মাহবুব হাসান
……
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য যে কয়েকজন প্রবাসী আছেন, কবি মাহবুব হাসান (Mahboob Hasan) তাদের মধ্যে অন্যতম একজন প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ ।
তিনি একাধারে কবি-আলোচক-প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
কবি মাহবুব হাসান আমাদের কালের সেই বিরলদের একজন, যিনি প্রতিনিয়ত রূপান্তরিত, নবায়িত করে যাচ্ছেন, নিজের কবিতা এবং নিজেকে। সমৃদ্ধ করে যাচ্ছেন বাংলা কবিতার অমূল্য ভাণ্ডার।
তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন, বেশ কয়েক বছর যাবত। প্রবাসের ব্যস্ততা ও প্রতিকূলতা রুখতে পারেনি তার সৃষ্টিশীলতা। এটি আশার কথা।
প্রচারের ডামাডোলে না থেকেও যে অপূর্ব সৃষ্টিশীল ও গতিশীল থাকা যায়, তিনি তার উজ্জ্বল উদাহরণ।
চলুন, পড়া যাক তার সাম্প্রতিক কিছু কবিতা:
বৃষ্টিতে যমদূত
কাল সকালে বৃষ্টি আনলাম আঙুলে। ভিজতে দিলাম পৃথিবী-প্রকৃতি বেদনা আর কষ্টের হাঁসফাঁস।
সেই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে যমদূত এসে দাঁড়ালো আমাদের পরবাসী বোধের দরোজায়।
আমি তাকে বললাম তোমার চেহারা যেন কোথায় দেখেছি!
সে হেসে বললো আজরাইল।
গতকাল তার মেহমান হয়েছিলাম। সে আমাকে ঘাম দিয়ে শাদাভাত আর শাহাদাতের বানী মিশিয়ে
খেতে দিয়ে মহাকাশে ত্রিশঙ্কু হয়ে গেলো।
আমি জলের জন্য আকাশ চাইলাম,
সে আমাকে আকাশের বজ্র-বিদ্যুতের নহরে ছেড়ে দিয়ে উধাও!
আমি বলি এই গল্পটিকে আমের আচারে কয়েক কোটি বছর ভিজিয়ে রাখো।
সে বললো আমি জল খেতে এসেছি।
আমার গলায় আটকে আছে গোটা পৃথিবী। আমি শ্বাস নিতে পারছি না।
আমি মরে যাবো। আমাকে বাঁচাও, জল দাও।জল দাও।
আমি হেসে উঠি আকাশ যেমন বজ্র-বিদ্যুতে হেসে ওঠে।
মৃত্যু এখন মরণ যন্ত্রণায়, আর আমি জ্যাকসন হাইটসের দিকে যাবো সাবওয়ের অন্তরে উঁকি দিতে।
আমার জন্য জ্যামাইকা অপেক্ষা করছে প্রেমিকার উৎকণ্ঠাকে গলার হার বানিয়ে।
সে বললো, আমি যমদূত, আমাকে এড়াতে পারো না।
আমি বললাম সে তো হিন্দুদের জন্য। আমি তো মুসলমান। আর থাকি খ্রিস্টান পৃথিবীর অন্তরের রাজধানীতে,
তুমি অন্য পথ দেখো।
সে নাছোড় ভীষণ যেন সে বিভীষণ এক আগলে দাঁড়িয়েছে আমার পথ।
আমি তাকে একপাত্র পানি দিলাম।
সে বললো পানি না, জল।
আমি খলবল করে উঠলাম, তুমি শালা মওতের চাকর হয়েছো,
জল আর পানির পার্থক্য বোঝো না।
পথ ছাড়ো। নাহলে কপ কল করবো ৯১১-এ ডায়াল করে।
শুনেই তার পিলে চমকে গেলো।
যমদূত পানি খেলো জলের সুষমা নিয়ে এবং মুহুর্তে উধাও।
আমি হাঁটতে হাঁটতে জুকারকে বললাম এই কবিতাটিকে অভ্রতে কম্পোজ করে
পোস্ট করে দিতে। সে আমার মেমরির ভাজি খেতে খেতে উত্তর দিলো
ইয়েস।
১১/০১/১৬ জ্যাকসন হাইটস, নিউ ইয়র্ক
২.
আমাদের মনে
আমার মনের ভেতরে কে যে ঢুকিয়ে দিলো
একটি হৃদয় আর একটি মারণাস্ত্র
পাশাপাশি তারা লুকিয়ে আছে সবুজের গহণে ক্যামোফ্লাজ করে ;
তারা দোসর বটে কিন্তু নয় সোদরও
এবং নিরাপদও নয়। আপদ….
একটি তাক করেছে মানুষ আর অন্যটি মানচিত্র।
কে যে কাকে ছিন্ন-ভিন্ন করবে? কে জানে?
সেই রহস্যের সুতো কার হাতে?
প্রভাতে এই নিয়ে তর্ক হলো খুব,
দুপুরে উল্টে গেলো ভাতের থালা, কান ঝালাপালা…..
আর রাতে মুখচ্ছদ সুগম্ভীর মগডালে।
কারো হালেই পানি নেই, কেবল রক্ত!
১০/০৫/১৬
জ্যাকসন হাইটস, নিউ ইয়র্ক
৩.
এ বছর বন্যা হবে
এ বছর বন্যা হবে ভরা গাঙে দক্ষিণা বাতাস
করেছে এমন বাণী চিরচেনা প্রাকৃত সে খনা
জীবন সংগ্রামী নারী, কবি সে যে, ভাবুকের হাঁস
জানি না সে কোনোদিন হবে কি না আমার সুমনা!
সনেট রূপকে ঢাকি বেতরাঙা নারীর সুবাস
রাত-ভর হাড়-ভাঙা শ্রমে বুনি ধানের মহিমা
আমার হৃদয় বোনো পলিময় রূপের আকাশ
শস্যে ভরে যাক গোলা, গর্ভিণীর পেটের প্রতিমা!
চৈত্রে গেছে শীত আর ঘন-কুয়া ভাদরের বান
সংকটে পড়েছে আজ জনগণ মায়ের সন্তান
বুধ-শুক্র জানে না এ, এই সত্য শোনে না যে কান
পতন হবেই তার, এই সত্য বলছে হাসান।
প্রকৃতির কন্যা তুমি ক্ষণজন্মা বাঙালি-বধুয়া
তোমার বচন সুরে কেটে যাক দুর্ভিক্ষের কুয়া!
০৬/২৪/৯৭
…….
ছন্দে দক্ষ এই কবি’র কাছে ছন্দবিহীন এ কালে আরো ছন্দবন্ধ কবিতা কামনা কি অন্যায় হবে?
আরো লিখুন না কেন, মনোমুগ্ধকর চতুর্দশপদী বা বিচিত্র মাত্রার ও স্বাদের সব সনেট, হে কবি?
……
মাসুদ খান
…..
আমরা যখন সাহিত্যে প্রবেশ করছি, তখন-ই দেখি কবি মাসুদ খান (Masud Khan) আলোচিত। এক ভিন্ন ধারার ভিন্ন স্বরের ও সুরের কবিতা লিখছেন, দেশের বিভিন্ন লিটলম্যাগাজিনে।
আর কে না জানে, লিটলম্যাগাজিন মানেই এক স্বতন্ত্র ও অগ্রসর জগত। সেই অগ্রসর জগতের এক প্রাগ্রসর বাসিন্দা হলেন কবি মাসুদ খান। তার সমকালে, অন্যান্যদের মধ্যে যাদের নাম মনে পড়ছে, এরা হলেন : সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ (প্রমিথিউস বাউন্ড), কাজল শাহনেওয়াজ, রিফাত চৌধুরী, অসীম কুমার দাশ, বিষ্ণু বিশ্বাস, সরকার মাসুদ, বদরুল হায়দার, সৈয়দ তারিক প্রমুখ।
এরপর অনেক দিকে অনেক জল গড়িয়েছে। অনেক নতুন বৃক্ষ মেলেছে ডানা। এগিয়েছে, সময়, প্রকৃতি, সমাজ। কবি মাসুদ খানও এগিয়েছেন। ইতিমধ্যে তার বেশ কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে কবিতা ও গদ্যের। গদ্য রচনাতেও তার নিজস্বতা স্বাক্ষরিত। কবি মাসুদ খান-এর গদ্য পড়লেও কবিতার স্বাদ পাওয়া যায়।
তিনি দেশান্তরী হয়েছেন। শিকড় গেঁড়েছেন বরফ শীতল দেশ ‘কানাডা’য়। যেখানে নেই কোন “কুড়িগ্রাম”! কিন্তু, তাতে কি? মাসুদ খান এখনো মাসুদ খান-ই আছেন। এখনো সমানতালে, সমান অনুধ্যানে বয়ন করে যাচ্ছেন তার নিজের কবিতা। নিজস্ব আঙ্গিকে।
……
কবি মাসুদ খান এর সাম্প্রতিক কবিতা:
……
দুপুরের এক শূন্য বন্দর
বন্দরের অনেক ওপরে
প্লুতস্বরে
দুপুরবিলাসী এক সুতাকাটা ঘুড়ি
চি… …চি… … ডেকে ডেকে কক্ষপথে ঘোরে
জেটিতে দাঁড়ানো এক বিপুলা জিরাফ, তাকেই কেন্দ্র ক’রে।
অন্যদিকে গাঙচিলের কক্ষপথ স্পাইরাল।
গাঙচিল
ওই ঘুরে
ঘুরে নিচে
নামছে
এক পাক
নামছে,
অমনি পালকে তার
মৃদু জং
ধরছে–
আর পাক
নামছে,
চকচকে
পালকেই
আরো জং
ধরছে।
ডানা থেকে
ঝুরঝুর
জং ঝরে পড়ে
ঘুমঘুম
লালজামা
কুলির ওপরে।
ঘুমঘোরে
কুলি ভাবে,
লাল খুদ ঝরছে
ধুত্তোরি,
মহাকাশ
থেকে খালি
রেশন ছিটাচ্ছে।
যেইভাবে
আজ দূরে দূরে
ওরসের
দিনে ঝরে
লাল চা’ল
পিরের ওপরে।
২.
ছায়াছবি
ধোঁয়া ও মাখনে মাখামাখি ছিল সারাটা আকাশ।
জমকালো কারুকাজ।
সেই কারু ভেদ করে একদিন একটি পাখি
পথ ভুলে আচম্বিতে উঠে গিয়েছিল মেঘরাজ্যের ওপরে।
উঠে দ্যাখে, অবাক-করা সব কাণ্ড–
একপাশে ধাঁ-ধাঁ করে ধেয়ে চলছে শতশত আর্জি ও মোনাজাত
অন্যপাশে হন্যে হয়ে ছুটছে বহু বার্তা ও সংকেত, ভিনগ্রহের দিকে।
আর, সবই এই পৃথিবী থেকে প্রেরিত।
আবার উল্টাদিকে, সাততলা আসমান থেকে প্রতিহত হয়ে
হাহাকার করতে করতে ফিরে আসছে অনেক অপূর্ণ আর্জি ও বাসনা।
এতে হুটপাট হচ্ছে, ঠেলাঠেলি ও ঠোকাঠুকি হচ্ছে।
অপরূপ ছায়াছবি যেন এক তীর্থযাত্রার।
ভিড়ের মধ্যে দিশা হারিয়ে কাঁদছে অনেকে–
কেউ হাউমাউ, কেউ-বা ইনিয়ে বিনিয়ে।
ছোট-ছোট ফরিয়াদগুলি কেবলই খ্যান-খ্যান করছে।
কোথাও কোনো গ্রহে কাউকে না পেয়ে মনের দুঃখে
ফিসফাস করতে করতে ফিরছে কিছু বার্তা ও সংকেত।
তেলের-শিশি-ভেঙে-ফেলা বিষণ্ণ হাটুরের যেমন ভাবতে ইচ্ছা করে–
আজ হাটে সব্বারই শিশি গেছে ভেঙে একযোগে। কিংবা,
ছাতা-হারানো জব্দ মানুষ যেমন
দুঃখিত বিড়ালের মতো হাট থেকে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবে–
হারিয়ে যাক তবে আজ সব ছাতা যত ছাতিয়ালের।
ব্যর্থ হয়ে যাওয়া বার্তা ও সংকেতগুলি হয়তো ওরকমই কিছু
ভাবতে ভাবতে ফিরে আসছে পৃথিবীতে…
৩.
গূঢ়লেখ
বেশ স্পষ্ট, প্রতিটি লক্ষণ।
আধাভেদ্য ঝিল্লির ভেতর দিয়ে অতি ধীরে লোনা তরলের পারাপার,
তিক্ততায় ভরে যায় ঝিল্লিসীমা এপার-ওপার।
ধুম-অগ্রগতি।
উন্নয়ন-বাঁধানো সড়কপথে যেতে হবে দূর থেকে বহুদূর পার
পথের দু-ধারে তার অন্তরাত্মা-ধাঁধিয়ে-দেওয়া বিপণিবাহার–
বাঁয়ে বডি শপ, স্বর্ণবিতান, স্পা, পণ্যাগার, বিলাস-সদন
ডানে মনোহারি, দেহসুষমার দোকান– স্তন-ও-বাঁক-উন্নয়ন…
স্তব্ধ হয়ে এলে বহুব্যঞ্জন, এবং বহুস্বর,
রাজ্য হয়ে ওঠে বৃন্দযৌনতার লীলাপরিসর
সে-রতি বহুপথিক, সে-গতি বহুধাগামী–
অবাধ, আন্তঃশ্রেণিক, সম ও বিষমকামী।
বাক্যে-বাক্যে প্রতীকের এতটা দুর্ব্যবহার! ফলাফল–
রুষ্ট হয়ে চলে যাচ্ছে শ্রাবকের দল।
শ্রাবকেরা ফিরবে না আর– সহজেই অনুমেয়
প্রতীকের অতিরেকে অতিষ্ঠ স্বয়ং প্রতীকেয়।
বক্তব্য অনেক হলো। হলো বহু ঝালাপালা কথার আরতি
এবার ভোক্তার দাবি– এ-কথারতির চাই স্পষ্ট পূর্ণযতি।
বক্তব্য আর না, ওরে বাচস্পতি, ওহে বাগীশ্বরী
দিশাহারা ভোক্তা চায় এবার ভোক্তব্য সরাসরি।
…..
এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছেন আমাদের কবি মাসুদ খান ও আমাদের বাংলা কবিতা।
…
আবু হাসান শাহরিয়ার
….
দুনিয়াজুড়ে স্বীকৃত বিকল্প মিডিয়া ফেসবুক-এ, এ মূহুর্তে বাংলাদেশের কবিদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে সরব ও সচল এবং প্রতিবাদমুখর, তিনি হলেন, কবি আবু হাসান শাহরিয়ার (Abu Hasan Shahriar)।
সামাজিক অন্যায়, সাহিত্যিক অবক্ষয় ইত্যাকার ঘটনা, মানবিকতা ও মানসিকতার পচন, বিকারে তার উঠান এক তীব্র তীর।
ভণ্ড ও কূপমণ্ডূকদের মুখোশ উন্মোচনে, তার ভাষায় : “পোকা নিধনে” তিনি নির্ভিক, আপোষহীন ও একগুয়ে। পাশাপাশি গুণী ও প্রতিভাবানদের কদরেও তিনি অকৃপণ, উদার।
কবি আবু হাসান শাহরিয়ার স্বনামেই পরিচিত। তার কবিতার ও গদ্যের খ্যাতি-কীর্তি নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। শুধু এটুকুই বলা যায়, তার সমকালীন অনেকে যেখানে, স্থবির, অচল ও একঘেয়েমিতে পরিপূর্ণ, সেখানে তিনি সচল ও অগ্রসর, তাদের চেয়ে অনেকগুণ ও অনেক দিকে।
দেখুন কীভাবে তিনি নবায়ন করে যাচ্ছেন, নিজেকে ও তার নিজের সমাজ।
কবি আবু হাসান শাহরিয়ার এর সাম্প্রতিক কবিতা :
চাপাতি নামাও
সুরধর্মে মুগ্ধ আমি; আমাকে মোহিত করে ফজরের আজানের জাদু। বেলালের চিঠি হাতে ভোর আসে কবেকার মরুদেশ থেকে। একই সুরধর্মে আমি মুগ্ধ হই উলুধ্বনি শুনে। ভাষার আদিতে ধ্বনি, আমার বসতি ধ্বনিমূলে। গির্জার ঘণ্টার ধ্বনি বিশদ পরানে তোলে ঢেউ। শ্রুতির কুশলমূলে বুদ্ধ দেন নির্বাণের পাঠ। চাপাতি নামাও, রাখো এ সংজ্ঞাবেদিতনিরোধ। সুরের পূজারী আমি, কার সাথে কীসের বিরোধ?
২৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৩
৮ জুন, ২০১৬
২.
বাঁচাও সুন্দরবন, বাঁচো
বাদাবনে ধর্ষক নেমেছে, তাই হরিণেরা ‘বরুণ বরুণ’ বলে ডাকে
ভাঙো ঘুম, জাগো ধীবরেরা
নদীরা মাতম করো জলের কোরাসে
ফুঁসে ওঠো সাগরের ঢেউ
কেওড়ার ফলাগুলো প্রতিবাদী বর্শা হয়ে নাচো
গরান গাছের ডালও ঢাল হও কঠিন শপথে
ফণা তোলো গোলপাতা; দুবেণী দুলিয়ে বলো, “রোকো”
অনাদি সুন্দরবনে কলের বিদ্যুৎ হতে দেব না, দেব না
এত যে বিদ্যুৎ মেঘে, তবু কেন বনগ্রাসী ক্ষুধা?
ধর্ষকামী সভ্যতা কি সবুজের পরিভাষা বোঝে?
রূপসী বাঙলার মুখ এসিডনিক্ষেপে হবে অরূপা-কুরূপা?
অনাদি সুন্দরবনে কলের বিদ্যুৎ হতে দেব না, দেব না
সুন্দর নিঃশব্দে কাঁদে, বাদাবনে ধর্ষকের হাঁক
কবিরা ভিখিরি; গেছে উলুবনে পদক কুড়াতে
খাগের কলমে তাই ফিরে আসি চর্যার কোবিদ–
অনাদি সুন্দরবনে কলের বিদ্যুৎ হতে দেব না, দেব না
বাঁচাও সুন্দরবন, বাঁচো
২৩ শ্রাবণ, ১৪২৩ বঙ্গাব্দ
৭ আগস্ট, ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দ
৩.
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ : ২০১৬
কোকিলের সুরাশ্রম অসুরের তাণ্ডবে বিরান
আকাশে-বাতাসে সপ্তসুরের মাতম
সুরেরা কান্নার পাখি– তারানা তেলেনা
ক্ষমা করবেন ওস্তাদ, আপনার প্রিয় জায়নামাজ আর চিঠিপত্রগুলো আমরা রক্ষা করতে পারিনি
পাখির পালকে লেখা চিঠিপত্রগুলো
চিঠির জমিনে থাকা হস্তলিপিগুলো
গালিচা কী জায়নামাজ– ছবি-ছবি উপস্থিতিগুলো
বর্বরের ক্ষোভের আগুনে পুড়ে ছাই
ক্ষমা করবেন ওস্তাদ, একদা বীরগাথা রচনা করলেও এখনও আমরা নিতান্তই দুগ্ধপোষ্য এক জাতি
কতকাল আগে এক গতকালে কে যেন, কী যেন
মরমি দরদ ঢেলে কে যেন, কী যেন
সুরে-সুরে দূরে-দূরে কে যেন, কী যেন
সরোদে ঝংকার তুলে বলে যায়– শোনো হে, মানুষ
সুরে না লাগিলে ঢেউ শ্রাবণেও মেঘেরা ডাকে না
জনপদে দলবেঁধে হায়েনারা নামে
মশালে জীবন জ্বালো, হায়েনা নেমেছে জনপদে
[কিছু দৃশ্য অকারণে প্রিয়]
…..
কবি’র সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ : ” কিছু দৃশ্য অকারণে প্রিয় “র বহুল প্রচার ও পাঠকপ্রিয়তা কামনা করছি।
…..
মনজু রহমান
….
সদ্য ৬০-এ পদার্পণ করেও তীব্র প্রেমের কবিতায় একজন কবি কতটা মগ্ন হতে পারেন, তার জ্বলন্ত উদাহরণ কবি মনজু রহমান (Manzu Rahman)।
কবি ও লিটলম্যাগাজিন “এলবাম” সম্পাদক মনজু রহমান এর কবিতায় প্রেম ও দ্রোহ মিলেমিশে থাকে।
প্রেম, মানুষের জীবনে নি:সন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য অনুষঙ্গ। প্রেম ও দয়া-মায়া আছে বলেই, প্রকৃতি এতো সুন্দর। জীবন এতো মায়াময়। পৃথিবী এতোটা বাসযোগ্য। কিন্তু প্রেম-ই কি সব বা একমাত্র অনুষঙ্গ? একমাত্র বিষয়?
এর উল্টা পীঠে যে কুৎসিত হিংসা, হানাহানী, হিংস্রতা, কদর্যতা, রাজনীতি ইত্যাদি হাজারো অনুষঙ্গ বিদ্যমান তা অন্যান্য মানুষের মতো একজন কবিকেও ছুঁয়ে যাবে বা যাওয়া উচিত নয় কি? কিন্তু কবি মনজু রহমান এর সাম্প্রতিক কবিতায় তার কোন ছোঁয়া বা ছায়া কেন নেই, আমি ভেবে পাচ্ছি না!
অথচ, আমরা জানি যে, তার সত্তায় মিশে আছে প্রেম ও দ্রোহ। তিনি যেমন তীব্র রোমান্টিক, তেমনি তিনি প্রচণ্ড প্রতিবাদীও। কিন্তু তার ইদানীংকালে রচিত কবিতায় এসবের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
কবি কি তবে এ গ্রহণকালে শুধু প্রেমের কবিতা লিখেই সন্তুষ্ট থাকতে চান? কেন?
কোন প্রশ্ন নয়। পাঠকের প্রশ্নের ব্যারিকেড একপাশে সরিয়ে রেখে, আসুন পাঠকরি, সাম্প্রতিককালে লেখা কবি মনজু রহমান এর কয়েকটি অনবদ্য প্রেমের কবিতা :
…..
চন্দ্রবিন্দু তোমাকে
ভাবলাম—-ওই হাত বৃষ্টির আবেগ
সোনালি রোদ্দুরে ডানাখোলা উড়াল স্বভাব
এই হাত তুলোরাশি—-
বীজভূমির উর্বর স্তনে উৎপন্নে বিভোর
ওই হাত প্রেমিকার—-সেবিকার
বীজঘ্রাণে খেলে তার স্বস্তির নব যৌবন
ভাবলাম—-ওই হাত নিশ্চিত ধরা যায়…নিশ্চিত
*০৫ নভেম্বর ২০১৬
২.
বৃষ্টিও চুম্বন দিতে জানে…
*
বৃষ্টিও চুম্বন দিতে জানে—
শিখে নাও বৃষ্টি কাছে, কিভাবে
শরীরে ফেলে শ্রাবনের আদুরে কণা
রক্তের দ্রোহে টানে দূরের মেঘদূত!
শিখে নাও—
দেবী মনসার কাছে
কিভাবে আলিঙ্গনে নত করে উদ্ধত ফনা;
প্রকৃতির কাছে শিখো দেবী—
নদী পাহাড় কিংবা সমুদ্র, বৃষ্টির পরশে
ভালোবাসা ধ্বনির স্রোতে
কিভাবে পৃথিবীর সকল প্রান্তে প্রান্তে ঘোরে।
শিখে নাও– বাবুই পাখির কাছে
প্রিয় বর্ষা কিংবা বসন্তে পত্রালির ফাঁকে
ঋতুময় করে
আর
পালকের নিচে ওমে ফোঁটায় সুপ্ত প্রেম
বৃষ্টিও চুম্বন দিতে জানে…
শিখে নাও—
মৃত্রিকা নদী ও ফলবতী বৃক্ষের কাছে…
ভীষণ কৃপণ তুমি—ছুঁয়েও ছুঁলে না
যেখানে বৃষ্টির
চুম্বনে আমাদের সুপ্ত প্রেম রোপিত আছ…
২২ সেপ্টেম্বর ২০১৬
৩.
তুমি…
খড়কুটোর মতো ধরেছি বলে; অন্ধকারে ঢেকে দাও আলো
প্রেম ও প্রণয়ের ত্রিকোণ মুখে ঢেলে দাও বিষের পেয়ালা
আর যাতনার ক্ষতে বাঁধাও অসুখ
তোমার চাবুক চোখ, যে আমার প্রেম; তাকে ফেলো প্রতিযোগিতায়;
ঠেলে দাও এমন ভূমে যেখানে শূন্যতা ছাড়া আর কিছু নেই
টান নেই; প্রেম-পদাবলি নেই, আরক্ত শিল্প নেই—
নেই বলেই এই বুক হাহাকার শূন্য খাঁচা;
কেন যে প্রতিরুদ্ধ হয়ে উঠো তুমি!
আর ডিজিটাল যুগে
ঘূণেধরা ডাকবাক্সে ফেলো সোনালি স্মৃতি!
কেন যে অবাঞ্চিত চুলে আমার স্বপ্ন মুড়ে ফেলে দাও
আকাশময় করো ঘনকালো মেঘ!
কেন যে কেটে দাও ঘুড়ির সুতো—
আমি ভাসতে ভাসতে খাঁদের কিনারে পড়ি!
তোমাকে জানার পর ভাবতাম—মরা নদী যেন
উঠলো জেগে; স্রোতের উন্মাদ চুলের
ভাঁজে ভাঁজে ডুবন্ত ঋষিকে তুলে নিলে উষ্ণ নৌকায়
ভাঙালে ঘুম…আর ঘুমসত্ত্বায়
বেঁধে নিলে তোমার ছড়ানো চুলের খাঁজে…
আহ্ সুখ!
যেন ভোঁ দৌঁড়ে তোমার মশৃণ নাভি ছুঁয়ে দিই!
যতোবার লিখি নীলখামে প্রণয়ের চিঠি
ঋতুমতী নদীকে ধরতে যাই; নদী ডানা মেলে উড়ে
আমাকে বাঁধলে অসম ত্রিভূজে—আর
রাধিকা তুমি যেন তুমিই রয়ে গেলে… !
২৪ অক্টোবর ২০১৬
….
মাঈন উদ্দিন জাহেদ
……
কয়জন কবি’র ভাগ্য হয় পবিত্র ভূমিতে দাঁড়িয়ে কবিতা রচনা করার? পরম প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে মুষ্টিমেয় যে কয়জন বা যারা সেই কাঙ্ক্ষিত ভূমিতে পৌঁছে প্রিয় পথ প্রদর্শকের উদ্দেশে সালাম ও দরুদ জানাতে পারেন বা পেরেছেন, সেই মহান সৌভাগ্যবানদের একজন, একালের, আমাদের কালের এক অনন্য ভাবুক, চিন্তক ও কবি মাঈন উদ্দিন জাহেদ (Mayeen Uddin Jahed) তাদের মধ্যে অন্যতম।
তিনি নিপুণ নিষ্ঠায় পালন করে যাচ্ছেন বিবেকের দায়িত্ব। তার কবিতায়। আলোচনায়।
এ সময়ের এক উজ্জ্বল ও শক্তিমান কবিস্বর কবি মাঈন উদ্দিন জাহেদ।
দেখুন, বর্তমান সময় ও সমকালের অসঙ্গতি কী দারুণ ব্যাঙ্গচিত্রে উঠে আসছে তার কবিতায়।
কবি মাঈন উদ্দিন জাহেদ এর কবিতা :
…..
জুতো জোড়া
…..
আজকাল চোরের উপদ্রব হয়েছে বেশ-
রাষ্ট্র থেকে জুতো জোড়া পর্যন্ত চুরি যাচ্ছে, সব চুরি হয়ে যাচ্ছে…
তাই আমি আমার জুতো জোড়া খুউব যত্ন করে রাখি;
আজকাল মসজিদেও আমার কড়ানজর থাকে জুতো জোড়ার প্রতি;
যা কস্মিনকালেও হতো না।
মাঝে মাঝে ভাবি আমার নামাজ হচ্ছেতো?
আসতাগফিরুল্লাহ…
এভাবে আর কত জুতো জোড়া পাহারা দেবো?
আমার জুতো জোড়ার সাথে হারামাইনের স্মৃতি জড়িয়ে আছে,
হেঁটে হেঁটে পরিব্রাজনে কী আনন্দ আছে প্রেমহীন হৃদয় বুঝে না এসব।
কুবা থেকে মসজিদে নববী আসার ধূলিময় স্মৃতি কাতরাচ্ছে হৃদয় রেহালে;
আরো আছে আরবের পথে পথে রাসুলুল্লাহার স্মৃতি চিহ্ন খুঁজে খুঁজে ধূলিমাখা পথ রোমন্থনের দ্যুতি।
জবলে সুর খোঁজার কষ্ট যখন হৃদয়ে বিঁধে!
আমার জুতো জোড়া রহমতে পরশ হয়ে তপ্ত রোদে বেদনার স্মৃতি হয়ে কাঁদে।
হায় খোদা! এমন সংবেদনশীল করে আমাকে কেনো পাঠালে বাঙলা মুলুকে ?
তার চেয়ে আরবের ধূলো হয়ে আমি যদি উড়তে পারতাম ক্বাবা ও রাসুলের রওজায় ;
জীবন আমার ধন্য হয়ে যেতো,
লাগতো না আশরাফুল মাখলুকাত তকমা-
যেখানে কূটনীতির গোপন রূপকথায় চুরি হয়ে যায় রাষ্ট্রও;
যখন ধানমণ্ডির ধূলি মুছে মুছে যাবর কাটে গোদা বংশের শেষ বুড়ো।
ব্যাক্তি উচ্ছন্নে যায়
সমাজ উচ্ছন্নে যায়
রাষ্ট্র উচ্ছন্নে যায় নটনীতির বিপাকে;
কেনো আমি জুতো জোড়া পাহারা দেবো ধূলোর আস্তরণ সরাতে?
ধূলিতে ধূলিময় আস্তো বিবেক যখন শুড়ি খানার আড্ডায়;
রাজপথ বেকে গেছে ধানমণ্ডির লেকের বিনোদ বিহারে;
বিপ্লবী বিনোদ বিহারীর উত্তরসূরি ফেঁসে গেছে যখন নট ও নাট্যমে।
সাকী শুরা গোলজার হ্যায় যখন-
হা হা হা… আমি আছি শুধু জুতো ঠিক রাখার সংগ্রামে!
……..
০১.১১.১৬
২.
তোমার বাঁশী বাজুক!!
হে ক্ষমতা! তুমি অবিনশ্বর হও;
তবু আমাদের রেহায় দাও-
চাপাতির কোপ, বুলেট ও ব্যালেটের ধূম্রজাল থেকে।
গুপ্তহত্যা, গুম, চোখ উপড়িয়ে ক্রসফায়ার থেকে।
আমার ট্যাক্সের টাকায় কেনা বুলেট যখন আমাকে বিঁধে
হে ক্ষমতা! তখন আমার বলার থাকে না কিছুই;
বেঁচে থাকার আর্তনাদ ছাড়া আর কোনো দাবী নেই।
ভোটাধীকার আমি চাই না;
দণ্ডমুন্ডের খোয়াব উবে গেছে বহু আগে;
আমি নির্বীয নপুংসক হয়েগেছি সিটি কর্পোরেশন কল্যাণে;
জন্মনিয়ন্ত্রণ বিভাগের কর্মীরা বহু আগেই আমাকে কিছু টাকা গুজে দিয়ে ইন্জেকশন পুশ করেছে ;
আমি বহু আগেই স্বপ্নকে বেচেছি মুড়ি মুড়কি দামে।
এখন শুধু আমি বাঁচতে চাই;
খোকা ঘুমিয়েছে, পাড়া জুড়িয়েছে,
বর্গী আসলে আসুক;
আমার প্রাণটা না গেলেই হয়-
হে ক্ষমতা! তোমার বাঁশী বাজুক! তোমার বাঁশী বাজুক!!
…………
২৭.০৪.১৬
৩.
মুহাম্মাদ (সা:) এর বেদনায়
পথভুল করে চলে গেছি জান্নাতুল মাওয়ার একেবারে পেছনে;
যেম্নিভাবে পথ হারায় বাংলাদেশ-
মদিনা সনদ থেকে যায় পূঁথিগত তত্ত্বকথায়।
আবার যখন ফিরে যেতে চাই,
ততক্ষণে শুকিয়ে যায় সব;
পথে পাওয়া পিউর ওয়াটার,
ব্যাগের কোণেথাকা আবে জমজম
নি:শেষ করে যখন দাড়িয়েছি মুাহাম্মদ(সা:) এর বেদনায়,
তখন আমিও প্রায় নি:শেষ-আবেগাপ্লুত;
বুকের মাঝে উষ্মবাষ্পের ঘণঘণ পতন।
খাদিজার কবর যেন নিস্তব্ধ-বাঙ্ময়,
হায় মুহাম্মদ! তুমি কীভাবে এমন চরম বেদনা বুকে নিয়ে
মানুষকে ডেকেছো মহত্বের পথে-
জীবনের রক্তিম পথপ্রান্তে?
প্রিয় হারা দু:খ তোমাকে করেছে খাঁটি?
জীবনের চরম সত্য নির্মাণ বিনির্মাণে।
খাদিজার প্রিয় সান্নিধ্য, সত্যকে পাওয়ার অলৌকিক প্রণোদনা,
গারে হেরার স্মৃতি, যাপনের আনন্দ বিষাদগীতি
তুমি কীভাবে ভুলো ইয়া আয়য়ুহাল মুদ্দাসসির!
গহীন অন্তর থেকে ভেসে আসে :
ওঠো! জাগ্রত করো এ বেদনাপ্লুত বাংলার বালুচরে,
যেখানে মদিনা সনদ কান্না করে
লৌকিক চাণক্য কৌশলে।
……….
জবলে ক্বাবা,মক্কা।
৩১.০৮.১৬
….
কে ঠেকাতে পারে এমন কবি ও কবিতার উত্থান?
জয় হোক শুভ চিন্তা ও সুবেদী কবিতার।
…
ইরফানুর রহমান রাফিন
….
আমার যদি ভুল না হয়, তাহলে আমি যতটুকু জেনেছি বা বুঝেছি, তাতে বলতে পারি কবি ইরফানুর রহমান রাফিন (Irfanur Rahman Rafin), মূলত, সরাসরি রাজনীতির মানুষ। এবং রাজনীতির মানুষ বলেই সচেতন ও বিবেকবান। আর বিবেকবান বলেই হয়তো প্রতিবাদী।
দেশ-বিদেশের অন্যায়-অবিচারে তার বিবেক বা চিন্তা বা মন চুপ থাকতে পারে না, বলে তিনি প্রতিকারের পথ সন্ধানে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়। কোন রাজনীতি বা কীসের রাজনীতি? এ মুখ্য নয়। তিনি মানবতাবাদী বলে আমার মনে হয়েছে।
সচেতন মানুষ মাত্রই রাজনীতি প্রবণ। রাজনীতির সঙ্গে তাদের সখ্য। আমিও রাজনীতি সচেতন। রাজনীতি প্রবণ। কিন্তু সক্রিয় রাজনীতি আমার ক্ষেত্র নয়, বলে আমি কবিতা লিখি। সাহিত্যচর্চায় জড়িত। জারিত।
অন্যায়ে আমিও প্রতিবাদে ফেটে পড়ি। আন্দোলিত হই। বিক্ষোভ প্রদর্শন করি। কিন্তু শিল্পীতভাবে। শৈল্পিক উপায়ে। এটি আমার ক্ষেত্র। আমাদের (শিল্পী-সাহিত্যিকদের) ক্ষেত্র। আমাদের মাধ্যম বলে, আমি মনে করি ও বিশ্বাস করি।
অনেকের, আমার মতের সঙ্গে অমত বা অমিল থাকতে পারে। থাকবেও। এতে অসুবিধা নাই।
প্রসঙ্গক্রমে সবকিছু মনে রেখেও আমার মনে হয়েছে, কবি ইরফানুর রহমান রাফিন-এর কবিতা লেখার চমৎকার হাত আছে। সম্ভাবনা আছে। আমার কথার সমর্থনে তার নিজের কবিতা ও কবিতার অনুবাদ পেশ করছি।
কতই না ভালো হবে, এই কবি যদি কবিতায় আরো সময় দেন। আরো সিরিয়াস হন।
শুভ কামনা, হে কম্রেড।
…
কবি ইরফানুর রহমান রাফিন-এর কবিতা :
…..
আপনি যখন নাজিম হিকমেতের জেলখানার চিঠি পড়ছেন
বা মার্টিন নাইমোলারকে স্মরণ করছেন কারণে অকারণে
দিলীপ রায় একটা অন্ধকার ঘরে বসে আছে
দিলীপ রায় কে?
বাপের নাম কি?
মায়ের নাম কি?
দ্যাশের বাড়ি কই?
ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে?
পাসপোর্ট আছে তার?
জাতীয় পরিচয়পত্রের নাম্বার?
আমি জানি আপনি আমাকে এসব প্রশ্ন করবেন।
কিন্তু এসব প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই।
আমি জানি না।
শুধু জানি দিলীপকে ওরা ধরে নিয়ে গেছে
তাতে আমাদের বিন্দুমাত্র কোনো অসুবিধা হচ্ছে না
আমরা ভালো আছি।
খাওয়ার সময় খাওয়া
পড়ার সময় পড়া
ঘুমের সময় ঘুম
আমরা ভালো আছি।
নয়টা পাঁচটা অফিস
হাতে বাজারের ব্যাগ
বিদ্যুৎ লণ্ড্রির বিল
আমরা ভালো আছি।
আমরা ভালো থাকতে থাকতে গণ্ডার হয়ে যাচ্ছি
শুধু
একটি ছেলে
সব দৃশ্য থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে
কারণ সে বোকা
কারণ সে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শিখেছে
কারণ সে অন্যায়ের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে শিখেছে
কারণ সে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম চালাতে শিখেছে
তাই সে একটা অন্ধকার ঘরে বসে আছে
তাতে অবশ্য শেখিস্তানের কিছুই যায় আসে না
শেখিস্তান ভালো আছে তার শিল্পকলা একাডেমি নিয়ে
শেখিস্তান ভালো আছে তার একাত্তর টিভি নিয়ে
শেখিস্তান ভালো আছে তার ইতর বুদ্ধিজীবী নিয়ে
শেখিস্তান ভালো আছে তার মোসাহেব সাংবাদিক নিয়ে
মিনিস্ট্রি অফ ট্রুথ ইতিহাসের পায়ে শেকল পড়াচ্ছে
এটা সেই সময় যখন চুপ থাকতে হয়
তবু আপনার স্নায়ুতে কি সামান্য যন্ত্রণা হচ্ছে?
(জিজ্ঞাসাবাদ । ০৬.০৯.২০১৬)
২.
জাহেলিয়াহ
একটি আরব ছেলে
আর তার মা
মসজিদুল হারামের কাছেই
একটা তুর্কি হোটেলের
সিঁড়িতে বসে আছে
পকেটে রিয়াল নাই
তাই তারা ক্ষুধার্ত
ছেলেটির চোখে কান্না
বাবা নাই তার
অর্থাৎ এতিম আর
তার মা বিধবা
ভয়ে ছেলেটির নাম
জিজ্ঞেস করিনি আমি
কেননা যদি সে
বলে তার নাম
আহমেদ, তবে আমি
অই চোখে আর
সাহস পাবো না,
তাকানোর। হায় খোদা
তোমার এই শহর
আর নবির শহর
দুটোই দখলে গেছে
সৌদ বংশের, অথচ
শেষ নবী তো
তেইশ বছর ধরে
লড়াই করেছেন এই
মিথ্যে বংশ গৌরব
আর অর্থের অহমিকার
বিরুদ্ধে। আর আজ
সামান্য রিয়ালের অভাবে
অভুক্ত থাকতে হয়
একটি এতিম ছেলে
আর এক বিধবাকে।
বড়ো সৌকের প্রবেশপথে
হোটেলের লবির দেয়ালে
ঝোলানো আছে হাস্যোজ্জ্বল
সৌদি রাজপুরুষদের ছবি
যাদের দেখলে আমার
আবু জেহেল আর
আবু লাহাবের কথা
মনে পড়ে যায়
প্রাচুর্য উপচে পড়ছে
বড়ো বড়ো সড়কে
চোখধাঁধানো সব সৌকে
অথচ আড়ালে গলিতে
লুকিয়ে রাখা দারিদ্র্য
মনে হয় যেনো
ফিরে এসেছে আবার
সময় সে মূর্খতার
আলোর আড়ালে অন্ধকার।
ফিলিস্তিনে
লেবাননে
ইয়েমেনে
আফগানিস্তানে
ইরাকে
লিবিয়ায়
সিরিয়ায়
যে শিশুরা মরলো
সৌদি তেলের খরিদ্দার
মার্কিনীদের বিমানের বোমায়
আর ইজরায়েলের ট্যাংকে
তাঁদের নিষ্পাপ রক্ত
সৌদিদের লানত দিচ্ছে
সৌদিদের লানত দিচ্ছে
সৌদিদের লানত দিচ্ছে
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি
নিষ্পাপের রক্তের লানত কোনোদিনও বৃথা যায় না…
আল খাইমাহ হোটেল
মক্কা
১ মে ২০১৬
৩.
অঙ্কণ শিক্ষা
আমার ছেলে তার রঙতুলির বাকশো রাখলো আমার সামনে
আর আমাকে বললো একটা পাখি এঁকে দিতে।
আমি ধূসর রঙের মধ্যে তুলিটা ডুবিয়ে দিলাম
এবং একটা চতুর্ভুজ আঁকলাম তালা ও গারদের।
তার চোখ থেকে উপচে পড়লো বিস্ময়ঃ
“…কিন্তু এটা তো একটা জেলখানা, বাবা
তুমি জানো না কি করে পাখি আঁকতে হয়?”
আর আমি তাকে বললামঃ “বাবা, আমাকে ক্ষমা করো।
আমি ভুলে গেছি পাখিদের আকার ও আকৃতি।”
আমার ছেলে তার ড্রয়িং বুকটা রাখলো আমার সামনে
আর আমাকে বললো একটা গমের বৃন্ত আঁকতে।
আমি কলমটা ধরলাম
এবং একটা বন্দুকের ছবি আঁকলাম।
আমার ছেলে পরিহাস করলো আমার অজ্ঞতা নিয়ে,
দাবী করলো,
“বাবা, তুমি এটাও জানো না, একটা গমের বৃন্ত
আর একটা বন্দুকের মধ্যে কি ফারাক?”
আমি তাকে বললাম, “সোনামনি,
একসময় আমি জানতাম কেমন আকৃতি গমের বৃন্তের
কেমন আকৃতি পাউরুটির
কেমন আকৃতি গোলাপের।
কিন্তু এই কঠিন সময়ে
জঙ্গলের গাছের যোগ দিয়েছে
মিলিশিয়াদের সাথে
আর গোলাপ পড়ে নিয়েছে বিবর্ণ পরিচ্ছদ।
এই সশস্ত্র গমের বৃন্তের সময়ে
সশস্ত্র পাখির সময়ে
সশস্ত্র সংস্কৃতির সময়ে
এবং সশস্ত্র ধর্মের সময়ে
তুমি এমন কোনো পাউরুটি কিনতে পারবে না
যার ভেতরে একটা বন্দুক নেই
তুমি বাগানের একটা গোলাপ ছিঁড়তে পারবে না
যার কাঁটা বিঁধে যাবে না মুখে তোমার
তুমি একটা বই কিনতে পারবে না
যা তোমার আঙুলের মধ্যে বিস্ফোরিত হবে না।”
আমার ছেলে আমার বিছানার ধার ঘেঁষে বসলো
আর আমাকে বললো একটা কবিতা আবৃত্তি করতে
আমার চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো বালিশে।
আমার ছেলে তা জিবে ছোঁয়ালো, অবাক হয়ে, বললোঃ
“কিন্তু, এটা তো অশ্রু বাবা, কবিতা নয়!”
এবং আমি তাকে বললাম,
“যখন তুমি বড়ো হবে, সোনামনি আমার
এবং আরবি কবিতার দিওয়ান পড়বে
তুমি আবিষ্কার করবে শব্দ আর অশ্রু যমজ
এবং আরবি কবিতা
লেখমান আঙুল থেকে ঝরে পড়া অশ্রু বৈ কিছু নয়।”
আমার ছেলে তার কলম, ক্রেয়ন বক্স রাখলো
আমার সামনে
আর আমাকে বললো তার জন্য একটা দেশ এঁকে দিতে।
আমার হাতে তুলিটা থরথর করে কাঁপছে
আর আমি ডুবে যাচ্ছি, কান্নায়।
— নিজার কাব্বানি (সিরিয়া)
— তর্জমা : ইরফানুর রহমান রাফিন
…..
ইমতিয়াজ মাহমুদ
……
কথিত আছে যে, কবি’র শক্তিমত্তা না কি প্রমাণিত হয়, দীর্ঘ কবিতায়! সত্যি-মিথ্যা বা বিশ্বাস-অবিশ্বাস, যার-যার ব্যক্তিগত।
আগে লিখিত হতো, মহাকাব্য। একালের কবিরা কেউ সে পথে আগ্রহী বলে মনে হয় না। তা ছাড়া সময় ও ব্যস্ততা মানুষের সুকুমারবৃত্তি চর্চায় একটি প্রধান অন্তরায়, এটিও অস্বীকার করা যায় না।
এতো দীর্ঘ লেখা পড়ার সময় কই? তাও আবার কবিতা? কবিতা তো এমনিতেই একটি সুক্ষ্ম ও স্পর্শকাতর এবং জটিল সুকুমারশিল্প।
কবিতার পাঠক সারাবিশ্বেই কম। বাংলাদেশে তথা বাংলাভাষার পাঠক-পাঠিকা বা পড়ুয়ার সংখ্যা আরো কম। সে ক্ষেত্রে কবিতার পাঠক যে কতজন, তা সহজেই অনুমেয়।
যাই হোক, যার কবিতা আলোচনা করতে গিয়ে এতো কথা, এবার সেই কবি’র কবিতা প্রসঙ্গে আসা যাক।
তিনি কবি ইমতিয়াজ মাহমুদ (Imtiaz Mahmud)। সাম্প্রতিক বাংলাদেশে যে সব তরুণদের কবিতা ইতিমধ্যে পাঠক সমাজে ব্যাপক আদৃত হয়েছে, তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম একজন। আমার নিজেরো তার কবিতা ভালো লাগে। দীর্ঘ কবিতা এবং আখ্যানধর্মী কবিতা রচনায় তার দক্ষতা প্রশ্নাতীত।
জীবনের গভীরে গিয়ে তিনি তুলে আনেন সাধারণ জীবনের অসাধারণ ব্যঞ্জনা গাঁথা।
কবি ইমতিয়াজ মাহমুদ -এর কবিতা :
১.
একদিন
একদিন সব অবহেলা দ্বিগুণ করে ফিরিয়ে দেব। সব দাঁড়িয়ে থাকা।
চেয়ার থাকতেও বসতে না বলা- ফিরিয়ে দেব। ঐদিন আমিও খুব
ভ্রু কুঁচকে তাকাব। এমন ভাব দেখাব যে কোন কথাই শুনছি
না। যেন আমার সময় নাই। আমি এসকল ব্যস্ততা ফিরিয়ে দেব।
সব অবহেলা দ্বিগুণ করে। একদিন আর কোথাও যাব না। আমার
কবরের পাশ দিয়ে তুমি হেঁটে যাবে ঠিকই। আমি ফিরেও তাকাবনা।
২.
সম্পর্ক
আমার বাবাকে একটি এনজিওর কাছে ভাড়া দিয়েছি।
প্রতি সপ্তাহে পনেরশ টাকা পাওয়া যাবে। তার বয়স
কম। এই মার্চে ৭২ হবে। এনজিওর পরিচালক বলেছে
বয়স ৮২ হলে আরও সাতশ টাকা বেশি পাওয়া যেত।
বাবাকে মাঠকর্মীর কাছে তুলে দেয়ার সময় তার চোখ
ভেজা ছিলো। চোখ মুছে উনি বলছিলেন, তুই পারলি?
আমি চুপ থাকি। এর উত্তরে আর কীইবা বলা যায়!
মাঠকর্মী তাকে পিকআপে উঠানোর সময় তিনি আমার
মৃত্যু কামনা করলেন। আমি অবশ্য তার দীর্ঘায়ু চাই,
বাবাকে ভাড়া দেয়া ছাড়া; আমার কোন রোজগার নাই!
৩.
শূন্যস্থান
কবিতার দুটি লাইনের মধ্যে এতটুকু শূন্যস্থান রাখতে
হয় যেন তার মধ্যে একটা সূর্য উঠতে পারে আর
সূর্যের আলোয় একটা লোক হকার্স মার্কেটে কমলা
রঙের একটা মশারির দরদাম করতে পারে। দরদাম
শেষ হবার আগেই
এই
কবিতা
পরের
লাইনে
চলে যাবে যেখানে দেখা যাবে লোকটা তারও পরের
লাইনের মধ্যবর্তী শূন্যস্থানে ছুটছে। কেননা একটু
আগে তার পকেটকাটা গেছে। সে পকেটমারের পেছনে
দৌড়াচ্ছে। আর তার পেছনে দৌড়াচ্ছে আরও দশজন।
(ঐ দশজন অবশ্য তাকেই পকেটমার সন্দেহ করছে!)
দৌড়াতে
দৌড়াতে
লোকটা
একটা ঠেলাগাড়ি, দুইটা ভ্যান আর তিনটা রিক্সা পেছনে
ফেলে এখন একটা বাসের পেছনে পেছনে দৌড়াচ্ছে আর
অবাক ব্যাপার যে বাসটাও তার সামনে সামনে দৌড়াচ্ছে
লোক দৌড়াচ্ছে/বাস দৌড়াচ্ছে/লোক দৌড়াচ্ছে/বাস দৌড়াচ্ছে
লোক দৌড়াচ্ছে/বাস দৌড়াচ্ছে/লোক দৌড়াচ্ছে/বাস দৌড়াচ্ছে
লোক দৌড়াচ্ছে/বাস দৌড়াচ্ছে/লোক দৌড়াচ্ছে/বাস দৌড়াচ্ছে
এভাবে কবিতা পরের লাইনে গেলে দেখা যায়
ঐ লোকটার চেয়ে
পেছনের দশজন ভালো দৌড়েছিলো
আর
পকেটকাটার
অপরাধে লোকটার লাশ ফুটপাথে পড়ে আছে;
তবু তার
দৌড় থামানো যায়না, কেননা
মানুষ জীবনভর নিজের লাশের পেছনে দৌড়ায়,
সে লাশের যতো কাছে যায়
লাশ তত দূরে সরে যায়
লোকটা
তাও
দৌড়াতে থাকে। দৌড়াতে দৌড়াতে সে লোকালয়
আর পাহাড় অতিক্রম করে এখন একটা
জঙ্গলের মধ্যে দৌড়াচ্ছে
আর তার সামনে
দৌড়াচ্ছে একটা বাঘ
লোক দৌড়াচ্ছে/বাঘ দৌড়াচ্ছে/লোক দৌড়াচ্ছে/বাঘ দৌড়াচ্ছে
লোক দৌড়াচ্ছে/বাঘ দৌড়াচ্ছে/লোক দৌড়াচ্ছে/বাঘ দৌড়াচ্ছে
লোক দৌড়াচ্ছে/বাঘ দৌড়াচ্ছে/লোক দৌড়াচ্ছে/বাঘ দৌড়াচ্ছে
কবিতার
পরের
শূন্যস্থানে বাঘ থেমে যায়। আর তার পেছনে
থেমে যায় লাশ। ফলে লোকটা তার লাশটাকে ধরে
ফেলে। আর এখন সে বাঘটাকে অনুরোধ করছে
যেন দয়া করে তার লাশটা খেয়ে ফেলে।
বাঘ বললো ‘কী নাম?’
লোক বললো ‘জামান’
বাঘ বললো ‘জামান, নিজের টাকা চুরি করে
যে লাশ হয় তাকে আমার খাবার রুচি হয়না’
এই বলে বাঘ কবিতায়
মিলিয়ে যায় আর
লোকটা তার লাশ নিয়ে ফের দৌড়ানো শুরু করে
তার
মাথার উপর
দৌড়ায়
শূন্য থেকে বের হয়ে আসা চাঁদ
লোক দৌড়াচ্ছে/চাঁদ দৌড়াচ্ছে/লোক দৌড়াচ্ছে/চাঁদ দৌড়াচ্ছে
লোক দৌড়াচ্ছে/চাঁদ দৌড়াচ্ছে/লোক দৌড়াচ্ছে/চাঁদ দৌড়াচ্ছে
লোক দৌড়াচ্ছে/চাঁদ দৌড়াচ্ছে/লোক দৌড়াচ্ছে/চাঁদ দৌড়াচ্ছে
এরপর
চাঁদ ডুবে
গেলে কবিতার দুই লাইনের মধ্যবর্তী শূন্যস্থানে সূর্য ওঠে
যার আলোয় লোকটা হকার্স মার্কেটে মশারি কিনতে যায়
আর লাশ হয়ে পুনরায়
এতদূর
আসে
(অথচ কবিতার শেষেও থাকে এক দীর্ঘ শূন্যস্থান
যেখানে অনায়াসে একটি কবর রচনা করে
চক্র ভাঙা যায়)
‘জামান?’
‘জি’
আপনার লাশটা ঐ শূন্যস্থানে নামান!’
(কালো কৌতুক/২০১৬)
……
এই কবি’র প্রকাশিত বই সমূহ: অন্ধকারের রোদ্দুরে (২০০০), মৃত্যুর জন্মদাতা (২০০২), সার্কাসের সঙ (২০০৮), মানুষ দেখতে কেমন (২০১০), নদীর চোখে পানি ও অন্যান্য কোয়াটরেন (২০১৩), পেন্টাকল (২০১৫), ম্যাক্সিম (২০১৬), কালো কৌতুক (২০১৬)