রফি হক
‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়’–এর গাইয়ে সুবীর নন্দী। আমাদের অনেকের একটা প্রিয় গান। এই গানটা যিনি লিখেছেন—তিনি কবি জাহিদুল হক। কবি জাহিদুল হক (জাহিদ ভাই) আজ দুপুর ১২ টা ৪০ মিনিটে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি নেই– এ-কথা শোনার পর থেকে পাথর হয়ে আছি।
.
গীতিকবি, কবি, ও সাংবাদিক জাহিদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল চিত্রশিল্পী আমার মায়েস্ত্রো খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী মনিরুল ইসলামের ধানমন্ডির স্টুডিওতে। প্রথম পরিচয়েই এত আপন করে নিয়েছিলেন যে, আমার মনে হয়েছিল তিনি আমার অনেক দিনের পরিচিত। তাঁর মূল পরিচয় তিনি কবি।
.
জাহিদুল হকের প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে : ‘পকেট ভর্তি মেঘ’, ‘তোমার হোমার’, ‘নীল দূতাবাস’, ‘সেই নিঃশ্বাসগুচ্ছ’, ‘পারীগুচ্ছ ও অন্যান্য কবিতা’, ‘এই ট্রেনটির নাম গার্সিয়া লোরকা’, ‘তোমার না আসার বার্ষিকী’, ‘আমজাদ আলির মেঘবাড়ি’।
.
জাহিদুল হক ২০০০ সালে জসীমউদ্দীন সাহিত্য পুরস্কার এবং ২০০২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান। এ ছাড়া গীতিকবিতার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগ থেকে ২০১৭ সালে পান বিশেষ সম্মাননা। ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়’– এ গানটা সহ অগণিত জনপ্রিয় গানের গীতিকারও তিনি।
.
জাহিদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার ফোনে কথা হতো দীর্ঘক্ষণ। যেহেতু আমি শিল্পী, আমাদের কথাবার্তা হত শিল্প সংক্রান্ত অজস্র ঘটনা নিয়ে। তাঁর পশ্চিমা সমকালীন শিল্পকলা নিয়ে ভালো জ্ঞান ছিল। তিনি ইউরোপের প্রচুর আর্ট মিউজিয়ামে ভিজিট করেছেন। তাঁর প্রিয় পেইন্টিং নিয়ে আমাকে বলতেন। আধুনিক যুগের মদিগ্লিয়ানি, পাবলো পিকাসো, হেনরি মাতিস—প্রি-রেনেসাঁসের শিল্পী বতিচেল্লির পেইন্টিং তিনি ভীষণ ভালোবাসতেন। তাঁদের এগজিবিশনও দেখেছেন।
.
জাহিদ ভাইয়ের পেইন্টিংপ্রীতি আমার ভালো লাগতো। পেইন্টিং নিয়ে কথা বলার সময়ে আমি নৈকট্য অনুভব করতাম। প্রিয়জন মনে হত। আরেকটি বিষয়ে আমার তাঁকে কাছের মনে হতো— তিনি দৈনিক সংবাদে সাংবাদিকতা করেছেন। আমি দৈনিক সংবাদে দীর্ঘদিন কাজ করেছি শুনে উনিও খুশি হয়েছিলেন। জাহিদ ভাই জার্মানীর ডয়েছে ভেলেতেও কাজ করেছেন। সম্ভবত বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে বাংলাদেশ বেতারের ডেপুটি মহাপরিচালকের পদ থেকে অবসর নেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। জন্ম ১৯৪৯ সালে আসামের বদরপুরে।
.
জাহিদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার মঞ্চে একাধিকবার কবিতা পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। কবি আমিনুর রহমানের কাছে কৃতজ্ঞ যে তিনি আমাকে সে ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। আমি একটি আমার লেখা কবিতা পড়েছিলাম, সেখানে একটি পঙক্তি ছিল : “কোনো বৃষ্টিই আর ইশ্কুল জীবন ফিরিয়ে দিবে না”….। কবিতা পড়া শেষে আমাকে তিনি বলেছিলেন— “আহা, দারুণ দারুণ রফি— “কোনো বৃষ্টিই আর ইশ্কুল জীবন ফিরিয়ে দিবে না”….
.
আজ থেকে আপনিও আর ফিরে আসবেন না প্রিয় জাহিদ ভাই। কোনো প্রার্থনাই আপনাকে আর ফিরেয়ে দিবে না পরমেশ্বর ।
সব লেনাদেনা চুকেবুকে অসংখ্য কাজ অসমাপ্ত রেখে চলেই গেলেন।
কত পরিকল্পনা করলেন আমার সঙ্গে আমার পেইন্টিং আর আপনার কবিতা নিয়ে…
যেখানে গেছেন, যে পৃথিবীতে গেছেন তা পৃথিবীর মানুষের কাছে কুয়াশাময়, আপনি এখন কুয়াশার ওপারে। ভালো থাকুন ওপারে—আপনার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ।
.
সোমাবার, ১৫ জানুয়ারি ২০২৪
১ মাঘ ১৪৩০ । ঢাকা।
রফি হক : শিল্পী, ছাপচিত্রী, শিল্পলেখক, সম্পাদক। ভিজিটিং আর্টিস্ট এন্ড লেকচারার, ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো।
ছবি : কবি জাহিদুল হকের সঙ্গে। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র, ঢাকা।