মুহম্মদ মতিউল্লাহ্
বাংলাসাহিত্যে জসীমউদ্দীনের যখন আত্মপ্রকাশ— আধুনিকতার সেই ঊষালগ্নে বাংলা কবিতা আধুনিকতার উৎস অনুসন্ধান করছিল তার নগরমনস্কতায়। যদিও রবীন্দ্রনাথের সর্বতো বিস্তারী প্রতিভা তখনও পৌনপুনিক রূপান্তরের আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে। ক্রমশ গৌরব হারাচ্ছে কুমুদরঞ্জন-করুণানিধান-কালিদাস রায়ের কাব্যধারার গ্রামীন পটভূমি। নতুন দিনের কেতন উড়িয়ে নজরুলের তীব্র উদ্দীপক কবি-প্রতিভা বাংলা কবিতার ভাষা তখন পালটে দিচ্ছে। এরই সঙ্গে নতুন দিনের কবিতার ভঙ্গি নিয়ে ইংরেজি শিক্ষিত তিরিশের কবিরা বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত হাজির হচ্ছেন। দৃষ্টি তাদের য়ুরোপীয় সাহিত্যবাহিত আধুনিকতার দিকে। এঁদের দৃষ্টি যতটা নাগরিকজীবনের দিকে, ততটাই অনাগ্রহ ছিল গ্রামীণ লোকজ জীবনে। কল্লোলযুগের আধুনিকতার শহর সংবেদ্যতায় জসীমউদ্দীনের আবির্ভাব একক নিঃসঙ্গ এবং নিজস্ব স্বভাবকবিত্বের বাণীরূপায়ণ। আবহমান বাংলার পল্লী-প্রকৃতি, তার আন্তর্জীবন, লোকজ গ্রামীণ সংস্কৃতি থেকে আহৃত জসীমউদ্দীনের কন্ঠস্বর। তার যাবতীয় ঋণ তার ঐতিহ্যের কাছে, অবশ্যই দেশীয় ঐতিহ্যের কাছে।
ইউরোপিয় সাহিত্য থেকে আমদানিকৃত নাগরিক আধুনিকতার পথযাত্রায় জসীমউদ্দীনের মনোভূমি যে প্রস্তুত ছিল না, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর একদিনের কথোপকথন সে সাক্ষ্য বহন করে। রবীন্দ্রনাথের কাছে অনুযোগ করেছিলেন তিনি ‘আজকাল একদল অতি আধুনিক কবির উদয় হয়েছে। এরা বলে সেই মান্ধাতার আমলের চাঁদ জোছনা ও মুগ্ধনয়নের উপমা আর চলে না। … গদ্যকে এরা কবিতার মতো করে সাজায়। তাতে মিল আর ছন্দের আরোপ বাহুল্যমাত্র। এলিয়ট আর এজরা পাউন্ডের মতো করে এরা লিখতে চায়। … কবির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য যদি না থাকল তার প্রকাশে তাকে কবি বলে স্বীকার করব কেন?’ উত্তরে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করে বলেছিলেন: ‘এটি একটি সাময়িক ঘটনা। মেকির আদর বেশি দিন চলে না।’ তিরিশের কবিদের আধুনিকতার অন্বেষণ কালে জসীমউদ্দীন ছিলেন নিজভূমে স্ববাসী। কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি ভেবেছিলেন পশ্চিমের অনুকারক আধুনিকতা নয়, বরং কবির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অর্জনের কথা।
কবি হিসেবে জসীমউদ্দীন ‘নিজস্ব বৈশিষ্ট্য’ অর্জন করতে পেরেছিলেন।
তাঁর আত্মপ্রকাশলগ্নে তাঁর স্বরচিত সরলতার ভুবন, যা তার কবি হিসেবে ‘নিজস্ব বৈশিষ্ট্য’; তার সত্যমূল্য নিরূপণ করে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “জসীমউদ্দীনের কবিতার ভাব ভাষা রস সম্পূর্ণ নতুন ধরনের। প্রকৃত কবির হৃদয় এই লেখকের আছে। অতি সহজে যাদের লেখবার শক্তি নেই, এমনতর খাঁটি জিনিস তারা লিখতে পারে না।’ অতি সহজ ভাষায় সরল মানুষের কথা লিখবার কবিত্বশক্তি জসীমউদ্দীনের ছিল। জসীমউদ্দীন কবিতা রচনা করেছেন তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে, নিজস্ব ভাষার ব্যবহার দিয়ে। তাঁর এই অভিজ্ঞতা লোকজীবন থেকে তাঁর অর্জন। সরল গ্রামীণ গৃহস্থ মানুষের কথা দিয়ে মোড়া তাঁর কবিতার জগৎ। যে জগৎ-কে তিনি দেখেছেন আপন অভিজ্ঞতায়। লোকজীবন থেকে তিনি সংগ্রহ করেছেন তার কাব্যভুবনের উপাদান। আবহমান প্রাচীন পল্লীকথা-কাহিনি থেকে, জারি-সারি-মুমিনি গানের লোকায়ত ঐশ্বর্য থেকে তাঁর এই আহরণ। আর এই প্রকাশে তিরিশের বাংলা কবিতার নগর বৈদগ্ধের র পাশে তিনি ছিলেন একক ও অকৃত্রিম। ইংরেজি বাহিত আধুনিকতায় দীক্ষিত সে সময় সর্বাংশে যখন নগরমুখীনতায় আচ্ছন্ন তখন এক প্রসারিত দিগন্তপ্লাবী দৃষ্টি দিয়ে জসীমউদ্দীন পিছন ফিরে তাকিয়েছেন গ্রামীণ সংস্কৃতির লুপ্তপ্রায় ঐশ্বর্যের দিকে। দীনেশচন্দ্র সেনের ব্যবস্থাপনায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে জসীমউদ্দীন যে সর্ববঙ্গীয় গীতিকার সন্ধান করে বেড়িয়েছেন, সেখানেই ছিল তাঁর আত্মার অনুসন্ধান। তারই প্রকাশ ঘটেছে তাঁর কাহিনিকাব্যে, গীতিকবিতায়। তাঁর ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’ কাহিনিকাব্য পড়ে দীনেশচন্দ্র সেনের মনে হয়েছিল, ‘এই পল্লীদৃশ্য আমাদের চোখের সামনে ছিল। এখনও হয়তো কিছু আছে কিন্তু এই সকল হারাইয়া। ফেলিয়াছিলাম। এই হারানো জিনিস নূতন করিয়া পাওয়ার যে আনন্দ কবি জসীমউদ্দীন তাহা আমাদিগকে দিয়াছেন।’ জসীমউদ্দীনের কথনরীতি অনেকটা যেন প্রাচীন পুঁথিসাহিত্য আশ্রিত। চলে আসা গীতিকাহিনি, কাব্যগাথা, লোকগল্প থেকে তিনি যেমন উপাদান সংগ্রহ করেছেন তেমনি শৈলীর সরলতা। তিনি যেন কবিতা শুরু করেন গল্প বলার সাবেকি ঢঙে— ‘এক গাঁয়ে এক চাষীর ছেলে লম্বা মাথার চুল।’… এবং তা প্রকাশ করেছেন সহজাত স্বভাবকবিত্বের সহজতা দিয়ে। নির্মাণ নয়, তাঁর কবিতা একারণেই সহজ অনায়াস হয়ে-ওঠা। ফলে-ওঠা। কাহিনিকাব্য জসীমউদ্দীন যে প্রথম লিখলেন তা নয়। রবীন্দ্রনাথ অসংখ্য সার্থক কাহিনিকবিতা রচনা করেছেন। মধুসূদন দত্ত এ বিষয়ে পথিকৃৎ। কিন্তু মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথ সে কাহিনি সংগ্রহ করেছেন রামায়ণ মহাভারত থেকে, পুরাণ কথা বৌদ্ধ জাতক থেকে। জসীমউদ্দীন কাহিনি সংগ্রহ করেছেন লোকজ বাংলার স্বদেশি সংগ্রহ থেকে; যা তাঁর যাপিত জীবন-অভিজ্ঞতার উজ্জ্বল উদ্ধার।
অতি সক্রিয় আধুনিকতার সেই নাগরিক উত্তালতার কালে জসীমউদ্দীনের গ্রামীণ পটভূমির আবিষ্কারে ছিল একাকীর নতুনত্ব অবশ্যই। যদিও চমক দেওয়ার প্রচেষ্টা তাতে ছিল না। তাঁর নক্সীকাঁথার মাঠ’ কিংবা ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ সেই দেশজ বাংলার গরীব গৃহস্থ সমাজজীবনের অপরূপ কথায় সমৃদ্ধ কাহিনিকাব্য। ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ অবনীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল ‘বইখানি সুন্দর কাঁথার মতো বোনা।’ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চোখে ‘এই লেখার মধ্য দিয়ে বাংলার পল্লীজীবন আমাদের কাছে চমৎকার একটি মাধুর্যময় ছবির মতো দেখা দিয়েছে’। এই সব কাহিনিকাবো কিবো তাঁর ‘রাখালী’, ‘বালুচর’, ‘ধানখেত’ কাব্যে জসীমউদ্দীন তুলে আনলেন হাজার বছরের বাংলাকে। বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল তো বটেই সেই সঙ্গে উঠে এল গ্রামবাংলার চাষী- জোলা- পোটো- তাঁতি- জেলে কুমোর এবং সাধারণ হতদরিদ্র মুসলমান সম্প্রদায়ের কথা, তাঁর কবিতায় ছায়া ফেলে ‘শাওন মাসের তমাল তরুর ছায়া’ কোথাও বা ‘তুলসীতলায় প্রদীপ যেন জ্বলছে সাঁঝের বেলা।’ জসীমউদ্দীন তাঁর কবিতায় যেন রূপকথারই কাহিনি শোনাচ্ছেন কিন্তু সে রূপকথার সব চরিত্রই অকাল্পনিক, চেনা মানুষ। সেখানে নেই রাজকন্যা, রাজপুত্র কিংবা রাক্ষস খোক্ষস। আছে গ্রামীণ সমাজজীবন থেকে উঠে আসা তরুণ-তরুণী। আছে ভালোবাসার ভরসার কথা। আছে মটরের ফুল, কলমির লতার কথা। স্বভাবকবির কথকতায় তাঁর কবিতা চিরায়ত বঙ্গসংস্কৃতির অপরূপ রূপান্তরে সমৃদ্ধ হয়েছে। চেনা শব্দকে চলিত অর্থের অন্যপারে নিয়ে এসে শব্দাতীত ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করেছেন। সেখানে নেই কোনো আরোপিত কারুকৃতি। তা শুধুই এক আলোকিত সহজতা। নদীচরের ধূ-ধূ স্তব্ধতা, ধান খেতের সবুজতা, নবীন তৃণের ছায়া, নিঃসঙ্গ পাখির উড়াল, দিঘিজলের কাজল কালো তরঙ্গ, নৌকা- কলসি- কবর এবং কুঁড়েঘর জসীমউদ্দীনের কবিতায় মায়াবি দর্পণের মতো হেসে ওঠে। গ্রামীণ জনজীবনের সরল মানুষ আর নিসর্গ-লোক এক অনির্বচনীয় আনন্দে আলোকিত হয় তাঁর কবিতায়—
‘কৃষাণী কি বসি সাঁঝেরবেলায়
মিহিচাল ঝাড়ে মেঘের কুলায়
ফাগের মতো কুঁড়া উড়ে যায়
আলোক ধারে।’
সহজ উপমা রচনায় অদ্বিতীয় কবি জসীমউদ্দীন—
‘কচি ধানের পাতার মতো কচি মুখের মায়া
তার সাথে কে মাখিয়ে দেছে নবীন তৃণের ছায়া
জালি লাউ-এর ডগার মতো বাহু দুখান সরু
গাখানি তার শাওন মাসের যেমন তমাল তরু।’
আজ জসীমউদ্দীনের পাঠকের নিশ্চয় লক্ষ্য থাকবে ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ গ্রন্থটির জনপ্রিয়তা সে কালে কম ছিল না। এ পর্যন্ত তার ১৯টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। তেমনি তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থেরও। ১৯৩১-এ ই.এম. মিলফোর্ড-এর অনুবাদে ইংরেজি সংস্করণ বের হয় The Field of Embroidered Quilt নামে Oxford University Press থেকে। ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ ইংরেজি অনুবাদ করেন বি.পেইন্টার এবং ওয়াই লাভলফ ‘Gipsy Wharf’ নামে লন্ডনের অ্যালেন অ্যান্ড আনউইন প্রকাশন সংস্থা থেকে (১৯৬৯)। পরে এটি UNESCO-র Rep resentative Works: Asian Series-এর অন্তর্ভুক্ত হয়।
রবীন্দ্রপরবর্তী কবিরা নতুন দিকদর্শনে আধুনিকতার পাঠ নিয়ে হয়ে উঠলেন বিশ্বপথিক। জসীমউদ্দীন তখন একাকীর নিঃসঙ্গতায় কুঁড়েঘরের পাশে একটি ধানের শিষের উপর একটি শিশিরবিন্দু নিয়েই আত্মস্থ থাকলেন। সুধীন্দ্রনাথ-বিষ্ণু-বুদ্ধদেব জীবনানন্দ নাগরিকেরা কেউ গ্রামমুখী হতে পারলেন না। বুদ্ধদেব-জীবনানন্দ পূর্ববঙ্গ থেকে উঠে এলেন নগর কলকাতায়। এবং জীবনানন্দ ‘রূপসী বাংলা’-র কবি। তবু জীবনানন্দের কাব্যাদর্শ ইউরোপীয় আধুনিকতার, ইয়েটন অনুসারী। একই সঙ্গে তাঁরা নগরবাসী এবং বিশ্ববাসী। জসীমউদ্দীন যদিও উঠে এলেন কলকাতায় কিন্তু তার সর্বাংশ জুড়ে গ্রামীণ বাংলার বিশ্বভুবন। সুতরাং তিরিশ ও পরবর্তী পাঠকেরা-‘কঙ্কাবতী’, ‘বনলতা সেন’ কিংবা ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’ পড়ার পর জসীমউদ্দীনে নতুন কিছু পাবেন নিশ্চয় তা সম্ভব ছিল না। তিরিশের বিপুল আধুনিকতার আন্দোলনে জসীমউদ্দীনের কাব্যজগৎ কোনো উদ্দীপনা যে যোগাতে সমর্থ হযনি তা-ই স্বাভাবিক। যদিও বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ সংকলনে জসীমউদ্দীনের কবিতা সংকলিত হয়েছে। বাদ পড়েছেন কুমুদরঞ্জন মল্লিক। আধুনিকতার শিকড় অভিলাষী চৈতন্যের সন্ধানে একুশ শতকের বারো তেরো বছরে এসে আজ আমাদের আধুনিকতার রসদ খুঁজতে হবে জসীমউদ্দীনের কবিতার জগতে। দ্রুত নগরায়ন এবং শিল্পায়নের অমোঘ অগ্রসরে ‘মিউজিয়ম-পিস’হয়ে উঠছে বিলুপ্তপ্রায় বাংলার গ্রামীণ লোকজ ঐশ্বর্য। সত্যিই একদিন যদি দুর্ঘটনাক্রমে গ্রামীণ বাংলার এই সংস্কৃতি সম্পদ লুপ্ত হয়ে যায়, তাহলে আশার কথা, হয়তো তার সম্পূর্ণ সারণী পুনরাবিষ্কৃত হতে পারে জসীমউদ্দীনের কাব্যভুবন থেকে। আধুনিকতার আর এক প্রবণতা প্রবহমানতা। এই প্রবহমান আধুনিকতা তার শিকড় অভিলাষী চৈতন্যকে অস্বীকার করে না। তাই আমাদের ফিরে যেতে হয় বাউলের গানে। জসীমউদ্দীনের কবিতায়।
Excellent