তার স্ত্রী বেগুনক্ষেতে ভাত নিয়ে যাওয়ায় স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, “দেশের পরিস্থিতি খারাপ, “তাই তোমাকে ভাত নিয়ে আসতে বারণ হরছিলাম।”
হরছিলামের কথক যিনি তিনিই আবার তার স্ত্রীকে বেগুনক্ষেতেই বলেন,
“জসীম চোয়াল দেখিয়ে বলে, এই আমাকে একটা পাপ্পু দিলে না?”
যিনি হরছিলাম বললেন তিনিই আবার প্রমিত ভাষায় কথা বলেন।
ভাষা পরিবর্তনশীল। স্থান, সময়,পরিবেশের স্রোতে ভাষা পরিবর্তন হয়। আজকের ইয়ং জেনারেশনের কাছে,শহুরে জনতার কাছে পাপা,আব্বু,বাবু,কিস,ডেডি গ্রামে গেলেই আবহ পাল্টে যায়। ৫৩ বছর আগে অজপাড়াগাঁয়ের একজন কৃষক তার স্ত্রীকে চাষের জমিনে চুমো দেওয়ার প্রস্তাব দিতে পারে তা ভাবনার বিষয়। চুমুকে সেই সময় সেই প্রত্যন্ত গ্রামে পাপ্পু বলতো কিনা তাও ভাবার বিষয়।
“প্রথম গুলির আঘাতে জসীম থমকে দাঁড়ালো
দ্বিতীয় গুলির আঘাতে জসীমের হাত থেকে কোদালটা ছিটকে পরে এবং জসীম টলতে টলতে মাটিতে পড়ে যায়।”
“গেদু মারিয়াকে পাটক্ষেতের ভিতর নিয়ে কাঁধ থেকে লামায়….”
“এদিকে পাটক্ষেতে ধর্ষণের তাণ্ডবে পাটের দাপাদাপিতে পাতাগুলি কাঁপছে।”
….
….
জসীমের দেহটা নিথর হলো।
বোধশক্তিহীন মারিয়া জসীমের গালে পাপ্পি দেওয়ার জন্য….”
“কাঁধ থেকে লামায়”।
লামায় কি নামায় ছিল? নাকি গল্পকার নিজের আঞ্চলিকতার মুদ্রাদোষ জনিত কারণে লিখেছেন?
“পাটের দাপাদাপিতে পাতাগুলি কাঁপছে।”এখানে পাটের দাপাদাপির চেয়ে মারিয়ার দাপাদাপিটা মানানসই ছিল।
“বোধশক্তিহীন মারিয়া জসীমের গালে পাপ্পি দেওয়ার জন্য….” এই বাক্যের মারিয়া সংঘবদ্ধ ধর্ষণের পর তার স্বামীকে পাপ্পি দিতে এগিয়ে আসা মারিয়া। গল্পকার সংলাপ, ঘটনা,সময়,পরিস্থিতি বিবেচনা করে সংলাপ চরিত্রের মুখে তুলে দিতে অসতর্কই বলা যায়। আরও যত্নবান হওয়া কাম্য। সম্পাদকও পরিচর্যা করতে পারতেন। এই গল্প ছাড়াও আরও দুটো গল্প আছে। দুটো গল্পেরই মূল বিষয় পরকীয়া। সম্পাদকের সজাগ দৃষ্টি থাকলে বিষয়ে ভিন্নতা এনে কাগজের মান বাড়ানো যেত।
মজিদ মাহমুদের গদ্যের গতি আছে। অতিকথন এড়িয়ে যেতে পারলে গদ্যের প্রাণ বাড়ে। অপরিহার্য কথায় মূল বক্তব্য প্রকাশ করতে পারলে চিত্তাকর্ষক হয়। গদ্য যারা লিখে তাদের কেউ কেউ এ বিষয়টি করে থাকেন নিজের অজান্তে। পাঠক যখন তা বুঝতে পারেন তখন লেখা আর তাকে টানে না। লেখার মেদকে রুচিশীল পাঠক অবজ্ঞা করে। কোনটা মেদ,কোনটা মেদহীন তার তর্কে না গিয়ে পাঠ থেকে বিরত থাকে পাঠক। ভালো লিখেও তখন অজনপ্রিয় হয়ে যান লেখক।
মজিদ মাহমুদ ভালো জানেন,অনেক বলেন। পাঠক পাঠ করতে করতে ভালোর ভিতর কিছু বাহুল্য ভাব উপলব্ধি করেন।
শীতলপাটি’তে মূল রচনা মজিদ মাহমুদের গদ্য।
“আসলে মানুষের চিন্তা ভাষাকে বাহন করে মুক্তি চায়।”
তারপর বলতে বলতে বলেন, “কবিতার মুক্তির কথা বলল” ,….
শুরু করেছেন ‘ কবিতা মুক্তির জন্য” তার গদ্যের শিরোনাম ” কবিতা ও মুক্তি”।
কবিতাকে মুক্তি দিতে চান,আবার মুক্তিকেই মুক্তি দিতে চান।
” কবিতা ও মুক্তি একই সঙ্গে চলতে পারে না। আসলে মুক্তি মানে ভালোবাসা।”
” পৃথিবীতে মানুষের কাঙ্খিত ও যাচিত মুক্তি সম্ভব নয়;…..তাই মুক্তির জন্য একক কোন সংজ্ঞা রাখা হয়নি।”
মুক্তি আছে,মুক্তি নাই, এই দোদুল্যমানতার ভিতর দিয়েই শেষ হয়েছে ” কবিতা ও মুক্তি” গদ্যকথা। শেষ করার আগে বলেছেন, ” ভাষা দিয়ে সেই মুক্তির সৌন্দর্য হয়তো সব সময় ব্যাখ্যা করা যাবে না; তখন সন্তকবি কবীরের মতো বলতে হবে–
কথার ফাঁদে মুক্তি নাই কো/ মুক্তি আছে ভক্তিতে/ চতুরতা- ত্যাগ প্রেমকে ধরো/ মুক্তি মিলবে সেই তাতে/”।।
” অর্থাৎ কেউ যখন মনে স্বাধীন থাকতে চাই,তখন বাইরের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।” চাই,আর চায় এর ব্যবহার লেখকদের প্রায়শই বিভ্রান্ত করে। নবীন লেখক থেকে বিজ্ঞজনও এই বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হতে পারেন না। তবে মুক্ত হওয়া উচিৎ বলে মনে করি।
“কবিতায় দিন,কবিতায় যাপন” মূলত স্মৃতি গদ্য। ইসলাম রফিক স্মৃতিচারণ করেছেন তার কবিজীবনের। কবিতার পথে হাঁটতে হাঁটতে কার বাসায় গেলেন,কার সোফায় বসলেন,কার কাছ থেকে শুনলেন কবির কথা,কবিতার কথা এসব বয়ান করেছেন সাবলীল ভঙ্গিমায়।
” আমরা ভ্রমণের মাধ্যমে, পরিচয়ের মাধ্যমে সম্পর্ক তৈরী করতে চাই,উদ্দেশ্য কবিতা ছাপা হওয়া।”
অথচ একজন কবির সাথে পরিচয়,সাক্ষাৎ হতে পারতো হৃদ্যতার জন্য,আন্তরিকতার জন্য। কবিতা ছাপা হওয়া ভালো। তার থেকে আরও ভালো কবিতাকে ছাপার যোগ্য করে তোলা। কবিতাকে কবিতা করে তোলা। পরিচয়ের মাধ্যমে কবিতা ছাপাছাপি কবি ও কবিতার জন্য ক্ষতিকর,অস্বাস্থ্যকর।
শীতলপাটিতে যেসব কবির কবিতা ছাপা হয়েছে তাদের কিছু অংশের নাম আমরা উল্লেখ করেছি পূর্বেই। আরও অনেকেই আছেন কবিতার মিছিলে। তারা হলেন যথাক্রমে,মামুন মুস্তাফা,মামুন রশীদ,হারুণ মুহাম্মদ,এনামুল হক টগর,শাহনাজ পারভীন,মিনা মাশরাফী,যাযাবর জিয়া,মোল্লা আলী আছগর,শামীমা সীমা,জহুরুল আনাম,আশরাফ খান,সুমন রাজ সরকার প্রমুখ।
শীতলপাটি( শিল্প ভাবনার ছোটকাগজ)
সম্পাদক: রেহানা সুলতানা শিল্পী। নামলিপি: নীল নীলাঞ্জনা,প্রচ্ছদ: অধরা মুন। মূল্য: ২৫০ টাকা। শীতলপাটি উৎসব সংখ্যা : ২০২৪এ প্রকাশ হয়েছে। নিয়মিত হাজির থাকুক সাহিত্য ও শিল্পের ময়দানে। আমরা শীতলপাটি’র দীর্ঘ যাত্রা কামনা করি।