প্রচ্ছদপ্রবন্ধআধুনিক কবি আল মাহমুদের কবিতার মায়াবী ভুবন

লিখেছেন : আবু রাইহান

আধুনিক কবি আল মাহমুদের কবিতার মায়াবী ভুবন

আবু রাইহান

“কোন এক ভোর বেলা, রাত্রি শেষে শুভ শুক্রবারে
মৃত্যুর ফেরেশতা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ;
অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে
ভালো মন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ।”

‘স্মৃতির মেঘলা ভোরে’ কবিতায় কবি আল মাহমুদ নিজেই চেয়েছিলেন স্বপ্নাচ্ছন্ন শুভ শুক্রবারে ভোরবেলা না ফেরার দেশে পাড়ি দিতে। কিন্তু তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তর’ এর বিখ্যাত ‘রাত’ কবিতার মতো রাতের নির্জনতায় পাড়ি দিয়েছেন তাঁর প্রিয় স্রষ্টার কাছে। “তীক্ষ্ণ চোখে অন্ধকার খুঁড়ে/ আমি তাই খুঁজি শুধু কোথা আছে ঘুমের আফিম/ আদিম ক্লান্তিতে যেটা আমার শরীর বেয়ে নামে/ অথবা বানিয়ে দেয় বিছানায় নিবিড় আরামে/ শিথিল দেহের তাপে ভরে ওঠে ঘুমের জাজিম।”কবি আল মাহমুদের জন্ম হয়েছিল ১৯৩৬ সালে তিতাস নদীর কূলে ঐতিহাসিক ভূখণ্ড ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে।
জীবনানন্দ দাশ পরবর্তী সময়ে বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি আল মাহমুদ। গত শতাব্দীর পাঁচের দশক থেকেই বিস্ময় জাগানো মৌলিক একটি কাব্য ভাষায় শুরু হয়েছিল তার কবিতা চর্চা। গত ছয় দশক ধরে তার কবিতার নতুন নতুন ভাবনা চমকে দিয়েছে কবিতার পাঠককে।রবীন্দ্র উত্তর আধুনিককালের কবিদের মধ্যে যিনি শব্দচয়নে, জীবনবোধে, শব্দালংকারের নান্দনিকতায়, বর্ণনায় অসামান্য আর ধ্রুপদী, তিনি কবি আল মাহমুদ।যিনি দীর্ঘ সময় ধরে কবিতার খাতায় এঁকেছেন বাঙালিয়ানার এক চিরায়ত ছবি। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিদের দলে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে এই কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কালের কলসের পরে ‘সোনালী কাবিন’ কাব্যগ্রন্থটি একটি মাস্টারপিস হিসেবেই সমাদৃত হয়েছে, এমনকি কবির একচোখা সমালোচক ও নিন্দুকদের মাঝেও। এই কাব্যগ্রন্থটি অনুবাদ হয়েছে অনেকগুলো ভাষায়। এতে প্রতিটি কবিতার শব্দ ব্যবহারের স্বতঃবেদ্য স্বাভাবিকতা এবং বিশ্বাসের অনুকূলতা নির্মাণে তিনি নিঃসংশয়ে আধুনিক বাংলা ভাষায় অন্যতম কবি। আর এমন কবিই উচ্চারণ করেন:

“আমরা তো বলেছি আমাদের যাত্রা অনন্ত কালের।
উদয় ও অস্তের ক্লান্তি আমাদের কোন দিনই বিহ্বল করতে পারেনি।
আমাদের দেহ ক্ষত-বিক্ষত,
আমাদের রক্তে সবুজ হয়ে উঠেছিল মূতার প্রান্তর।
পৃথিবীতে যত গোলাপ ফুল ফোটে তার লাল বর্ণ আমাদের রক্ত!”

উপরে উল্লেখিত সৃষ্টিতে বিশ্বাসীদের অনুভূতিকে কবি তার কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন আলোকিত চেতনার আবেগ। তার সেই চেতনাকে মূর্ত করেছেন শব্দে, অনুভূতির অবয়বে। কবিতায় ফুটে উঠেছে তার বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি, প্রকাশ পেয়েছে দৃঢ়তা আর জীবনের গন্তব্য, তাতে নেই সংশয়, শঙ্কা।
আধুনিক কবিতার একটি মৌলিক বিষয় শব্দের সমাহার বা চিত্রকল্পের ব্যবহার। এ ক্ষেত্রে আল মাহমুদ গ্রাম বাংলার সৌন্দর্যকে আশ্চর্য শক্তিময় শব্দ বিন্যাসে উপস্থাপন করেছেন। প্রখ্যাত সমালোচক অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায় বলেন, ‘সমকালীন যে দুজন বাঙালি কবির দুর্দান্ত মৌলিকতা এবং বহমানতা আমাকে বারবার আকৃষ্ট করেছে তাদের মধ্যে একজন হলেন বাংলাদেশের আল মাহমুদ, অন্যজন পশ্চিমবঙ্গের শক্তি চট্টোপাধ্যায়।’
আল মাহমুদ লোকজ অভিমুখে যাত্রা করে লোকায়ত বাংলার চিরায়ত শব্দ সুষমাকে আধুনিক বাক্য বন্ধনে উপস্থাপন করলেন। তার নির্মিত পটভূমির কেন্দ্রবিন্দু মানবতাই আত্মবিশ্বাস। জসীম উদ্দিন এবং জীবনানন্দ উভয়ের থেকে তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির কবি। কারও প্রতিধ্বনি নয়, নির্মীয়মাণ স্বকীয়তাই তাকে আধুনিক জগতে বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী করেছে। ক্রমশ হয়ে উঠেছেন আস্থাশীল এক কাপ্তান। আল মাহমুদই আমাদের বিপুল জনসমষ্টির জীবনধারার অভিজ্ঞতাকে কবিতায় ব্যবহার করেছেন:

“আমার বিষয় তাই, যা গরীব চাষির বিষয়
চাষির বিষয় বৃষ্টি ফলবান মাটি আর
কালচে সবুজে ভরা খানা খন্দহীন
সীমাহীন মাঠ।
চাষির বিষয় নারী।
উঠোনে ধানের কাছে নুয়ে থাকা।
পুর্নস্তনী ঘর্মাক্ত যুবতী।” (কবির বিষয়)

স্পন্দমান আবেগের ভূগোল, দেশজ চেতনা, লোককাহিনী ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সৌন্দর্যে আপ্লুত আল মাহমুদ একজন মিথলজিক্যাল রোমান্টিক কবি। যেমন তিনি তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ‘সোনালী কাবিন’ এ মাতৃভূমির ইতিহাস খনন করে তুলে এনেছেন ঐশ্বর্যময় ও বীর্যবান অনুষঙ্গসমূহ। তিনি এখানে শক্তিমত্তার সঙ্গে রোমান্টিসিজম প্রবেশ করিয়েছেন যা ‘সোনালী কাবিন’ সনেট গুচ্ছকে করেছে অন্যান্য।

“সোনার দিনার নেই, দেন মোহর চেয়ো না হরিণী
যদি নাও, দিতে পারি কাবিনহীন হাত দুটি
আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনকালে সঞ্চয় করিনি
আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি;
ছলনা জানিনা বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনি।”

আসলে ভালোবাসার মানুষের কাছে প্রিয়জনকে দিতে কোনো অর্থবিত্ত বা দেনমোহর গুরুত্ব বহন করে না, ভালোবাসা ছাড়া। তাই কবির এইসব পঙক্তিতে বিনয়ের উদার বটপাতায় ভেসে উঠেছে ভালোবাসার চিত্র। ‘সোনালী কাবিন’ সনেটগুচ্ছ কবি উপমা রূপকের চর্চার কুশলতার যে নিদর্শন রেখেছেন, আমাদের কবিতার ক্ষেত্রে তা নতুন এবং আন্তরিক সততায় উজ্জ্বল। গ্রামের মাটি থেকে বিচিত্র আকুল আগ্রহকে কবি উন্মোচন করেছেন, নদীর চরের প্রতি কৃষাণীর অধিকার প্রতিষ্ঠার রূপকল্পে প্রমাণিত হয়েছে নারীর প্রতি পুরুষের আকাঙ্ক্ষার ক্ষুধার্ত নদীর উপমায় নর-নারীর কামনার চিত্র। এইতো আমাদের আল মাহমুদ এবং তার গ্রামীণ প্রান্তরের উপঢৌকন যেখানে যৌনতার আন্তরিক অভিব্যক্তি ঘটেছে:

“বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল
পৌরুষ আবৃত করে জলপাইয়ের পাতাও থাকবে না
তুমি যদি খাও আমাকেও দিও সেই ফল
জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হবো চিরচেনা ” (সোনালী কাবিন)

কবি অতীত গৌরব, সাম্য মানসিকতা, ইতিহাস থেকে ঐতিহ্য, কাম থেকে প্রেম এবং কামকলার অভূতপূর্ব চিত্রায়নের সঙ্গে ধর্মের মিথলজিক্যালের ব্যবহার করেছেন। আল মাহমুদ মানুষের মানবিক মেধা ও মননের বিষয়গুলো খুব চমৎকারভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। কবির দৃষ্টিভঙ্গি যুগপৎ সমাজনিষ্ঠ।তিনি নারী নিসর্গ প্রেম ভালবাসায় নির্মাণ করেছেন নিজস্ব সৌধ।নর-নারীর যুথজীবন যাত্রায় নগ্নতা, রম্যতা, জীবন ঘনিষ্ঠতা অতি বাস্তব। এই বাস্তবতাকে উপমা চিত্রকল্পে যথার্থ করা, শব্দের এবং চিত্রের অর্থময়তা ও আনন্দময়তা যে কবি যতবেশি দান করতে পারেন নব নব শিল্প চিত্রণে সে তত বড় কবি, তত আধুনিক মানুষ।
বিপ্লবের ধারাতে না, বিবর্তনের প্রবাহমানতায় আল মাহমুদ তার কাব্যিক শক্তিও সুষমাকে উৎসারিত করেছিলেন।তিনি গ্রাম, নদী, চর ভূমি, মেঘমালা, সমুদ্র মেঘলা,পরিবেশ এবং বিপুল জনজীবনকে তার জীবনের সঙ্গে যোজনা করেছিলেন।সম্মিলন ঘটিয়েছেন মানুষের অতীত এষনা এবং অভিকাঙ্ক্ষাকে। প্রেম, প্রীতি, প্রণয় প্রতিটির প্রতিবিম্ব ভাসিত হয়েছে তার সমস্ত কাব্য ভুবনে! দেশ ও দেশমৃত্তিকার প্রকৃতি ও নিসর্গের চিত্র যেন তার জীবনের একান্ত দৃশ্যকল্প। জীবনবাদী ,মানবতাবাদি ,বহুমাত্রিক অনন্যপূর্ব আল মাহমুদ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের তার আর এক মহৎ কবি। তার কাব্যবোধ, লোকো চেতনাবোধ, নারী ভাবনা, দেশপ্রেম এবং জীবনবোধের বহুরৈখিক বোধ তাকে বিশ্বমানের কবিতে পরিণত করেছে।বাংলা কবিতার ইতিহাসে অত্যন্ত মেধাবী ও সংবেদনশীল কবি আল মাহমুদ আমাদের গর্ব। ‘সোনালী কাবিন’, ‘লোক লোকান্তর’, ‘কালের কলস’ এর কবি আল মাহমুদ ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠে’ কাব্যগ্রন্থে এসে বদলে গেলেন। তাঁর বিখ্যাত ‘সোনালী কাবিন’ কাব্যগ্রন্থের ‘প্রকৃতি’ কবিতায় যে কবি লিখেছিলেন–

‘কতদূর এগুলো মানুষ এগোল।
কিন্তু আমি ঘোর লাগা বর্ষনের মাঝে
আজ ও উবু হয়ে আছি! ক্ষীরের মতো গাঢ় মাটির নরমে
কোমল ধানের চারা রুয়ে দিতে গিয়ে
ভাবলাম এ মৃত্তিকা প্রিয়তমা কিষানী আমার।
বিলের জমির মত জলসিক্ত লজ্জায়
যে নারী উদাম করে তার সর্ব উর্বর আধার।’

কিংবা ‘কবিতা এখন কবিতায়’ লিখেছিলেন,–

‘কবিতা চরের পাখি, কুড়ানো হাঁসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস
মলিন মুখ বউটির দড়ি ছেঁড়া হারানো বাছুর
গোপন চিঠির প্যাডে নীল খামে সাজানো অক্ষর
কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার।’
সেই কবি তার ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠে’ কাব্যগ্রন্থের কবিতায় লিখলেন-
‘পৃথিবীর সর্বশেষ ধর্ম গ্রন্থ টি বুকের ওপর রেখে
আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম! হয় এ ছিল সত্যি কারের ঘুম।
কিংবা দুপুরে খাওয়ার পর ভাতের দুলুনি! আর ঠিক তখনই
সেই মায়াবী পর্দা দুলে উঠলো, যার ফাক দিয়ে
যে দৃশ্য চোখে পড়ে, তোমরা বল স্বপ্ন।’

কোরআন শরীফের নির্দেশিত পথ বেছে নিলেন কবি আল মাহমুদ।বিশ্বাস ও আত্মপ্রত্যয়ী ব্যতীত বলিষ্ঠ উজ্জ্বল কাব্য কবিতা রচনা করা অসম্ভব। বিশ্বাসের দীপ্তি প্রত্যেক কবির কাব্য ভবনে চন্দ্রালোকের উজ্জ্বল কিরণ বিকিরণ করে। কবি আল মাহমুদ ও বিশ্বাসের বৃত্তে আবর্তমান। আল মাহমুদ তার গদ্যগ্রন্থ ‘কবিতার জন্য বহুদূর’ এ বলেছেন- ‘আমি নিসর্গ রাজি অর্থাৎ প্রকৃতির মধ্যে এমন একটা সঙ্গুপ্ত প্রেমের মঙ্গলময় ষড়যন্ত্র দেখতে পাই যা আমাকে জগৎ রহস্যের কার্যকারণের কথা ভাবায়। এভাবেই আমি ধর্মে এবং ধর্মের সর্বশেষ এবং পূর্ণাঙ্গ বীজ মন্ত্র পবিত্র কোরআনে এসে উপনীত হয়েছি। আমি ইসলামকে আমার ধর্ম ইহলোক ও পারলৌকিক শান্তি বলে গ্রহণ করেছি। আমি মনে করি একটি পারমাণবিক বিশ্ব বিনাশ যদি ঘটেই যায় আর দৈবক্রমে মানবজাতির যদি কিছু অবশেষে চিহ্নমাত্র অবশিষ্ট থাকে। তবে ইসলামী হবে তাদের একমাত্র আচরণীয় ধর্ম। এই ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্যই আমার কবি স্বভাব কে আমি উৎসর্গ করেছি। আল্লাহ প্রদত্ত কোন মূলনীতি কেবল মানব জাতিকে শান্তি ও সাম্যের মধ্যে পৃথিবীতে বসবাসের সুযোগ দিতে পারে। আমার ধারণা পবিত্র কোরআন এই সেই নীতিমালা সুরক্ষিত হয়েছে। এই হল আমার বিশ্বাস। আমি এ ধারার একজন অতি নগন্য কবি’। আর ‘কবির আত্মবিশ্বাস’ পুস্তকে কবি লিখেছেন- ‘আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি জীবনের একটি অলৌকিক কিছু প্রাকৃতিক নিয়ম হিসেবে। মার্কসবাদ সম্বন্ধে বীতশ্রদ্ধ হয়ে। কারন আমার বিশ্বাস নাস্তিকতার ওপর মানবতা দাঁড়াতে পারে না, পারবে না।’
কবি আল মাহমুদের মৃত্যু(১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯) র পর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কবি মৃদুল দাশগুপ্ত লিখেছেন– ‘আমাদের কালের মহাকবি ছিলেন তিনি। তামাম বাংলা ভাষার কবি আল মাহমুদ প্রয়াত হলেন। ঝপ করে অন্ধকার নেমে এলো যেন মনে। বিশ্ব জগত মনে হল অন্ধকার। সেই আঁধারে, নিকষ আঁধারে ডানার শব্দ শুনতে পেলাম, দেখলাম ও শেত পোশাকের দেবদূতরা নেমে আসছেন, ওই তো রামধনুর সাতটি রঙের পথ চলে গেছে শূন্যে, স্বর্গের বেহেস্তের পথ ধরে চলে যাচ্ছেন, ছোটখাটো চেহারায়, কিন্তু পর্বতের চেয়ে উঁচু, উচ্চ শির ওই কবি। রোদন করছে সমগ্র সুন্দরবন। ধান ক্ষেত গুলিতে ঢেউ তুলে ঘুরছে ক্রন্দনরত বাতাসের দল। বছরের পর বছর বাংলাদেশে গিয়ে আল মাহমুদের নিগ্রহ দেখেছি। গণতান্ত্রিক মহল, স্বাধীনতার চেতনা সম্পন্ন অভিজাত কুল তাঁকে পরিত্যাগ করেছিল। আল মাহমুদ ছিলেন এক ঘরে। আল মাহমুদের প্রতি এই আচরণ যতনা সামাজিক-রাজনৈতিক, অতলে অনেক বেশি ছিল সাহিত্যিক ঈর্ষা। বামপন্থা থেকে তিনি ইসলামে আস্থা স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু তাঁকে ধর্মান্ধ মৌলবাদী আখ্যা দেওয়া হয়েছিল সাহিত্যিক ঈর্ষাতেই। ঔপনিবেশিকতার উদর সঞ্জাত বাংলা আধুনিক সাহিত্যে জীবনানন্দের বলয়ের দুই কবি আল মাহমুদ ও বিনয় মজুমদার সেই বৃত্ত ভেদ করে মুক্তির আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। বিনয় তার বিজ্ঞান ও গণিতের সংশ্লেষে, আল মাহমুদ তার লোকায়তে’।বারবার আল মাহমুদ এভাবে অভিযুক্ত হওয়াতে জিজ্ঞাসা পত্রিকার সম্পাদক শিবনারায়ণ রায় বলেছিলেন-‘আল মাহমুদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ আদতে সাহিত্যিক ঈর্ষা সঞ্জাত। আমার বিবেচনায় কবিরা কোন দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন না। তাঁরা ভাষার সন্তান। আল মাহমুদ বাংলা ভাষার কবি, যে ভাষা বিভক্ত হয় নি। তিনি আপামর বাংলার। সারা জীবনব্যাপী আল মাহমুদ বাংলা কবিতায় ভাটি বাংলার জনজীবন, নদী নির্ভর, জনপদ, গ্রাম, চর, জলার কর্ম মুখরিত জনচাঞ্চল্য, প্রেম-ভালোবাসা, সংগ্রাম মিশিয়েছেন। আমার বিবেচনায় তিনি হিন্দু সংস্কৃতির সঙ্গে তামাম বাংলার চর্চিত সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ইসলামী সংস্কৃতির মহা মিলন ঘটিয়ে দিয়েছেন। যে ঘাটতি ঐতিহাসিকভাবেই ছিল। আল মাহমুদই তার প্রথম মেরামতকারী।এই কর্মে তিনি বাংলা কবিতাকে সমৃদ্ধ করেছেন। সাবুদ হিসাবে আল মাহমুদ সহজভাবে ইসলামে আস্থা প্রকাশ করার ঢের আগেই তাঁর অতি বিখ্যাত ‘সোনালী কাবিন’ গ্রন্থের ১৩ সংখ্যক কবিতাটির কয়েকটি প্রতি তুলে ধরছি–

‘শুভ এই ধান দূর্বা শিরোধার্য করে মহীয়সী
আব্রু আলগা করে বাঁধো ফের চুলের স্তবক
চৌকাঠ ধরেছে এসে ননদীরা তোমার বয়সী
সমাগত হয়ে শোনো সংসারের প্রথম সবক
বধূবরণ এর নামে দাঁড়ায়েছে মহামাতৃকুল
গাঙের ঢেউয়ের মতো বল কন্যা কবুল কবুল।’

এই কবিতায় কোথায় হিন্দু সংস্কৃতির সঙ্গে ইসলামী সংস্কৃতির মিশেল পাঠক আপনাকে নিশ্চিত কি তা বুঝিয়ে দিতে হবে না। আল মাহমুদ ছিলেন একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কবি। অথচ তিনি একুশে পদক পান নি। এই আফসোস তাঁর সারা জীবন ছিল। সাহিত্যিক হুমায়ুন কবির তাঁর ‘বাংলার কাব্য’ নামক গ্রন্থে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার কবি প্রকৃতির একটি পার্থক্য চিহ্নিত করেছিলেন। লিখেছিলেন– ‘পশ্চিম বাংলার কবি মানসে এক ধরনের রহস্যময় উদাসীনতা, যেন এক বাউল মন। আর পূর্ব বাংলার কবি স্বভাবে রয়েছে অফুরন্ত প্রাণচাঞ্চল্য’। পূর্ব প্রান্তের সেই প্রাণপ্রাচুর্যের প্রধান কবি প্রতিনিধি আল মাহমুদ। আর তাঁর কবিতা সমগ্র বাংলাদেশের স্বরূপ ও চৈতন্যকে বিম্বিত করে। দেশ ও জনপদগুলি অতি আধুনিকতায় দীপ্ত তো হয়। কবিতার জন্য তাঁর অনন্ত পথ চলা।’
এক সাক্ষাৎকারে আল মাহমুদ জানিয়েছিলেন- ‘আমি মৌলবাদী কিনা জানিনা, তবে আমার ধর্মে আমি বিশ্বাস করি। একটা আধ্যাত্মিক শাসনের মধ্যে বাস করি। আমার একটি ধর্মীয় জগত আছে। এটাকে যারা মৌলবাদ বলছে বলুক। আমার কিছু যায় আসে না।’
আল মাহমুদ সুফি মানুষ। সোনালী কাবিন কাব্যগ্রন্থের কবিতা গুলিতে যে সাম্যের কথা বলা হয়েছিল, এই মিষ্টিক চৈতন্য তার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। আসলে কবি আল মাহমুদ নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন’ এমন এক কবিতালোক, যা অন্যদের মতো নয়। আল মাহমুদ রোমান্টিক কবি। রোমান্টিক কবি স্বভাবের বৈশিষ্ট্য হলো ঐন্দ্রজালিক কবি কল্পনায় অবস্তুগত সৌন্দর্য, রূপ, সুষমা ও আনন্দের অনুধ্যান করা।আল মাহমুদের প্রথম দিককার কাব্য কবিতায় দেহজ কামনা-বাসনার ও নারীর নগ্ন দেহের উত্তেজক বর্ণনা বহু রয়েছে। পরবর্তীকালে আল মাহমুদের চিন্তা চেতনার জগতে যখন পরিবর্তন ঘটে, তখন থেকে তাঁর কাব্যের উপজীব্য, রূপকল্প, চিত্রকল্প, উপমা ও প্রতীকের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে।
আল মাহমুদের কাব্যকর্মের প্রতি নিবিষ্ট দৃষ্টিপাত করলে কয়েকটি পর্যায় লক্ষ্য করা যায়। তাঁর ‘লোক লোকান্তর’, ‘কালের কলস’ ও ‘সোনালী কাবিন’ পর্যন্ত একটি পর্যায়। এখানে নারী ও প্রকৃতি একান্ত ভাবে তাঁর কবি কল্পনাকে প্রভাবিত করে রেখেছে।‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’, ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’, ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’, ‘আরব্য রজনীর রাজহাঁস’, ‘প্রহরান্তের পাশ ফেরা’, ‘এক চক্ষু হরিণ’, ‘মিথ্যেবাদী রাখাল’, ‘আমি দূরগামী’ এবং ‘দোয়েল ও দয়িতা’ পর্যন্ত কাব্যগ্রন্থের কবিতা আল মাহমুদ এর দ্বিতীয় পর্যায় বলা যায়। 1974 সালে কারাবাসের সময় থেকেই আল মাহমুদের চিন্তা-চেতনার যে পরিবর্তন সূচিত হয়, তার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় তার এই দ্বিতীয় পর্যায়ের কাব্য কবিতায়। তার এ পর্যায়ের কবি কর্মে ইসলামী ঐতিহ্য ,ভাবচেতনা ও বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান স্থান লাভ করেছে। কোরআনের আয়াত, বিভিন্ন কাহিনী চরিত্র এই পর্যায়ে কবি কল্পনায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু কোন ক্রমেই আদর্শিক চেতনা তার কবিতার শিল্পগুণ বিনষ্ট করেনি। বরং এই চেতনার ফলে বাংলা কাব্যে বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন নানা রূপকল্প, উপমা, অনুষঙ্গ যুক্ত হয়েছে।
দ্বিতীয় ভাঙ্গন কাব্যগ্রন্থে এসে আল মাহমুদ আবার বাঁক ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। ‘দ্বিতীয় ভাঙ্গন’, ‘নদীর ভিতরে নদী’, ‘উড়াল কাব্য’, ‘বিরাম পুরের যাত্রী’, ‘না কোন শূন্যতা মানি না’ কাব্যগ্রন্থ গুলিকে তার কাব্যকর্মের তৃতীয় পর্যায় বলা যায়। এ পর্যায়ে কবি আল মাহমুদ অধিকতর ঐতিহ্য সচেতন হয়ে উঠেছেন। মূলত তার চিন্তা-চেতনায় ইসলামের প্রভাব তাঁর কাব্য কবিতায়, তার প্রকাশ অধিকতর সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।আর সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাঁর বিশ্বানুভুতি। সোনালী কাবিন কাব্যগ্রন্থের পরবর্তী কালের সাহিত্যচর্চার সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে আল মাহমুদ বলেছিলেন, ‘সুফি মত আমার কবিতায় বিশেষ প্রভাব ফেলেছে। আর পবিত্র কোরআন আমার কবিতা লেখার প্রধান পাথেয়। ইসলাম আমি গ্রহণ করেছি। যা আমার জীবনের সকল সমস্যার সমাধান। আমি বিশ্বাস করি ইসলামী সাহিত্য আগামী দিনে সারা বিশ্বকে পথ দেখাবে’। কবি আল মাহমুদ কর্মমুখী ইসলামকে মর্মের সঙ্গে মেলান এক প্রকৃত সিদ্ধ সাধকের দক্ষতায়। আধুনিক সাহিত্য বিচার তত্ত্ব দিয়ে সাধনাকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। আল মাহমুদ এক মরমী সাধক,যিনি জানেন শব্দের নিহিত শূন্যতাকে। শূন্যতার অতীত মহাঅস্তিত্বকে ও। সোনালী কাবিন কাব্যগ্রন্থ থেকে বারুদ গন্ধি মানুষের দেশ কাব্যগ্রন্থ পর্যন্ত সেই মহা অস্তিত্বের সন্ধান। এ এক আধ্যাত্ম যাত্রা।
কবি আল মাহমুদ আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে, চেতনা ও বাকভঙ্গিতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি।তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি।তাঁর প্রকৃত নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। একাধারে তিনি কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্প লেখক, শিশুসাহিত্যিক ও সাংবাদিক। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তর’ সর্বপ্রথম তাঁকে স্বনামধন্য কবিদের সারিতে জায়গা করে দেয়। এরপর ‘কালের কলস’, ‘সোনালী কাবিন’, ‘মায়াবী পর্দা দুলে উঠো’ কাব্যগ্রন্থগুলো তাঁকে প্রথম সারির কবি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে।
আল মাহমুদ শুধু কবি হিসেবেই নয়, তিনি ছিলেন একজন শক্তিমান গাল্পিক,ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, গবেষক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক। ১৯৭৫ সালে তার প্রথম ছোটগল্প গ্রন্থ ‘পানকৌড়ির রক্ত’ প্রকাশিত হয়। ১৯৯৩ সালে বের হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘কবি ও কোলাহল’। তাঁর সৃষ্টির পরিধি সাহিত্যের বিশাল এলাকা জুড়ে। কিন্তু এত কিছু ছাড়িয়ে তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন কবি এবং শুধুই কবি।
বাংলা কবিতা যাদের হাত ধরে আধুনিকতায় পৌঁছেছে, কবি আল মাহমুদ তাদের অগ্রগণ্য। যেন ঐশ্বরিক মতা রয়েছে তাঁর কলমের কালিতে। আল মাহমুদের কলম বাংলা সাহিত্যকে করেছে আরো উর্বর। তাঁর লেখনীর ব্যতিক্রম স্বাদের জন্য তিনি বারবার আলোচিত হয়েছেন। হয়েছেন অসংখ্যবার পুরস্কৃত। মাত্র দু’টি কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। তার মাঝে ছিল সাড়া জাগানো সাহিত্যকর্ম ‘সোনালী কাবিন’।
কবি আল মাহমুদের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা-কবিতা, গল্প, উপন্যাসসহ শ’খানেকের মতো। কবিতা ছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে-পানকৌড়ির রক্ত, সৌরভের কাছে পরাজিত, গন্ধবনিক, ময়ূরীর মুখ, নীল নাকফুল, কলংকিনী জ্যোতির্বলয়, গন্ধ বণিক, সৌরভের কাছে পরাজিত, আল মাহমুদের গালগল্প ইত্যাদি ছোট গল্পগ্রন্থ।কাবিলের বোন, উপমহাদেশ, চেহারার চতুরঙ্গ, নিশিন্দা নারী ইত্যাদি উপন্যাসগ্রন্থ। পাখির কাছে ফুলের শিশুতোষগ্রন্থ। কবির আত্মবিশ্বাস,কবির সৃজন বেদনা, আল মাহমুদের প্রবন্ধগ্রন্থ।কবিতার জন্য বহুদূর, কবিতার জন্য সাত সমুদ্র ভ্রমণগ্রন্থ । আত্মজীবনী- যেভাবে বেড়ে উঠি,বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ।
আল মাহমুদ আমার স্বপ্নের মায়াবী কবি। আমার যাপিত জীবনে, আমার যে দুজন প্রিয় কবির কবিতা সারাক্ষণ জড়িয়ে রয়েছে, তার একজন হলেন কবি আল মাহমুদ এবং অন্যজন হলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। এ বাংলায় হরফ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত আল মাহমুদের শ্রেষ্ঠ কবিতার বইটি ছিল আমার যৌবনের কবিতা চর্চায় দৈনন্দিন দিনের সঙ্গী।আমার সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল আমার প্রিয় কবি আল মাহমুদের সঙ্গে জীবিত অবস্থায় অন্তত একবার দেখা করার। দীর্ঘ এক দশকের প্রচেষ্টার পর আমার সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছিল ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে। বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি প্রয়াত সাজ্জাদ কাদির প্রতিষ্ঠিত বাংলা কবিতা দিবসের অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠের আমন্ত্রণে বিশিষ্ট কবি ও কথা সাহিত্যিক আব্দুস শুকুর খান এবং কবি তাজিমুর রহমান এর সঙ্গী হিসাবে ঢাকা গিয়েছিলাম। আমাদের তিনজনেরই মানের প্রবল ইচ্ছে ছিল কবি আল মাহমুদের সঙ্গে একবার দেখা করা।কিন্তু বাংলাদেশে যাওয়ার পর খবর পেয়েছিলাম খুবই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তাই আশঙ্কায় ছিলাম শেষ পর্যন্ত আমাদের আশা পূর্ণ হবে কিনা। ঢাকায় আমাদের সারাক্ষণ এর ভ্রমণ সঙ্গী ঢাকার কলেজ পড়ুয়া কবিতা লেখা যুবক এবং প্রতিশ্রুতিমান আবৃত্তিশিল্পী শেখ সাদী মারজান আমাদের আশ্বস্ত করে, সে খোঁজ নিয়ে জেনেছে কবি হাসপাতাল থেকে এখন বাড়ি ফিরেছেন। কবি তখন তাঁর বড় ছেলের বাসায় ছিলেন।প্রথম কয়েক দিন সাহিত্য সভার ব্যস্ততার পর মারজান পথ প্রদর্শক হয়ে ঢাকার মগবাজারে কবির কাছে আমাদের নিয়ে গিয়েছিল। তখন দুপুরের সময়, বাসায় গিয়ে জানতে পারলাম কবিকে তখন তাঁর বড় বৌমা স্নান করাচ্ছিলেন। কিছুক্ষণ ড্রইং রুমে অপেক্ষা করার পর কবির বড় ছেলে আমাদের চারজনকে কবির বেড রুমে নিয়ে গেলেন। কবি আল মাহমুদের বার্ধক্যের জরাজীর্ণ চেহারা দেখে মনে মনে খুবই কষ্ট পেলাম। হরফ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত তার শ্রেষ্ঠ কবিতার পুস্তকে বাংলা কবিতার যুবরাজের যে ছবি আমার হৃদয়ে অঙ্কিত হয়েছিল, সেই ছবির সঙ্গে কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না। যৌবনের সুদর্শন সেই কবি আজ সময়ের অভিঘাতে বার্ধক্যে পৌঁছে কেমন শীর্ণ হয়ে গিয়েছেন। বিছানায় কবির পাশে নিবিড় ভাবে বসে কবির হাত দুটি নিজের হাতে তুলে নিলাম! স্বপ্নীল আবেগে ভেসে যাচ্ছিলাম! এই সেই হাত যে হাত দিয়ে বেরিয়েছে সোনালি কাবিনের কবিতা! কবির হাতে আমার তখনো পর্যন্ত প্রকাশিত একমাত্র কাব্যগ্রন্থ নিষিক্ত ভালোবাসা তুলে দিলাম। কবি বইটি হাতে নিয়ে অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে চাইলেন। কবি অনেকক্ষণ নীরব থাকার পর কেবল একটি কথাই বললেন, কি করব। বুঝতে পারছিলাম এটি কবির যন্ত্রণাময় উপলব্ধি। অনেকদিন ধরেই পড়ার দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। গুনআগ্রহী অনুজ কবিরা এসে প্রাপ্ত পুস্তক গুলি থেকে কবিতা পাঠ করে শোনালে, তবে তিনি কবিতা পড়তে পারেন। কবিকে বললাম, আপনি আমার কবিতা লেখার অলিখিত গুরু। আপনার হাতে আমার কবিতার বই তুলে দিতে পারলাম এতেই আমার জীবন সার্থক বলে মনে করছি। প্রায় আধা ঘন্টার মত কবির বেডরুমে কবির সঙ্গে একান্ত একান্তে কাটিয়েছিলাম,যা আমাদের আজীবনের স্বর্ণালী স্মৃতি হয়ে আছে। যখন ফিরে আসছিলাম তখন একই সঙ্গে আমাদের মন জুড়ে ছিল আনন্দ ও বিষাদ এর এক অদ্ভুত অনুভূতি।কবি আল মাহমুদ এক সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করা হয়েছিল আপনি কি সুখী? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন-‘ না আমি সুখী না, আমি এ জীবনে পরিতৃপ্ত। সুখী হওয়া বিষয়টি আর্থিক সামর্থের উপর নির্ভর করে। আর পরিতৃপ্ত হওয়া বিষয়টি নিজস্ব স্বপ্নের বাস্তবায়নের উপর নির্ভর করে। আমি কবি হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম কবি হয়েছি। আমি যা লিখতে চেয়েছিলাম তা লিখতে পেরেছি। তাই কবি হিসাবে আমি পরিতৃপ্ত’। কবি আল মাহমুদ পরিতৃপ্তির বিশ্রাম নিতে অনন্ত শূন্যে মিলিয়ে গিয়েছেন। আর আমরা যারা তার গুণগ্রাহী পাঠক তাদেরকে রেখে গিয়েছেন অপরিতৃপ্তির গভীর অন্ধকারে।

আবু রাইহান। কবি ও প্রাবন্ধিক। পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা