আবদুল হাই শিকদার
সাঈদ
……..
সাঈদ সাঈদ বলে ডেকে ডেকে পাড়া মাত করি,
ও পুত্র, বাপ আমার, ফিরে আয় আগ্নেয় মশাল ধরি।
পাললিক দেশ আজ পৃথিবীর কসাইখানা,
হাজার লাশের উপর ক্রূর হাসে পিশাচের ডানা।
তবু তোর রক্তে রেঙে ঘরে ঘরে জেগেছে তরুণ,
গোরগুলো লালে লাল চায় শুধু ড্রাকুলার খুন।
হেয়াৎ মামুদের দেশে বাবনপুর গ্রাম—
এ গ্রাম আজ বাংলাদেশ, কোটি কোটি মানুষের নাম।
রাষ্ট্র উদ্ধারে আজ আসমুদ্র স্বদেশ ব্যাকুল,
ফ্যাসিবাদমুক্ত দেশে ফুটবেই পলাশ-শিমুল।
এ ভূমির সবাই আজ তোর মতো সাঈদ সাঈদ,
সম্মিলিত স্বপ্ন চায় রাহুমুক্ত পবিত্র ঈদ।
ফিরে আয় হে সন্তান, ফিরে আয় শূন্য এ বুকে —
অমানুষ উৎখাত করে মরি ফের সগৌরব সুখে।
১৯ জুলাই ২০২৪
ও স্বদেশ
………….
ঘাতকের হাতে রক্ত ঝরছে দেশে,
আমরা রয়েছি রক্তের পরিবেশে।
তবু বুক টান করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছ তুমি,
তোমার গর্বে কাঁদছে মাতৃভূমি।
তোমার ছেলেরা তোমার মেয়েরা আজ,
রক্তে আঁকছে মুক্তির কারুকাজ।
ফ্যাসিস্ট ঘাতক মানবেই পরাজয়,
এই তাঁবেদার এ দেশের কেউ নয়।
২০ জুলাই ২০২৪
আমরা মানুষ আমরা এসেছি
………….
আমরা মানুষ আমরা এসেছি অনাদি অতীত উদয়ের পথ ধরে
আমরা এসেছি হাজার হাজার বছরের ধূলি পায়ে
আমরা এসেছি নিযুত কালের পুঞ্জিত ব্যথা হয়ে
আমরা এসেছি মেসোপটেমিয়া গিলগামেশের মতো
আমরা মানুষ আমরা এসেছি দাস বিপ্লব করে
আমরা মানুষ আমরা এসেছি পলাশির গোঙরানী
আমরা এসেছি মজনু শাহের দহন
আমরা এসেছি শ্রীরঙ্গপত্তম
আমরা এসেছি ১৮৫৭ ’র বজ্রের গর্জন
আমরা এসেছি গালিবের ক্রন্দন
আমরা মানুষ আমরা এসেছি আন্দামানের কারাগারগুলো ভেঙ্গে
আমরা মানুষ আমরা এসেছি কোটি তিতুমীর ছেলে
আমরা এসেছি জালিয়ানআলা থেকে
আমরা এসেছি বীর শমসের গাজী
আমরা মানুষ আমরা এসেছি চুরুলিয়া থেকে আগুনের ফুল হয়ে
আমরা মানুষ আমরা এসেছি লৌহ কঠিন শের আলীর দৃঢ় পাঞ্জা
আমরা এসেছি ক্ষুদিরাম সহোদর
আমরা এসেছি সূর্য সেনের সাথী
আমরা এসেছি রজব আলীদের মাতৃমুক্তিপণ
আমরা এসেছি তেজতপ্ত ফরায়েজী দুুদু মিয়া
আমরা এসেছি চির বিদ্রোহী সাঁওতাল পরগনা
আমরা মানুষ আমরা এসেছি রোকেয়ার সন্তান
আমরা মানুষ আমরা এসেছি একুশে ফেব্রুয়ারী
আমরা এসেছি রফিক শফিক বরকতময় হয়ে
আমরা এসেছি মতিউর বীরশ্রেষ্ঠ
আমরা এসেছি নূর হোসেনের বুকে পিঠে পোস্টার
আমরা এসেছি আসাদের শার্ট গায়ে
আমরা মানুষ আমরা এসেছি মুক্তিযুদ্ধ টগবগ করা খুনে
আমরা মানুষ আমরা এসেছি নীল নদী সাঁতরিয়ে
আমরা এসেছি ঘন অরণ্য আমাজন পার হয়ে
আমরা এসেছি ব্রহ্মপুত্র যমুনার তীরে তীরে
আমরা এসেছি শ্যামল কোমল মেঘনার কূলে কূলে
আমরা এসেছি ভাঙ্গনোন্মাদ পদ্মার ঢেউ হয়ে
আমরা মানুষ আমরা এসেছি গাঙ্গেয় দেশে মরমিয়া মানচিত্র
আমরা মানুষ আমরা এসেছি বুলেটে বুলেটে ক্ষতবিক্ষত দেহ
আমরা এসেছি অথৈ তুফানে রক্তের স্রোতে ভেসে
আমরা এসেছি ক্রুর বারুদে শত শত লাশ হয়ে
আমরা এসেছি সন্তানহারা কারবালা বুকে করে
আমরা মানুষ আমরা এসেছি আবু সাইদের বেশে
আমরা মানুষ আমরা এসেছি ক্ষুব্ধ ক্রদ্ধ দেশ
আমরা এসেছি মানুষের আহাজারি
আমরা এসেছি দু’কূলপ্লাবী অশ্রুর বন্যায়
আমরা মানুষ আমরা এসেছি শ্রেণীহীন সমারোহে
আমরা মানুষ আমরা এসেছি রক্তপিপাসু হায়েনাকে রুখে দিতে
আমরা এসেছি বিষবৃক্ষের জঙ্গল উপড়াতে
আমরা এসেছি জল্লাদদের তন্ত্রের উচ্ছেদে
আমরা মানুষ আমরা এসেছি পিশাচের দাঁত ফ্যাসিবাদ উৎখাতে
আমরা মানুষ আমরা এসেছি পাথরে খোদিত ইতিহাস অক্ষয়
আমরা এসেছি ফিলিস্তিনের অগ্নিগর্ভ বালু
আমরা এসেছি কালো আফ্রিকা দুঃখের দাবানল
আমরা এসেছি নিযুত জন্ম মানিনিকো পরাজয়
আমরা মানুষ আমরা এসেছি কোটি কোটি ক্রোধ হাতে
আমরা মানুষ আমরা এসেছি রেসকোর্স প্রান্তর
আমরা এসেছি কালুর ঘাটের ইথারের হুংকার
আমরা এসেছি মীর মরদান খাপ খোলা তরবারী
আমরা এসেছি অমানুষ সংহারে
আমরা মানুষ আমরা এসেছি প্রীতি ও প্রেমের বিশ্ব উৎপাদনে
আমরা মানুষ আমরা এসেছি কুরআনের পাখি হয়ে
আমরা এসেছি গীতার মর্মগাথা
আমরা এসেছি তওরাত বাইবেল
আমরা এসেছি ত্রিপিটক আর যবুরের কথামালা
আমরা এসেছি আকাশ কাঁপানো কালবৈশাখী ঝড়ে ঝড়ে পাখা মেলে
আমরা এসেছি জুলুম রুখতে দুর্বার আবাবিল
আমরা মানুষ আমরা এসেছি দশ দিগন্ত থেকে
আমরা মানুষ আমরা এসেছি লাখো শহীদের স্বপ্ন জড়ানো প্রাণে
আমরা এসেছি সুষম সমাজ মানুষের কল্যাণে
আমরা এসেছি শোষণমুক্ত স্বদেশের সুঘ্রাণে
আমরা মানুষ আমরা এসেছি– শুধু মানুষেরা এই কথাটুকু জানে
আমরা মানুষ আমরা এসেছি মানুষের বাণী মনে
আমরা এসেছি বিমানবিক আন্ধার বিতাড়নে
আমরা এসেছি আবার পৃথিবী যেন মানুষের হয়
আমরা এসেছি শঙ্কাবিহীন শান্তির বরাভয়
আমরা এসেছি ছাড়ো উদ্বেগ বিজয় সুনিশ্চয়
আমরা এসেছি পায়ে পিষে পিষে দীনতা ও হীনতাকে
আমরা মানুষ আমরা এসেছি হারিয়ে যাওয়া স্বাধীনতা উদ্ধারে
২৩ জুলাই ২০২৪
স্বাধীনতা ও মুক্তি
……………
শহীদের রক্ত আর আহতদের বেদনা দিয়ে
আমরা তৈরি করি আশা
সেই আশার হৃদয়ে নির্মাণ করি ভবিষ্যৎ
আমরা আমাদের জনগণের জন্য
উপস্থাপন করি মেঘমুক্ত আকাশ
এবং আমাদের জাতির জন্য
সৃষ্টি করি স্বাধীনতা ও মুক্তি
১৩ এপ্রিল ২০২৪
দুঃসহকাল
……….
পরিত্যক্ত ছেঁড়া জুতার প্রতিও একধরনের মায়া থাকে,
আমাদের শাসকদের ততটুকু দরদও
নিজ দেশের জনগণের জন্য নেই
করোনাকালে পথের কুকুরগুলোকে পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছিল
বাংলাদেশের মানুষ
পরম মমতায় জড়িয়ে রেখেছিল নকশী কাঁথার মাঠ
সেই মানুষকে গুম করে খুন করে
লাশের উপর উন্মাদ নৃত্য করছে ফ্যাসিস্ট পিশাচ
একটা ছোট্ট পাখিরও সন্ধ্যায় নীড়ে ফেরার আকুলতা থাকে,
সেই তাড়নায় অশ্রুসিক্ত আজ
বাংলাদেশের জনগণের হৃদয়
তার বসতবাড়ি ভেঙে গুড়িয়ে ঘুঘু চড়াচ্ছে বাকশালী দানব
আর তাড়া খাওয়া হরিণের মতো
দিগি¦দিক উর্ধ্বা ছুটছে যুবক বৃদ্ধ কিশোর
তাদের পেছনে শত শত হাজার হাজার ঘাতক পুলিশ
ঝাঁক ঝাঁক মামলার পঙ্গপাল।
আর শাসকরা ভয়ঙ্কর ড্রাকুলার মতো
হাড় হিম করা দাঁত বের করে হিস হিস করে হাসে
প্রতিকারহীন শক্তির হিংস্র ক্রুদ্ধ ক্রূর জিঘাংসের সামনে
স্তম্ভিত মাতৃভূমির অস্তিত্ব কেঁপে উঠেছে কষ্টের ভূমিকম্পে
বাংলাদেশের মায়েরা কুলহীন কিনারহীন অথই তুফানে হাহাকার তোলে
প্রভু, আমাদের জরায়ুগুলোকে মানুষ জন্ম দেওয়ার মতো উপযুক্ত করে দাও
যাতে তারা ঘাতকের পিঠের চামড়া তুলে নিতে পারে
নদী মরে কিংবা সরে গেলে
নদী কিছু চিহ্ন রেখে যায়
আধিপত্যবাদের দাসরা যে একদিন মানুষ ছিল
তা-ও আজ আর বোঝার উপায় নাই।
এ এমন এক দুঃসহকাল
যখন বায়ুদূষণ ও শব্দ দূষণে আমাদের অন্তরাত্মা স্তব্ধ
দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে গেছে
ফুসফুস হারিয়েছে তার কার্যকারিতা
ফলে দাস আর মুক্ত মানুষের মধ্যে
আজ আর কোনো পার্থক্য ঠাহর করা যায় না।
২৩ মার্চ ২০২৪
ডাক
……..
বাংলাদেশের মুক্ত আত্মা দাসদের পায়ে পিষ্ট
নেকড়ের দল সাধু সেজে সেজে কথা বলে খুব মিষ্ট
ভণ্ড এবং ষণ্ডের হাতে প্রেম-প্রীতিগুলো ক্লিষ্ট
পরগাছা পাঠা সবকিছু খেয়ে হচ্ছে পুষ্ট-হৃষ্ট
এই অপমান করো খান খান যারা আছো দেশনিষ্ঠ।
২৩ মার্চ ২০২৪
শিকদার ভাই’র কবিতায় এ সময় ও আমাদের জাতীয়তা অনিবার্য প্রাসঙ্গিক।