কাজী জহিরুল ইসলাম
“কফি হাউজের সেই আড্ডাটা” ছড়িয়ে পড়েছে সারা পৃথিবীতেই। স্বপ্নের অভিবাস বাঙালি কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংবাদিকদের কত কত দূর ভূগোলে টেনে নিয়ে গেছে; লন্ডনে, প্যারিসে, ক্যালিফোর্নিয়ায়, টরন্টোতে, নিউইয়র্কে এখন বাঙালি শিল্প-সংশ্লিষ্ট মানুষের দৃপ্ত পদচারণা। জীবন ও জীবিকার যুদ্ধ তাদের যতই ব্যস্ত রাখুক আড্ডা-বিলাসী মন ঠিকই টেনে নিয়ে যায় ক্যাফেটেরিয়ায়, টি-স্টলে। কবি মাহবুব হাসান যখন নিউইয়র্কে ছিলেন প্রায় প্রতিদিনই আমরা একত্রিত হতাম; গ্রীষ্মের দুপুরে, হেমন্তের বিকেলে কিংবা শীতের সন্ধ্যায় ধুমায়িত চায়ের কাপ সামনে নিয়ে আড্ডায় মেতে উঠতাম। মাহবুব হাসান অভিবাস জীবনে যতিচিহ্ন এঁকে ফিরে যান মাতৃভূমির কোলে। আমি এবং আমরা অনেকেই রয়ে গেছি। এই শহরে কী আড্ডা জমিয়ে তুলবার মতো সতীর্থের সংখ্যা কমে গেল? নিশ্চয়ই না। আজ হঠাৎ হিলসাইডের একটি রেস্টুরেন্টে বসি আমি এবং সৈয়দ কামরুল। দুজন কবিতার মানুষ একসঙ্গে হলে কবিতার কথা উঠবেই, আল মাহমুদ লিখেছেন, কতদূর এগুলো মানুষ, আমাদের মনের জলাশয়ে প্রশ্নেরা গলা বাড়ায়, ডানা ঝাপ্টায় কবিতার রাজহংসী, কত দূর এগোলো বাংলা কবিতা? আজ দুপুরে আমার প্রিয় বন্ধু, আশির দশকের কবি সৌমিত বসুর কবিতা নিয়ে একটি ভার্চুয়াল অনুষ্ঠান করেছি। সৌমিতের বেশ কিছু কবিতার লাইন তখনো আমার মাথায় জ্বলজ্বল করছে। আওড়ালাম তেমন কিছু পঙক্তি। “কান্নাদের সংসার এতো বড়ো হয় কেন?” এই লাইনটিকে খপ করে ধরে ফেললেন সৈয়দ কামরুল। দেখুন, কত সহজ করে মানুষের প্রলম্বিত কষ্টের কথা লাইনটিতে তুলে ধরা হলো। সমাজের অতীব সত্য কথাগুলো এভাবে দার্শনিক বক্তব্যে তুলে ধরতেন হুমায়ূন আহমেদও। এটিই তাকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে গেছে। আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে সৈয়দ কামরুল লিখেছিলেন, “রোদের জোহর” কথাটি, নামাজের অক্তকে এমন চমৎকার অসাম্প্রদায়িক অনুষঙ্গে উপস্থাপন করবার ক্ষমতা আমাকে বিস্মিত করেছিল। আজো আমার মাথায় গেঁথে আছে এই শব্দযুগল। যেন কেউ আমার মস্তিস্কে একটি পেরেক ঠুকে দিয়েছে। এইসবই হলো আজকের কবিতার ভাষা। কয়েক দিন আগে “নদীরা” শিরোনামের একটি কবিতা পোস্ট করেছি আমার ফেইসবুক পেইজে। সেখান থেকে তিনি একটি লাইনের প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, “রঙের মাদুরে বসে নুন মেখে খেয়ে নেয় সবুজ ওড়না”। এরপর লাইনটির প্রশংসা করে বলেন, মাথায় ঢুকে যায়। আমরা তো আসলে সারাক্ষণ বিশ্বকবিতার মাঠ চষে বেড়াই এমন একটি লাইনের জন্য যা আমাদের বোধের নিস্তরঙ্গ জলাশয়ে ঝড় তোলে।
” বধূবরণের নামে দাঁড়িয়েছে মহামাতৃকুল/
গাঙের ঢেউয়ের মতো বলো কন্যা কবুল, কবুল।” আল মাহমুদের এই লাইন থেকে আমাদের আলোচনা বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে যায় ইংরেজ কবি এডমুন্ট স্পেনসারের সনেট গ্রন্থ “অ্যামোরেটি” তে। সৈয়দ কামরুলই স্পেনসারের প্রসঙ্গটি তোলেন। চার্লস ল্যাম্ব তাকে বলতেন কবিদের কবি। উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ, জন মিল্টন, উইলিয়াম ব্লেক, লর্ড বায়রন, আলফ্রেড টেনিসন কে না স্পেন্সারের প্রশংসা করে দু’লাইন লিখেছেন। সৈয়দ কামরুল বলেন, ১৫৯৫ সালে স্পেন্সারের ৮৯টি সনেট নিয়ে যখন “আমোরেটি” বইটি বেরুলো তখন তোলপাড় শুরু হয় ইওরোপের কাব্যাঙ্গনে। শেক্সপিয়রের ডার্ক লেডি এবং স্পেনসারের আমোরেটির সনেটের আলোকে সৈয়দ কামরুল আল মাহমুদের সনেটগুলোর এক দুর্দান্ত বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, আল মাহমুদ সেখান থেকে বের করে এনে সোনালী কাবিনের সনেটে প্রেমকে উপস্থাপন করেছেন একদম নতুনভাবে, বাস্তবতার নিরিখে। এমনকী তার সমকালের কোনো কবিও এভাবে চিন্তা করতে পারেননি। বলা বাহুল্য কদিন আগে আমি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শামসুর রাহমান এবং আল মাহমুদের একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে প্রবন্ধ লিখেছি, সেই সুত্রেই আল মাহমুদের সনেটের প্রসঙ্গটি উঠে এসেছিল। এখানে বলে রাখা ভালো যে স্পেনসার ইংলিশ কবি হলেও তিনি তার সনেটগুলোতে পেট্রার্কান ফর্ম অনুসরণ করেছেন।
আমাদের আলোচনায় প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বৃত্তায়নের কথাও উঠে আসে। বাংলা একাডেমি এবং বাংলাদেশ সরকার দলীয়করণের মাধ্যমে এবং এসব প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা আর্থিক দুর্নীতির মাধ্যমে সাহিত্যের যে ক্ষতি করছে জাতিকে তার খেসারত দিতে হবে বহু বহুকাল ধরে। শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গনে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিপ্রাপ্ত একজন টাউটের কথাও উঠে আসে। যাকে নিয়ে বছর দেড়েক আগে আমি লিখেছিলাম। তিনি সুযোগ পেলেই নানান অজুহাতে প্রবাসীদের কাছে টাকা চান, কখনো ধার, কখনো অনুদান। সপ্তাহ খানেক আগে তিনি সৈয়দ কামরুলের কাছেও ৬ লক্ষ টাকা চেয়েছিলেন। আশানুরূপ সাড়া না পেয়ে পাঠানো ম্যাসেজগুলো মুছে দেন। তার অর্থলোভের বিষয়টি জানতাম কিন্তু আজ তার লাম্পট্যের কথা জেনে বিস্মিত হলাম। ঘনিষ্ঠ বন্ধুর স্ত্রীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেছিলেন গাড়ির ভেতরে বন্ধুর উপস্থিতিতেই। অথচ এইরকম লম্পটেরা আমাদের সমাজে একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়ে জ্ঞানী ও মানী লোকের মুখোশ পরে ঘুরে বেড়ায়। হায় সেলুকাস কী বিচিত্র এই দেশ!
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ২ ডিসেম্বর ২০২২।