spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদগদ্যঅক্ষয় কীর্তি : তিন

ধারাবাহিক জীবনী। লিখেছেন : আবু তাহের সরফরাজ

অক্ষয় কীর্তি : তিন

আবু তাহের সরফরাজ

অফিসে কাজ করছিল মোহন। বিকেলে এই সময়টায় কাজের চাপটা একটু কম থাকে। সকলের মধ্যেই একটু ঢিলেঢালা ভাব। পাশের টেবিলের ইন্দুবাবু পান চিবোতে চিবোতে বললেন, আছেন তো মশাই আরামেই। ঝাড়া হাত-পা। আর আমার তো টিকি বাঁধা। বাড়িতে শ্যালিকা আসছে। এদিকে আমার পকেট গড়ের মাঠ। মহা ফাঁপড়ে আছি মশাই।

মোহন একটু হাসলো। আহা রে, বেচারা! সংসারের ঝক্কি সামলে উঠতেই কাহিল। ক’পয়সাই আর বেতন পায়! পুরো মাসটাই টেনেটুনে চলতে হয়। সংসার থাকলে তারও নিশ্চয়ই একই অবস্থা হতো। কে জানে! এমনিতে সে ভালোই আছে। সংসারের ঝক্কি হয়তো তার পোষাতো না। পকেটে সারা মাসেই কিছু পয়সা থাকে। ইন্দুবাবুর প্রতি খানিক মায়া হলো তার। জিগেশ করল, শ্যালিকা থাকবে কতদিন?

ইন্দুবাবুর মুখ বেজার। বললেন, তা দু’চারদিন তো থাকবেই। আচ্ছা, অফিস থেকে কিছু অগ্রিমের ব্যবস্থা করা যায় না?

পকেট থেকে আট আনা বের করলো মোহন। ইন্দুবাবুর টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে বলল, তার আর দরকার হবে না ইন্দুবাবু। আপাতত এই দিয়ে কাজ চালিয়ে নিন। বেতন হলে আমাকে শোধ করে দিয়েন।

আহা, আপনি আবার কেন! তবে বেজায় উপকার হলো মোহনবাবু। সত্যিই আপনি বড় মনের মানুষ। যাক, গিন্নির মুখ ঝাপটা থেকে এ যাত্রায় রক্ষে পেলাম।

মোহন হাসলো, আমার গিন্নি নেই। থাকলে এই উপকারটুকু আপনাকে করতে পারতাম না ইন্দুবাবু।

পকেটে পয়সা রাখতে রাখতে ইন্দুবাবু মাথা নাড়লেন, তা যা বলেছেন। আচ্ছা, আপনার সেই যে ভাইটার কী অবস্থা? সে তো এখন কলকাতায় পড়ছে, তাই না?

মোহন জবাব দিল, হ্যাঁ, আছে ভালোই।

হঠাৎ মোহনের চোখ পড়ল দরজার দিকে। জ্যাঠাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো সে। আরে জ্যাঠা, আসেন আসেন। এগিয়ে গেল মোহন।

আছি ভালোই। তোমার খবর কি মোহন?

আমার ভালোই চলছে জ্যাঠা। আপনি বসেন। আমার হাতে তেমন কাজ নেই। একটু পরই বের হবো। বাড়িতে আর ফিরব না। সরাসরি কলকাতায় রওনা দেব।

সেই ভালো মোহন। বাড়িতে তোমার জেঠিমা একা। একটা দিন বাড়তি খরচ করা ঠিক হবে না। তবে আর দেরি কেন, চলো বের হই।

টেবিলের কাগজপত্র গোছগাছ করে উঠল মোহন। রাস্তায় নেমে জিগেশ করলো, জ্যাঠা, চলেন আগে মুখে কিছু দেয়া যাক। আপনার নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে।

পীতম্বর বললেন, এখন খাবার কোথায় পাবি মোহন?

সে আছে, আপনি আসেন আমার সঙ্গে।

বাবাকে দেখে আনন্দে কথা ফুটলো না অক্ষয়ের মুখে। বাবাকে জাপটে ধরে বুকের সাথে সে লেপটে রইল। অপত্য স্নেহে পীতম্বরের বুকটাও হু হু করে উঠল। কলকাতায় আসার আগে সেই যে একবার বাড়িতে গিয়েছিল অক্ষয়, দু’দিন থেকে এসেছিল। এরপর আর তাদের দ্যাখা হয়নি। অক্ষয়ের বয়েস এখন ১৫ বছর। দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেল ছেলেটা!

রামধন বললেন, হ্যাঁরে অক্ষয়, বাবাকে আগে হাত-মুখ ধুতে দে। কিছু মুখে দিয়ে নিক। এত বড় ছেলে, এখনো বাবার ন্যাওটা!

একটু লজ্জা পেল অক্ষয়। বাবাকে ছেড়ে দিয়ে মুখ আড়াল করে চোখের জল মুছলো।

খেতে বসে পীতম্বর জিগেশ করলেন, হ্যাঁরে খোকা, বিয়ে করতে আপত্তি নেই তো তোর?

অক্ষয় জবাব দিল, সে আপনারা যা ঠিক করবেন, তা-ই হবে। যদি মনে করেন এখন আমার বিয়ে করা দরকার, তাহলে বিয়ে করব। আগে মেয়েকে আপনারা দেখেন।

পীতম্বর বললেন, আমরা তো দেখবোই। তুইও দেখবি। তোর পছন্দ সবার আগে।

রামধন সায় দিল, তা তো বটেই, তা তো বটেই। অক্ষয়কে সাথে নিয়েই তাহলে আমরা পাত্রী দেখে আসি। কী বলেন জ্যাঠা?

হ্যাঁ, সেটাই ভালো। শুভস্য শীঘ্রম। শুভকাজে দেরি করতে নেই।

খবর পেয়ে গনেশ মিত্তির এসে হাজির। তিনিই পথ প্রদর্শক। একটা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে তারা রওনা দিলেন আগডপাড়ায়। ভদ্র পরিবার। তবে আর্থিক অবস্থা খুব বেশি ভালো নয়। তা থাক, শ্যামামণিকে দেখে কারো চোখে আর পলক পড়ে না। এমন নম্র আর সুলক্ষণা মেয়ে সচরাচর দেখা যায় না। কথা পাকাপাকি হয়ে গেল। শ্যামামণির মা বললেন, দেখতেই পাচ্ছেন আমার অবস্থা। উনি নেই। আমি একা মানুষ। যতটা পারি মেয়েকে সাজিয়ে দেব।

পীতম্বর বললেন, সেসব আপনি ভাববেন না। আমার অক্ষয়ের সাথে আপনার শ্যামামণিকে বেশ মানাবে। আমরা এতেই খুশি। সারা জীবন ওরা একসাথে থাকবে। আপনার আশির্বাদই ওদের পরম পাওয়া।

বিয়েতে খুব বেশি মানুষকে বললেন না পীতম্বর। নিজেরা কয়েকজন উপস্থিত থেকে পুরুত ডেকে সাত পাকে বেঁধে দিলেন অক্ষয় ও শ্যামামণিকে। পীতম্বর হাঁফ ছাড়লেন। তার মনে হলো, এতদিনে তার দায়িত্ব বুঝি শেষ করতে পারলেন। সংসারে আর মন টিকছিল না তার। অনেক তো হলো। এবার ঠাকুরের পায়ে আশ্রয় নিতে মনের ভেতর ডাক শুনতে পেলেন। দয়াময়ীকে একদিনও বললেন এই কথা। দয়াময়ী বললেন, আমারও আর মন টিকছে না গো। একটা জীবন এভাবেই চলে গেল। এদিকে বয়েসও যে হচ্ছে। কখন পরপারের ডাক চলে আসে।

পীতম্বর বললেন,  আমি ভাবছিলাম কাশিতে চলে যাব। বাকি জীবনটা ওখানেই কাটিয়ে দেব। তুমি কী বলো?

দয়াময়ী বললেন, সে তো ভালোই। তবে তোমাকে তো একা ছাড়বো না। আমিও যাব। অক্ষয় তো এখন নিজেই চলতে শিখেছে। লক্ষ্মীমন্ত একটা বউ ঘরে তুলে দিতে পেরেছি, এই-ই আমার শান্তি।

বেশ তো, তবে তাই চলো। আমি মোহন আর অক্ষয়কে খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি। ওরা এসে একটা দিন এখানে কাটিয়ে যাক। বউমার হাতের রান্নাও খেয়ে যেতে পারব।

দয়াময়ী বললেন, হ্যাঁ গো, তাই করো। কালই সবাইকে চিঠি লিখে দাও।

চিঠি লিখলেন পীতম্বর। মোহন ও অক্ষয়কে আলাদা আলাদা চিঠি। চিঠিতে অতকিছু ভেঙে লিখলেন না। কেবল লিখলেন, একদিনের জন্য এসে বেড়িয়ে যেতে। সবাই মিলে একটা দিন কাটাতে খুব ইচ্ছে তার ও দয়াময়ী দেবীর। ব্যস, এটুকুই।

দিন দুয়েক পর একই সাথে এসে হাজির হলো মোহন ও অক্ষয়। শ্যামামণি লাজুক চোখে ইতিউতি চেয়ে দেখতে লাগলো। দয়াময়ী বুকে টেনে নিলেন তাকে। মোহন হইচই বাঁধিয়ে দিল, কই জেঠিমা, কী কী পদ খাওয়াবে বলেন তো! খুব তো খবর দিয়ে নিয়ে এলেন। একটা দিন বেশ ভালোমন্দ খাওয়াতে হবে কিন্তু। আপনার হাতের রান্না তো নয়, যেন অমৃত। খিদিরপুরে কীসব খাই! কেবল আপনার রান্না খেলেই মনে হয়, এই খেলাম।

দয়াময়ী বললেন, সে খাবি বাবা। কী কী খাবি সে সব অক্ষয়কে সাথে নিয়ে বাজার থেকে এনে দে। আমি রেঁধে দেব। আর বউমাকেও শিখিয়ে দেব রান্নার কায়দাটা। আমি আর কতদিন! আমি না থাকলে শ্যামাই যেন তোদের মন  ভরে খাওয়াতে পারে।

মোহন গলা চড়ালো, সে কী কথা জেঠিমা! বালাই ষাট, তুমি আবার কোথায় যাবে? তুমি অনেক অনেক দিন আমাদের মাঝে থাকবে। আমরা তোমাকে কোথাও যেতে দিলে তো!

হ্যাঁ রে অক্ষয়, তোর লেখাপড়া কেমন চলছে রে? বিজ্ঞানটা এখন বুঝিস তো?

বাবার সাথে বসে কথা বলছিল অক্ষয়। মায়ের কথায় ঘাড় ফেরালো। বলল, সে ভালোই চলছে। আর, বিজ্ঞানটাই ভালোমতো শিখব ভাবছি। জানো তো মা, প্রকৃতির রহস্য খোলার চাবি হচ্ছে বিজ্ঞান। চোখের সামনে যে বিশ্বপ্রকৃতি আমরা দেখছি তার ভেতর কত যে রহস্য লুকিয়ে আছে, তুমি ভাবতেও পারবে না।

দয়াময়ী হাসলেন। বললেন, মনে আছে খোকা? খুব ছোটবেলায় তুই আমাকে জিগেশ করেছিলি পৃথিবী কত বড়। আমি তখনই বুঝেছিলাম, তোর ভেতর অজানাকে জানার আগ্রহ আছে। সেই আগ্রহই তোকে বিজ্ঞানের দিকে টেনে নিয়ে গেছে। আশির্বাদ করি বাবা, তুই মানুষের মতো মানুষ হয়ে ওঠ। বিজ্ঞানের আলোয় দেশবাসীকে সঠিক পথ দেখা।

মোহন হাঁক দিল, কই রে অক্ষয়, চল। বাজারটা ঘুরে আসি। জেঠিমা, বাজারের থলেটা নিয়ে আসুন তো।

বাড়িতে যেন চাঁদের হাট বসেছে। বারান্দায় মাদুর পেতে বসেছে পীতম্বর, মোহন আর অক্ষয়। হেঁশেলে দয়াময়ী আর শ্যামামণি। দয়াময়ীর চোখ ছলোছলো। তবে তিনি তা বারবার লুকোতে চেষ্টা করছেন। রান্নায় তার মন আজ আর বসছে না। শ্যামাকে তিনি বলেকয়ে দিচ্ছেন। রান্নাটা শ্যামাই করছে। বারান্দার এক কোণে জ্বলছে হেরিকেন। আকাশে আধখানা চাঁদ। গাছপালার ফাঁক-ফোকড় দিয়ে আবছা জ্যোছনা এসে ছড়িয়ে পড়েছে উঠোনে। বাড়ির পেছন দিকের ঝাকড়ানো আমগাছটায় কী যেন একটা পাখি থেকে থেকে ডেকে উঠছে। দূরের জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে শেয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক। পীতম্বর গম্ভীর মুখে বসে আছেন। অক্ষয় বলছিল ওরিয়েন্টাল সেমিনারির গল্প। বেশ উৎসাহ নিয়ে মোহন শুনছিল সেসব কথা।

নানান ভাষা শেখার মজাটা কী জানো? ওই ভাষার শ্রেষ্ঠ বইগুলো পড়ে ফেলা যায়। হার্ডম্যান জেফ্রয় খুবই পণ্ডিত মানুষ। খুব যত্ন নিয়ে তিনি আমাদেরকে গ্রিক, ল্যাটিন, হিব্রু, জার্মান ভাষা শেখান। কেবল ভাষা শেখানোই নয়, পাশাপাশি তিনি বিজ্ঞানের নানা শাখায় আমাদের জ্ঞান বাড়ানোর চেষ্টা করেন। তার সংগ্রহে কত যে বই, দেখলে তুমি অবাক হয়ে যাবে। সেসব বই আমাদেরকে পড়তে দেন। কোথাও বুঝতে না পারলে খুব আন্তরিকভাবে বুঝিয়ে দেন।

মাথা নেড়ে মোহন বলল, হ্যাঁ, সাহেবটাকে দেখে আমারও তাই মনে হয়েছে। কী রকম গম্ভীর মুখ! কথাও তো মনে হয় খুবই কম বলে।

হ্যাঁ, খুবই কম। মেপে-মেপে।

যাক, তোকে সেমিনারিতে ভর্তি করতে পেরে আমি সার্থক রে অক্ষয়। এখন বাকি পথটুকু তোর নিজের ইচ্ছে আর চেষ্টা। কী বলেন জ্যাঠা? মোহন তাকালো পীতম্বরের দিকে। হঠাৎ তার খেয়াল হলো, সেই কখন থেকে তারা এখানে বসে আছে, অথচ এর মধ্যে জ্যাঠা তেমন কোনো কথাই বলেননি। সে আর অক্ষয় বকবক করে চলেছে। মোহন জিগেশ করলো, কী হলো জ্যাঠা, এত চুপচাপ বসে আছেন যে!

পীতম্বর বললেন, কী আর বলবো। তোরা কথা বলছিস, আমি শুনছি। শুনতেই আমার ভালো লাগছে। আমাদের অক্ষয় কত কত বই পড়ছে এখন। শিখছে দুনিয়ার কত কিছু। এ কী কম আনন্দের! কথা বলতে বলতে গলা ধরে এলো তার। চোখে পানি এসে গেল। মুখ ঘুরিয়ে উঠোনের লেবুগাছ তলার দিকে তাকালেন তিনি। ধুতির খুটে দিয়ে চোখ মুছে নিলেন।

মোহন জিগেশ করলো, কী হলো জ্যাঠ্যা? কী রকম যেন দেখাচ্ছে আপনাকে। মনে হচ্ছে, কিছু একটা লুকোচ্ছেন। সেই এসে থেকে দেখছি, আপনার আর জেঠিমার সেই আগের উচ্ছ্বাস যেন হারিয়ে গেছে।

অক্ষয়ও বলল, হ্যাঁ বাব। মোহনদা ঠিকই বলেছে। আমিও ব্যাপারটা খেয়াল করেছি। কী হয়েছে, বলো তো?

তেমন কিছু না, বললেন পীতম্বর। এখানে আর মন টিকছে না রে। ভাবছি, বুড়োবুড়ি এবার কাশিতে চলে যাব। বাকি জীবনটা ওখানেই কাটিয়ে দেব। এর জন্যই তো তোদেরকে চিঠি লিখে নিয়ে এসেছি।

সে কী বাবা! ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা তো বাড়িতে বসেও করা যায়। সেজন্য একেবারে তীর্থে গিয়ে বসবাস করতে হবে? তা কেন? যেতে চাইছো যাও, কিন্তু বাকি জীবনটা সেখানেই কাটিয়ে দেবে, এই সিদ্ধান্ত আমি মেনে নিতে পারছি না। তোমাদের না দেখতে পেলে আমি কি ভালো থাকবো? আমার দিকটাও তো তোমাদের ভাবা উচিত বাবা। কথা বলতে বলতে অক্ষয় টের পেল, তার গলার জোর ক্যামন যেন কমে আসছে। গলা দিয়ে কথা যেন বের হতে চাইছে না।

[চলবে]

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

নয়ন আহমেদ on দু’টি কবিতা
নয়ন আহমেদ on পাখিমানুষ