টুটুল রহমান
কলেজের প্রিন্সিপাল রুস্তম আলির সাথে তর্ক করে লাভ নেই। তবুও সে বার কয়েক বললো, দেখুন এবার বই পুস্তকে ইতিহাস বিকৃত করে লেখা হয়েছে। ভুল ইতিহাস পড়ানো মানে একটা জাতির মেধা-মননকে খুন করা। এটা মানুষ খুনের সামিল।
প্রিন্সিপাল একটু আগেই একটা সিংগারা, হাফ-কাপ রং চা মেরে দিয়ে পরবর্তী স্কেলে তার বেতনটা ঠিক কত হবে মনে মনে সেই হিসাব কষছিলেন। তার মুখে একটা পান ঢোকানো। সেটাকে চিবিয়ে গালের এদিক- সেদিক নিচ্ছেন আর পানের রস গলার ভেতরে নিচ্ছেন। কিছু লালরস যখন গড়িয়ে পড়লো ঠোটের কোণা দিকে তখন তিনি রূমালে মুখ মুছলেন। পায়ের কাছে রাখা পিকদানিটায় পুত্ করে পিক পেলে কথা বলতে শুরু করলেন। খয়ের মাখা পানে দেয়া হাকিমপুরী জর্দ্দার একটা মাতাল সুরভি তখন পুরো ঘরময় ছড়িয়ে পড়েছে।
তিনি কথা বলেন ধীরে —
‘দেখুন আপনার কাজ হলো পড়িয়ে যাওয়া। কে খুন হলো না হলো সেটা দেখার দায়িত্ব তো আপনার না। সরকার চাইছে জাতি এভাবে ইতিহাস জানুক। আমরাও তাই চাইছি।’
ইতিহাসের লেকচারার সাজ্জাদ শফি আগপাছ আর কিছুই ভাবলেন না। ছাত্রজীবনে বামরাজনীতির পোকা মাথায় ঢোকা মানুষ। প্রিন্সিপাল স্বাধীনতা বিরোধী তার সাথে তর্ক না করে বেরিয়ে পড়লেন রাস্তায়। এবং তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন চাকরি ছাড়বেন। বাড়িতে যেটুকুন জমি-জমা আছে, পুকুর আছে মাছ চাষাবাদ করবেন। বয়স বেশি হয়নি। বিয়ে থা করেননি।
তবে আগের খবরটা সাংবাদিক বন্ধু মুনিরকে জানানো দরকার। ইতিহাস বিকৃত করা পাঠ্যবই। সে একটা নিউজ-টিউজ করতে পারে। কিন্তু সেও তো সেদিন তার অফিসে নানা ঝামেলার কথা বললো। আগের মতো সত্য লিখা যায় না। সম্পাদককে উপর থেকে যা বলে দেয়া হয় সেভাবে নাকি লিখতে হয়। খুব কড়াকড়ি। প্রায় দিন সন্ধ্যায় নাকি অফিসে টিকটিকি ঘোরাফেরা করে। এনিয়ে সম্পাদকের সাথে তার নাকি তর্কও হয়েছে। মুনির বলেছে, মিথ্যা তথ্য দেয়া মানে মানুষ খুন করা। সম্পাদক বলেছে, মিয়া আগে পেট বাঁচান পরে মানুষ খুনের কথা চিন্তা কইরেন। মুনিরও হয়তো চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে এতক্ষণে।
হ্যাঁ ঘটনা যা ভাবা হয়েছিল তাই, ফোনে সাজ্জাদ শফি জানলো, মুনির চাকরি ছেড়ে দিয়ে এখন ফুল টাইম বেকার। নতুন করে তার নাকি আর চাকরি খোঁজার ইচ্ছেও করছে না। মুনির জানালো একটু বুদ্ধি মাথায় এসেছে দুই দ্রুত চলে আয়। জানাচ্ছি। সাজ্জাদ শুনে বললো, বুদ্ধিটা খারাপ না। চল দেখি কি হয় শেষ-মেষ।
মুনির একটা বিজ্ঞাপন রেডি করলো পত্রিকার জন্য এবং সেটা পাঠিয়ে দিলো তার সাবেক কর্মস্থলে।
এ ধরনের বিজ্ঞাপন চাকরিজীবনে একবারও পায়নি পত্রিকার বিজ্ঞাপন বিভাগের ডিজিএম ফরিদ আলি। ১৫ বছর আগে বিজ্ঞাপন নির্বাহী হিসেবে কাজ শুরু করেছিল। কত ধরনের বিজ্ঞাপনই তো তাকে ছাপতে হয়েছে।
ভিষন অদ্ভুত সে বিজ্ঞাপনের ভাষা। ফরিদ আলি বারবার পড়ে। কোথাও ভুল হচ্ছে না তো। নাকি বিজ্ঞাপনের আকালের দিনে সে একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলো?
সে আবার পড়ে–
‘সুলভে মানুষ খুন করা হয়। ব্যথাহীন মৃত্যু। আমরা ক্লায়েন্টের চাহিদা অনুযায়ি গুমও করে থাকি।’
ডিজিএম ফরিদ উদ্দিন ঘামতে থাকে। তার গলা শুকিয়ে আছে। বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষ খুন করছে? এও কি সম্ভব। তাহলে তো সেও যে কোনোদিন খুন হয়ে পড়ে থাকতে পারে। সে জিএম নাসির সাহেবের কাছে যায়। বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করে। নাসির সাহেব বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলেন।
তারপর বললেন, এটা হয়তো একটা বড় সংবাদ হতে পারে। এ ধরণের ঘটনা সংবাদপত্রের ইতিহাসে প্রথম। বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষ খুন। ‘সুলভে মানুষ খুনের বিজ্ঞাপন।’
হন্তদন্ত দুজনেই ছুটতে থাকে এডিটরের কাছে। ভাবে এ খবর ছাপা হলে পত্রিকা মারমার কাটকাট। প্রচুর বিক্রি হবে। একটা স্কুপ নিউজও হতে পারে।
সম্পাদক ভাবলেন অনেকক্ষণ। তার ভিষন গরম লাগছে। এমনিতেই আজ মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের সেমিনারে গিয়েছিলেন সকালে। গরমের মধ্যেই ব্লেজার গায়ে চড়িয়েছেন। সম্পাদক-সম্পাদক একটা ভাব তো আনতে হবে। আলোচনায় জোড়ালো ভাবে বললেন, স্বাধীন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কারো বাঁধায় মন গড়া কোনো নিউজ করা যাবে না। সমস্ত ভয়ভীতির উর্দ্ধে উঠে সংবাদ পরিবেশ করা আমাদের দায়িত্ব কারো লেজুড়বৃত্তিও করা যাবে না।
এসব গরম গম বক্তৃতা দিয়েছেন আজ। কিন্তু অফিসে এসে তিনি দেখলেন রিপোর্টার দেশের বিরাট ব্যবসায়ী গ্রুপের ভূমি দখলের রিপোর্ট করে বসে আসে। বছরে যারা অন্তত ১০ লাখ টাকার বিজ্ঞাপন দেয়। আরেকজন লিখেছে, এক মন্ত্রীর নারি কেলেংকারীর কথা। যে মন্ত্রী তার বন্ধু মানুষ। প্রায়ই পাঁচ তারকা হোটেলে আড্ডা দেন। তার মেজাজ খুব খারাপ। নিউজ এডিটর, চিফ রিপোর্টারকে ডেকে দিলেন এক ঝাড়ি। আপনার রিপোর্টারটা কি উন্নয়নের কোনো নিউজ পায় না? খালি নেগেটিভ নিউজ। এসব লিখলে পত্রিকা চালাতে পারবো?
এই গরম হাওয়ার মধ্যেই তারা সম্পাদকের সামনে দাঁড়ায়। ইনিয়ে-বিনিয়ে বলে সব কথা।
তবে সম্পাদক এ ধরনের নিউজ করার পক্ষে না।
তিনি বললেন, পুলিশকে ইনফর্ম করেন। এদের খুঁজে বের করতে পারলে অনেক কিছু বেরিয়ে আসতে পারে। অনেক খুনের রহস্য উন্মোচিত হবে।’
পত্রিকা অফিস থেকে ফোন গেলো থানায়। সম্পাদক বিষয়টা গুরুত্ব দিয়েছেন। ওসি সাহেব ভাবলেন, ভেরি ইন্টারেস্টিং ঘটনা। তিনি বিস্মিত হলেন আশ্চর্য হলেন।
ডিজিটাল যুগে অপরাধের নানা ধরণ দেখা যাচ্ছে। এটা আবার কোন ধরনের অপরাধ? তবে এই চক্রটা রাজধানীতে যে বড় বড় মার্ডারগুলো করছে সেটা পুলিশ প্রায় নিশ্চত হয়ে গেলো।
কোনো পলিটিক্যাল তদ্বির বাঁধা না হলে পুলিশ খুব সহজে সমস্যার সমাধান করতে পারে। পুলিশ এখন অনেক দক্ষ। এই ঘটনার সাথে জড়িত থাকায় সাজ্জাদ-মুনির এরেস্ট হলো। দুজনেই চাকরি যাওয়া মানুষ তখন। একজন প্রফেসর। আরেকজন সাংবাদিক। তাদের কোনো কঠোর জিজ্ঞাবাদ করতে হয়নি। দুজনেই তো কথার কারিগর। ফটাফট বলতে লাগলো।
সাজ্জাদ শফি বলতে লাগলো, দেখুন আমি ইতিহাসের একজন প্রফেসর। বিকৃত ইতিহাস পড়াতে পারবো না। ভুল ইতিহাস পড়ানো মানে একজন দুজন নয়, পুরো জাতিকে হত্যা করা। মনন মেরে ফেলা। বিকৃত আর ভুল ইতিহাসের প্রতিবাদ করেছিলাম। ব্যস। চাকরি গেলো। চাকরি যাওয়া লোকের চাকরি হয় না এদেশে।
মুনির বলতে লাগলো, আমারও প্রায় একই সমস্যা। আমি যে তথ্য পেয়েছিলাম তার উল্টোটা লিখতে বলা হয়েছিল। আমি বল্লাম এটা কি করে সম্ভব? ভুয়া কাগজপত্রে ব্যাংকের টাকা লুটে নিচ্ছে। ব্যাংকগুলো সহায়তা করছে। লিখলে রিপোর্ট ছাপা হচ্ছে না। সিন্ডিকেট করে তেলের দাম, চালের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। সিন্ডিকেট চিহ্নিত করে লিখলে সম্পাদক বলেন, ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না। মেক্সিমাম বিজ্ঞাপন তো এরা দেয়। মানুষের আমানত যারা লুটে নিচ্ছে, কষ্টে উপার্জন করা টাকা যারা জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে পকেটে তুলছে তারা তো মানুষ খুনই করছে তাই না?
ফরমালিন মিশিয়ে ফল বিক্রি করে, পঁচা ভেজাল খাবার বিক্রি করছে। এগুলো খেয়ে মানুষ তো ধীরে ধীরে খুন হয়ে যাচ্ছে।
এবার আসেন ডাক্তার, ওষুধ, হাসপাতালে। সেখানে খুনোখুনি তো কম চলছে না। আমরা দু‘বন্ধু এসব কিছুই করবো না। ভাবলাম খুন এখন একটা বৈধ পেশা বাংলাদেশে। সবাই আড়ালে আবডালে খুন করছে। আমরা জানি আমাদের ম্যাক্সিমাম ক্লায়েন্ট হবে পলিটিক্যাল দলগুলো। তারা এখন আর খুন-গুম কষ্ট করে করতে চাইছে না। এদের এখন প্রচুর টাকা। এরা এখন থার্ড পার্টি খুঁজছে।
ভাবলাম পেশা হিসেবে খুন এখন একটি দারুণ সম্ভাবনাময় পেশা হয়ে উঠবে। আমরা আগে ভাগে শুরু করতে চাই।
আমরা একটু মানবিক খুনি। যাদের মারবো তারা যাতে ব্যথা না পায়। কষ্ট না পায় সেদিকেও খেয়াল আমাদের আছে। পরকিয়া করে স্বামী স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে খুন করতে পারছে না। সন্তান খুন করতে পারছে না মায়া মমতার কারণে মা। সম্পত্তির লোভে পিতাকে সন্তান খুন করতে পারছে না। তারা আমাদের ক্লায়েন্ট হবে আশা করছি।
পুলিশের বড় কর্তা চুপ হয়ে রইলেন। কিছু বললেন না। ভাবলেন তিনিও তো খুনি। ইয়াবা পকেটে ঢুকিয়ে একজনকে ক্রস ফায়ার দেয়ার হুকুম তো সে দিয়েছিল একবার। নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগে তার। এদের কথা তো সত্য। খানিকবাদে বললেন, স্ক্রু দেখছি দুইজনেরই ঢিলা হয়ে গেছে। পাবনায় পাঠাতে হবে। তিনি কোনো মামলা দিলেন না। পাগলা গারদের ইনচার্জের ফোন নম্বরটা খুঁজতে লাগলে। কারণ এই নম্বর মনে হচ্ছে এখন প্রায়ই লাগবে। দুই বন্ধু অজানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়, সুলভে মানুষ খুনের একটা ফার্ম তারা খোলার পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে।