৯. আপনি কি কখনো বাংলাদেশে এসেছেন? আপনার অভিজ্ঞতা জানতে চাচ্ছি।
উত্তর: বাংলাদেশ তো আমার দ্বিতীয় মাতৃভূমি। কোভিড-এর সময়কাল বাদ দিয়ে গত ২০ বছরে আমাকে অন্তত ২৫/২৬ বার ঢাকাসহ বাংলাদেশের ভিন্ন ভিন্ন জেলাশহরে যেতে হয়েছে বিভিন্ন কবিতা উৎসবে বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে। এমনকি এমনও হয়েছে অন্তত ১৫টি বছর একটানা আমি ২১ ফেবরুয়ারির দিন ঢাকাতেই অবস্থান করেছি আর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আমার শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছি। ফলে বাংলাদেশের কবিতাকেন্দ্রিক মানুষজন যেমন আমার অতীব আত্মজন, ঠিক তেমনই বাংলাভাষার জন্যে বাংলাদেশের আত্মবলিদান আমাদের বুকের ভেতর গভীর প্রেরণার উৎস হিসেবেই থেকে যাবে আজন্মকাল।
সেই ২০০২-এর সেপ্টেম্বরে আমার প্রথম যাওয়া বাংলাদেশে, প্রিয় কবি শ্যামলকান্তি দাশ-এর সঙ্গে, সঙ্গে ছিলেন কবি মৃদুল দাশগুপ্ত, কবি কমল চক্রবর্তী এরকম আরও একঝাঁক প্রিয় কবি। জীবনের সেই কঠিন সময়টিতে কবিবন্ধু মাহবুব হাসান হয়তো চেয়েছিল কয়েকটা দিন ওদের কাছে গিয়ে কবিতার সঙ্গে একাকার হয়ে থাকলে কিছুটা মানসিক শক্তি ফিরতে পারে আমার। বিশিষ্ট আবৃত্তি শিল্পী সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ও সঙ্গে ছিলেন আমাদের। সেই প্রথম কবি শামসুর রাহমান আর কবি আল মাহমুদের কাছেও যেতে পেরেছিলাম।
তারপর তো বছরে কখনও একবার, কখনও দু-বার বিভিন্ন কবিতার অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ যেতে হয়েছে আমাকে। কখনও জাতীয় কবিতা উৎসবে, কখনও ওখানকার বাংলা একাডেমি আয়োজিত আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে, কবিতা পড়তে কিংবা আলোচনায় অংশ নিতে। প্রিয় কবি, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা ভাইয়ের আমন্ত্রণে কয়েক বার কক্সবাজার গেছি দরিয়ানগর আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসবে, সেই সঙ্গে সেন্ট মার্টিন দ্বীপেও। ঠিক সেরকমই প্রিয় কবি মাহমুদ কামালের আমন্ত্রণে বারংবার গেছি টাঙ্গাইল, আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসবে। আর বরিশাল তো যেতেই হয়েছে প্রিয় কবি, একান্ত স্বজন হেনরী স্বপনের আমন্ত্রণে। সেই কীর্তনখোলা, ধানসিঁড়ি, ব্রজমোহন কলেজ… জীবনানন্দ ছড়িয়ে আছেন সর্বত্র… বুকের ভেতর কেমন একটা গা-ছমছম অনুভূতি তৈরি হয় বরিশাল ঘুরতে ঘুরতে। ঠিক এমনটাই হয় কুষ্টিয়ায় লালন সমাধির সামনে মাথা নোয়ালে, আটকে রাখা যায় না চোখের জল। কবিবন্ধু, কাছের মানুষ মজিদ মাহমুদের ভালোবাসা আর আয়োজনে পাবনাসহ কুষ্টিয়া ভ্রমণও সম্ভব হয়েছে, সেই সঙ্গে শিলাইদহ, রবীন্দ্র কুঠিবাড়িতেও।
বলতে ভুলে গেছি, প্রিয় কবি এবং প্রখ্যত কণ্ঠশিল্পী হাসান মাহমুদের সঙ্গে ভোলা দ্বীপাঞ্চল ঘুরে বেড়িয়েছি ঢাকা থেকে জাহাজে চেপে, চার-চারটে নদী পার হয়ে। আমার পঞ্চান্নতম জন্মদিন পালিত হয়েছিল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে, এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিল কবিবন্ধু আসলাম সানী আর ছোটভাই রোকন জহুর। ঢাকায় আমার এক গোপন আর তুমুল আড্ডাস্থল আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পীবন্ধু ধ্রুব এষ-এর বাসাটি। প্রখ্যাত শিশু সাহিত্যিক হুমায়ূন কবীর ঢালী ভাইয়ের সঙ্গে কত কত রাত যে ধ্রুবর বাসায় উদ্দাম আড্ডা দিয়েছি, তার হিসেব দিতে পারব না। আমার অনেক বইপত্রের প্রচ্ছদ সে এঁকে দিয়েছে, এমনকি আমার “শ্রেষ্ঠ কবিতা”-র প্রচ্ছদচিত্রও। এই তো মাস-তিনেক আগেও কবি অরুণ শীলের আমন্ত্রণে চট্টগ্রামে, কবি শামীম রেজার আমন্ত্রণে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি অনুষ্ঠানে, আর কবি স ম তুহীন-এর আমন্ত্রণে সাতক্ষীরা পরিভ্রমণ করে এলাম কবিতাকে বুকে জড়িয়ে। এসব গুলি তো শুধুই অনুষ্ঠান নয়, যেন নিয়তই মানবিক বন্ধনে জড়িয়ে পড়তে থাকা।
আমার বাংলাদেশ যাত্রার শুরুর দিকে অনেকগুলি বছর কবি শামসুন নাহারের ফার্মগেটের বাসাবাড়িই ছিল আমার একান্ত আশ্রয়। তারপর তো ধীরে ধীরে যেমন মজিদ, যেমন হাসান ভাই, যেমন হেনরী, এদের বাসাগুলি যেমন, তারও অনেক আগে থেকেই আমার আর এক তেজী ভাই, কবি-সম্পাদক কামরুল হুদা পথিকের বাসাবাড়িও বছরের পর বছর ধরে তো আমার নিজেরই হয়ে গেছে! আর একজন প্রিয়তম মানুষের কথা মনে পড়ছে এখন। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে ফোন করলেই তিনি বলে উঠতেন: ‘… রফিক, ব্যাগপত্তর নিয়ে সোজা আমার বাসায় চলে এসো।…’ তিনি আর কেউ নন, কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী। একবার কলকাতায় এসে, আমার অসুস্থতার খবর পেয়ে, সিরাজী ভাই আর নূরুল হুদা ভাই কবি উত্তম দাশকে নিয়ে আমার বাসায় চলে এসেছিলেন। ঢাকার বিশিষ্ট প্রকাশন সংস্থা ” কথাপ্রকাশ” থেকে প্রকাশিতও হয়েছে আমার ‘কবিতাসংগ্রহ’। এই সবকিছুই জুড়ে-গেঁথে-বেঁধে বাংলাদেশের এইসব আত্মজনের সঙ্গে একাকার করে আমার এই সামান্য লেখালেখির জীবন।
১০. বাংলাদেশের সাহিত্য পড়েন? আপনার প্রিয় বা পছন্দের বাংলাদশী সাহিত্যিক কে-কে বা কারা? কেন?
উত্তর: কেন পড়বা না! উৎকৃষ্ট সাহিত্য রচনায় বা গবেষণার ক্ষেত্রগুলিতে বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিক-গবেষকগণ তো পিছিয়ে নেই। ফলে তাঁদের রচনা এড়িয়ে সামগ্রিকভাবে বাংলাসাহিত্যের বিকাশের দিকগুলি পরিপূর্ণভাবে জানা সম্ভব নয়। কতজনের নাম করব আমি? বেগম রোকেয়া, শওকাত ওসমান, জাহানারা ইমাম, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, শহীদুল জহির, আবুবকর সিদ্দিক, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, সানাউল হক খান, আবিদ আজাদ এরকম করে অজস্র মহান স্রষ্টার নাম উল্লেখ করা যায়, তাতেও কি সম্পূর্ণ হবে এই তালিকা? মনে হয়, না।
একজন স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির উৎকর্ষতার কারণেই জনমানসে স্থান করে নেন। আমার কাছেও বিষয়টি সেইরকমই।
১১. বাংলাদেশ এবং ভারতীয় বাংলা সাহিত্যের মিল ও তফাৎ — কোথায়? কি-কি?
উত্তর: এখানে একটি বিষয় খুব স্পষ্টভাবে মনে রাখা জরুরি, বাংলাদেশ সৃষ্টিই হয়েছে বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, এবং মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে। আর সাহিত্য তো জীবনেরই দর্পণ। ফলে বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের বিস্তৃত আর সরাসরি প্রভাব থাকবেই। ঠিক এরকমের প্রভাব ভারতীয় সাহিত্য থেকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি পুরোপুরিই আলাদা, আর সামাজিক আন্দোলন বলতে পরবর্তীকালের, সত্তরের দশকের নকশাল আন্দোলন। এই আন্দোলনেরও ভূমিকা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এসব ব্যতিরেকে, সাহিত্যগত যে মূল ধারা, সেখানে দুটি দেশের মধ্যে অনেকটাই মিল খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। তবে একটি বিষয় আমার কাছে পরিষ্কার, বাংলাদেশ যেভাবে বাঙালীত্বকে নিজেদের অন্তরে লালিত আর উন্মাদনায় রেখেছে, তা ভারতবর্ষে কেন, এই পশ্চিমবঙ্গেও তার ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই। আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গে অন্যান্য ভাষার আগ্রাসন এবং সংস্কৃতি আমাদের বাঙালিয়ানাকে দুমড়ে মুচড়ে কোণঠাসা করে ফেলছে।
১২. এই দুই দেশের সাহিত্যিক মেলবন্ধন উন্নয়নে কোন-কোন পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আপনার মনে হয়?
উত্তর: অনেক কিছুই করা যেতে পারে, যেসবের কিছু কিছু অবশ্য শুরু হয়ে গেছে, কিন্তু আরও পরিকল্পিত আকারে, আরও জোরালোভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া দরকার। সেসব বিষয়গুলির মধ্যে দু-বাংলার বইপত্রের সহজ আর স্বাভাবিক আদানপ্রদান খুবই উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়াও, দু-বাংলার কবি-সাহিত্যিকদের মত-বিনিময়ের জন্যে যথাযোগ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলাও খুব জরুরি। আমাদের এই বাংলায় আলাদাভাবে বাংলাদেশ বইমেলা হয়, তা ছাড়াও, এখানকার আন্তর্জাতিক পুস্তক মেলায় বেশ বড়ো পরিসরে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ান থাকে। এইসব উদ্যোগ থেকে আমরা বাংলাদেশের বইপত্রের সুনির্দিষ্ট হদিশ পেয়ে যাই। দুই বাংলার সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনে এগুলি তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করি। উভয় বাংলার কবি-সাহিত্যিক-গবেষকদের ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে অনেক উদার এবং সহানুভূতিশীল রীতি-প্রণয়নও মতবিনিময়ের পথটি প্রশস্ত করতে পারে।
১৩. আপনি কখনো কি কোন পত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিন অথবা সংকলন সম্পাদনা করেছেন? বিস্তারিত বলুন।
১৪. লিটল ম্যাগাজিন এর সংজ্ঞা কি? এ নিয়ে আপনার ভাবনা বলুন।
উত্তর: আমি প্রথমে ১৪ নম্বর প্রশ্ন নিয়ে কিছু কথা বলার চেষ্টা করি। আমার ধারণা, প্রতিভাবান কবি-লেখককে আবিষ্কার করাটাই লিটল ম্যাগাজিন এর প্রধানতম চরিত্র হওয়া জরুরি। সেইসব প্রতিভাবান তরুণ অথবা তরুণতম কবি-লেখকদের রচনা প্রতিষ্ঠিত লেখকদের রচনার সঙ্গে মিলিয়ে-মিশিয়ে বৃহত্তর পাঠকগোষ্ঠির নজরে আনা লিটল ম্যাগাজিন এর মূল আদর্শ বলেই বিবেচনা করি আমি।
আমি যে লিটল ম্যাগাজিনটি সম্পাদনা করতাম, তার নাম “গ্রামনগর”। সে বহুকাল আগেকার কথা, সেই আশির দশক। হঠাৎ-ই মনে হতে থাকল, নিজেদের, অর্থাৎ সমমনস্ক, স্পন্দিত আর নিভৃত চর্চাকারীদের আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্যে একটি যথার্থ ভূমি তৈরি করে নেওয়া দরকার। শহরকেন্দ্রিক নামী কবিদের কণ্ঠস্বরের সঙ্গে সুদূর জেলাগুলিতে নির্জনে চর্চারত কবিদের কণ্ঠস্বর যুক্ত করে একটি সম্মিলিত ধ্বনিরূপ নির্মাণে সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন। এইসব ভাবনারই ফলশ্রুতিতে ‘গ্রামনগর’ পত্রিকাটির আত্মপ্রকাশ ১৯৮৫-তে। অগঠিত হৃদয়ের উন্মাদনায় জন্ম হলেও, একে একে কবি সুব্রত রুদ্র, কবি সুধীর দত্ত, কবি ও বরেণ্য চিত্রশিল্পী পূর্ণেন্দু পত্রীও তাঁদের সবটুকু অন্তঃকরণ যুক্ত করেছিলেন পত্রিকাটির সঙ্গে। বারংবার তাঁদের গদ্যে-পদ্যে, অলংকরণ আর উপদেশেও সমৃদ্ধ হয়েছে ‘গ্রামনগর’।
‘গ্রামনগর’-এর লেখকসূচি ঈর্ষণীয়। বাংলা ভাষার প্রায় সব প্রধান কবি-ই কোনো-না-কোনো সংখ্যায় কলম ধরেছেন পত্রিকাটির জন্যে, যেখানে সমভাবে তাঁদের লেখনী যুক্ত করেছিলেন বাংলাদেশের কবিরাও। সে তো এক রোমহর্ষক সময়কাল! বর্তমান বিশ্বের যোগাযোগের মাধ্যমগুলির বিন্দুমাত্র সুযোগ-সুবিধা ছিলনা তখন, পুরোটাই ডাক-ব্যবস্থা নির্ভর, এমনকি ছিল না দূরভাষের সুবিধাও! ডায়মন্ড হারবার থেকে চিঠি পাঠানোর পর, ঢাকা কিংবা বরিশালের কোনো কবির লেখা আদৌ পাব কিনা, এটুকু বুঝে উঠতেই কমপক্ষে ৩০/৩৫ দিনের রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষায় থাকা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না! ফলে, কবি সুব্রত রুদ্র-র নির্দেশেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল বছরে একটি বা দুটি সংখ্যা প্রকাশের। ১৯৯৮ পর্যন্ত, ১৪ বছরে, মোট ২০টি সংখ্যা প্রকাশ পেয়েছিল ‘গ্রামনগর’-এর।
ঘুপচি ঘরের লেটার-প্রেসে, টিমটিমে বাল্বের আলোয় সীসার অক্ষর একটি একটি করে জুড়ে কম্পোজ হত নির্বাচিত রচনাগুলি। দু-তিনবার ভিজে কাগজের ওপর গালি-প্রুফ সংশোধনের পর, ছাপা হত পা-য়ে চালানো মুদ্রণযন্ত্রে। ধৈর্যের চরম পরীক্ষা দিতে দিতে ক্লান্ত হওয়ারও উপায় থাকতো না। মনে পড়ে, বাড়ি ফেরার শেষ অবলম্বনটুকুও হাতছাড়া হওয়ার পর, ঝাঁপ-বন্ধ প্রেসের সামনে আড্ডা দিতে দিতে, গভীর রাতে পুলিশের খপ্পরে পড়া! এরকম দুঃসহ স্মৃতির পাশাপাশি মনের কোণ আলোকিত করেই আছে মূল্যবান অনেক স্মৃতিও। যেমন, ‘দেশ’ পত্রিকার অফিস থেকে দু-বার ফিরে এসেছি সুনীলদা (গঙ্গোপাধ্যায়) লেখা দিতে পারেননি, বলেছেন: ‘সামনের সপ্তায় এসো…’। সেই সপ্তাহে গিয়েও দেখি, কবিতা লিখে উঠতে পারেননি ‘গ্রামনগর’-এর জন্যে। এত দূর থেকে গিয়ে, বিমর্ষ মুখে, ফিরে আসার জন্যে যেইমাত্র উঠে দাঁড়িয়েছি, সুনীলদা বললেন: ‘বোসো’। বসলাম আমি। পাশের টেবিলে বসা জয় গোস্বামীকে ডেকে বললেন: ‘ জয়, দেশ-এর ফাইল থেকে আমার কবিতাটি বের করে রফিককে দাও তো, আমি কালকে তোমায় নতুন কবিতা দিয়ে দেব…!’ বিস্ময়ে অভিভূত আমি। এমন দরাজ মনের মানুষ জীবনে খুব কমই দেখেছি আমি। ‘গ্রামনগর’ বহুবার সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁর নতুন নতুন কবিতায়।
মোটামুটি ছাপা হত ৩০০/৩৫০ কপি, আলোচনা সংখ্যাটি বোধহয় ছাপা হয়েছিল ৪০০ কপি। এটুকু করতেই হিমসিম অবস্থা হত টাকা সংকুলানের। কয়েকজন হৃদয়বান সংস্কৃতি-প্রেমীর প্রাণপণ সহযোগিতা আর সামান্য কিছু বিজ্ঞাপনে কুলিয়ে উঠতে হত আমাদের। এঁদের মধ্যে ডাঃ অরুণ বসু, আর কবি দীপক হালদারের কথা চিরজীবন মনে থাকবে আমার। বিদেশী কবিতার অনুবাদে সিদ্ধহস্ত ছিলেন ডাঃ বসু। কিন্তু পত্রিকা প্রস্তুত হয়ে যাওয়ার পর, সবচেয়ে দুরূহতম কাজটি ছিল পত্রিকার কপি লেখক-কবিদের কাছে পৌঁছানো। ডাকখরচ করার তেমন সামর্থ ছিলনা আমাদের, হয়তো কলকাতা ঘুরে ঘুরে কিছু কপি বিলি করা গেল, এটুকুই। তারপর অপেক্ষা করতে হত ২৫ বৈশাখের জন্যে। ওই দিন ভোর থেকেই কলকাতার রবীন্দ্র সদন চত্বর বিভিন্ন ছোট পত্রিকার স্টল আর অজস্র কবিদের ভিড়ে মুখরিত হয়ে উঠতো। ‘গ্রামনগর’ও যোগ দিত সেখানে। ‘গ্রামনগর’ থেকেই ১৯৯৩ থেকে ২০০০ পর্যন্ত প্রতি বছর ২৫ বৈশাখের ভোরে প্রকাশিত হত ‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ’ বিশেষ ট্যাবলয়েডটি। আমাদের স্টলে যুক্ত হত ওটিও
শুধুমাত্র পত্রিকা প্রকাশেই মন থেমে থাকতে চাইল না একসময়। ‘গ্রামনগর’ থেকে কবি সুব্রত রুদ্র সম্পাদিত কবিতার বিশেষ বিশেষ সংকলনগ্রন্থ যেমন প্রকাশিত হয়েছিল, ঠিক তেমনই প্রকাশ পেয়েছিল কবি আলোক সরকারের ‘তমোশঙ্খ’, সামসুল হকের ‘ত্রসরেণু’, সুধীর দত্তের ‘প্রাকপুরাণ’, দীপক হালদারের ‘হে অনঙ্গ উত্তরীয়’, অরুণ পাঠকের ‘প্রশস্তির ভিন্ন রূপ’ ইত্যাদি উজ্জ্বল কবিতাগ্রন্থগুলিও। এমনকি ‘গ্রামনগর’ থেকেই তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করতে চেয়ে স্বনামধন্য কবি ও চিত্রশিল্পী পূর্ণেন্দু পত্রী ২২.০২.১৯৯৬-তে একটি পত্র লিখেছিলেন আমাকে, পাণ্ডুলিপিও তুলে দিয়েছিলেন আমার হাতে। সে এক অন্য রোমাঞ্চকর ইতিহাস!
বিস্তৃত সময়ের অন্ধকার, আর পত্রিকার অ-সংরক্ষিত সংখ্যাগুলির ধুলোমলিন আস্তরণ সরিয়ে বাংলা সাহিত্যের উদ্যমী গবেষক লিটন রাকিব এবং তরুণ প্রজন্মের কবি আরফিনা অক্লান্ত পরিশ্রম আর যত্ন করে ‘গ্রামনগর’-এর একটি নির্বাচিত সংকলনগ্রন্থ (নির্বাচিত গ্রামনগর) প্রস্তুত করেছেন, যেটি ‘আবিষ্কার’ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে জানুয়ারি ২০২০-তে। এই প্রকাশনার ক্ষেত্রে বিশেষ সহযোগিতা করেছেন কথাসাহিত্যিক মুর্শিদ এ এম। এঁদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফিনিক্স-ডানায় আবারও সাম্প্রতিক আলোয় কিছুটা ফিরে এসেছে হারিয়ে যাওয়া ‘গ্রামনগর’। আমার চিরজীবনের কৃতজ্ঞতা এঁদের প্রতি।
১৫. অনলাইন ম্যাগাজিন বা ওয়েব ম্যাগাজিন চর্চাকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন?
উত্তর: আমি তো সদর্থক দৃষ্টিতেই দেখি, সমস্যা কোথায়! সাহিত্য-শিল্পের প্রসারে মুদ্রণশিল্পের যেমন গভীর ভূমিকা আছে, ওয়েব বা অনলাইন মাধ্যমের গুরুত্বও অনস্বীকার্য নয়। তবে একটি মুদ্রিত পত্রিকা বা পুস্তক হাতে ধরে নতুনের সৌরভ নিতে নিতে পাঠ করার যে আনন্দ বা তৃপ্তি তা ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব। কিন্তু যাদের কাছে সময় খুবই দ্রুতগামী, তারা ওয়েব বা অনলাইনে চোখ বুলিয়ে নিতে পারে মুহূর্তের অবসরেও, পত্রিকা বা পুস্তক বহন করার ঝক্কিও থাকে না। সব মিলিয়ে মুদ্রণ আর ওয়েবকে একে অপরের পরিপূরক মনে হয়। আর একটি কথা মনে রাখা দরকার, ওয়েব বা অনলাইনের কোনও দেশ-কালের পরিসীমা থাকে না।
১৬. আগামী দিনের সাহিত্য কেমন হবে? আপনার কল্পনায়।
উত্তর: আমি তো এরকম কিছু কল্পনা করিনি কখনও। কারণ, প্রথমত, সাহিত্য-শিল্প তার নিজের মতন গতিপথ তৈরি করে অগ্রসরমান হয়, এরকমই আমার বিশ্বাস। তবে, যতদিন জীবন থাকবে, ততোদিনই জীবিত থাকবে প্রেম। সেইসঙ্গে অসহায় নিপীড়িত মানুষের প্রতিবাদ কিংবা প্রতিরোধ জারি থাকতে বাধ্য। ফলে সাহিত্য-শিল্পের আঙিনা থেকে এইসব বিষয়গুলিকে কোনও কালেই মুছে ফেলা সম্ভব হবে না। আর দ্বিতীয়ত, মন দিয়ে নিজের সবটুকু সামর্থ উজাড় করে নিজের সৃষ্টিশীলতায় মগ্ন থাকাটাই আমার কাছে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর বেশি কিছু ভাবতে চাইনি কখনও।
গ্রহণে সাজ্জাদ বিপ্লব