তৈমুর খান
২৮
জীবন শুধু মৃত্যু বহনকারী একটি শবযান
আমার বাবার মধ্যেই কবিতা ছিল। দুঃখের সংসারে বাবাকে কবিতাই বাঁচিয়ে রেখেছিল। মুখে মুখে কত কবিতা বলতে পারতেন বাবা। কার কবিতা, কোন্ বইয়ে আছে তা জানতাম না। বাবা যখন যা পড়তেন তখন তা প্রায় মুখস্থ হয়ে যেত। তাই জীবনের নানা দুঃখে,অভাবে অভিযোগে কবিতাতেই সান্ত্বনা খুঁজতেন। বাবার বলা কয়েকটি কবিতার কেবল শুরুটা উল্লেখ করছি:
১)
“দোকান করে রামুদামু মিলে দুটি ভাই
দুইজনা যে বেজায় কৃপণ বাজে খরচ নাই।”
২)
“খেজুর গাছেতে হাঁড়ি বেঁধে রস তার পেড়ে লয়
সেই রস দিয়ে পাটালি ও গুড় প্রতিদিন ভোরে হয়।
তাই ফেরি করে বিনোদ গাছির চলে যায় সংসার
মা আর বউ আত্মীয় ছাড়া নাই কেহ আপনার।”
৩)
“যতদিন করে নর অর্থ উপার্জন
ততদিন নিজ বশে থাকে পরিজন।
রোগে-শোকে শক্তিহীন হয় যবে দেহ
কুশল শুধায় না ডেকে আর কেহ।”
৪)
“মা গুণে হয় বিটি
আটা গুণে হয় রুটি
মাটির ঘরে বাঁশের খুঁটি
যেমন মানায়।”
আরও কত কত কবিতা বাবা অনেক সময় বানিয়ে বানিয়েই বলতে পারতেন। তবে রবীন্দ্রনাথের স্পর্শমণি, পুরাতন ভৃত্য, দুই বিঘা জমি; কুমুদরঞ্জন মল্লিকের আদুরী; সুকুমার রায়ের ষোল আনাই মিছে এবং রামপ্রসাদ সেনের গানের কয়েক পংক্তি প্রায়ই উচ্চারণ করতেন— ‘সুখ পেয়ে লোক গর্ব করে, আমি করি দুঃখের বড়াই’। কবিতা বা গান, বা কিছু এলোমেলো সুর বাবার কণ্ঠে ধ্বনিত হতো। তিনি যেন আশ্রয় পেতেন সেইখানে। সেগুলোই যেন তাঁর জীবন সংগ্রামের ঢাল। সংসারের যুদ্ধভুমিতে তিনি নিজেকে রক্ষা করতেন।
চার ভাই ছিলাম আমরা এবং তিন বোন। সকলেরই বড় আমি। সব থেকে ছোট ভাইটির সঙ্গে আমার বয়সের ব্যবধান প্রায় কুড়ি বছর। আমি লেখাপড়া শিখলেও আর তিন ভাই তেমন অগ্রসর হতে পারেনি। হাইস্কুল অবধি পৌঁছালেও এখান থেকে আর উত্তরণ ঘটেনি। কেবল ছোট ভাইটিই উচ্চ মাধ্যমিক পৌঁছেছিল। আমার পরের দু’ভাই মজুর খেটেই জীবিকা নির্বাহ করে। ছোট ভাইটি কম্পিউটার চালনা শিখে গ্রামীণ সমবায় ব্যাংকে সামান্য বেতনে ক্লার্কের চাকরি করত। ২০১৯ সাল থেকে ২০২২ পর্যন্ত নানা সময়ে লকডাউনের কারণে তার উপার্জন প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। তখন অতিরিক্ত সুদের উপর ধারদেনা করে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। কিছুটা সামাল দেবার চেষ্টা করেও আমরা আর ওকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারি না। অতিরিক্ত মদ সেবনের ফলে এদিকে ভেতরে ভেতরে তার মারণ রোগ লিভার ক্যান্সারও দেখা দেয়। ফলে মাত্র ৩৫ বছর বয়সেই বাড়িতে সবার ছোট হয়েও সবার আগেই সে প্রস্থান করে। তার মৃত্যু শুধু আঘাতই নয়, আমাদের সব বড়দের গভীর বিষাদেও পতিত করে। সেই বিষাদ সহ্য না করতে পেরেই তার মৃত্যুর ৮ মাস পরেই বাবাও আমাদের ছেড়ে চলে যান। চারিদিকেই একটা শূন্যতা আমাদের গ্রাস করতে থাকে। আমি শহরে এলে আমার সঙ্গে আমার বাবাও চলে আসেন। ঘরে তিন ভাইসহ মা থাকলেও তারা প্রায় অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। গ্রামের অধিকাংশ মানুষই মজুর খাটা। সারাদিন কাজ করে সন্ধেবেলায় একটু নেশা না নিলে তারা স্বস্তি পায় না। নীতি-নৈতিকতার আদর্শ তাদের মধ্যে নেই বললেই চলে। তার উপর মদ-ছেনালী, পরকীয়াও নানাভাবে বেড়ে যায়। যে গ্রাম আমি ছেড়ে এসেছিলাম, সেই গ্রাম যে অনেকটাই পাল্টে গেছে তা পরে বুঝতে পারলাম। রাজনীতি, বৈষম্য-বিভাজন, মদ-জুয়ার আসর, তাস-মোবাইলের ব্যবহার যে মাত্রা ছাড়িয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবু গ্রামে গেলে আমি কবরস্থানে আগে যাই। বিকেলবেলার আলোর রোশনাই কবরের উপর বিছিয়ে দেয় সূর্য। অপূর্ব এক দৃশ্য তৈরি করে।বড় বড় ঘাসের মধ্যে থেকে ডেকে উঠে কোনো পাখি। কোনো শেয়ালের মুখ আড়ালে আমাকে নিরীক্ষণ করে।
মানুষের মৃত্যু ঘটলেও মনের মাঝে তারা জীবিত থাকেন। নীরব ভাষায় কথা বলেন। আমি গভীর মগ্ন হয়ে তাদের কথা শুনতে পাই।ছোট ভাইটির কবরের কাছে গিয়ে ডাকতে থাকি:
—রুকুন, তোকে কতবার মানা করেছিলাম, তবু তো শুনিসনি আমার কথা! তোর যত ঋণ ছিল সব আমি শোধ করে দিতাম। আমাকে তুই একটিবার বললি না কেন?
—আমি লজ্জায় তোমার সামনে দাঁড়াতে পারিনি;যেভাবে নেশাগ্রস্ত হয়ে উঠেছিলাম সেখান থেকে আর বেরিয়ে আসা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই তোমার ভাই হয়ে আমি কুলাঙ্গার পরিচয়ে বাঁচতে চাইনি।তিলে তিলে নিজেকে শেষ করে দিয়েছিলাম।
—তোর একমাত্র আট বছরের সন্তান, আর কম বয়সী একটি বউ তাদের কথাও একবার ভাবলি না! তারা কী অন্যায় করেছিল?
—না, তারা কিছুই অন্যায় করেনি; তাদের প্রতি আমি অবিচার করেছি। কিন্তু আমার আর কোনো উপায় ছিল না নিজেকে ভালো করে তোলার। ধ্বংসের পথে অনেকটাই পৌঁছে গেছিলাম। তোমরা যারা আছো, তারা ওদের দেখিয়ো। আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো।
—ক্ষমা তো করে দিয়েছি। আল্লাহ যেন ক্ষমা করেন সর্বদা এই প্রার্থনাই করি।….
মনে মনে বলতে বলতেই ভেতর থেকে দু-ফোঁটা অশ্রু এসে চোখ ভিজিয়ে দেয়।দুই হাত তুলে তখন দোয়া করতে থাকি বাবার জন্য আর আমার ভাইয়ের জন্য। আমি জীবিত মানুষ হলেও আমারও যে কোনো ক্ষমতাই নেই তা বুঝতে পারি মহান স্রষ্টাকে উপলব্ধি করে। কবরখানা থেকে ফিরি আর ধীরে ধীরে সূর্যও অস্ত যায়।
আমাদের পরিবারটিকে নিম্নবিত্ত পরিবারও বলা যায় না। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় পরিবার; একবেলা খেয়ে আর দু’বেলা উপোস দিতে হয় যে পরিবারকে—সেই পরিবারকে কী করে নিম্নবিত্ত বলা যায়? কিন্তু তবুও আমরা কেউ চুরি করা শিখিনি। আমরা কেউ কারও না বলে কোনো জিনিস আত্মসাৎ করতে পারিনি। সেই মূল্যবোধ বাবাই শিখিয়েছিলেন। সততার মূল্য অসীম একথা ছোটবেলাতেই বুঝিয়েছিলেন। তাই একদিকে ধৈর্য ধারণ করা, অন্যদিকে সৎ পথে থাকা এবং অল্পে সন্তুষ্ট থাকা আমরা আয়ত্ত করতে পেরেছিলাম। বাবার মৃত্যুতে তাই মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়েছিল। কোনো কাজ করতে গেলে, কখনো পরামর্শের দরকার হলে তা বাবার কাছেই পেতাম। তাই মৃত্যুর প্রথম উপলব্ধিতেই যে কবিতাটি আমার হাতে এসেছিল তা এখানে তুলে দিলাম:
“বাবার চলে যাবার প্রথম দিন
চশমাখানা বাবাই খুলে রেখেছিলেন
লাঠিখানা বাবাই দেওয়ালে ঠেস দিয়ে রেখেছিলেন
কতদূর পড়া হয়েছিল বিভূতি সমগ্র?
তা বাবাই চিহ্নিত করে রেখেছিলেন…
উঠোনে শীতের রোদ এসে ফিরে গেল
ফাঁকা চেয়ারটি আজ আর সরাতে পারলাম না
বাবার চপ্পল জোড়া তেমনই খুলে রাখা আছে
একটা ডট পেন পড়ে আছে টেবিলে
কোথায় গেল বাবা? আমরা সারাদিন কাঁদলাম
কে আমাদের বানিয়েছিল? কেন পাথর হইনি তবে?
জন্মের পর সবাই মৃত্যুর দিকে হাঁটে
কেউ খুব দ্রুত হাঁটে, কেউ হাঁটার গতি কমিয়ে দেয়
আমরা রোজ অন্ধকার পুষে পুষে
আলোর মরীচিকাকে ভালবাসতে চাই
আমরা রোজ মৃত্যুকে লুকিয়ে রেখে জীবনকে হাসাতে চাই
আমরা রোজ বাবাকে হারিয়ে নিজেরাই বাবা হয়ে যাই”
কবিতা যে কত সত্য কথা বলতে পারে তা আমার মনে হয় একজন প্রকৃত কবিই সেটা উপলব্ধি করতে পারেন। বাবার শূন্যতা কখনো পূরণ হবে না। অন্ধকারের মধ্যে, আলোর মধ্যে, আকাশে-নক্ষত্রে, শূন্যতায় বাবাকে দেখতে পাই। ঘুম আসে না যখন একলা বিছানায়, তখন মনে হয় মাথার কাছে বাবা এসে বসে আছেন। জীবিত অবস্থায় যেমন ছিলেন তসবিহ দানা নিয়ে, এখনো ঠিক তেমনই রয়েছেন। ফজরের অক্ত যাবার আগেই বাবা এসে যেন ডাক দিচ্ছেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। একটা নতুন কবিতা লিখে নিজেই যখন পড়ছি, তখন মনে হচ্ছে আমার সঙ্গে সঙ্গে আমার বাবাও পড়ছেন। একটা জীবন যেভাবে বেঁচে আছে, যেভাবে দৌড়ে চলেছে, যেভাবে বক্তৃতা দিচ্ছে, যেভাবে ‘বাবা’ ডাক শুনছে, যেভাবে ভাবছে—সবকিছুতেই যেন অনেক জীবনের সমন্বয়। একার মধ্যে বহু বিরাজ করছে। বাবা নেই, তবু বাবা আছে,মা আছে, ছোট ভাই আছে, পুত্র-কন্যা, অতীত বর্তমান সব আছে। হঠাৎ মনে পড়ে যায় মৃত্যু শয্যায় ছটফট করা নাসিম-এ-আলম এর কথাও। ক্যান্সারে পুরো মুখগহ্বর ক্ষত হয়ে আছে। নাকের ফুটো দিয়ে নল ভরে নলের ভেতর দিয়ে পাঠানো হচ্ছে তরল খাবার। কথা বলার সামর্থ্য নেই। শয্যা ছেড়ে ওঠার সামর্থ্য নেই। কী কষ্ট! কী কষ্ট! ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে শুধু চোখে চোখে তাকিয়ে আছে। সান্ত্বনা দেবার কথা কিছুই নেই। মৃত্যু তাঁর চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একসঙ্গে কত সিগারেট, কত চা পান করেছি। হইহুল্লোড় করেছি কত কবিতা নিয়ে। চোখের সামনে তাঁর এই দশা! আইরিশ কলোনিতে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। চাঁদ সদাগরও তাঁর সপ্তডিঙা মধুকর নিয়ে আর ফিরে আসবে না। সব মৃত্যু মুখগুলি এক জায়গায় জমা হতে লেগেছে। আমিও স্থির হতে পারছিলাম না। ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে এসেছিলাম রাস্তায়। জীবন শুধু মৃত্যু বহনকারী একটি শবযান। স্মৃতি বহনকারী একটি বাক্স। কান্না বহনকারী একটি হৃদয়।