spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদসাক্ষাৎকারআমি হচ্ছি মগ্নধ্যান পন্থি : মিলটন রহমান

সাক্ষাৎকার গ্রহণে : সাজ্জাদ বিপ্লব

আমি হচ্ছি মগ্নধ্যান পন্থি : মিলটন রহমান

. আপনার প্রথম প্রকাশতি বই কোনটি কবে প্রকাশতি হয়েছিল? প্রথম বই প্রকাশরে অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি কেমন ছিলো?

–প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ছোটগল্প ‘ব্রুটাস পর্ব এবং কর্তার শারীরিক অবনতি‘। প্রকাশিত হয় ছায়ালোক থেকে ২০০২ সালে। প্রকাশোত্তর অনুভূতি অনুভব করার পূর্বেই ভেবেছিলাম এ বিষয়ে। তবে অনুভূতি নয় চিন্তার উদ্রেক কতটুকু হবে সে বিষয়ে ভেবেছিলাম। কেননা যে কোন রচনা মাত্রই পাঠককে স্বল্প কিংবা দীর্ঘ সময় চিন্তার ভেতর দিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। আমিও গল্পগ্রন্থ প্রকাশের আগে নির্বাচিত গল্পগুলো এক করার পর পাঠ করে আগে নিজেই বুঝতে চেয়েছিলাম তা পাঠকের কতটুকু অভিনিবেশ আদায় করতে পারবে। আর ‘অনুভূতি‘ শব্দটি অনেকটা ‘জনপ্রিয়‘ শব্দের মতই একই চরিত্র বহন করে। একজন মানুষ তার ‘অনুভুতি‘কে জোর করে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে পারে। নিজের অনুভূতিতে আত্মতৃপ্তিতে ভোগা লেখকের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। তাই বলতে চাইছি ‘অনুভূতি‘ এবং ‘জনপ্রিয়‘ এ দু‘টি শব্দ বাজারী। মৌলিক সাহিত্যে এর কোন স্থান নেই। আর অভিজ্ঞতার কথা যদি বলেন, তাতো কিছুটা হয়েছেই। যে গল্পগুলো আমার প্রথম গ্রন্থে রয়েছে, মহাপ্রস্থানের পথে, বুনোফুল, ছায়া শিকারী, পত্র বিষয়ক, ক্ষত বৃত্তান্ত, রূপনের শীতলক্ষ্যা বিভ্রাট এবং ব্রুটাস পর্ব এবং কর্তার শারীরিক অবনতি, এই গল্পগুলোর শিরোনাম যে চিন্তা বা দর্শন ইঙ্গিত করে তাতে প্রকাশের পূর্বেই মনে হয়েছিলো মনোযোগি পাঠক তাঁর চিন্তার রসদ পাবেন।   

. সাহিত্যে আপনি কার উত্তরাধিকার বহন করেন?

–সাহিত্যে আমি কোন ব্যক্তি–লেখকের উত্তরাধিকার বহন করি না। আর এই একটি শব্দের মাধ্যমে আপনি ঠিক কি নির্দেশ করতে চেয়েছেন তাও আমার কাছে খানিকটা অপরিস্কার। যদি বলেন প্রভাব, তাহলে বলবো একক কোন সাহিত্যিক দ্বারা আমি প্রভাবিত হই নি। বাংলা সমালোচনা সাহিত্য এই একটি তুলনা বা সাজুয্য সন্ধানের কারণে এখনো অনেক বেশি পশ্চাদপদ। কোন রচনা সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলেই লেখকের মধ্যে অন্য কোন লেখকের প্রভাব রয়েছে তা অত্যন্ত পান্ডিত্যের মাধ্যমে প্রকাশের চেষ্টা লিপ্ত থাকে সমালোচক। আমি এই পন্থি নই। আমি হচ্ছি মগ্নধ্যান পন্থি। ফলে প্রভাব বা উত্তরাধিকার নয়, বলতে পারেন, আন্ত:সম্পর্ক। পাঠ করতে গিয়ে অন্য লেখকের সাথে একজন সাহিত্যিকের মনোসম্পর্ক তৈরী হয়। ধরুন আমি এখন বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎ চন্দ্র, মানিক বন্দোপাধ্যায় পাঠ করে প্রভাবিত হলে তো হবে না। সময় তো আর সেখানে থেমে নেই। ঠিক একইভাবে উইলিয়াম ব্ল্যাক, শেকসপীয়র, বায়রন, কীটস শেলী, গ্রামসী, টেড হিউস কিংবা প্লাথের প্রভাব মেজাজে নিয়ে কি হবে? চিন্তা তো এগিয়েছে। ফলে প্রভাব নয় বলতে পারেন একজন কবি-সাহিত্যিক কে পাঠের পর তাঁর চিন্তা-দর্শনের সাথে একটি সম্পর্ক স্থাপন করা যেতে পারে। সেখান থেকে যে নতুন চিন্তার উলম্ফন হয় তাতো মৌলিক। তাহলে প্রভাব কোথায়? তবে মোটা দাগে যদি বলি তাহলে বলবো আমি বাংলা সাহিত্যের উত্তরাধিকার বহন করছি। এই যে বললাম বাংলাসাহিত্যের উত্তরাধিকার বহন করছি, এখান থেকে নতুন করেও আলোচনার সূত্রপাত হতে পারে। বিষয়টি এখান থেকে ব্যাখ্যাত হতে পারে।

. এ যাবৎ সর্ব মোট আপনার কতটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে? এর মধ্যে কোনটি বা কোনকোন কাজকে বা কোন বইকে আপনি আপনার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি বলে মনে করেন?

–আমার প্রকাশিত গ্রন্থ পাঁচটি। ব্রুটাস পর্ব এবং কর্তার শারীরিক অবনতি (গল্পগ্রন্থ, ছায়ালোক, ২০০২), চূর্ণকাল (কাব্যগ্রন্থ, আগামী প্রকাশনী, ২০১০), নিষঙ্গ (কাব্যগ্রন্থ, আড়িয়াল,২০১২), নকশাপুরাণ (গল্পগ্রন্থ, বিদ্যা প্রকাশ, ২০১৫) এবং কবি শহীদ কাদরী ও অন্যান্য প্রবন্ধ (প্রবন্ধগ্রন্থ, আগামী প্রকাশনী, ২০১৭)। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ কোনটি সেটি বিচার করবে তো পাঠক। আমি তো প্রতিটি গ্রন্থ প্রকাশের আগে নির্বাচিত রচনাগুলোই অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেছি। বাকিটা পাঠক বিচার করবে। আমার কাছে তো সব ক‘টি রচনাই উল্লেখযোগ্য। কিন্তু কথা হলো আমি বললে তো হবে না, পাঠক বলতে হবে কোন লেখাটি উল্লেখযোগ্য। সেক্ষেত্রে দেখবেন আমি কিংবা আপনি উল্লেখযোগ্য বলছি সেটিকে অন্য একজন পাঠক বলছে না, তিনি বলছেন অন্য একটির কথা। মূল কথা হলো সব পাঠকের কাছে সব রচনা সমান গুরুত্ব পায় না। পাঠকের এই পছন্দকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।

. সম্প্রতি প্রকাশিত আপনার নতুন বই সর্ম্পকে বলুন। 

–আমার সম্প্রতি প্রকাশিত প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘কবি শহীদ কাদরী ও অন্যান্য প্রবন্ধ‘। আট টি প্রবন্ধের একটি বৃক্ষ। তবে এটি কোন একজাতীয় বৃক্ষ নয়। এর রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের ডালপালা। রয়েছে বাংলা এবং বিশ্বসাহিত্যের গুণিনদের উপস্থিতি। রয়েছে তাঁদের কাজ এবং অবস্থানের কথা। প্রতিটি রচনায় আমি সময় কে ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। এই সময় হয়তো একদিন নতুন সময়ের হাতে তার উত্তরাধীকারের স্বীকৃতি দেবে। বাংলা গদ্যসাহিত্যে এমন কাজ প্রচুর রয়েছে। তাই প্রায় প্রতিটি প্রবন্ধে আমি প্রেক্ষাপট এবং রচনার ভাষাভঙ্গী ও রীতি প্রয়োগে স্বকীয় অবস্থান চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছি। বাকিটুকু পাঠক আবিস্কার করে নিতে পারবেন।

‘যাদুরবংশীবাদক মার্কেজ‘। ল্যাটিন আমেরিকান সাহিত্যের অন্যতম প্রধান লেখক গার্বিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ এর  কাজ বিষয়ে রচিত এই প্রবন্ধ। ম্যাজিক রিয়েলিজমের এই যাদুকরকে আমি নানান দিক থেকে আলো ফেলে দেখার চেষ্টা করেছি। তাঁর লেখক জীবনের সূচনা থেকে শেষ পর্যন্ত যেসব রচনা তিনি রেখে গেছেন, প্রায় প্রত্যেকটি লেখা ও সময়কে ধরার চেষ্টা করেছি। উঠে এসেছে মার্কেজের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক চিন্তা ও দর্শন। আমি মনে করি এই প্রবন্ধে পাঠক একসাথে পেয়ে যাবেন তাঁকে। যে কোন পাঠক মার্কেজকে পাঠের পূর্বে এই প্রবন্ধ পাঠ করলে তাঁর রচনা বুঝতে অনেক সহজ হবে বলেও মনে করি। কেননা যে কোন সাহিত্যিকের বই পাঠের পূর্বে তাঁকে চেনা এবং তাঁর পারিপার্শ্বিক পরিবেশ-প্রতিবেশের সাথে পরিচিত হওয়া জরুরী বলে মনে করি। 

‘তখন টেড হিউজ অন্য নারী শয্যায় ছিলেন‘। ব্রিটিশ কবি টেড হিউজ এবং আমেরিকান-ব্রিটিশ কবি সিলভিয়া প্লাথ সম্ভবত ইংরেজি সাহিত্যের সবেচেয় বেশি আলোচিত নিজেদের ব্যক্তিগত এবং সাহিত্যের কারণে। আত্মবিধ্বংসী কবি সিলভিয়া প্লাথের মৃত্যুর এতো বছর পরও রহস্যের খোলস উন্মোচনে এখনো চলছে আলোচনা-সমালোচনা। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ওরসেস্টার কলেজের শিক্ষক, গবেষক স্যার জোনাথন বেট, ‘টেড হিউজ: দি আনঅথরাইজড লাইফ‘ নামে এই গ্রন্থ রচনা করেছেন। গ্রন্থটি ২০১৫ সালের ৮ অক্টোবর প্রকাশিত হয়(আমার রচনাটি এই গ্রন্থ প্রকাশের কয়েকদিন পূর্বে রচিত)। সেখানে তিনি সিলিভিয়া প্লাথ আত্মহত্যার সময় স্বামী টেড হিউজ কোথায় ছিলেন এবং সেই মুহুর্তের দৃশ্য উপস্থাপন এবং তা নিয়ে আলোকপাত করেছেন। গ্রন্থটি প্রকাশের আগেই ব্রিটেন, আমেরিকাসহ পুরো বিশ্বে আলোচনার ঝড় ওঠে। তারই প্রেক্ষাপট আমার আগ্রহের স্থান। ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাবশালী এই দুই কবি সব সময় আমার আগ্রহের কেন্দ্রে ছিলো। সেজন্যেই এ রচনায় আমি প্রসঙ্গের সাথে তুলে এনেছি আরো বিস্তারিত ভূমি। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একমাত্র ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ ‘স্ট্রে বার্ড‘স‘ এর চায়না অনুবাদ নিয়ে তুমুল বিতন্ডা শুরু হয়েছিলো একবার। গ্রন্থটি অনুবাদ করেছিলেন চীনের তরুণ লেখক ফ্যাং টাং। তাঁর রচনার প্রেক্ষাপটে আমার প্রবন্ধ ‘ তীব্র সমালোচনায় রবীন্দ্রনাথের স্ট্রে বার্ড‘স এর চায়না অনুবাদ‘। এই অনুবাদ গ্রন্থ নিয়ে ব্রিটেন-আমেরিকা থেকে শুরু করে ভারত-চীনসহ পুরো বিশ্বে সমালোচনা চলে। তবে এ নিয়ে বাংলাদেশে সমালোচনা তো দূরে থাক বেশ কয়েকজন তুখোড় সাহিত্যকর্মীর সাথে আলোচনা করে বুঝি তারা এ বিষয়ে কিছুই জানে না। ব্রিটেনের দি গার্ডিয়ান, ডেইলী মেইল, ডেইলি টাইম, বিবিসি থেকে শুরু করে আমেরিকার প্রভাবশালী পত্রিকাগুলো এ নিয়ে মেতে ওঠে। বাংলাদেশে একমাত্র দৈনিক সমকাল এর ‘কালের খেয়া‘ তে আমার এ সংক্রান্ত প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধটি প্রকাশের পর অনেকেই বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চান। সেই আগ্রহ থেকেই প্রবন্ধটি এই গ্রন্থভুক্ত করলাম। 

‘নীলপদ্মের উদ্যান জিংকি বয়েস‘। নোবেল বিজয়ী বেলারুশের সাংবাদিক সেটলানা আলেক্সিয়ভিস এর রিপোর্টিংধর্মী উপন্যাস ‘জিংকি বয়েস‘ বিষয়ে আমার এই প্রবন্ধের অবতারনা। ২০১৫ সালে তাঁর নোবেল বিজয়ের পর পরই এটি রচনা করি। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের যুদ্ধক্ষেত্র এই উপন্যাসের পটভূমি। তাতে যুদ্ধবিরোধী এই সাংবাদিক মানবিকতা ভুলুন্ঠিত হওয়ার দৃশ্য তুলে এনেছেন অনুপুঙ্খ। সাংবাদিকের চোখ যখন ঔপন্যাসিকের চোখ হয়ে ওঠে তখন দৃশ্য কেমন হয়, সেই বিষয়টি উঠিয়ে আনার জন্যই আমার এই রচনা।   

আমি কবি আবুল হাসান-এর রচনাকে সব সময় বুকে আগলে রেখেছি। এখানে সেখানে চিরকুটের মত অসংখ্য কথা তাঁকে নিয়ে লিখেছি। এই গ্রন্থভ’ক্ত প্রবন্ধ ‘ অনন্তযাত্রার কবি আবুল হাসান‘ সম্ভবত পূর্ণাঙ্গ রচনা। তাঁকে নিয়ে অসংখ্য রচনা রয়েছে। তবে কোন রচনা আমার দেখার দৃষ্টির সাথে এক নয়। আমি আবুল হাসানকে পাশ্চাত্যের আলো ফেলে নতুনভাবে আবিস্কার করেছি। এতে করে আমি আবারো বুঝতে পেরেছি সব ভাষার কবিতার সুর কিন্তু এক। এর চিন্তা, দর্শনও এক। কেবল কবির ভৌগলিক অবস্থান ভিন্ন। এটি আবুল হাসানকে দিয়ে আমি আবিস্কার করেছি। 

শহীদ কাদরী দীর্ঘ প্রবাস জীবনের কবি। রচনার বহর খুব বেশি নয়, কিন্তু জনপ্রিয়। তাঁকে নিয়ে রচিত আমার প্রবন্ধ ‘পাখিজীবনের কবি শহীদ কাদরী‘। এতে আমি মূলত বলতে চেয়েছি নতুন কোন কবিতা রচনা না করার ভেতর দিয়ে কবি কিভাবে কাব্য রচনা করে গিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে আমি বলতে চেয়েছি একজন কবি সব সময় কবিতা রচনা করেন। এমন কি কবি মৃত্যুর পরেও কবিতা রচনা করেন। অনেকেই বলে থাকেন শহীদ কাদরী প্রবাস জীবনে তেমন কোর কবিতা রচনা করেন নি। এই কথাটিকে আমি ভুল প্রমাণ করেছি। বলেছি তিনি কখনো কাব্য রচনা থেকে বিরত থাকেন নি। এটি গভীর নীরিক্ষণের বিষয়। 

কবি শামীম আজাদ এর কাব্যগ্রন্থ ‘জিয়ল জখম‘ নিয়ে আমার রচনা ‘দীর্ঘ সহবাসের জিয়ল জখম‘। কবির অনেকগুলো কাব্যগ্রন্থ থেকে আমি বিশেষ কারণে এটি নির্বাচন করেছি। আমার মনে হয়েছে এখানে কবি শামীম আজাদ নিজেকে মেলে ধরেছেন। এখানে তিনি চিন্তা, ভাষা, দর্শন, পারিপার্শিকতা, প্রকৃতি নিয়ে নতুন কাব্যভাষা তৈরী করেছেন। কবি বিলেতে অবস্থান করেন বলে তাঁর কাব্যভঙ্গি যে নতুন বাঁক নিতে দেখেছি তাকে তুলে ধরার জন্যই আমার এই রচনা। 

বহুমাত্রিক জ্যোতির্ময় হুমায়ূন আজাদ বিষয়ে আমার রচনা ‘তান্ত্রিক হুমায়ুন আজাদ‘। এতে হুমায়ুন আজাদ এর সাথে আমার ব্যক্তিগত স্মৃতিতর্পনের মাধ্যমে তুলে এনেছে তাঁর অভিব্যক্তিক চেহারা। যেখানে একজন হুমায়ুন আজাদকে আমি দেখেছি বাংলাসাহিত্যের একজন প্রভাববিস্তারি ব্যক্তিত্ব হিসেবে। সম্ভবত হুমায়ুন আজাদই একমাত্র সাহিত্যিক যাঁর মধ্যে কোন রকম রাঢাক ছিলো না। তিনি স্পষ্টভাষী এবং চিন্তুক। আমার এই প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাসাহিত্যে তাঁর রাজকীয় চেহারা উপস্থাপন করতে চেয়েছি।

. আপনি নিজেকে কোন দশকের কবিলেখক বলেন? কেন?

–এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। আমি দশক বিভাজনে বিশ্বাসী নই। বলতে পারি আমার উল্লেখযোগ্য বেশকিছু রচনা নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে শেষ সময়ে। আমি তো এখনো বিরাজমান। এখনো প্রতিদিন লিখতে না পারলে স্বস্তি পাই না। তাহলে আমাকে সময়ের ফ্রেমে কিভাবে বাঁধবেন? 

. আপনার সমকাল নিয়ে বলুন। 

–সমকালের তো অসংখ্য এলিমেন্টস রয়েছে ধরুন, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, শিল্প-সাহিত্য কোন বিষয় নিয়ে বলবো। এগুলোই তো প্রতিটি কালের ও সমকালের প্রধান লক্ষণ সমূহ। রাজনীতি নিয়ে বলতে চাই না, কারণ বাংলাদেশে রাজনীতি হয় না, হয় দল নীতি। এই দল নীতি বাংলাদেশের মানচিত্র ছিঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে। ইতিহাসের ভুল ব্যাখ্যা করছে। যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সকল মানুষ এক থাকার কথা ছিলো, তা হচ্ছে না, কারণ দেশে এখন দলনীতি রয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে যারা অস্বীকার করে তারা তো আসলে বাংলাদেশ কে স্বীকার করে না। আবার বঙ্গবন্ধুর আদর্শের দোহাই দিয়ে যে দলনীতি হচ্ছে তাও ঠিক নয়। এসব বদলাতে হবে। কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেই একটি দেশে স্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করে না। সার্বিক গণতন্ত্রায়নে সমাজ, অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন-শৃঙ্খলা এবং সর্বোপরি রাজনীতির একটি সহনশীল পর্যায়ে থাকতে হবে। তা তো হচ্ছে না। আর শিল্প-সাহিত্য চর্চার কথা যদি বলেন সেখানেও পুঁজির কালো ছায়া। বাংলা নাটকের অবস্থা ত্রাহি, ত্রাহি। মঞ্চে এখনো কিছু ভালো কাজ হচ্ছে। সাহিত্য এখন ঠিকাদারদের হাতে বন্দি। কেউ কেউ সাহিত্যিক তৈরীর কারখানা খুলে বসেছে। এর মাঝেও ভালো কাজ যে হচ্ছে না তা নয়। তবে খেয়াল করে দেখবেন, একজন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, একজন হুমায়ুন আজাদ, একজন আহমদ শরীফ, শামসুর রাহমান, আহমদ ছফা কিংবা একজন সৈয়দ শামসুল হক কিন্তু আর পাচ্ছি না। এই জায়গাগুলো শুন্যই থেকে যাচ্ছে। কথাসাহিত্যের বিরহকাল চলছে। পদ্যের তোড়ে কবিতা ভেসে যাচ্ছে। কিছু ভালো কাজও হচ্ছে, সেগুলো প্রকাশক এবং পত্রিকাগুলোর ঠিকাদারীর কারণে প্রকাশিত হচ্ছে কম। পাঠক সেসব লেখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বলতে পারেন সমকালের সব ক্ষেত্রেই একটি বন্ধ্যাকাল বিরাজ করছে।  

. সাম্প্রতিক কালে কারা ভালো লিখছে বলে মনে করেন? 

–আপনার এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে কারো মন খারাপ করতে চাই না। পৃথিবীর সকল প্রাণী সুখে থাক। 

. কত দিন আপনার প্রবাস জীবন? কোথায় আছেন? কি করছেন? পারিবারিক পরিচিতি জানতে চাই।

–‘প্রবাস‘ বা ‘প্রবাসী‘ এই শব্দের প্রয়োগে আমরা ভুল করছি। আমি বারবার বিভিন্ন লেখায় বলেছি, লেখক-সাহিত্যিক কখনো প্রবাসী হয় না। একজন ব্যক্তি প্রবাসী হতে পারে। লেখকের কোন সীমান্ত নেই। লেখক সর্বত্র বিরাজিত। তাঁকে বলতে পারেন ‘অনাবাসী‘। আমি আপনার প্রশ্নে উত্তরে বলতে পারি, প্রায় এগারো বছর অনাবাসে আছি। থাকি শিল্প-সাহিত্য এবং একই সাথে বুর্জোয়া পুঁজিবাদীদের ব্যস্ত শহর লন্ডনে। তবে এই শহরে থেকে একটি বিষয় খুব ভালো করেও বুঝতে পারছি যে, শিল্প-সাহিত্যের কদর কিভাবে করতে হয়। এখানে সাহিত্য চর্চার অসম্ভব রকম সম্ভাবনা এবং সুযোগ রয়েছে। আমি চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ পাহাড়ের ছায়াঘেরা সীতাকুণ্ড থেকে ঢাকায় সাংবাদিকতা ও সাহিত্য চর্চায় নিবিষ্ট ছিলাম। হঠাৎ লন্ডনে চলে আসি। বাবা ডাক্তার এ কে এম ওয়াহীদি, মা নুরজাহান বেগম। ছয় বোন চার ভাইয়ের মধ্যে বোনের মধ্যে আমি সপ্তম। ভাইদের মধ্যে চতুর্থ।     

. প্রবাস জীবনে সাহিত্যচর্চায়  প্রতিবন্ধকতা বা সুবিধা কি? কোথায়?

–লন্ডনের অনাবাস জীবনে সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতা আমি দেখি না। বরং এখানে সকল সম্ভাবনার দুয়ার খোলা। রয়েছে পড়াশুনার সুযোগ। রয়েছে অসংখ্য লাইব্রেরী। লাইব্রেরীগুলোকে ঘিরে শত রকমের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। গবেষকদের জন্য অবারিত সুযোগ এখানে। প্রয়োজনীয় সব গ্রন্থই রয়েছে লন্ডনের বিভিন্ন লাইব্রেরীতে। ফলে আমি লন্ডনে বসে অনেক উল্লেখযোগ্য কাজ করেছি। ঢাকায় বসে এমন সুযোগ একজন লেখক কল্পনাও করতে পারবে না।  

১০. আপনি কখনো কি কোন পত্রকিা বা লটিল ম্যাগাজনি অথবা সংকলন সম্পাদনা করছেনে? বিস্তারিত বলুন।

–লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা একটি কঠিন কাজ। একবার চেষ্টা করেছিলাম। ‘অরণ্য‘ নামে একটি লিটলম্যাগ সম্পাদনা শুরু করেছিলাম পঁচানব্বই সালের দিকে। সম্ভবত দু‘টি সংখ্যা প্রকাশের পর আর এগুতে পারি নি। পরে দেখেছি ঢাকার কাঁঠাল বাগান থেকে একটি ছোট কাগজ প্রকাশিত হয় একই নামে। তারপর আরো উৎসাহ হারাই। দীর্ঘ সময় পর আমি ইউরোপের তেইশটি দেশের লিটলম্যাগ নিয়ে গবেষণা করেছি লন্ডনে বসে। একটি দীর্ঘ রচনা দাঁড়িয়েছে।  

১১. লিটল ম্যাগাজিন এর সংজ্ঞা কি? এ নিয়ে আপনার ভাবনা বলুন।

–এসব নিয়ে আর কথা বলতে চাই না। প্রতিষ্ঠান বিরোধী মনোভাব থেকে যে লিটলম্যাগ আন্দোলনের সূচনা হয়েছিলো তা অবিচল থাকে নি। বাংলাদেশে যারা এই আন্দোলনের শুরুতে ছিলেন তাদের প্রায় সকলেই প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে। এখন তো অসংখ্য সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয় (এগুলোকে আমি লিটলম্যাগ বলতে চাই না)। যেগুলোকে সম্পাদকরা লিটলম্যাগ বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। কিছু লিটলম্যাগ আছে যেগুলো চরিত্র ধরে রাখার চেষ্টা করছে।   

সাক্ষাৎকার গ্রহণে : সাজ্জাদ বিপ্লব, ২০১৭

আরও পড়তে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ