spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদসাক্ষাৎকারসাক্ষাৎকার : হাসান আলীম

গ্রহণে : সাজ্জাদ বিপ্লব

সাক্ষাৎকার : হাসান আলীম

১. বাংলা রিভিউ : আপনার প্রথম প্রকাশিত বই কোনটি? কবে প্রকাশিত হয়েছিলো? প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি কেমন ছিলো? 

হাসান আলীম: আমার প্রথম প্রকাশিত বইটি কবিতার বই। এর নাম ‘শ্বাপদ অরণ্যে অগ্নি শিশু ‘

এটি প্রকাশ হয়েছিল জানুয়ারী -১৯৮৩,পৌষ-১৩৮৯, রবিউল আউয়াল -১৪০৩।

প্রথম সন্তান জন্ম দেওয়ার আনন্দের মতো। এটি সহজে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এক অনিন্দ্য অনির্বচনীয় আনন্দের কথকতা হৃদয়ে ভর করে আড়ষ্ট করে দেয়। 

‘প্রত্যয়ী’ প্রকাশ থেকে এটি প্রকাশ করেছিলো বন্ধুবর কবি আসাদ বিন হাফিজ। এটি প্রকাশের অর্থনৈতিক এবং মানষিক সহযোগিতা করেছিলেন আমার জন্মদায়িনী মা জননী। 

এর প্রচ্ছদ করেছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক, কবি ও বর্তমানের ‘সূচী’ সাহিত্য ম্যাগাজিনের সূফী সাধক সম্পাদক নূরুল ইসলাম। 

এটি প্রকাশের পর আমার সহপাঠীরা আনন্দ করেছিলো এবং আমার শিক্ষক রসায়নের নামকরা মেধাবী অধ্যাপক, বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী ঔপন্যাসিক, কিংবদন্তী চলচ্চিত্র নির্মাতা, ড. হুমায়ুন আহমেদ। তিনি  আমাকে মিষ্টিমূখ করে আপ্যায়িত করেছিলেন এবং তার একটি বিখ্যাত উপন্যাস ‘শঙ্খনীল কারাগার ‘ ও ছোট গল্পের বই ‘নিশিকাব্য’ উপহার দিয়েছিলেন। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের এমএসসির ছাত্র। 

২. বাংলা রিভিউ : সাহিত্যে আপনি কার উত্তরাধিকার বহন করেন?

হাসান আলীম: লেখকের উত্তরাধিকার বহন করি না। তবে আমি অবশ্যই আমাদের ঐতিহ্যবাদী কবি, সাহিত্যিকদের সাহিত্য ভালোবাসি। আমি আলাওল, সৈয়দ সূলতান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসিম উদ্দিন, জীবনানন্দ দাশ, ফররুখ আহমদ, আল মাহমুদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, বিনয় মজুমদার, আবুল হাসান এবং ড. মাহবুব হাসানের কবিতা পছন্দ করি। 

আমি বিশেষ ভাবে কাজী নজরুল ইসলাম,জীবনানন্দ দাশ,আবদুল মান্নান সৈয়দ, বিনয় মজুমদার এবং মাহবুব হাসানের কিছু ব্যতিক্রমী চিত্রকল্প প্রধান এবং তত্ত্ব মূলক কবিতা পছন্দ করি। 

আমি আলাদা এবং ব্যতিক্রমী চিন্তার কবিতা এবং আলাদা ছন্দ প্রকরণের কবিতা লিখতে উৎসাহ বোধ করি। এ বিষয়ে কিছু কবিতা, কাব্যগ্রন্থ এবং তত্ত্বমূলক প্রবন্ধও লিখেছি।

৩. বাংলা রিভিউ : এ যাবত সর্বমোট আপনার কয়টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে? এর মধ্যে কোনটি বা কোন কোন কাজকে বা কোন বইকে আপনি আপনার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি বলে মনে করেন?

হাসান আলীম: আমার এ পর্যন্ত প্রায় পঞ্চাশটি বই প্রকাশ হয়েছে। এর মধ্যে কবিতা, ছড়া,কিশোর কবিতা ও কাব্য সমগ্র, নির্বাচিত ছড়া মিলিয়ে ৩২ টি, গবেষণা গ্রন্থ ও সমালোচনা গ্রহ্ন ৯ টি,ছোট গল্প ২ টি, সংগীত ১ টি, নাটক ১ টি, বিজ্ঞান কল্প কাহিনি ১ টি।

এ ছাড়াও সম্পাদনা গ্রন্থ ও পত্রিকা বের হয়েছে প্রায় ১০ টি।

আমি এর মধ্যে ছড়া, কবিতা ও গবেষণার ক্ষেত্রে কিছু নতুন কাজ করেছি। আমার কিছু নতুন চিন্তার কবিতা ও ছড়ার বই রয়েছে। গবেষণার ক্ষেত্রে দুটি বই রয়েছে।

নতুন তত্ত্ব মূলক কবিতার বই কয়েকটি, যেমন–

 ১. ‘তোমার উপমা’(১৯৯৪,সালে প্রকাশিত),  এ কাব্য গ্রন্থে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান –পরাবাস্তববাদী কবিতা রয়েছে। এ জাতীয় কবিতার বই বাংলা সাহিত্যে আমার জানা মতে নেই। 

২. ‘কাব্য মোজেজা‘(২০০০,সালে প্রকাশিত), এ গ্রন্থ মোজেজা, জাদু-বাস্তবতা এবং কল্প -জাদুবাস্তবতা বিষয়ক কবিতা রয়েছে। আমাদের সাহিত্যে কোন কবিতা নেই এমন তবে আল মাহমুদের ‘আগুনের মেয়ে ‘উপন্যাসটি জাদুবাস্তবতার বলে ধারণা করা যায়। আমার এ কাজটি বাংলা কাব্যসাহিত্যে নতুন তবলে আমি দাবি করি।

৩. ‘কিউব কবিতা ও অন্য চাঁদ ‘(২০১৬,সালে প্রকাশিত),  এটি কিউবিজম বা ত্রিমাত্রিকতা,  গানিতিক এবং জ্যামিতিক তত্ত্বের কবিতা গ্রহ্ন। এ জাতীয় কবিতাও আমাদের বাংলা কবিতায় তেমন হয়নি। 

৪. ‘ছু মন্ত্র সরল অঙ্ক’ (২০২৩,সালে প্রকাশিত), এ গ্রন্থ মোজেজা, জাদুবাস্তবতা,বিজ্ঞান, গণিত, বিমূর্ত ভাব, ডাডাবাদ এবং অধ্যাত্মবাদ নিয়ে নতুন ধাচের কবিতা রয়েছে। এ জাতীয় কবিতাও আমাদের বাংলা কাব্য সাহিত্যে কেউ লিখেন নি। এটাও আমার নতুন কাজ।

৫.‘নতুন ছন্দের ছড়া’(২০২৩,সালে প্রকাশিত) 

এ ছড়ার বইয়ে স্বরবৃত্ত ছন্দে ১৬ রকম ফর্মুলা দিয়ে ছড়া লিখেছি। এ রকমও নতুন ছন্দ প্রকরণে ফর্মুলা দিয়ে কেউ ছড়া লিখেন নি। এটা আমার নতুন কাজ।

৬.  ‘ফানাফিল্লা’ (২০২৩,সালে প্রকাশিত)। 

এটি দ্বিপদী পঙক্তির বাংল তিন ছন্দের আধ্যাত্মিক কবিতা।  বাংলা সাহিত্যে আধ্যাত্মিক কবিতা ও গান অনেকে লিখেছেন কিন্তু দ্বিপদী পঙক্তির অক্ষর বৃত্ত, মাত্রা বৃত্ত, স্বরবৃত্ত ছন্দের আধ্যাত্মিক কবিতা আমার জানা মতে কেউ রচনা করেন নি। 

গবেষণার ক্ষেত্রে আমার দুটি উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে —

১. ‘ছন্দ বিজ্ঞান ও অলংকার’ (২০০৭,২০১৮,সালে প্রকাশিত)। এ বইয়ে বাংলা তিন প্রধান ছন্দের গাণিতিক ফর্মূলা দিয়েছি এবং শতাধিক কবির কবিতা বিশ্লেষণ করেছি। বাংলা সাহিত্যে ২৫৬ টি নতুন ছন্দের ফর্মূলা দিয়েছি এবং কবিতা লিখে তার উদ্ধৃতি দিয়েছি। সন্ধ্যক্ষর, দল ও শব্দের গানিতিক ফর্মূলা দিয়েছি। 

আরবি, সংস্কৃত ও ইংরেজি ছন্দেরও বিশ্লেষণ করেছি। অলংকার, চিত্রকল্প, ও রস নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।

২. ‘কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতার নন্দনতত্ত্ব ‘(২০২০সালে প্রকাশিত)  এবং এর ইংরেজি ভার্সন Aesthetic Essence of the REBEL by Kazi Nazrul Islam (2021), এ গ্রহ্নে ১৬ টি প্রবন্ধ লিখেছি কেবল বিদ্রোহী কবিতাকে নিয়ে। এর মধ্যে বিদ্রোহী কবিতার শব্দ সম্ভার, বিদ্রোহী কবিতার ধ্বনি তত্ত্ব, বিদ্রোহী কবিতার ধ্বনিতাত্ত্বিক ম্যাজিক নাম্বার, বিদ্রোহী কবিতার ছন্দ, বিদ্রোহী কবিতার ছন্দের পরীক্ষা নিরীক্ষা, বিদ্রোহী কবিতার অলংকার, বিদ্রোহী কবিতার চিত্রকল্প, বিদ্রোহী কবিতার রস, বিদ্রোহী কবিতার আবৃত্তি গুণ,বিদ্রোহী কবিতার মিথ, বিদ্রোহী কবিতার বৈজ্ঞানিক তথ্য, বিদ্রোহী কবিতায়  ইসলামী বিশ্বাস  প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। 

আমাদের বাংলা সাহিত্যে নজরুলের এ কবিতার ওপর এমন গবেষণামূলক গ্রন্থ কেউ লিখেন নি। এ বইটি প্রায় তিনশত পৃষ্ঠার।

৪. বাংলা রিভিউ  : সম্প্রতি প্রকাশিত আপনার নতুন বই সম্পর্কে বলুন।

হাসান আলীম: ২০২৩ এর বই মেলা উপলক্ষে আমার চারটি বই প্রকাশ হয়েছে। এর মধ্যে দুটি কবিতার বই, একটি গীতিকবিতা/গানের বই এবং একটি ছড়ার বই। 

বই গুলো হলো  ১. ‘ছু মন্ত্র সরল অঙ্ক ‘,২.ফানাফিল্লা ৩. গীতি নির্ঝর ও ৪.  নতুন ছন্দের ছড়া। 

১.

‘ছু মন্ত্র সরল অঙ্ক ‘ –, কাব্য গ্রন্থটি অগ্রসর কবিতা প্রেমীদের জন্য। এটি একটি পরীক্ষা মূলক কবিতার বই। বিভিন্ন তত্ত্ব মূলক কবিতা রয়েছে এ গ্রহ্নের ৬৪ পৃষ্ঠায়। মোট ৫৬ টি কবিতার মধ্যে ১৩ টি কবিতা রয়েছে মোজেজা এবং জাদু বাস্তবতা মূলক। এ কবিতা গুলো গদ্য ফর্মের কবিতা। ৯ টি কবিতা বিশুদ্ধ গনিত,  ক্যালকুলাস ও জ্যামিতিক তত্ত্ব মূলক। এরপরের ১০ টি রসায়ন, জীববিজ্ঞান এবং ঔষধ বিজ্ঞান বিষয়ক কবিতা। এরপরের ৫ টি বিমূর্ত ভাবের কবিতা। এরপরের ১১ টি ডাডাবাদ এবং বিশৃঙ্খলবাদ বা এন্ট্রপি বিষয়ক কবিতা। তারপরের বাকি কবিতাগুলো অধ্যাত্মবাদ ও ভাববাদী চেতনার কবিতা। এই ৫৬ টি কবিতার মধ্যে মাত্র দুটি ছন্দ বদ্ধ –যার একটি মাত্রা বৃত্ত ছন্দের এবং একটি অমিল মুক্তক অক্ষর বৃত্ত ছন্দের, আর বাকিগুলো গদ্য ফর্মের কবিতা। 

এ বইয়ের কবিতাগুলোর প্রত্যেকটির চিত্রকল্প বিষয়ের সাথে সাজুয্যময় এবং নতুনকাব্যভাষার। 

 অধিকাংশের অলংকার অর্থালংকার এবং কিছুটা জটিল। 

তবে প্রায় প্রতিটি কবিতার মূলসূর এর সারবস্তু অস্তিত্ববাদের সাথে বিশ্বাসের জারক রসে নিষিক্ত। 

আমার এ গ্রন্থের কবিতাগুলো বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন চিন্তার ও তত্ত্বের পরিচয় বহন করবে। 

২. ‘ফানাফিল্লা’ –,কাব্য গ্রন্থটি দ্বিপদী পঙক্তির অধ্যাত্মবাদের এবং ভাববাদের কবিতায় ভরপুর। এ কাব্য দুই লাইনের ২০২ টি কবিতা রয়েছে। 

বিষয়বস্তু হিসেবে কবিতাগুলোকে সাত শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। 

ক. স্রষ্টা তত্ত্বমূলক কবিতা রয়েছে ৫৭ টি। 

খ.নবি তত্ত্বমূলক কবিতা রয়েছে ১০ টি। 

গ.রূপ তত্ত্বমূলক কবিতা রয়েছে ২১টি।

ঘ.সৃষ্টি তত্ত্বমূলক কবিতা রয়েছে ২৬ টি।

ঙ.দেহ তত্ত্বমূলক কবিতা রয়েছে ৫১ টি।

চ.কর্ম তত্ত্বমূলক কবিতা রয়েছে ১০ টি। 

ছ. প্রেম তত্ত্বমূলক কবিতা রয়েছে ২৭ টি।

 এ কবিতা গুলো আধ্যাত্মিক রসে ভরপুর। এর প্রতিটি কবিতা ছন্দ বদ্ধ। অক্ষর বৃত্ত, মাত্রা বৃত্ত ও স্বরবৃত্ত ছন্দে কবিতাগুলো কাব্যভাষা ও ভাব অনুযায়ী সৃষ্টি করা হয়েছে। 

এ কবিতা গুলো আমাদের কাব্য সাহিত্যে একটি ঐতিহ্যের এবং ভাববাদী চেতনার অস্তিত্ববাদে উচ্চকিত। এর রস ও চিত্রকল্প একটা চৌম্বকত্ব সৃষ্টি করবে পাঠক হৃদয়ে। 

৩. ‘গীতি নির্ঝর’ — আমার প্রথম গানের বই। এ গ্রন্থ ১৩ রকমের  প্রায় ১২৫ টি গান রয়েছে। গানগুলো অক্ষর বৃত্ত, মাত্রা বৃত্ত এবং স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা হয়েছে। গান রচনার ফর্মেট অনুযায়ী অর্থাৎ আস্হায়ী,অন্তরা,সঞ্চারী ও আভোগ এই চারটি স্তবকে বিভক্ত করে যথাযথ ভাবে সৃজিত হয়েছে। 

গানের ভাষা আলাদা-সমসায়িক বিষয়বস্তু ও চিরন্তন বিষয়াবলি রইলেও এর ভাষা আমার নিজস্ব এবং আকর্ষণীয়। 

হামদ,নাত,ভাব সংগীত, ভক্তি গীতি,বিচ্ছেদ সংগীত, আনন্দ সংগীত, প্রেম সংগীত, প্রকৃতি সংগীত, দেশ সংগীত, ফুল কলিদের গান,জাগরণী গান ও নিবেদন মূলক গান রয়েছে এ গ্রহ্নে। 

৪. ‘নতুন ছন্দের ছড়া ‘ এটি আমার সপ্তম ছড়ার বই। আমার প্রথম ছড়ার বই বের হয়েছিল ২০০৪ সালে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে। 

আমার এ বইয়ের ১৬ টি ছড়া-কবিতা স্বরবৃত্ত ছন্দের ১৬ রকম বিন্যাসে ফর্মুলাসহ প্রকাশিত হয়েছে। আমি মনে করি এ রকম পরিকল্পিত এবং স্বরবৃত্ত ছন্দের বিচিত্র বিন্যাসে আর কেউ এক বইয়ে প্রকাশ করেন নি। আমি মনে করি এগুলো আমাদের ছড়া কবিতার ভুবনে নতুন চেষ্টা। 

আমি অবশ্য ২৫৬ রকম নতুন ছন্দের ফর্মূলা দিয়েছি আমার ‘ছন্দ বিজ্ঞান ও অলংকার ‘ গবেষণা গ্রন্থে। 

৫. বাংলা রিভিউ : আপনি নিজেকে কোন দশকের কবি-লেখক বলেন? কেন?

হাসান আলীম: আমি নির্দিষ্ট কোন দশক বদ্ধ করে কবিদের শৃঙ্খলিত করতে চাই না, তবে কবিদের উত্থান পর্বকে চিহ্নিত করতে দশক উল্লেখ করা যায়। কবিরা সর্বকালীন এবং সার্বজনীন। কবিরা নিজের উত্থান পর্বকে অতিক্রম করে সার্বজনীনতা এবং সর্বকালীনতা অর্জন করে। এ হিসেবে আমার বেড়ে ওঠা এবং চিহ্নিত হওয়ার কাল গত আট দশক বা প্রচলিত আশির দশক। 

৬. বাংলা রিভিউ : আপনার সমকাল সম্পর্কে বলুন। 

হাসান আলীম: আমার সমকাল বাংলা কবিতার  একটি টার্নিং পয়েন্ট। অর্থাৎ গত শতকের আশির দশকের প্রায় আশি জন কবি সরবে কাব্য চর্চা করেছেন। এদের মধ্যে রয়েছে একদল শক্তিশালী  ঐতিহ্যবাদী, মূলধারা নিসৃত উত্তর আধুনিক কবি ও চিন্তুক এবং অন্যটি বাম ঘরণার /পাশ্চাত্য-আধুনিক কবিবৃন্দ। 

এখন সরব রয়েছেন প্রায় দশ/বারো জনের মতো।  এদের মধ্যে অবশ্যই ঐতিহ্যবাদী, উত্তর আধুনিক বিশ্বাসী কবিবৃন্দ শক্তিশালী। 

আশির দশকের কবিদের ওপর প্রবন্ধ লিখেছেন,গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং সম্পাদনা করেছেন যথাক্রমে, কবি আল মাহমুদ, নজরুল গবেষক শাহাবুদ্দীন আহমদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, হাসান আলীম, মজিদ মাহমুদ, শরীফ শাহরিয়ার, আসাদ বিন হাফিজ, আবদুল হাই শিকদার,অধ্যাপক মতিউর রহমান প্রমুখ। শাহাবুদ্দীন আহমদ ‘চতুর্দশ শতাব্দীর বাংলা কবিতা’ গ্রন্থ আশির দশকের ওপর প্রবন্ধ লেখেন। খোন্দকার আশরাফ হোসেন সম্পাদিত ‘একবিংশ ‘ সাহিত্য ম্যাগাজিনে সৈয়দ তারিক সম্পাদিত একবিংশ ক্রোড়পত্র ‘অনিরুদ্ধ আশি : একদশকের কবিতা ‘ অংশে আশির একাংশের কবিদের কবিতা ও পরিচিত ছাপা হয়। আবদুল মান্নান সৈয়দ আশির দশকের কবি রিফাত চৌধুরী ,মোশাররফ হোসেন খান এবং হাসান আলীমের কবিতার ওপর আলাদা প্রবন্ধ লেখেন।

আমি আশির দশকের এগারো জন কবিদের ওপর একটি গ্রন্থ লিখি ‘আশির দশক জ্যোতি জোছনার কবি কণ্ঠ ‘ এটি প্রকাশ পায় জুলাই -২০০৩.. সালে।

মজিদ মাহমুদ লেখেন ‘আশির কবি ও কবিতা‘।

অধ্যাপক মতিউর রহমান লেখেন একটি অনবদ্য গ্রন্থ ‘ আশির দশকের কবি ও কবিতা’(২০২৩)।

আমার সম্পাদনায় আশির দশকের ৫৭ জন কবির ১০টি করে মোট ৫৭০ টি  কবিতা ও লেখক পরিচিতি নিয়ে একটি চমৎকার গ্রন্থ বের হয় ‘ আশির দশক নির্বাচিত কবিতা ‘গ্রন্থ। এতে কভার প্রবন্ধ লেখেন কবি আল মাহমুদ, শিরোনাম ‘আশির কবিতা’.। ভূমিকা প্রবন্ধ লেখেন কবি ও সাহিত্য সমালোচক আবদুল মান্নান সৈয়দ। তিনি কয়েকটি উপশিরোনামে লেখেন ভূমিকা –‘কাব্যকথা কমল সুগন্ধি পরিপুর’,’সাহসের স্বরলিপি’ ‘,’বিশেষতা’, ও ‘পাণ্ডুলিপি-পাঠ’।

‘আশির দশকের কবি ও কবিতা ‘ শিরোনামে আশির দশকের ৯১ জন কবির ৫ টি করে কবিতা এবং পরিচিতি নিয়ে গ্রন্থ সম্পাদনা করেন শরীফ শাহরিয়ার। 

আশির দশকের কবিদের কারো কারো কবিতা  সম্পর্কে দেশের প্রখ্যাত কবি, সাহিত্য সমালোচক ও গবেষকগন সুচিন্তিত মতামত দিয়েছেন, এদের মধ্যে  আল মাহমুদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, শাহাবুদ্দীন আহমদ, আল মুজাহিদী,অধ্যাপক মতিউর রহমান,  ড. মাহবুব হাসান, অধ্যাপক ড. ফজলুল হক সৈকত, অধ্যাপক জসিমউদদীন, অধ্যাপক ড. ইয়াহিয়া মান্নান প্রমুখ প্রধান। 

আমি আশির কোন কোন কবি সম্পর্কে দারুণ আশাবাদী। আশির কবিরাই আমাদের বাংলা কবিতাকে ঐতিহ্যবাদী, বিশ্বাসী,  উত্তর আধুনিক ও উত্তর ঔপনিবেশিক  ধারায় প্রবাহিত করেছেন  এবং বিভিন্ন তত্ত্ব ও তথ্য মূলক পরীক্ষা নিরীক্ষাময় ব্যতিক্রমী চিন্তার কবিতা উপহার দিচ্ছেন।

৭. বাংলা রিভিউ : সাম্প্রতিক কালে কারা ভালো লিখছে বলে আপনি মনে করেন? 

হাসান আলীম:  সাম্প্রতিক সময়ে সত্তর, আশি, নব্বই, প্রথম দশক এবং দ্বিতীয় দশকের কবিরা কবিতা লিখছেন। 

এদের মধ্যে সত্তর দশকের, আশির দশকের কিছু কিছু কবি সচল রয়েছেন। 

অনেকে ভালো লিখছেন কিন্তু ব্যতিক্রমী চিন্তার কবিতা লিখছেন হাতে গুনা দু/এক জন।

আমার অগ্রজ কবিদের মধ্যে ব্যতিক্রমী ধারার কবিতা লিখছেন ড. মাহবুব হাসান। 

আশির কবিদের মধ্যে চার /পাঁচ জন বেশ ভালো লিখছেন কিন্তু ব্যতিক্রমী চিন্তার কবিতা দু/এক জন লিখছেন।

নব্বই দশকের কবিদের মধ্যে নয়ন আহমেদ, সায়ীদ আবু বকর, জাকির আবু জাফর, আবদুল বাতেন,মনসুর আজীজ,মহিবুর রহিম  সহ আরও কেউ কেউ। 

এরপর যে সব তরুণের কবিতা আমাকে আকর্ষণ করে তাদের মধ্যে আফসার নিজাম, হাসনাইন ইকবাল, মাহফুজা অনন্যা, কামরুন্নাহার রুনু, রাহমান মাজিদ, মাহবুবা করিম, তানিয়া হাসান,ফারুক মোহাম্মদ ওমর,  সহ আরও কেউ কেউ। 

ছোট গল্প ভালো লেখেন ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ, নাজিব ওয়াদুদ, মঈন শেখ, রফিক মুহাম্মদ লিটন সহ আরও কেউ কেউ। 

প্রবন্ধ ভালো লিখছেন ড. মাহবুব হাসান, অধ্যাপক জসিমউদদীন, মুজতাহিদ ফারুকী, সোলায়মান আহসান প্রমুখ। 

৮. বাংলা রিভিউ : কোথায় আছেন?  কি করছেন? পারিবারিক পরিচিতি জানতে চাই। 

হাসান আলীম: আমি ঢাকায় বসবাস করছি। আমার জন্মস্থান ফরিদপুর জেলা।  একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছি। আমি এপোলো ফার্মাসিউটিক্যালস ল্যাব.  লি. এ ঔষধ উতপাদন ও মান নিশ্চয়তায় কাজ করি। বর্তমানে কোয়ালিটি এস্যুরেন্স ম্যানেজার পদে এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।

আমার পিতা মরহুম আলহাজ্ব শাহ ইসরাইল মিয়া। তিনি পাকিস্তান আমলে ইউনিয়ন পরিষদের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। শেরে বাংলা প্রতিষ্ঠিত ঋণ শালিসি বোর্ড ফরিদপুর জেলার সভাপতি এবং জেলা জজকোর্টের জুরি বোর্ডের সদস্য ছিলেন। 

তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা শেষে নিজ এলাকায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্হাপন করেছেন এবং সমাজ সেবা করেছেন। 

আমার মাতা আলহাজ্ব রাহিলা বেগম। তিনি নিজ মহল্লায় সমাজ সেবা করেছেন। 

আমরা বর্তমানে পাঁচ ভাই ও দুই বোন। আমি সবার বড়ো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে বিএসসি অনার্স এবং এমএসসি ডিগ্রি লাভ করি ১৯৮৪ সালে।

মেজো ভাই শাহ আসাদ উল্লাহ এমএ দর্শন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সে জনতা ব্যাংকের সাবেক মহাপরিচালক। তৃতীয় ভাই হাফেজ মাওলানা শাহ হাবিব উল্লাহ্।সে একটি মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল। চতুর্থ ভাই শাহ সাইফ উল্লাহ, এমকম। সে একটি টিভির প্রোগ্রাম ডাইরেক্টর। পঞ্চম ভাই শাহ আবদুল্লাহ, এমকম। সে একটি প্রতিষ্ঠানের ডাইরেক্টর। 

আমার স্ত্রী ফাহমিদা আকন্দ এমএসএস,বিএড।

একপুত্র আমাদের হাসান আল জাবির। সে আর্কিটেক্ট। একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। 

দ্বিতীয় ভাইয়ের এক মেয়ে এক ছেলে। মেয়ে সিভিল ইনজিনিয়ার। ছেলে একটি ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ’র 

ছাত্র। তৃতীয় ভাইয়ের তিন ছেলে মেয়ে। মেয়ে ও বড় ছেলে ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করছে। ছোটো ছেলে স্কুলে পড়ে। 

চতুর্থ ভাইয়ের তিনছেলে মেয়ে। স্কুল কলেজে পড়ছে। ছোট ভাইয়ের একছেলে এক মেয়ে। স্কুল কলেজে তারা পড়াশোনা করে। 

বোনদের দুই ছেলে দুই মেয়ে। বড় ভাগিনা কম্পিউটার ইন্জিনিয়ার, আরেক ভাগিনা কম্পিউটার ইন্জিনিয়ারিং পড়ছে। বড় ভাগনি আর্কিটেক্ট। ছোট ভাগনি বিবিএ পড়ছে। 

ছোট বোন ফাহমিদা ইয়াসমিন আমেরিকা প্রবাসী। 

৯. বাংলা রিভিউ :  স্বাধীনতা পূর্ব ও স্বাধীনতা উত্তর বাংলা সাহিত্য কোন ধারায়?  কি ভাবে প্রবাহিত হয়েছে –হচ্ছে —বলে আপনি মনে করেন? 

হাসান আলীম: স্বাধীনতা পূর্ব আমাদের সাহিত্য মূলধারার বিশ্বাসী সাহিত্য, আধুনিক সাহিত্য এবং বাম ঘরনার সাহিত্য ধারায় প্রবাহিত ছিল। চল্লিশের ফররুখ আহমদ, সৈয়দ আলী আহসান, সৈয়দ আলী আশরাফ, পঞ্চাশ দশকের আল মাহমুদ( আশির দশকে বিশ্বাসী কবিতায় পাশ ফেরা),  ষাটের আবদুল মান্নান সৈয়দ(আশির দশকে বিশ্বাসী ধারায় প্রত্যাবর্তন), আফজাল চৌধুরী, আবদুস সাত্তার প্রমুখ বিশ্বাসী ধারায়  কবিতা লিখেছেন। 

তবে তিরিশ দশকের পঞ্চ কবি –জীবনানন্দ দাশ, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্নু দে দ্বারা সৃষ্ট  আধুনিক ধারার কবিতা বিপুল ভাবে প্রভাবিত করেছে এ সময়ের কবিদের। বিশেষ করে রবীন্দ্র নজরুল প্রভাব মুক্ত কাব্য রচনার ফর্ম এবং দর্শন স্বাধীনতা পূর্ব কবিদের বিপুল ভাবে প্রভাবিত করেছে। আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আল মুজাহিদী, প্রমুখ কবি বৃন্দ আধুনিক কবিতা এবং এদের কেউ কেউ কিছু কিছু  উত্তর আধুনিক এবং উত্তর ঔপনিবেশিক কবিতা লিখেছেন।  এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, চল্লিশ দশকে ফররুখ আহমদ রবীন্দ্র নজরুল প্রভাব মুক্ত হয়ে এবং তিরিশি কবিদের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব কাব্য ভাষায় এবং ছন্দ শাসনে একটি আদর্শবাদী, ঐতিহ্যবাদী স্মার্ট কবিতা সমুদ্র উপহার দিয়েছেন। এটি তার নিজস্ব অর্জন, যা তিনি পুথি সাহিত্যের আকর থেকে আহরণ করেছিলেন। 

আল মাহমুদ আধুনিকতাকে ধারণ করে ক্রমে ক্রমে ঐতিহ্যবাদী এবং মূলধারার বিশ্বাসী কবিতা লিখেছেন এবং উত্তর ঔপনিবেশিক, উত্তর আধুনিক কবিতা লিখেছেন। তার কাব্য ভাষা,  চিত্রকল্প, মিথ, নৃতত্ত্ব ছিলো এ মাটি মৃত্তিকা সন্নিহিত সম্পূর্ণ আলাদা মেজাজে উদ্ভাসিত। মৃত্তিকা সংলগ্ন ভূমিপুত্রের বিশ্বাস, আচার আচরণ তার কবিতায় সাবলীল ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, যা তিরিশি তত্ত্ব থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

স্বাধীনতা উত্তর বাংলা কবিতা মূলধারার দিকে ফিরে যায় নতুন অবয়বে, নতুন চিত্রকল্পে, নতুন ভাষায়। আশির একদল কবি কখনো একাকী, কখনো যূথবদ্ধ হয়ে একটি চেতনা, একটি বিশ্বাসকে রঙিন করে ফুল ফসলে ভরিয়ে তুলেছিল। তারা ফর্মে, ছন্দে রবীন্দ্র নজরুল প্রভাব মুক্ত হয়ে নতুন ভাবে, তত্ত্ব মূলক কিছু কবিতা সৃষ্টি করতে প্রয়াস পেয়েছে। তারাও উত্তর আধুনিক এবং উত্তর ঔপনিবেশিক কবিতা লিখেছেন কিন্তু তা অবশ্যই পূর্ববর্তীদের থেকে আলাদা। 

১০. বাংলা রিভিউ: আপনি কি কোন পত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিন অথবা সংকলন সম্পাদনা করেছেন?  বিস্তারিত বলুন।

হাসান আলীম: আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নে বিএসসি অনার্সের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তখন ‘স্বাক্ষর’ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেছিলাম। সেটা ১৯৮০, ১৯৮১ সনের কথা। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফএইচ হলের আবাসিক ছাত্র ছিলাম। হলে থেকেই এটি কয়েকটি সংখ্যা বের করেছি। এরপর মাসুদ মজুমদার এর প্রেরণায় ‘দীশা ‘নামিয় একটি লিটল ম্যাগাজিনের সাথে যুক্ত ছিলাম। পত্রিকাটি ঢাকার আজিমপুর থেকে বের হতো। ছাত্র জীবন শেষে আমি ঢাকায় একটি ঔষধ শিল্প প্রতিষ্ঠানে মান নিয়ন্ত্রণ বিভাগে অফিসার পদে চাকরি করতাম আর সাহিত্য আড্ডায় সাহিত্য চর্চা করতাম। এ সময়ে  কিছু কিছু লিটল ম্যাগাজিন এবং কিছু সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদনার সাথে জড়িত ছিলাম। নব্বই দশকে বুলবুল সাঈদীর সম্পাদনায় ‘আরাফাত ডাইজেস্ট ‘ বের হতো। আমি এর প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলাম প্রায় ছয়  সংখ্যার। 

নাট্যকার আরিফুল হকের পরিচালনায় ঢাকার সিদ্ধেশ্বরীতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘নাট্যমঞ্চ ‘। গাইড হাউস এবং মহিলা সমিতি মিলনায়তনে বিভিন্ন নাটক মঞ্চস্হ হতো। ‘নাট্যমঞ্চ’ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন বের হতো এই প্রতিষ্ঠান থেকে। আমি এই ‘নাট্যমঞ্চ ‘ পত্রিকার সম্পাদক ছিলাম। এটিও কয়েকটি সংখ্যা বের হয়ে বন্ধ হয়ে যায়। আরিফুল হক এবং মোহাম্মদ আব্দুল হান্নান এর যাবতীয় ব্যবস্থাপনায় জড়িত ছিলেন। আরিফুল হকের প্রেরণায় ‘ফুটলাইট’ নামে একটি ভাজপত্রও বের করি (২০০১-২০০৩)।

ষাটের দশকে প্রতিষ্ঠিত ‘স্বদেশ সংস্কৃতি ‘ সাহিত্য সংস্কৃতি সংগঠন সৃষ্টি হয়। এটি আবার সচল হয় মধ্য আশি ও নব্বই দশকে। এ সংগঠনের উদ্যগে ঢাকা শহরে বিভিন্ন সাহিত্য সভা অনুষ্ঠিত হতো। এর উদ্যোগে ‘স্বদেশ সংস্কৃতি ‘ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন বের হতো। এটিও আমি বেশ ক’ বছর সম্পাদনা করেছি। এটি ছিলো উত্তর আধুনিক এবং উত্তর ঔপনিবেশিক তত্ত্বের সাহিত্য ম্যাগাজিন।

‘অনুপম’ নামে একটি কবিতার মাসিক  ভাজপত্র সম্পাদনা করি (২০০১-২০০২) পর্যন্ত কয়েক সংখ্যা। 

আমি বর্তমানে ‘নজরুল একাডেমি পত্রিকা’ (২০২৩ –..)  এবং ‘ফররুখ একাডেমি জার্নাল’ (২০২৩–….)  সম্পাদনা করছি। ‘অহনা’ শিল্প সাহিত্যের লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনার উপদেষ্টা হিসেবে যুক্ত রয়েছি।

১১. বাংলা রিভিউ :  লিটল ম্যাগাজিনের এর সংজ্ঞা কি? এ নিয়ে আপনার ভাবনা বলুন। 

হাসান আলীম: লিটল ম্যাগাজিন একটি ব্যতিক্রমী কবিতা চিন্তা ও সাহিত্য চিন্তার কাগজ। এটি প্রচলিত সাহিত্য চর্চার সমালোচনা করে এবং নতুন দীশা দান করে। তবে এর হায়াত সুদীর্ঘ নয়। ধূমকেতুর মতো এর আলোর ঝলকানি। চিন্তাশীলদের ঝাঁকি দিয়ে যায়। 

পাশ্চাত্যে লিটল ম্যাগাজিন ধারণাটি দানা বাঁধে।

আমেরিকা বিপ্লবের সময় প্যাম্ফলেট হিসেবে যা জনগনের মধ্যে বিতরণ হয়েছিল তাকে কেউ কেউ লিটল ম্যাগাজিন বলতে প্রয়াস পেয়েছে। 

বস্টনে ১৮৪০ থেকে ১৮৪৪ পর্যন্ত এটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। 

বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘বঙ্গদর্শন ‘ (১৮৭০)নামে যে সাহিত্য কাগজটি সম্পাদনা করেন, তাকে অনেকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম লিটল ম্যাগাজিন বলে থাকেন।

তবে প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজ পত্র'(১৯১৪) কে বোদ্ধা সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরা মননশীল এবং যথার্থ লিটল ম্যাগাজিন বলে স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন।

১৯২৩ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত ‘কল্লোল ‘, ‘সওগাত’,  ‘শিখা’,’কালি ও কলম’, ‘প্রগতি ‘, ‘পরিচয়’, ‘পূর্বাশা’,’কবিতা ‘,’ চতুরঙ্গ ‘, প্রভৃতি লিটল ম্যাগাজিন নতুন চিন্তা ও লেখার দরোজা খুলে দিয়েছে।  

ঢাকা থেকে ১৯২৭ সালে বুদ্ধদেব বসু  ও অজিত দত্ত  

সম্পাদিত ‘প্রগতি’ লিটল ম্যাগাজিন তরুণ লেখক ও বুদ্ধিবাদীদের মধ্যে আলোচনায় আসে।

১৯৪৭ সালে চট্টগ্রাম থেকে মাহবুব আলম চৌধুরী ও

সুচরিতা চৌধুরী সম্পাদিত ‘সীমান্ত ‘ লিটল ম্যাগাজিনটিও আলোচনার টেবিলে উষ্ণতা ছড়ায়।

অপরদিকে ঢাকা থেকে কবি  ফজল শাহাবুদ্দীন সম্পাদিত ‘কবি কণ্ঠ ‘ সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী মহলে ব্যাপক সাড়া জাগায়। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন ও শহীদ দিবস আমাদের ঢাকা শহর সহ সারা দেশের বড় বড় শহর গুলোতে বিপুল পরিমান নতুন নতুন লিটল ম্যাগাজিনের উন্মেষ ঘটে। এদের মধ্যে ‘সপ্তক’, ‘বক্তব্য ‘, ‘স্বাক্ষর ‘, ‘স্যাড জেনারেশন ‘, ‘সাম্প্রতিক ‘, ‘কালবেলা ‘, ‘কণ্ঠস্বর’, ‘ছোটগল্প ‘,’না’,

‘বহুবচন’, ‘স্বদেশ ‘ ‘শিল্প তরু ‘ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। 

তিতাশ চৌধুরীর ‘অলক্ত’, আবিদ আজাদের ‘কবি’,আবুল কাশেম ফজলুল হকের ‘লোকায়ত’, তপন বড়ুয়ার ‘গাণ্ডীব ‘, খোন্দকার আশরাফ হোসেনের ‘একবিংশ ‘, বদরুদ্দীন উমরের ‘সংস্কৃতি ‘

মোহাম্মদ শাকের উল্লার ‘ঊষালোক’, লিটল ম্যাগাজিন আমাদের সাহিত্যে নতুন খোরাক যুগিয়েছে এক সময়। আমার সম্পাদনায় ‘স্বদেশ সংস্কৃতি ‘, ও ‘নাট্যমঞ্চ’ নব্বই দশকে বের হয়েছে। 

নব্বই দশকে বগুড়া থেকে সাজ্জাদ বিপ্লবের সম্পাদনায় বের হতো ‘স্বল্পদৈর্ঘ্য ‘। 

এখন ঢাকা থেকে আল মুজাহিদীর সম্পাদনায় বের হচ্ছে ‘নতুন এক মাত্রা ‘।  নতুন চিন্তা ও অগ্রসর পাঠকদের জন্য ড.  মাহবুব হাসানের সম্পাদনায় উত্তর আধুনিক ও উত্তর ঔপনিবেশিক শিল্প সাহিত্যের কাগজ ‘অনন্য ‘ বের হয়েছে সূচনা সংখ্যা। 

অনেক সমৃদ্ধ লেখা রয়েছে এ লিটল ম্যাগাজিনের পাতায় পাতায়। 

কবি মনসুর আজিজের সম্পাদনায় বের হচ্ছে 

‘আড্ডাপত্র’। চমৎকার এ লিটল ম্যাগাজিন লেখকদের কাছে বেশ কদর পেয়েছে। 

তরুণ কবি রাহমান মাজিদের সম্পাদনায় বের হয়েছে চমৎকার এবং চিন্তাশীল লেখকদের সাহিত্যের কাগজ ‘অহনা’।

১২. বাংলা রিভিউ  : অনলাইন ম্যাগাজিন বা ওয়েব ম্যাগাজিন চর্চাকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন? 

হাসান আলীম: অনলাইন ম্যগাজিনে বা ওয়েব ম্যাগাজিনে সাহিত্য চর্চা  ইলেকট্রনিক মাধ্যমকে ব্যবহার করা হয়। প্রিন্টিং মিডিয়ায় কাগজকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এ দু’মাধ্যমের মধ্যে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সাহিত্যের প্রচার বেশি এবং দ্রুত সময়ে হয়ে থাকে। এ মিডিয়ায় অল্প সময়ে পৃথিবী জুড়ে প্রচুর সংখ্যক পাঠক এটি পড়তে পারে। এর মাধ্যমে ব্যপক প্রচার হয়। তবে এটি বেশি ক্ষণ স্হায়ী হয়না এবং সংরক্ষণ না করলে বারবার পড়াও যায়না।  সাহিত্য আসলে তাত্ক্ষণিক কোন বিষয় নয় এটা ধীরে ধীরে সঞ্চালিত হয় এবং বোধের জগতে স্হায়ী হতে থাকে। কিন্তু ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তার তেমন সুযোগ থাকেনা।

তবে আমি এ মিডিয়াকে স্বাগত জানাই। আমিও অনলাইনে বিশেষ করে ফেসবুকে লেখা লেখি করি। ইউটিউবে আমার অনেক সাক্ষাৎকার ও সাহিত্য বিষয়ক বক্তব্য রয়েছে। পাঠকেরা এখান থেকে আমার সাহিত্য সম্পর্কে অনেক কিছু অল্প সময়ে জানতে পারে। গুগলে গেলে আমার সম্পর্কে, আমার সাহিত্য সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারে আগ্রহী পাঠকেরা। 

আমি এ মিডিয়াকে ব্যবহার করা ভালো মনে করি কারণ এতে সহজেই অল্প সময়ে পৃথিবী জুড়ে সকলের কাছে পৌঁছে যাওয়া যায়। 

১৩. বাংলা রিভিউ :  আগামী দিনের সাহিত্য কেমন হবে?  আপনার কল্পনায়। 

হাসান আলীম: আগামী দিনের সাহিত্য আরও স্মার্ট,  তথ্য,বিজ্ঞান  ও প্রযুক্তিনির্ভর হবে। তবে সাহিত্যের মূল বিষয় থাকবে সত্যের অন্বেষণ ও সুন্দরের আবাহন।

পরম সত্য, পরাবাস্তবকে বাস্তবে অনুধাবন করার পরম আকুতি থাকবে সাহিত্যের প্রাণ কেন্দ্রে। 

মানুষের মনে স্থিতি যেমন থাকবে তেমন থাকবে না পাওয়ার অস্থিরতা। 

না পাওয়ার বেদনা এবং অস্থিরতাই মানুষকে গতিশীল এবং আরও মানবিক করে তুলবে। আমি সাহিত্যের নতুন দিগন্ত উন্মোচনের আনন্দময়তায় উদ্বেলিত।

গ্রহণে : সাজ্জাদ বিপ্লব

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

পথিক মোস্তফা on সাক্ষাৎকার : নয়ন আহমেদ
সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা