ওমর বিশ্বাস
বাংলা সাহিত্যে আবদুল মান্নান সৈয়দের অবস্থান অনিবার্য। বহুমুখী প্রতিভার মধ্যে তিনি ছিলেন অত্যন্ত ছন্দ সচেতন। ছন্দ বিষয়ক “ছন্দ” নামে তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বই আছে। এরকম একজন গুণী ব্যক্তির সাথে আমার সাহিত্যে নানাবিষয় নিয়ে বিভিন্ন সময় আলাপ করার সৌভাগ্য হয়েছে। আমাদের সম্পর্ক ছিল শ্রদ্ধা ও স্নেহাশিসের।
তার পাণ্ডিত্য নিয়ে কারো মনে কোনো প্রশ্ন থাকার কথা না। তিনি সাহিত্যকে উচ্চমার্গে নিয়ে গেছেন। এবং নিজের নিবদনকে সর্বজনগ্রাহ্য করে তুলেছিলেন। এরকম শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তির সাথে পরিচয় সত্যি সৌভাগ্যের।
তবে এখানে তার সাহিত্যকর্মের একটি ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করা। বিষয়টা অনেকেরই কাজে লাগবে বলে আশা করি। মানুষ হিসেবে আবদুল মান্নান সৈয়দেরও ভুল হতে পারে। ভুল হওয়াই স্বাভাবিক। এর একটি ব্যাখ্যা থাকলে ভুল বোঝাবুঝির অবসান হতে পারে। এরকমই একটি ভুলের প্রতি আমি একদিন বিনয়ের সাথে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম।
তিনি তার ছন্দের বইতে ‘কবিতা’ ও ‘নজরুল’ শব্দের ছন্দের বিশ্লেষণে সিলেবলের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘ক’, ‘বি’, ‘তা’ – তিনটিই রুদ্ধ সিলেবল। নজরুল শব্দে ‘নজ’ ও ‘রুল’ দুটিই মুক্ত সিলেবল। কিন্তু তার এই ব্যাখ্যা নিয়ে খটকা লেগেছিল মনে। এটা কি ভুল না কি ঠিকই আছে? তার মতো ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের পক্ষে ভুল হবে কি? এই প্রশ্ন আমার ছিল অনেকদিনের। একদিন তার সাথে এ বিষয়ে আলাপ হয়ে যায়।
আমি সরাসরি আবদুল মান্নান সৈয়দকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। এটা উনার ভুল। উনি প্রথমে বুঝতে পারেননি আমার কথা। পরে ব্যাখ্যা দিলে ভালো করে মনোযোগ দিয়ে দেখেন। বলেন, উনারই ভুল হয়েছে। এরপর একই বইয়ের ৩২ পৃষ্ঠায় স্বরবৃত্তের মাত্রা বিশ্লেষণেও ভুল আছে। সেটাও উনার দৃষ্টি আকষর্ণ করা হলে তিনি সুন্দরভাবে নিয়েছিলেন। রাগের পরিবর্তে প্রশংসা করেছিলেন। স্বভাবসুলভ হো হো করে হেসে বলেছিলেন, ওমর তো ভালোই ছন্দ শিখেছ। বাহ! তুমি ঠিকই ধরেছ। এটা আমি নোট করে রাখছি। পরের সংস্করণে ঠিক করে নেব। তিনি রাগ করেননি। উল্টো খুশি হয়েছিলেন। কেননা তিনি আমাকে ও আমার ছন্দ সম্পর্কে জানার আগ্রহের বিষয়টি জানতেন।
ছন্দ সচেতন হয়েও মানুষের ভুল হতে পারে। কেউই ভুল-ত্রুটির উর্ধ্বে নয়। এটা নিছক ভুল। অনিচ্ছাকৃত ভুল। এই ভুল ধরানোকে তিনি স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিলেন। সরল স্বীকারোক্তি ছিল তাতে।
আমার দৃষ্টি আকর্ষণেরর বিষয়টি শুনে তিনি ‘রানু’ বলে ডাক দিলেন। ভাবিকে তিনি রানু বলে ডাকতেন। ভাবি আসলে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বললেন বইটির কোথায় আছে এবং বের করে দিতে। বইটি খুলে মনোযোগ দিয়ে বিষয়টিকে তিনি ভুলই বলেছিলেন।
আবদুল মান্নান সৈয়দ তখন থাকতেন ৫২ গ্রিন রোডের পৈতৃক বাড়িতে। তিনতলা সেই বাড়িটা এখন আর নেই। এখন সেখানে ডেভলপার দিয়ে বহুতল ভবন করা হয়েছে। সেদিন তার বাসাতেই কথা হয়। আমাদের দীর্ঘ এক আড্ডা হয়েছিল। মাঝেমধ্যেই এরকম আড্ডা হতো। আরো অনেক আগে এরকম আড্ডা ছিল নিয়মিত। তিনি সবক্ষেত্রেই স্বতঃস্ফূর্ত আড্ডার ক্ষেত্রেও তিনি স্বতঃস্ফূর্ত। এসব নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলাম “প্রাণবন্ত সৈয়দ” নামে।
সেদিন আড্ডাপ্রেমিক মান্নান সৈয়দের সাথে নানাবিষয়ে কথা হচ্ছিল। রবীন্দ্রনাথ নজরুল চর্চা, তাদের গান, লেখক, গবেষক, গানের শিল্পীদের বিষয়েও তিনি তাঁর কথা বলে যাচ্ছিলেন। কাদের কী ভূমিকা, কারা এব্যাপারে যোগ্য-অযোগ্য, নিজের কথায় জানালেন। রবীন্দ্রনাথের উপর তার লিখিত একটি বইয়ের উপরও আলোকপাত করেছিলেন। এদেশের রবীন্দ্র-নজরুল চর্চার উপর নিজের কথা বলেছিলেন। তার বলার ঢঙে আত্মবিশ্বাস থাকে। আমি পুরো সময়টিতে প্রত্যয়ের সাথে আত্মবিশ্ববাস লক্ষ করেছি।
ঘটনাটা আজ থেকে আনুমানিক ১৯-২০ বছর আগের। এই বইটা আমি কিনেছিলাম ১৭.০২.২০২১ তারিখে বইমেলা থেকে। বইটি পড়ার পর আবদুল মান্নান সৈয়দের সাথে কথা হয়। এই বইটি অবসর থেকে প্রথম সেবারই বের হয়। এর আগে বইটি একই নামে, “ছন্দ” নামে বাংলা একাডেমি থেকে বের হয়েছিল। বছর কয়েক আগে বাংলা একাডেমির সংস্করণ বইটি আমি ফুটপাতে দেখেছিলাম। বইটির প্রতি আমার দীর্ঘদিনের আগ্রহ ছিল। তবে তার আগেই অবসরের বইটি হাতে আসায় বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বইটি আর সংগ্রহ করা হয়নি। তবে “ছন্দ” বইটি সবার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত।
সেদিন বন্ধের দিন ছিল। দুপুর পর্যন্ত আমাদের আড্ডা হলো। আমার নাম ধরে ভাবিকে নাস্তাপানি দিতে বলেছিলেন। কেউ গেলে তিনি এভাবেই বলতেন।
আমার সৌভাগ্য আমার সাথে উনার দারুন সম্পর্ক ছিল। উনার সাথে আমার বেশ কিছু স্মৃতি আছে।