প্রচ্ছদপ্রবন্ধআমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা

লিখেছেন : নাজিয়া ফেরদৌস

আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা

নাজিয়া ফেরদৌস*

কালোত্তীর্ণ কবিতা সবসময়ই সাম্প্রতিক বৈশ্বিক ভাবনাকে লালন করে রচিত হয়। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বমানবের অভিন্ন ডাক শুনতে পেয়েছিলেন বলেই তাঁর কবিতা আজও প্রতিটি ক্ষেত্রে সমান গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়। একুশ শতকের কবিরা আধুনিকতার থেকে উচ্চতর ভাবধারাকে লালন করেন বলে তাঁদের কবিতায় পাওয়া যায় আর্ন্তজাতিকতা এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের ভিন্ন চিত্র। তাঁদের দেখার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ নতুন এবং এর প্রকাশও বিচিত্র। আশির দশকে কাব্য জগতে প্রবেশের প্রস্তুতি গ্রহণ করলেও কবি আমিনুল ইসলাম প্রতিষ্ঠা লাভ করেন নব্বই এবং শূন্য দশকে এসে। শূন্যের দ্বিতীয় দশক বা একুশ শতকের কবিদের মাঝেও তাঁকে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো চিহ্নিত করা যায়। তাঁর কবিতায় বিশ্ব ও আর্ন্তজাতিক প্রেক্ষাপট ভিন্ন দৃষ্টিতে বর্ণিত হয়েছে। সাম্প্রতিক কালের কবিদের মতো তিনি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখে কেবল আত্মকোটরের স্বগত উচ্চারণে বন্দি থাকেননি। আধুনিকতা, উত্তরাধুনিকতা, শিল্পের জন্য শিল্প– এসব তত্ত্ব মনে রেখেও তিনি কবিতায় কাব্যবোধ ও শিল্পবোধের সাথে বিশ্বপ্রেমী দায়িত্ববোধের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। এখানেই তিনি কবি হিসেবে সমসাময়িকদের থেকে নিজেকে স্বতন্ত্র মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। আমিনুল ইসলামের কবিতা পাঠ করতে গিয়ে বারবার মনে আসে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুটি লাইন, ‘আমি পৃথিবীর কবি, যেথা তার যত উঠে ধ্বনি / আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনি-’।(ঐকতান)১ আমিনুলের ‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি’, ‘ব্লু-মাউন্টেনে দাঁড়িয়ে’, ‘তুর্কি মেয়ের জন্য’, ‘ ইস্তাম্বুলের ই-মেইল’, ‘পিছিয়ে যাওয়া মানুষ’, ‘আমার শরৎ দিন বিলি কাটে আকাশের চুলে’, ‘আঁধারের জানালায়’, ‘বিপিএটিসি তোমাকে’, ‘সভ্যতার সংঘর্ষ’, ‘ভালোবাসার পদাবলি’,‘ আমাদের ভালোবাসার দিন’, ‘প্রেম অথবা প্রার্থনা’ একাকী, অবরণ্যে’, ‘জঙ্গলায়ন’, ‘নেফারতিতির সঙ্গে’, নাফ নদীর তীরে দাঁড়িয়ে’, ‘অভিবাসীর গান’, ‘অভিবাসী চিরদিন’ এবং এমন আরও অনেক কবিতায় বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট চিত্রিত হয়েছে তার অতীত, বর্তমানসহ। তাঁর কবিতায় মিশরের নীল, ইংল্যান্ডের টেমস, ইটালির পো, থাইল্যান্ডের কাওয়াই, ভারতের যমুনা, পাকিস্তানের সিন্ধু, ইরাকের শাতিল আরব প্রভৃতি নদী, অস্ট্রেলিয়ার ব্লু মাউন্টেন, নেপালের হিমালয়, ভারতের কাঞ্চনজংঘা, বিন্ধ্যা, তুরস্কের কৃষ্ণসাগর, মর্মর সাগর, বসফোরাস প্রণালী এবং বহু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম ব্যবহৃত হয়েছে। আন্তর্জাতিক ভূগোলের প্রচ্ছদে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের প্রচুর সংখ্যক সফল কাব্যিক ছবি এঁকে আমিনুল ইসলাম নিজেকে তাঁর সমসাময়িক কবিদের থেকে আলাদা করে তুলেছেন এবং কবি হিসেবে নিজের অবস্থানকে উচ্চে উন্নীত করেছেন।

আমিনুল ইসলাম শিকড়সন্ধানী কবি। তিনি স্বজাতির শিকড় সন্ধানের পাশাপশি বিশ্বমানুষের শিকড়ের সন্ধান করেছেন। তিনি বর্তমান সভ্যতার সঙ্গে অতীতের সভ্যতার যোগসূত্র আবিস্কার ও প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন; ফারাও যুগের নেফারতিতির সঙ্গে বর্তমান সময়ের সুন্দরী বাঙালি নারীর যোগসূত্র প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস পেয়েছেন। অতীতে আজকের অস্ত্রহাতে পাহারাঘেরা কাঁটাতার বেষ্টিত রাষ্ট্রীয় কৃত্রিম সীমান্ত ছিল না। তখন মানুষ মুক্তভাবেই পৃথিবীর আনাচেকানাচে ভ্রমণ করতে পারতো। তখন সাইবেরিয়ান হাঁস আর মরক্কোর ইবনে বতুতা সমান স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়াতে পারতো বিশ্বময়। তখনও আন্তর্জাতিক ব্যবসা বাণিজ্য ছিল। আমিনুল তাঁর কবিতায় বিশ্বসভ্যতার শিকড়কে খুঁজে পেতে চেয়েছেন তার সবখানি গৌরব ও উজ্জ্বলতাসহ।

‘————-অনেক বছর আগে এ শহর ছিল প্রেম ও প্রাণের
ঠিকানা; কিছুটা পিছিয়ে হয়তোবা তারা ছিল প্রস্তরযুগের মেধা;
সত্য তবু- শুধুই শিকারি নয়,- সদাগর ছিল তারা- আর ছিল
মৃত্তিকার ব্যবহারে দক্ষ কারিগর; চোখ বুজে দ্যাখো- শহরের
কোলঘেঁষা বিস্তীর্ণ বন্দরে শরতের সোনালি প্রভাতে নোঙর
করেছে কত বিদেশি জাহাজ; মাল নিয়ে আবার দিয়েছে পাড়ি
সুদূরের রোমান সাম্রাজ্য কিংবা স্বল্পদূরের শ্যামদেশ; রাতের
তারারা দিনের ইশারা হয়ে হেসেছে আকাশে। এই যুগের
বিশ্ববাণিজ্য তবে অভিনব নয়-যেমন নতুন নই আমি-তুমি
অথবা সুমনা।
(পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি, পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি)২

আমিনুল ইসলাম কাব্যভাবনায় একজন বিশ্বপর্যটক। তিনি পৃথিবীর কোথায় কি ঘটছে সেদিকে তীক্ষ্ণ ও জাগ্রত দৃষ্টি মেলে রাখেন। তিনি আন্তর্জাতিক অর্থনীতি, সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও তার কুফল ইত্যাদি বিষয়ে একজন নির্মোহ চিন্তকের দৃষ্টির অধিকারী। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করতে গেলে আমিনুল ইসলামের কবিতায় প্রথমেই চোখে পড়ে অর্থনৈতিক সচেতনতার ছবি:

‘সোমালিয়া থেকে সুদান, ইরাক থেকে ইথিউপিয়া-
কংকালের চিত্রকল্প হয়ে শুয়ে আছে অনাহারী নদী-
পিঠের নিচে প্রচ্ছদ শোষিত সভ্যতার ধূসর জনপদ;
কণ্ঠে কাঁপা অস্পষ্টতা স্টিফেন হকিন্সের ভাবনার মতো
বাতাসের অনুবাদে বেজে ওঠে ইথারে-
‘শূন্য হতে ফেলে-দেয়া রিলিফজলের তামাশা নয়,
পিপাসার বুক ভরে ভালোবাসার তুমুল বৃষ্টি চাই- বৃষ্টি!’
(আমি কান পেতে রই, মতিহারী ভালোবাসা)৩

নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন ‘সম্মান তাদের প্রাপ্য, যারা কখনো সত্যকে পরিত্যাগ করে না, এমনকি যখন পরিস্থিতি অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং বেদনাদায়ক।’ আমিনুলের কবিতায় সেই যুগসত্যের পরিচয় মেলে। তিনি তাঁর কবিতায় বিশ্বত্রাতা হিসেবে পরিচিত প্রকৃত খলনায়কদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন। দেশের সঙ্গে বহির্বিশ্বের স্বার্থবাদী চুক্তির দিকে আঙুল তুলেছেন। বিশ্বকে হাতের ইশারায় চালানো আর্ন্তজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নোংরা অপতৎপরতার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন কিন্তু কখনই সত্য থেকে বিমুখ হননি। কবি জানেন আজ দেশে দেশে পুঁজিবাদের বাগান। বিশ্ব রাজনীতি এখন নির্ভর করছে গুটিকতক ক্ষমতাশীল রাষ্ট্রের অঙ্গুলি সংকেতের ওপর। মানুষের কোনো মূল্য তাদের কাছে নেই। তারা চেনে ক্ষমতা এবং অর্থ। ধনবাদ নিয়ন্ত্রিত বিশ্বসভ্যতার কাছে আজ জিম্মি হয়ে পড়েছে মানুষ ‘কারণ আলোকায়নের টাই পরে / আর্ন্তজাতিক ডাকাতির জন্য মন্ত্রণালয় আছে, /ইথনিক ক্লিনজিং আর গণহত্যার জন্য মন্ত্রণালয় আছে,’ (বঙ্গোপসাগরের দুই পাড়ে)৪ বৈশ্বিক রাজনীতির নীলনক্সার ফাঁদে পা দিয়ে ক্রমে আমরা জড়িয়ে যাচ্ছি নতুন দাসত্বে। বিশ্বের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শক্তিসমুদ্রে থেকেও হয়ে পড়ছি শক্তিহীন এবং আত্মবিশ্বাসের অভাবে আত্মপরিচয়হারা। অনেকেই গোষ্ঠীতন্ত্রের বৃত্তে আবদ্ধ হয়ে হারিয়ে ফেলছে মানবতা। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক হিংসার আগুনে দগ্ধ শিশু, বৃদ্ধ, কিশোরের পালিয়ে আসা চোখে কবি দেখেন আজরাইল দেখা আতঙ্ক। দেশে দেশে যুদ্ধবিধ্বস্ত শিশুদের কান্না, ধর্ষিতা নারীদের চিৎকার, আহত স্বজনদের যন্ত্রণা কোনো বিশ্ব নেতার কানে পৌঁছায় না। কবির ভাষায় : ‘হায়, এই আধুনিক বর্বরতা থামানোর নেই কোনো জোট / নেই কোন সম্মেলন প্রতিরোধ ঘোষণার / জাতিসংঘ- সমকামিতায় আসক্ত হয়ে ভুগছে ধাতুদুর্বলতায়।’ (নাফ নদীর তীরে দাঁড়িয়ে)৫ পুরো পৃথিবী যখন জ্বলছে অমানবিকতার আগুনে তখন মানবতার ঝাণ্ডা ওড়ানোর জন্য নেই কোনো সংঘ কিংবা পদক্ষেপ। বৈশ্বিক মহামারি রূপে মানব সভ্যতাকে গ্রাস করেছে ক্ষমতার লোভ। সাম্রাজ্যবাদ তার ছায়া বিস্তার করে চলেছে নিত্য নতুন রূপে। কবি আমিনুল এই বিষয়ে সক্রিয় শিল্পী। এ প্রসঙ্গে বীরেন মুখার্জীর বক্তব্য স্মরণযোগ্য :

“তিনি তাই সব ধরনের কুটিলতা, ষড়যন্ত্র এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন। জাগতিক অন্যায় অপকর্মের বিপক্ষে কবি বিপ্লব করেছেন।” (আমিনুল ইসলামের কবিতা : শিল্পপ্রজ্ঞা ও বিশ্বায়নের মিথষ্ক্রিয়া / কবিতার শক্তি)৬

বৈশ্বিক অপতৎপরতার পর্দা তিনি সরিয়ে দিয়েছেন সাহসিকতার সঙ্গে। সাম্প্রতিক বিশ্বের ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা কবিকে ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত করে। তিনি বিশ্ব সভ্যতার পতন দেখতে পান চোখের সামনে। মানবিকতার ভূলুণ্ঠিত চেহারা ভেসে উঠে তাঁর কবিতায়। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি অবিচারে কবি বাকরুদ্ধ হয়ে যান। অবাক হয়ে দেখেন বিশ্ববাসীর মৌনতা। তাঁর মনে হয়: ‘লোনা চোখে দেখে তা আহত নাফ / গুপ্ত পরিকল্পনার চোখে চায় পড়শি জঙ্গল / আর পর্দা প্রাচীর উঠিয়ে দেখে তা অমনুষ্যত্বে / বিভাজিত জাতিসংঘের পর্দাহীন চোখ।’(বঙ্গোপসাগরের দুই পাড়ে)৭ দেশহারা রোহিঙ্গা নারী, শিশু, যুবক, বৃদ্ধের অসহায়ত্ব পীড়া দেয় কবির হৃদয়কে। গেরুয়া বসনের অধিকারী না হওয়ায় আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়তে হয় তাদের, দেখতে হয় জলন্ত সুখের পৃথিবী। কবির সভ্যতার এমন অধঃপতন দেখে বলতে বাধ্য হোন: ‘হায় সভ্যতা, মুখোশ বানানোর গর্বে এতটা মাতাল তুমি।’ (অন্ধকারের এক্সরে রিপোর্ট)৮ কবি বোঝেন বিশ্বরাজনীতির গায়ে আজ দুর্গন্ধের ছত্রাক বাসা বেঁধেছে। সবাই এখন কেবল ভোগের উদ্দেশ্য নিয়ে পথ চলে। বিশ্ব সভ্যতার নিয়ন্তা থেকে শুরু করে গরিব দেশের পাতি নেতাদের মধ্যেও লোভের হিংস্র জিভ বিস্তার লাভ করেছে। তাদের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে শান্তিপ্রিয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ও মানবিক সভ্যতা। কবি আমিনুল ইসলাম লোভ নিয়ন্ত্রিত সভ্যতার এই লুকায়িত রূপ উন্মোচনে সচেষ্ট।

‘পেন্টাগনে ক্রিয়াশীল আঁধারের রাত
ডেভিলের ওয়ার্কশপ চালু পুরোদমে
আলোকের ছাদে হবে তামস আঘাত

আণবিক মসলার ঘ্রাণ ওঠে জমে।’

গুয়ান্তোনামোয় থির সূর্যহীন রাতে
সভ্যতা কঁকিয়ে ওঠে বর্বর আঁধারে
শৃখলিত আর্তনাদ বিপন্ন ভাষাতে
বেজে ওঠে বাদুড়ের বিস্মিত রাডারে।’
(আঁধারের জানালায়, স্বপ্নের হালখাতা)৯

আমিনুল ইসলামের কবিতায় বিশ্বত্রাতার নামধারী জাতিসংঘের মুখোশ উন্মোচিত হয় এভাবে : ‘বীর্যহীন জাতিসংঘ- তার মুখে সাদা কথা নেই / কাজির কুরসিতে বসে পাঠ করে লিখে দেয়া রায়।’ (সভ্যতার সংঘর্র্ষ-দুই)১০ আমিনুল ইসলামের ‘সভ্যতার সংঘর্ষ’ কবিতাটি তার বৈশ্বিক চেতনা ও শৈল্পিক প্রজ্ঞার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। পরিহাস, স্যাটায়ার, দেশি-বিদেশি শব্দ, নগর ও প্রকৃতির সাম্প্রতিক অনুষঙ্গ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত বিষয়াদির অবতারণা প্রভৃতি কবিতাটিকে একটি মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায় ঋদ্ধ করেছে। কবিতাটি নিয়ে প্রখ্যাত গবেষক কবি কাবেদুল ইসলামের ‘আমিনুল ইসলামের কবিতা ‘সভ্যতার সংঘর্ষ : সাম্রাজ্যবাদের মুখোশ উন্মোচন’ শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করা যেতে পারে:

‘প্রসঙ্গত, কবিতাটির নামকরণ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন (Samuel P.Huntington) Gi The Clash of Civilizations and the Remaking of World Order গ্রন্থের কথা, যেটির অন্যতম প্রতিপাদ্য মুসলিম বা ইসলামী সভ্যতার সঙ্গে তথাকথিত উন্নত ও প্রগতিশীল পাশ্চাত্য সভ্যতা, যার অন্যতম ভিত্তি ও উপাদান ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুষঙ্গ এবং চীন/চিন ও জাপানি (মনে রাখতে হবে এ দুটি দেশের মানুষের আচরিত অন্যতম ধর্ম বৌদ্ধধর্ম) ও ভারতীয় তথা হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্মকেন্দ্রিক সভ্যতাগুলোর অনিবার্য সংঘর্ষের প্রেক্ষাপট, কারণ ও স্বরূপ বিশ্লেষণ। বস্তুত তৃতীয় বিশ্বের গরিব ও অনগ্রসর দেশগুলোকে ছলে-বলে কৌশলে পুরোপুরি ‘তাঁবে’ বা কব্জায়-নিয়ন্ত্রণে এনে তাদের ভূগর্ভস্থ প্রাকৃতিক সম্পদ (‘তরল সোনা’ বলে পরিচিত অপরিশোধিত তেল, গ্যাস ও আনুষঙ্গিক দ্রব্যনিচয়) কুক্ষিগত করে নানাভাবে ভোগ করার যে নিশ্ছিদ্র ব্যবস্থা তারা মধ্যপ্রাচ্যে গড়ে তুলেছে, যেমন মরুভূমিতে পাইপলাইন স্থাপনের মাধ্যমে এবং সমুদ্রপথে ট্যাঙ্কার ভর্তি করে তেল নিয়ে গিয়ে স্বদেশের তথা নিজেদের প্রয়োজন মিটানো, সেটি যেমন এতে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে, তেমিন এর বিপরীতে পশ্চিমা দেশগুলো নিজের দেশের (এক্ষেত্রে আমেরিকার কথাই সর্বাগ্রে আসে) এ জাতীয় প্রাকৃতিক সম্পদ ভবিষ্যতের প্রয়োজন মিটানো ও ভোগ-বিলাস নিশ্চিতকরণার্থ ভূগর্ভে অনুত্তোলিত বা অব্যবহৃত রেখে দিয়েছে– এই বাস্তব চিত্রও কবি পঙক্তিবদ্ধ করেছেন।’’ (নদীকথা ও অন্যান্য প্রবন্ধ, কাবেদুল ইসলাম)১১

বিশ্ব নেতাদের লোভ উৎসারিত স্বেচ্ছাচারিতার হাতে বলি হতে থাকে সবুজ দেশ, ইতিহাস, ঐতিহ্য। যদিও লোকসম্মুখে ‘সত্য বলা যাবে না- এমন কোনো কথা নেই সত্যের বিশ্বঠিকাদার ন্যাটোর / ঘোষণায় কিংবা দশমুখে কথা বলা তথ্য মন্ত্রকের প্রজ্ঞাপনে;’ (সত্য বলা না-বলা)১২ তারপরেও সত্য বলা এ-যুগে ঘোর অপরাধ। কোনো গরু মার্কা, দুম্বা মার্কা সত্য বলা এখানে মানা। তবে মিথ্যাকে বাঁচাতে শেয়াল মার্কা সত্য বলা যেতে পারে বলে কবি ব্যঙ্গ করেন। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ কিংবা অন্য বিশ্ব সংস্থাগুলোর স্বার্থপরতার কথা তুলে আনেন কবি আমিনুল ইসলাম। তিনি চমৎকার উপমা সহযোগে বলেন: ‘বর্গীর রেকর্ড মোছে বিশ্বব্যাংক ধূর্তহাতে জলে ও ডাঙায়।’(অক্ষম উচ্চারণ)১৩ মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে নিম্নআয়ের দেশগুলোতে চলছে অভিনব কায়দায় লুটতরাজ। সেখানে গরিবের ঘামে রোদ লেগে ভ্যাট চিকচিক করে ওঠে, অর্থনীতির দোহাই দিয়ে বেড়ে চলে করের বোঝা। তিনি বহু কবিতাতে এসব পুঁজিবাদী আন্তর্জাতিক সংগঠনসমূহের শোষক চরিত্রটি উন্মোচন করেছেন সুচারুরূপে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে এসব ক্ষেত্রে তিনি কবিতার নান্দনিক সৌকর্য বজায় রখেছেন সাফল্যের সাথে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভিন্ন মুদ্রা চালুকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেছেন, ‘শোষণের হাত দ্যাখো জোটবদ্ধ অভিন্ন মুদ্রায়।’১৪ বিশ্বায়নের অন্যতম প্রধান অস্ত্র অবাধ আকাশ মিডিয়া। এটি অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার হিসেবেও কাজ করছে। অপেক্ষাকৃতভাবে দুর্বল রাষ্ট্র ও জনপদের পক্ষে নিজেদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য টিকিয়ে রাখা দিনদিন কঠিন হয়ে উঠছে। আমিনুল ইসলাম চমৎকার কাব্যভঞ্জনায় তুলে ধরেছেন এসব ছবি:

‘আলঘেঁষে কাঁটাতার- তার ’পর আকাশ হা-খোলা
হা-খোলা আকাশ পথে ওড়ে আহা ডলার দিনার
ওপেন মার্কেট আসে- কড়া ধরে দিয়ে যায় দোলা-
বেনিয়া-মনের সাথে দোল খায় প্রেমের মিনার।
আমি তো পুরোনো প্রেম ধরে আছি শ্যামল কোমর
আমাকে যেও না ফেলে- থাক শত অকাট্য ওজর।’
(ভালোবাসার পদাবলি, শরতের ট্রেন শ্রাবণের লাগেজ)১৫

পশ্চিমা দেশগুলো তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে গণতন্ত্র রফতানি ও প্রতিষ্ঠার কথা বলে এসেছে বছরের পর বছর। গণতন্ত্রকে সর্বত্তোম শাসনব্যবস্থা বলে অভিহিত করেছেন একালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ। এটি এখন একটি বৈশ্বিক ইস্যু। কিন্তু পৃথিবীর বড় বড় রাষ্ট্রগুলোতে গণতন্ত্রের নামে সংখ্যাগরিষ্ঠের বিভেদমূলক শাসন ক্ষুদ্র ও সংখ্যালংঘু জনগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রক্ষার পথে মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠেছে। ধর্ম, জাতপাত, বর্ণ, ভাষা সেসব রাষ্ট্রে বিভাজনের সৃষ্টি করছে। অন্যদিকে বড়ো বড়ো এবং সামরিকভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর ওপর অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় নানাবিধ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা নিজদেশে গণতন্ত্রের চর্চ্চা করলেও তাদের হাতে অন্যদেশের আত্মরক্ষার গণতান্ত্রিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। আমিনুল ইসলাম তার ‘ জঙ্গলায়ন’, ‘প্রাচ্যের অসুখ’, ‘সভ্যতার সংঘর্ষ’, ‘একাকী, অবরণ্যে’, ‘আঁধারের জানালায়’, ‘শান্তিদেব’, ‘মাঘের চিঠি’ প্রভৃতি কবিতায় এ বৈশ্বিক বিকারগ্রস্ত অবস্থার ছবি সুনিপুণ শৈল্পিক ভাষায় তুলে ধরেছেন। তিনি এ অবস্থার নাম দিয়েছেন ‘জঙ্গলায়ন’। তিনি বলেছেন, ‘মানুষ নেকড়ে হলে বৃহত্তম গণতন্ত্রও জঙ্গল হয়ে ওঠে।’(জঙ্গলায়ন)১৬

‘তথাপি আমার কানে পাকে তালগোল
বুকে এসে ভিড়ে ভিটেমাটিহারা শোক
জল কাঁটাতার ভেঙে চলে আসে রোল
কীসের বেগানা? সবাই আপন লোক।

সুদূরে বোমায় মরছে শিশু ও নারী
একই ঘটনা মাঝখানে এশিয়ার
গণতন্ত্র আজ জঙ্গলের অনুসারী
যত বড় সে যে তত বড় থাবা তার।’
(একাকী, অবরণ্যে, জলের অক্ষরে লেখা প্রেমপত্র)১৭

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করলে একটি বড় বিষয় হচ্ছে আশির দশকে পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের পতন এবং পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর ‘কল্যাণমূলক রাষ্ট্র’-এর চরিত্র থেকে পুনরায় চক্রবৃদ্ধি সুদনির্ভর শ্রমশোষণভিত্তিক চরম পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন। এতে করে সম্পদের মেরুকরণ আরও তীব্র হয়েছে এবং তা অব্যাহত আছে। গরিব, নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত শ্রেণির অস্তিত্ব মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। কেবল শিল্পোন্নত দেশসমূহেই নয়, তৃতীয় বিশ্বের সকল রাষ্ট্রে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। দিনদিন তা প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে উঠছে। আমিনুল ইসলামের কবিতা এই বৈশ্বিক অবস্থার ছবি দেখা যায় প্রায়শ।

‘বন্ধু, তুমি তো জানোই-
সাম্যবাদের ষড়যান্ত্রিক পতনের পর,
বিশ্বজুড়ে,
লুটেরাতন্ত্র ফিরে আসে তার আসল চেহারায়,
দিন যত যাচ্ছে, ততই সম্প্রসারিত হচ্ছে-
তার প্রলোভের মাত্রা;
তাকাও কেন্দ্রে
তাকাও পরিধিতে
তাকাও আঁলান্টিকে
তাকাও প্যাসিফিকে
তাকাও উৎসবে
তাকাও মিডিয়ায়
তাকাও বাজেটে
তাকাও বীমায়
সবখানেই তার থাবা, নখর ও দাঁত!
এমনকি কল্যাণমূলক মলমটুকুও
প্রত্যাহার করে নেয়া হচ্ছে-
‘মুক্ত ব্যবস্থায়
মাগনা কোনোকিছুই থাকতে পারে না!
(যদি আমি মরে যাই, হিজলের সার্কিট হাউস)১৮

আমিনুল ইসলামের কবিতায় বারবার এসেছে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় বিশ্বায়নের উভয়দিক। বিশ্বায়ন কেবল অর্থনৈতিক ব্যাপার নয়। একইসঙ্গে সাংস্কৃতিক এবং কিছুটা ধর্মীয়ও বটে। তৃতীয় বিশ্বের দুর্বল দেশগুলোর নিজস্ব সাহিত্য-ভাষা-সংস্কৃতি আকাশ সংস্কৃতির সর্বগ্রাসী স্রোতের মুখে পড়েছে। অসম প্রতিযোগিতার মুখে টিকে থাকাই দায় হচ্ছে এদের। আমরা লক্ষ করব আমিনুল ইসলাম সাম্প্রতিক সময়ে ব্যবহৃত দেশি-বিদেশি শব্দ ও প্রত্যয় যোগে অত্যন্ত সুচারুভাবে এবং উপভোগ্য ভাষায় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও সংকটের বিষয়টিকে কবিতা করে তুলেছেন। একটি পুরো কবিতা এখানে তুলে দিচ্ছি:

‘গ্লোবাল উইন্ড এসে ছিঁড়ে যায় ঘুড়িটার সুতো
লাটায়ে স্মৃতির ধুলো; তাতে- কার লাভ? কার ক্ষতি?
ঘুড়ি নেই- ড্রোন দ্যাখো- সে শিখেছে উড়বার ছুতো
ভেঙে পড়ে তক্ষশীলা- গড়ে ওঠে বেনিয়া বসতি।

এখন নতুন নাম- দ্যাখো তার ফ্যাশনের হাল
সে এখন পোস্টার, বিলবোর্ড, ডলারের চেক
অতীত-ফতীত নাই-‘নিত্য আজ’-মাল্টিন্যাশনাল
বলরুম শোরুম সে-যখন যেমন চাই- ভেক।

আমার যে-রাত ছিল- এখন সে টপলেস ভোর
আমার যে দিন ছিল- এখন সে নিউড নাইট
অথবা আমারি ভুল-প্রিমিয়ার এনেছে এ ঘোর
রেফারিহীন সময়- ডে-নাইট চলছে ফাইট।

গ্রীষ্ম কই- বর্ষা কই- কী ফায়দা এতকথা তুলে!
আমার শরৎ দিন বিলি কাটে আকাশের চুলে।
(আমার শরৎ দিন বিলি কাটে আকাশের চুলে, শরতের ট্রেন শ্রাবণের লাগেজ)১৯

আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ এবং সবচেয়ে পুরোনো বিষয় একাধিকবার এসেছে, সেটি হচ্ছে অভিবাসন। এই নিয়ে তার অনেক কবিতা আছে: ‘অভিবাসী চিরদিন’, ‘অভিবাসনের পথে’, ‘অভিবাসীর গান’, ‘তুর্কি মেয়ের জন্য’, ‘অস্বীকৃতির আগুন’, ‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি’ ইত্যাদি। নদী, হাওয়া, গ্রহ-উপগ্রহ, নক্ষত্রাদি, পশুপাখি, মানুষ সবাই সৃষ্টির শুরু থেকে অভিবাসী। এখন পৃথিবীতে নিবন্ধনকৃত অভিবাসী মানুষের সংখ্যা ২৫/২৬ কোটি বলে শোনা যায়। কিন্তু আসলে পুরো বিশ্বের মানুষের বড় অংশই অভিবাসী। আর্যরাও অভিবাসী হয়ে এসেছিল ভারতীয় উপমহাদেশে; আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা প্রভৃতি দেশের বর্তমান সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষেরা সবাই অভিবাসী। আবার অভিবাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার অভিবাসী জাতিগুলোর অনেকেই। এটা দ্বিচারী স্বভাব। আমিনুল ইসলামের কবিতায় অভিবাসনের নানাদিকের ছবি দেখতে পাওয়া যায়।

১.
‘আমি কিন্তু মোটেও নতুন কোনো আগন্তুক নই,
আমি আসছি সেই তখন থেকেই,
যখন চাঁদ সদাগরের সপ্তডিঙ্গা মধুকর এসে ভিড়তো
ভেনাসের ঘাটে আর রোমান জাহাজগুলো
করতোয়ার ঘাটে গিয়ে
বোঝাই করতো অগ্রগামী প্রভাতের আলো
এবং শরৎ শিশিরে ঈর্ষা জাগানো- আব-ই রওয়ান।’
(অভিবাসী চিরদিন, অভিবাসী ভালোবাসা)২০

২.
‘হে উদ্ভাসিতা, তবে কি প্ররোচিত তুমি ঘর থেকে
বিদায় দিতে চাও ভালোবাসাকে-
যেভাবে বের করে দিচ্ছে ট্রাম্প
আমেরিকাকে গড়ে তোলা আমেরিকাপ্রেমী অভিবাসীদের?’
(অভিবাসী ভালোবাসা, ভালোবাসার ভূগোলে)২১

আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক প্রচ্ছদে অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় সংকটের ছবি এসেছে; পাশাপাশি এ অবস্থা থেকে উত্তরণের আকুল আকাক্সক্ষাও ব্যক্ত হয়েছে তাঁর কবিতায় এসময়ের কবিদের কবিতায় যা একান্তভাবেই দুর্লভ। তিনি সকল প্রকার সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে পুরো মানবজাতির পক্ষে কথা বলেছেন।

‘আমি আশ্রয় চাই পেন্টাগন-দুপুরের
রোদ থেকে
যখন বারুদ পরে থাকে বৃক্ষের বাকল
আমি আশ্রয় চাই সুদকষা রাতের
অনিষ্ট থেকে
যখন শাইলকেরা শুষে নেয়
সভ্যতার সবখানি রস;
আমি আশ্রয় চাই
ক্যালকুলেটর-হৃদয়ের ছোঁয়া থেকে
যখন হিসাবে হলুদ হয়ে আসে
সম্পর্ক-বৃক্ষের পাতা।
(স্বাগত হে অভিনেত্রী, প্রণয়ী নদীর কাছে)২২

আমিনুল ইসলামের কবিতার বিষয়ের মধ্যেই শুধু নয়, তার কবিতাভাবনার মধ্যেও বৈশ্বিক শিক্ষা ও বৈশ্বিক চেতনার ছবি আছে। শিল্পসাহিত্যে ইতিহাসকে টেকনিকের ইতিহাস বলা হয়ে থাকে। রোমান্টিসিজম, মর্ডানিজম, সুররিয়ালিজম, পোস্ট কলোনিয়ালিজম, পোস্ট মর্ডানিজম, দাদাইজম, সিম্বলিজম এবং এমনতর অন্যসব সাহিত্যতত্ত্ব ও শিল্প-মতবাদ সম্পর্কে আমিনুলের সচেতনতা তাঁর কবিতার শরীরপ্রাণে লক্ষ করা যায়। এটিও তাঁর বৈশ্বিক চেতনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। আমিনুলের ‘ইজম-পাগল উত্তরাধুনিক/ আমাকে জানুক বাতিল দিনের লোক।’২৩, ‘গাল দিলে দিক্ মর্ডানিজম পরোয়া করি নাকো / মন যতদিন ঘুড়িবালক/ আকাশ হয়েই থাকো।’২৪, ‘আমরা আধুনিক নই / আমাদরে নাম কেটে দিন পণ্ডিত হুমায়ুন, বুশবিশ্ববিদ্যালয়’২৫, ‘টেবিলে দেরিদা, ফুকো উপরের তাকে/ চোখ মেলে চায়- হারালো কি কবি খেই/ প্রভাত চৌধুরী রয়েছে হাতের কাছে/ অঞ্জন সেনও- কোনো কথা উঠলেই!’২৬ প্রভৃতি চরণ তাঁর শিল্পসাহিত্য বিষয়ে আপডেট বৈশ্বিক ধারণা থাকা এবং সেসব ধারণাকে বিবেচনায় রেখে আপন অনন্যতায় নিজস্ব পথ তৈরি করে নেওয়ার স্বাক্ষর বহন করে।

বহুদিন যাবৎ বিশ্ব নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে পক্ষপাতদুষ্ট শক্তি দ্বারা। সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গী, স্বাধীনতা যোদ্ধা, আলোকায়ন, প্রগতিশীলতা, বিশ্বশান্তি ইত্যাদি বহুল উচ্চারিত প্রপঞ্চসমূহ ইউরো-মার্কিন জোট তাদের ভাবনার ও স্বার্থের অনুকূলে ব্যাখ্যা করছে এবং বাকি বিশ্বকে তা মেনে নিতে বাধ্য করছে। অর্থনীতি ও সমরাস্ত্রের চেয়েও বেশি ভয়ংকর হচ্ছে তাদের মিডিয়া। কোনো সত্য আর কোনটা মিথ্যা, কোনটা ন্যায় আর কোনটা অন্যায় তা নির্ধারণ করে দিচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী জোটের মালিকানাধীন ও পরিচালনাধীন ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট, ইন্টারনেট ও আকাশ মিডিয়া। মিডিয়ার সর্বগ্রাসী ও সর্বব্যাপী প্রচারণায় পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে, অন্যায়কে মেনে নিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। নিত্য বিশ্বসচেতন আমিনুল ইসলাম তাঁর কবিতায় এই বিষয়টিতে চিত্রিত করেছেন তাঁর অনেক কবিতায় বিদ্রুপে ও পরিহাসে, প্রতীকে ও তির্যকতায়।

‘চুরিবিদ্যা বড়বিদ্যা,–এটা আজ অতীতের শ্লোক
মলে মলে সিসিটিভি–বর্ডারেও ওয়াচ টাওয়ার
শূন্যে ঝোলে উপগ্রহ–আকাশে পাতালে তার চোখ
কোথায় চুরির রাত? রাতদিন নিউজ আওয়ার!

সাগরে ডাকাতি কত–লুটপাট প্রবাল ঝিনুক
তার চেয়ে মূল্যবান তরল সোনার গোডাউন
লুণ্ঠিত মাটির নিচে সোনাদানা হীরক সিন্দুক
বিবিসি ও সিএনএন হাতে? তবে করে যাও খুন!

স্বাধীনতা, সংগ্রাম, জঙ্গী, খুনী, লড়াই বাঁচার
ইত্যকার শব্দগুলো পেয়ে গেছে নতুন তর্জমা
কী হবে কলেজে গিয়ে? অভিধান? মূল্য কিবা তার!
ক্ষমতার দশমুখ, সে নিয়েছে সব অর্থ জমা।
(গফুর বলদ পোষে জমিদার পালিছে মিডিয়া, পরদেশী মেঘ)২৭

আমিনুল ইসলামের বৈশ্বিক ভাবনার একটা অনন্য ও প্রাতিস্বিক বৈশিষ্ট্য এই যে, তিনি বাঙালি হয়ে বাঙালি ও বিশ্বমানবকে একইসঙ্গে একাকার ব্যঞ্জনায় দেখতে ও উপস্থাপন করতে চেয়েছেন। তিনি মানবিক ভাবনায় সাম্যবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলাম দ্বারা প্রভাবিত অথবা তাঁর অনুসারী বলে প্রতীয়মান হয়। সম্ভবত সেকারণে আমিনুলের অনেক কবিতায় তাঁর সাম্যবাদী বিশ্বমানব-মনের ছাপ দেখা যায়। তাঁর কাব্যভাবনায় ঘর ও বাহির , স্বদেশ ও আন্তর্জাতিক ভূগোল একধরনের আত্মীয়তার বন্ধনে অভিন্ন ও অচ্ছিদ্য হয়ে ওঠে। কিছু লুটেরা, সাম্রাজ্যবাদী ও অত্যাচারী রাষ্ট্রনেতা ব্যতীত বাকি সকলেই তাঁর কবিতায় স্বজনের স্থান লাভ করে। মধুবালা, মধুমালা, মেরিলিন মনরো, নেফারতিতি, ক্লিওপেট্রা, কালিদাস, নজরুল, লালন রবীন্দ্রনাথ, রুমি, হাফিজ, কীটস, শেক্সপীয়ার, বোদলেয়ার, নেরুদা, তানসেন, গওহরজান, উম্মে কুলসুম, মহম্মদ রফি, মেহেদী হাসান, মাইকলে জ্যাকশন , রুনা লায়লা সকলেই আত্মীয়তার বৃত্ত রচনা করে তাঁর কবিতায়। তাঁর বৈশ্বিক ভাবনা ও স্বদেশ ভাবনা আন্তঃমহাসাগরের জল ও স্রোতের মতো একাকার হয়ে ওঠে মানবীয় সৌন্দর্যে ও হৃদয়িক সম্মোহনে।

‘নেফারতিতি, হে মিসট্রেস অব হ্যাপিনেস, তুমি কি তবে বহু জনমের
অধিকার লাভ করেছো, ঘুমুতে যাওয়ার আগে যার স্বপ্ন নিয়ে
পাথরের বুকে প্রাসাদ রচতেন দি ভ্যালি অব কিং এ ঘুমুতে যাওয়া
তুথমোসিস-রামেসেসের দল? অবয়বহীন চারহাজার বছর
নীলনদে ভেসে ভেসে তুমি কি পুনর্জন্মের মাটি খুঁজে পেয়েছো
রূপবান-মধুবালার গাঙ্গেয় অববাহিকায়? কী লাভ সত্যের মুলা খুঁজে?
অতএব ঘটনা যা-ই হউক, অথবা রহস্য, তোমাকে স্যালুট হে সম্রাজ্ঞী!’
(নেফারতিতির সঙ্গে, অভিবাসী ভালোবাসা)২৮

বিস্ময়কর সুন্দর ব্যাপার এই যে, আমিনুল ইসলাম তাঁর বৈশ্বিকভাবনাগুলোকে কবিতা করে তোলার সময় স্লোগাননির্ভর তারল্য পরিহারপূর্বক শৈল্পিক সৌন্দর্য ও নান্দনিক রসের সঞ্চারের মাধ্যমে সেসব কবিতাকে উৎকৃষ্ট মানের শিল্প সৃষ্টিতে উন্নীত করেছেন। বৈশ্বিক ভাবনার কবিতায় শব্দের ব্যবহার এবং উপমা চিত্রকল্প নির্মাণের সময় সেসবের মাঝে আন্তর্জাতিকতার ঘ্রাণ জুড়ে দিয়েছেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। কবি হিসেবে এটা আমিনুলের উজ্জ্বল প্রাতিস্বিকতার স্বাক্ষর বহন করে।

কি ব্যক্তিগত সৃষ্টির ভুবনে, কি জাতির বৃহত্তর অঙ্গনে স্বকীয়তা অর্জন এবং তা ধরে রেখে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার মধ্যেই প্রকৃত সার্থকতা নিহিত। নিজস্বতা হারানো যাবে না। আন্তর্জাতিকতা বর্তমান বিশ্বের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার পাথেয় হলেও এর বিরূপ প্রভাবের মধ্যে ভেসে যাওয়া নিজ ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে সুখকর নয়। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো ফেসবুক, ইন্টারনেট, টুইটার ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নয়া উপনিবেশ স্থাপনের যে নক্সা এঁকে চলেছে আমরা প্রতিনিয়ত তার ফাঁদে জড়িয়ে পড়ছি। আমরা হারিয়ে ফেলছি নিজস্ব ঐতিহ্য, সংস্কার। বিদেশি সংস্কৃতির মায়ায় আবদ্ধ হয়ে ক্রমেই হারিয়ে ফেলছি হাজার যুগের সংরক্ষিত সংস্কৃতি। কবি আমিনুল ইসলাম এই বিষয়ে সচেতন বলেই তিনি নিজস্ব ঐতিহ্য বিস্মৃত হননি। ভুলে যাননি আলকাপ, গম্ভীরা, জারি, সারি গানের কথা। নিজের দেশকে এগিয়ে নিতেই তিনি আর্ন্তজাতিক পরিমণ্ডলকে তাঁর লেখায় স্থান করে দেন। বিশ্ব পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করেন নিজ দেশের অবস্থান। অবশেষে তিনি নতুন পৃথিবীরই প্রত্যাশা করে বলেন: ‘পূর্বের দুহাতে ভোরের উদ্বোধন / সকল দুনিয়া আলোর উৎস হোক।’ (শাশ্বতিকী)২৯

তথ্যসূত্র
১। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৪২৬ বঙ্গাব্দ) সঞ্চয়িতা, একাদশ সংস্করণ, বিশ্বভারতী, কলকাতা; পৃ: ৮২৩।
২। আমিনুল ইসলাম(২০১০): পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি, ঢাকা; পৃ: ৬২।
৩। আমিনুল ইসলাম (২০২৪): মতিহারী ভালোবাসা, প্রতিবিম্ব প্রকাশ, ঢাকা; পৃ: ৬২।
৪। আমিনুল ইসলাম(২০২০): প্রেমিকার জন্য সার-সংক্ষেপ, অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা ;পৃ: ৪৯।
৫। আমিনুল ইসলাম(২০১৮): অভিবাসী ভালোবাসা, অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা; পৃ: ৩৩।
৬। বীরেন মুখার্জী(২০১৭): কবিতার শক্তি, ছোট কবিতা, ঢাকা; পৃ: ১০৩।
৭। আমিনুল ইসলাম(২০২০): প্রেমিকার জন্য সার-সংক্ষেপ, অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা ;পৃ: ৪৮।
৮। আমিনুল ইসলাম(২০১৯) বাছাই কবিতা, অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা; ঢাকা; পৃ:৭৬।
৯। আমিনুল ইসলাম(২০১১): স্বপ্নের হালখাতা, অ্যাডর্ন পাবলিকেশন, ঢাকা; পৃ:২২।
১০। আমিনুল ইসলাম(২০১৭) ভালোবাসার ভূগোলে, অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা; পৃ: ২০।
১১। কাবেদুল ইসলাম(২০২০): নদীকথা ও অন্যান্য প্রবন্ধ, জয়তী, ঢাকা; পৃ: ১৮৫।
১২। আমিনুল ইসলাম(২০১৯) বাছাই কবিতা, অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা; ঢাকা; পৃ:১৩৩।
১৩। আমিনুল ইসলাম(২০১৯) বাছাই কবিতা, অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা; ঢাকা; পৃ: ৩৫১।
১৪। আমিনুল ইসলাম(২০১৯) বাছাই কবিতা, অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা; ঢাকা; পৃ: ৩৪৩।
১৫। আমিনুল ইসলাম(২০১৯) বাছাই কবিতা, অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা; ঢাকা; পৃ: ১৯২।
১৬। আমিনুল ইসলাম(২০১৯): জলের অক্ষরে লেখা প্রেমপত্র, লেখাপ্রকাশ, ঢাকা;পৃ:১৩।
১৭। আমিনুল ইসলাম(২০১৯): জলের অক্ষরে লেখা প্রেমপত্র, লেখাপ্রকাশ, ঢাকা; পৃ: ৯।
১৮। আমিনুল ইসলাম(২০২১): হিজলের সার্কিট হাউস, বর্ণধারা, ঢাকা; পৃ: ৪৫।
১৯। আমিনুল ইসলাম(২০১৩) শরতের ট্রেন শ্রাবণের লাগেজ, লেখাপ্রকাশ, ঢাকা; পৃ: ৬৩।
২০। আমিনুল ইসলাম(২০১৮): অভিবাসী ভালোবাসা, অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা; পৃ: ৫৭।
২১। আমিনুল ইসলাম(২০১৭) ভালোবাসার ভূগোলে, অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা; পৃ: ৪৬।
২২। আমিনুল ইসলাম(২০১৬): প্রণয়ী নদীর কাছে, লেখাপ্রকাশ, ঢাকা; পৃ: ৭১।
২৩। আমিনুল ইসলাম(২০১৯): জলের অক্ষরে লেখা প্রেমপত্র, লেখাপ্রকাশ, ঢাকা; পৃ: ৬৪।
২৪। আমিনুল ইসলাম(২০১৮): অভিবাসী ভালোবাসা, অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা; পৃ: ২৪।
২৫। আমিনুল ইসলাম(২০১৯) বাছাই কবিতা, অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা; ঢাকা; পৃ: ৩৪৪।
২৬। আমিনুল ইসলাম(২০১৯): জলের অক্ষরে লেখা প্রেমপত্র, লেখাপ্রকাশ, ঢাকা;পৃ: ৯।
২৭। আমিনুল ইসলাম (২০২৪): পরদেশী মেঘ, বর্ণধারা, ঢাকা পৃ: ২৮।
২৮। আমিনুল ইসলাম(২০১৮): অভিবাসী ভালোবাসা, অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা; পৃ: ৫৫।
২৯। আমিনুল ইসলাম(২০১৬): প্রণয়ী নদীর কাছে, লেখাপ্রকাশ, ঢাকা; পৃ: ৩৫।

—–০০০—–


নাজিয়া ফেরদৌস
সহকারী অধ্যাপক
বাংলা বিভাগ
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
নোয়াখালী

আরও পড়তে পারেন

15 COMMENTS

  1. ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ।

    বহু কৌণিক অভিসার কবি আমিনুল ইসলাম। তাঁর কবিতায় বৈশ্বিকতা অনন্য মাত্রায় ছুটে চলে অজানার আহবানে। কবি লৌকিক জীবনের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে নিজের মধ্যে অলৌকিক এক ভাবের জগত নির্মাণ করেছেন এই জীবন যেন অন্য এক অসীম জগতে পৌঁছানোর প্রস্তুতি পর্ব সেই অসীম জগতের আনন্দই কোভিদ মনকে বর্তমান জগতের সঙ্গে একাত্ম হতে দিচ্ছে না বারবার দৃষ্টি মেলে সেই সুন্দরের আহবানে সাড়া দেওয়ার জন্য কান পেতে আছেন কবি। আন্তর্জাতিক অঙ্গন ও বৈশ্বিক ভাবনায় অনন্য মাত্রার সাহিত্য বিচার।
    ধন্যবাদ প্রাবন্ধিক এবং কবি উভয়কে।

    • আপনার বিশ্লেষণের দৃষ্টি অসাধারণ। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

  2. নাজিয়া ফেরদৌস একজন মেধাবী, পরিশ্রমী ও সাহসী গবেষক-লেখক। আমি তার আরও বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ পড়েছি। তিনি এই প্রবন্ধ বা আর্টিকেলটি লিখেছেন অনেক তথ্য-উপাত্ত সংযোজন করে। লেখার নিচে তথ্যের উৎস সংযোজন করে দিয়েছেন গবেণামূলক প্রবন্ধের আদলে। এতে করে আগ্রহী পাঠক লেখার উৎসগুলো দেখে নিতে ও পাঠ করে নিতে পারবেন। এই অর্টিকেলটির জন্য নাজিয়া ফেরদৌস অবশ্যই সাধুবাদ পেতে পারেন। ধন্যবাদ পেতে পারেন বাংলা রিভিউ ওয়েব-ব্লগ সম্পাদক কবি সাজ্জাদ বিপ্লব।

    • অসংখ্য ধন্যবাদ কবি। আপনার অসাধারণ লেখাই আমাকে পরিশ্রম করার প্রেরণা যোগায়।

  3. নাজিয়া ফেরদৌস ম্যাম রচিত “আমিনুল ইসলামের কবিতা ভিন্ন ধারায় সাহিত্যনুসন্ধান” শীর্ষক পুরো একটি প্রবন্ধের বই কবি আমিনুল ইসলামের রচিত কাব্যের সমালোচনা বিষয়ক পড়েছিলাম বছর খানেক আগে যা আমাকে তাঁর লেখনী ও ভাষাবোধ এবং শব্দের অলংকারিক ব্যবহার ইত্যাদির প্রতি আকৃষ্ট করে । আমি কোনো লেখক বা সাহিত্যের ছাত্রও নয় । তবে সাহিত্যের প্র‍তি টান প্রবল । বর্তমান সময়ের ৫০ উর্ধ্ব কবি আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড বা আমি ফলো করি । সেই তালিকায় আপনিও আছেন । একেকজন কবি বা লেখকের লেখার স্টাইল একেক রকম । তবে সমকালীন সময়ে কবি আমিনুল ইসলামের কাব্যবৈচিত্র,কবিতার শিরোনাম, বিষয়বস্তু,,প্রতীকি উপস্থাপনা,উপমা ইত্যাদি অনন্য । এত সাবলীল ভাবে তিনি অনেক কঠিন ও দুর্বোধ্য বিষয়কেও উপস্থাপন করেন যা যে কোন পাঠকের ভালো লাগার খোরাকে পরিণত হয় । তাঁর কবিতায় দেশীয় ইতিহাস ঐতিহ্য ও বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন এর ব্যবহারের পাশাপাশিও তিনি বিদেশী সভ্যতা ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিভিন্ন কিছু অবলীলায় ব্যক্ত করে খুব সুনিপুণভাবেই তবুও তাঁর কবিতার বিষয়বস্তুর সুতা পরিমাণও ব্যত্যয় ঘটে না । শেষ পর্যন্ত তিনি পাঠকের আকর্ষণ ধরে রাখতে পারেন আশ্চর্যজনকভাবে ।

    আপনার রচিত সুদীর্ঘ এই রচনাটি পড়লাম মনোযোগের সব টুকু ঢেলেই, আপনি যথার্থ অটোপসি করেছেন । আপনার সাথে আমিও একমত । তবে সমকালীন সময়ে আমিনুল ইসলামের বিভিন্ন দিক উন্মোচিত হয়েছে তথা হচ্ছে । কেউ বলছেন তিনি প্রেমের কবি,,কেউ বলছেন তিন শেকড় সন্ধানী কবি,কেউ বলছেন রোমান্টিক কবি, আবার কেউ কেউ বলছেন তিনি প্রতিকী চিত্রকল্পের কবি । সর্বোপরি তিনি সমকালীন সময়ের একজন অন্যতম জনপ্রিয় ও পাঠকনন্দিত কবি । আপনাদের উভয়ের সাফল্য ও সুস্বাস্থ্য কামনা করছি । ভালো থাকবেন ।

    • আপনাদের মতো পাঠক আছে বলে এদেশে এখনও কবি এবং সমালোচকদের কদর আছে। গঠনমূলক আলোচনার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

  4. বিশদ আলোচনা। ভালো।
    এটি লেখিকার গবেষণাপত্র বলে বিবেচিত হতে পারে। তাতে তার এমফিল বা পিএইচডি ভর্তিতে বা প্রমোশনে কাউন্ট হবে।
    এ রকম লেখিকা এখন দুর্লভ। কেউ লেখে না মৌলিক লেখা। অভিনন্দন কবি ও আলোচককে।

    • পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ। আপনাদের অনুপ্রেরণাই আমার পাথেয়।

  5. “আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা” প্রবন্ধটি লেখিকার পরিশীলিত হাতের অনবদ্য একখান কর্ম। তিনি কবির বৈশ্বিক ভাবনাকে যেভাবে চমৎকার করে পর্যবেক্ষণ ও সুক্ষ্ণভাবে বিশ্লেষণ করেছেন তা পড়ে মুগ্ধ হবেন যে কোন পাঠকই। সাধারণ পাঠকশ্রেণির কাছে কবিকে অনন্যরুপে উপস্থাপনের যে প্রয়াস লেখিকা দেখিয়েছেন তা আমিনুল-গবেষাণাকে নিঃসন্দেহে বেগবান করবে বলেই আমার বিশ্বাস।
    শুভকামনা প্রিয় দুজন মানুষের জন্যই।🧡

  6. খুব ভালো আলোচনা। কবি আমিনুল ইসলামের কবিতায় আন্তর্জাতিকীকরণের বিভিন্ন অনুষঙ্গ এনেছেন লেখক। পাশাপাশি এবং প্রাসঙ্গিক কিংবা অপ্রাসঙ্গিক কিছু বিষয় আলোচনার বিষয়কে পরিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন। কবির মানসের কিছু নতুন বিষয়াদি নিয়ে এনে প্রবন্ধটিকে ঋদ্ধ করা হয়েছে। দর্শন, বিভিন্ন তত্ত্ব ও বিশ্বসাহিত্যের তুলনামূলক কিছু আলোচনা যোগ করা হয়েছে, যা পাঠককে জমিয়ে দেবে। দুটি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে–কবিতায় আন্তর্জাতিকীকরণ ও পর্যটন। আন্তর্জাতিক বিষয়ের মধ্যে চলে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র ও অনেকের মোড়লপনার কথা, অথর্ব ও অসহায় জাতিসংঘের কথা। পর্যটন বিষয়ে চলে এসেছে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ভৌগলিক ব্যাপারস্যাপার। এসব প্রসঙ্গের কবিতাগুলোর প্রতিনিধি হিসাবে লেখক উপযুক্ত কবিতা/কবিতাংশই ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন বলে আমার বিশ্বাস হয়েছে। দুটি মূলবিষয়ের অবতারণায় কবি চিত্রকল্প, চিত্র, বিভিন্ন অলংকার ব্যবহার ইত্যাদিতে মুনশিয়ানা দেখানোর বিষয়গুলো লেখক নন্দনিকভাবেই এনেছেন। উপস্থাপন কৌশল প্রবন্ধটিকে উন্নততর করেছে। কবি আমিনুল ইসলামের কবিতায় তাঁর বৈশ্বিকভাবনাকে নিখুঁত একটা রূপ দিয়েছেন। কবিতায় শব্দাবলি বা বাগশৈলী ব্যবহারের অন্তর্নিহিত শক্তির কিছু বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। লেখক ইতিহাস, ঐতিহ্য ইত্যাদি শব্দাবলি ব্যবহারে প্রায় শতভাগ যথার্থতার বিষয়টিও এড়িয়ে যাননি। লেখকের এমন সব প্রচেষ্টা পাঠক মুগ্ধ হতে বাধ্য। ব্যতিক্রম এ প্রচেষ্টার ছাপ রাখার জন্য প্রবন্ধটির লেখক নাজিয়া ফেরদৌসকে ধন্যবাদ। গুণী লেখকদের আলোচনায় কবি আমিনুল ইসলামের কবিতা পৌঁছে যাবে এপার ছেড়ে ওপার বাংলায়; বাংলা পেরিয়ে বিশ্বসাহিত্যের আলোচনায়। আমি মনে করি, আমিনুল ইসলামের কবিতায় সে শক্তি আছে।

    • “আমিনুল ইসলামের কবিতায় সে শক্তি আছে।” মন্তব্যটির সঙ্গে সহমত পোষণ করছি। প্রকৃত কবির সমগ্র দৃষ্টিকে আলোচনার সীমায় বন্দী করা আসলে সম্ভব নয়। আমি শুধু পাঠকের সামনে তাঁর প্রবণতাগুলোকে পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছি। পাশে থাকার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

  7. আপনার শিকড় সন্ধানী গবেষণামূলক কবিতার মতোই গভীরভাবে আপনাকে তুলে ধরতে পেরেছেন প্রবন্ধের আলোচনায়।

  8. আমিনুল ইসলাম ভিন্ন শক্তির ভাবনা নিয়ে কবিতা লেখেন। নিসর্গ, স্মৃতিকাতরতা, দ্রোহ, প্রেম, যুদ্ধ, মানবিকতা, স্বদেশিকতা, আন্তর্জাতিকতা, সমাজ, সংস্কৃতি, রাষ্ট্র, রাজনীতি, আবেগ, মোহময়তা…. কী নেই তার কবিতার মধ্যে। ভাবনার অতল গভীরে প্রবেশের এক নিরব শক্তি আছে তার কলমের মধ্যে। একটি বিষয়কে অগণিত দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করার সক্ষমতা তাকে অনন্য করেছে। শুধু নিজেরই নয়, অন্যান্য সৃষ্টিশীল কাজকে অনুপ্রেরণা দেয়া, উৎসাহ দেয়ার মহানুভবতা কবিকে সুউচ্চ অবস্থানে উন্নীত করেছে। কবির সৃষ্টি সংখ্যাধিক হোক।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা