প্রচ্ছদপ্রবন্ধআহা মৃত্যু, কী অমোঘ! আহা জীবন, কী ঠুনকো!

লিখেছেন : আবু তাহের সরফরাজ

আহা মৃত্যু, কী অমোঘ! আহা জীবন, কী ঠুনকো!

আবু তাহের সরফরাজ

পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণাকে অণু বলে। দুই বা তারচেয়ে বেশি পরমাণু একসাথে মিলিত হয়ে অণু তৈরি হয়। একই পদার্থের দুই বা তারচেয়ে বেশি অণু বিশেষ একটি আকর্ষণে একটি আরেকটির সঙ্গে মিলিত অবস্থায় থাকে। এই আকর্ষণ বলকে সংসক্তি বলে। কবিতার শব্দগুচ্ছেও এরকম সংসক্তি বল রয়েছে। যদিও শব্দ পদার্থ নয়, কিন্তু যে কবি পদার্থ সেই কবির কবিতায় একটি শব্দ সংসক্তি বলে আরেকটি শব্দকে আকর্ষণ করে টেনে এনে তার পাশে বসিয়ে দেয়। অপদার্থ কবির কবিতায় এমনটি ঘটে না। কবি সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে। একদল কবি আছেন যারা কবিতা লেখেন না। কবিতাই তাদের ওপর ভর করে তাদের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করে নেয়। সন্দেহ নেই, পুরো প্রক্রিয়ার ভেতর এক রকম আধ্যাত্মিক বোঝাপড়া আছে। এসকল কবিরাই প্রকৃত কবি। আরেক দল কবি আছেন যারা কবিতা লেখেন। কবিতা তাদের ওপর ভর করে না। বরং তারাই কবিতার ওপর ভর করে টেনেহেঁচড়ে কবিতাকে নেমে আসতে বাধ্য করেন। আর এহেন টানাহেঁচড়ায় কবিতার দফারফা। কোনোমতে ছেঁড়াখোঁড়া অবস্থায় কবিতা তাদের হাতে ধরা দেয়। এসকল কবি যখন এই কবিতা দেখেন তখন আত্মপ্রসাদে গদগদ হয়ে ওঠেন। আহা, আমিও তাহলে কবি! কী আনন্দ! এসকল কবিরাই প্রকৃত অকবি। যেসব শব্দ দিয়ে তাদের কবিতা শরীরী হয়ে ওঠে সেসব শব্দ পাঠকের শৈল্পিক কর্ণকুহরে ঠকঠক খটখট আওয়াজ তোলে। নানা রকম শব্দকে জোড়াতালি দিয়ে কবিতার এক ধরনের অবয়ব দেয়ার চেষ্টা অকবিদের কবিতায় লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু কবিদের কবিতার বেলায় কী ঘটে? এবার সে বিষয়টি একটু চোখ বুলিয়ে দেখে নেয়া যাক।
জগৎ প্রাণময়। যাকে আমরা জড় বা প্রাণহীন পদার্থ বলছি, সেই পদার্থের ভেতরও প্রাণের স্পন্দন রয়েছে। এ বিষয়টি এখানো যাদের জানা হয়ে ওঠেনি তাদেরকে অনুরোধ করব রবীন্দ্রনাথকে লেখা জগদীশচন্দ্র বসুর চিঠিগুলো পড়ে ফেলতে। সকল পদার্থের মতো শব্দেরও প্রাণ আছে। যদিও শব্দ পদার্থ নয়। কিন্তু প্রকৃত কবির মধ্যদিয়ে বেরিয়ে এসে শব্দ যখন কবিতার শরীর নির্মাণ করে সেই সময় শব্দে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়। আমরা জানি, শব্দ যে কোনো একটি মানে প্রকাশ করে। কিন্তু প্রকৃত কবির কবিতায় মানে বহন করা ছাড়াও কবির বোধের স্পন্দন অনুরণিত হয়ে ওঠে শব্দে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, কবি ও অকবির সীমারেখা আমরা এখন গুলিয়ে ফেলেছি। অবশ্যি এজন্য গণমাধ্যম ও ক্ষমতার আস্ফালন বিশেষভাবে দায়ী। ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট পেতে গণমাধ্যমের সাহিত্য পাতার সম্পাদক ক্ষমতাধর অকবিদেরকে কবি হিসেবে আলোচনার শীর্ষে তুলে দিয়েছে। আবার, তেমন কোনো ক্ষমতা না থাকায় অনেক কবিই পাঠকের আড়ালে ঘাড়গুঁজে লিখে চলেছেন কবিতা। নব্বইয়ের দশকের কবি শাকিল রিয়াজকে আমার এরকম একজন কবি বলেই মনে হয়েছে। তিনি কবিতা লেখেন না। কবিতাই তাকে দিয়ে লিখিত হয়ে ওঠে। ফলে, তিনি নিমিত্ত। ‘ঘুমের ভেতর’ কবিতা থেকে কয়েকটি বাক্য পড়া যাক:

ঘুমের ভেতর আবছা করে তুমি
আবার এলে ঘুম ভাঙাতে ফের
আবার তুমি হাত দিয়েছো গায়ে
তাপ খুঁজেছো জ্বরের মানুষটায়।

এই যে দেখো কত বছর পর
জাগলে তুমি ঘুমের শহরটিতে
জানলা খোলা, উড়ছে পাতা কাচে
নক করেছে তোমার ছোটকাল।

তুমি তখন খুব অসুখি ছিলে
বাড়ির দিকের রাস্তা ছিল ভারি
তোমার পায়ে মদ্যদোলন ছিল
তোমার পায়ে ছিল পদস্খলন।

এই যে পঙক্তিগুচ্ছ আমরা পড়লাম, এখানে এমন একটি শব্দও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না যে শব্দটি মনে হতে পারে জোর-জবরদস্তি করে নামিয়ে এনে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। বরং দেখা যাচ্ছে, শব্দের সংসক্তি বলের আকর্ষণেই একটি শব্দ আরেকটি শব্দের সাথে বাঁধা পড়ে আছে। স্বরবৃত্ত ছন্দের গাঁথুনিতে নির্মিত এই কবিতায় অন্তমিল নেই। নেই যে, তাতেও কি পড়তে কোথাও হোঁচট খেতে হচ্ছে? না, তা কিন্তু হচ্ছে না। বরং, স্বরবৃত্তের দোলনটা আগাগোড়াই পাঠককে ছন্দায়িত করে রাখছে। কবিতার এরকম কৃৎকৌশল কিন্তু সহজাত। ভেতর থেকে উঠে আসতে হয়। তা না-হলে নিখুঁত জ্যামিতিক ছকে কবিতাকে শিল্পরূপ দেয়া কঠিন। জোর করে শব্দকে ধরে এনে এ ধরনের কবিতা নির্মাণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু অনেকেই সেই চেষ্টা করে থাকেন। নব্বইয়ের দশকের অনেক কবির কবিতাতেই এই প্রবণনা আমরা দেখতে পাই। কিন্তু তাদের নিয়ে কথা বলা নিরাপদ নয়। কেননা, সাহিত্যে তারা প্রভুত ক্ষমতাবান। কবিতায় কবি কী বলছেন, সেটাও কিন্তু পাঠকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। শব্দের পর শব্দ পড়ে আন্দোলিত হলেই পাঠক খুশি হয়ে যায় না। কবিতার ভেতর থেকে কিছু কথা কিংবা কোনো ইঙ্গিত পাঠক আশা করতেই পারে। এটা দোষের নয়। টেনেহেঁচড়ে নামিয়ে আনা কবিতার বোধ পাঠকের মাথার ওপর দিয়ে বায়বীয় হয়ে উড়ে যায়। পাঠক কিছুই তার ধরতে পারে না। নানা মাধ্যমের প্রচারণায় প্ররোচিত পাঠক ভেবে বসেই থাকে, আমি না বুঝলে কি, উনি এত্ত বড় কবি, ভুংভাং তো আর লিখতে পারেন না। অথবা দেখা গেছে, মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেলেও কোনো কোনো পাঠক এমন ভান করে যে, পুরো কবিতাটিই তার মাথার ভেতর ঢুকে বসে আছে। আর তিনি কবিতার সবটুকু বুঝে বসে আছেন। এসব চাতুর্যের বিপরীতে যে কবিতা মহাবিশ্বের কোনো এক জগৎ থেকে এসে এই পৃথিবীতে আত্মপ্রকাশ করে কোনো এক কবির মাধ্যমে, সেই কবিতার আকাঙ্খা থাকে তার স্বরূপ প্রকাশের। কবিতার সেই স্বরূপ পাঠকের চোখে যখন ধরা পড়ে সেই সময় পাঠকের যে আনন্দ হয়, এই আনন্দই আসলে শিল্পের মজা। পাঠক চিত্তের আনন্দ। ‘ঘুমের ভেতর’ কবিতা থেকে যে কয়টি পঙক্তি ওপরে তুলে দিয়েছি, পঙক্তিগুলো পড়তে পড়তে পাঠকের বোধের জগতে ছবি আঁকা হয়ে যাচ্ছে। ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। সুনির্দিষ্টভাবে সেই ছবি কিংবা ইঙ্গিতের ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। সম্ভব আসলে কখনো হয়ও না। কবিতা যেহেতু পরিমাপের কোনো পদার্থ নয়, ফলে কবিতার নির্দিষ্ট কোনো মানে দাঁড় করানোও আসলে প্রগলভতা। প্রত্যেক মানুষের বোধের জগৎ আলাদা আলাদা। অনুভূতির শিহরণ একেকজনের একেক রকম। ফলে, কবিতার ইঙ্গিত একেক পাঠক একেক রকমভাবে উপলব্ধি করবে, এটাই স্বাভাবিক।

মৃত্যু এসে কানে কানে ফিসফিস করে।
চেঁচিয়ে ধমক দেই তাকে,
কী বলবে বলো, জোরেশোরে বলো বন্ধুবর
অন্তর্ধানের এমন ডাক হোক উৎসবমুখর।
জীবন তো গোপনীয় কিছু নয়।

‘গুম’ কবিতার এই পঙক্তিগুলো শাকিল রিয়াজের দার্শনিক বোধকে আমাদের সামনে প্রকাশ করে দেয়। আমরা জানি, মৃত্যু খুব নীরবে অকস্মাৎ এসে হাজির হয় আমাদের জীবনের দরজায়। যেন আমাদের কানে কানে ফিসফিস করে সে তার আগমন বার্তা জানান দেয়। কিন্তু কবি মৃত্যুর এই চুপিচুপি আবির্ভাবকে মেনে নিতে পারেন না। আর তাই তিনি ধমক দিয়ে মৃত্যুকে বলেন, যা বলবে জোরসে বলো। এমন রাখোঢাকো কেন বাপু! কবি মৃত্যুকে বন্ধু হিসেবে সম্বোধন করছেন। অথচ আমাদের কাছে মৃত্যু একটি বিভীষিকার নাম। আতঙ্কের নাম। গৌতম বুদ্ধ বলেছিলেন, মানুষের যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি অবাক করে তা হচ্ছে, প্রতিদিনই তার চারপাশে কেউ না কেউ মারা যাচ্ছে। অথচ মানুষ এমনভাবে জীবনযাপন করছে যেন সে কখনোই মারা যাবে না। কিন্তু এই কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে আমাদের মনে হচ্ছে, শাকিল রিয়াজ মৃত্যুকে ভুলে নেই। মৃত্যু তার কাছে বিভীষিকা নয়, পরম আরাধ্য। বন্ধুর মতো কাঙ্ক্ষিত। জীবন যেহেতু গোপনীয় কোনো ব্যাপার নয় তাহলে মৃত্যুর এত গোপন আবির্ভাব কেন! শাকিল চান, মৃত্যুমুহূর্তটা করুণ নয়, আনন্দমুখর হয়ে উঠুক। কবিতার শেষ দুটি বাক্যে কবি লিখছেন, ‘উচ্চস্বরে আমি মারা যেতে চাই সোনা/নিরিবিলি অন্ধকারে গুম হতে চাই না কখনো।’ কবির শেষ ইচ্ছে, আনন্দমুখর পরিবেশে স্বশব্দে তিনি মারা যেতে চান। মৃত্যু যেভাবে গোপনে এসে আমাদেরকে হরণ করে নিয়ে যায় সেই অবস্থা কবির কাছে গুম হয়ে যাওয়া বলে মনে হয়েছে। তিনি গুম হতে চান না। কিন্তু ‘দুটি মুঠ’ কবিতায় তিনি লিখছেন:

মৃত্যুর সামনে এসে জীবনটা বেঁকে বসে আছে।
কিভাবে ফেরাবে তাকে?
… পাতা ঝরে রাতের গভীরে
কমলা রঙের পাতা, শয্যাশায়ী, সেখানে করুণ জ্যোছনা
কিছু সুর রেখে যায়।

মৃত্যু অনিবার্য। মৃত্যু এমনই এক সত্য যে, যা কোনো প্রাণীই এড়িয়ে চলতে পারে না। মৃত্যুর সামনে জীবন বেঁকে বসে আছে। মানে, জীবন মৃত্যুকে বরণ করতে চাচ্ছে না। কবি বলছেন, যতই বেঁকে বসে থাকো, মৃত্যুকে তুমি কিভাবে ফেরাবে হে? কোনোই উপায় নাই। মৃত্যু ঠিকই তোমাকে হরণ করে তুলে নিয়ে যাবে মহাকালের গহ্বরে। যদি তাই-ই হয়, তাহলে মৃত্যুকে আর বিভীষিকা ভেবে মৃত্যুর সামনে বেঁকে বসে থাকার কোনো মানে হয় না। তাই দৃঢ় কণ্ঠে শাকিল রিয়াজ ঘোষণা দিচ্ছেন, হে মৃত্যু, তুমি সশব্দে আসো। আমি প্রস্তুত আছি। পাতা ঝরে রাতের গভীরে/কমলা রঙের পাতা/করুণ জ্যোছনা কিছু সুর রেখে যায়— বাক্যগুলো মৃত্যুপরবর্তী চিত্রময়তা। কী সাঙ্ঘাতিক হাহাকার তুলে বাক্যগুলো ধূসর এক একটি ছবি হয়ে আমাদের বোধের মর্মমূলে গ্রোথিত হয়ে যায়। মৃতব্যাক্তি যেখানে শয্যাশায়ী সেখানে করুণ জ্যোছনা যেন কিছু সুর রেখে যায়। মাত্র কয়েকটি বাক্য এখানে। অথচ এক একটি বাক্য মৃত্যুপরবর্তী অবস্থার যে ধূসর ছবি এঁকে দেয়, সেসব ছবির ক্যানভাস কতটা বিস্তৃত সেটা মেধাবী পাঠকের বুঝতে সময় লাগে না। মনের চোখে যখন ছবিগুলো আমরা দেখতে থাকি তখন কখন যে আমাদের বুকের ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে, আমরা টেরও পায় না। আহা মৃত্যু, কী অমোঘ! আহা জীবন, কী ঠুনকো! মৃত্যু নিয়ে নব্বইয়ের দশকের কবিদের লেখা অনেক কবিতাই রয়েছে। সেসব কবিতা মৃত্যুকে নানাভাবে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করলেও শাকিল রিয়াজের চিত্রিত মৃত্যুর স্বরূপ ওই সময়ের আর কোনো কবিতায় আমার চোখে পড়েনি। মৃত্যু যে আমাদের চিরসখা, এই সত্য ঢাকঢোল পিটিয়ে সকলকে জানান দিয়েই যেন নিজেকেই বুঝিছে দিচ্ছেন শাকিল রিয়াজ। ধরাবাঁধা কোনো ছন্দের গাঁথুনি নেই এই কবিতায়। বৈঠকি গল্পচ্ছলে বলার কথাগুলা স্বচ্ছন্দ্যে বলে গেছেন শাকিল। শব্দের বাড়তি আয়োজন নেই। অপচয় নেই। যা বলার, যতটুকু বলার, ততটুকুই কেবল বলেছেন। এই পরিমিতিবোধ তার প্রায় সকল কবিতাতেই পাঠকের চোখে পড়বে। নানা ফর্মে কবিতা লিখেছেন শাকিল। যখন যে ফর্মেই লিখেছেন, খুব দক্ষতার সাথে তিনি সেই ফর্মের বৈশিষ্ট্য রক্ষা করেছেন কবিতায়। কখনোই কোনো শব্দকে আরোপিত মনে হবে না। মনে হবে না, কবিতার মতো করে আসলে তিনি প্রলাপ বকছেন। তবে একথা ঠিক, কোনো কোনো কবিতায় কিছু কিছু বিষয় (বলা ভালো, ইঙ্গিত) তিনি উহ্য রাখেন। যা পাঠককে খুঁজে নিতে হয়। শাকিল এই কাজটি করেন কারণ, আমার মনে হয়, তিনি চান ঋদ্ধ পাঠক। তৈরি হয়ে আসা পাঠক। শিল্পের প্রকৃত সমঝদার। তার এই চাওয়া ঠিকই আছে। আমাদের দেশে কবিতার পাঠক এমনিতেই কম। এর ওপর যারা আছে তারা সকলেই কবিদের নানা সিন্ডিকেটের প্রচারণায় প্রভাবিত। অকবিতাকেও এসব পাঠক কবিতা মান্য করে গোগ্রাসে গিলছে। এহেন ডামাডোলে শাকিল রিয়াজ হয়তো বিব্রতবোধ করেন। তাই তিনি আশা করতেই পারেন, প্রকৃত কিছু পাঠক। ‘পিথাগোরাস’ কবিতায় শাকিল রিয়াজ লিখছেন:

রাত স্তন্যপায়ী। হে চাঁদ, চাঁদের কঠোর প্রচ্ছায়া
তোমার গহ্বর ছিঁড়ে লাফ দেয় খয়েরি ইঁদুর
রাতের ইশারা পেয়ে গল্প শেষ করে ঘড়ির প্রলাপ
তবুও কখনো বিড়ালের কান্না কাঁধে নিয়ে
পাপবিদ্ধ এক ফেরিঅলা হেঁকে যায়
মধ্যরাতের সড়কে।

এই যে পঙক্তিগুচ্ছ, এখানে প্রতিটি শব্দেই প্রাণের স্ফুরণ আমাদের বোধকে তাড়িত করে ফেরে। বাক্যগুলো দিয়ে আঁকা হয়েছে রূপকথার একটা ছবি। কী রকম ঘোরের ভেতর নিয়ে যায় আমাদেরকে। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, এই রূপকথার ফাঁকে ফাঁকে বেশ কিছু ফাঁকা জায়গা রয়েছে। যেখানে পাঠক তার মতো করে দৃশ্যকল্প তৈরি করে নিতে পারে। মানে, কবি তার এঁকে তোলা ছবিতে কিছু কিছু জায়গা শাদা রেখেছেন যেখানে পাঠকের ছবি আঁকার সুযোগ রয়েছে। কোনো কবিতায় যখন পাঠক অংশগ্রহণ করতে পারে তখন পাঠকের বিশেষ আনন্দ হয়। শিল্পের স্রষ্টার সাথে পাঠক সেসময় একাত্ম বোধ করে। শিল্পের আনন্দ তখন হয়ে ওঠে যৌথ, একক নয়। আরও একটি বিষয় খেয়াল করার আছে। উপমা-উৎপ্রেক্ষার বিচিত্র প্রয়োগ। রাত স্তন্যপায়ী, এই কথাটি দিয়ে আসলে কী বোঝানো হয়? শব্দদুটির সরসারি কোনো মানে আমরা দাঁড় করাতে পারব না। তবে এমন একটি অনুষজ্ঞ হিসেবে রাত আমাদের সামনে নিজেকে প্রকাশ করে যে, আমরা বুঝতে পারি কিছু একটা ঘটতে চলেছে। গহ্বর ছিঁড়ে, খয়েরি ইঁদুর, রাতের ইশারা, কঠোর প্রচ্ছায়া, ঘড়ির প্রলাপ— এসব উপমা-উৎপ্রেক্ষা এক একটি সেন্সর। অথবা এমনও বলা যেতে পারে, পাঠকের জন্য এক একটি স্পেস। নানা মাত্রিক ইঙ্গিত। বিড়ালের কান্না কি আসলে কাঁধে নেয়া যায়? যায় না তো। কিন্তু কবি বলছেন, বিড়ালের কান্না কাঁধে নিয়ে মাঝরাতের সড়কে হেঁকে যায় পাপবিদ্ধ এক ফেরিঅলা। এই বাক্যের ব্যাখ্যা আমি দিতে পারতাম, কিন্তু দেব না। পাঠকের কাজ তো কেবল পড়ে যাওয়া নায়, নিজের মগজাস্ত্রকেও একটু-আধটু ব্যবহার করতে হবে। তবে আমি একটু সহযোগিতা করতে পারি। শুরুতেই কবি বলছেন, রাত স্তন্যপায়ী। এরপর মধ্যরাতের সড়ক ধরে হেঁটে যাচ্ছে বিড়ালের কান্না কাঁধে নিয়ে পাপবিদ্ধ ফেরিঅলা। ভাবুন, ভাবা প্র্যাকটিস করুন।
জি, শাকিল রিয়াজের অনেক কবিতাই পাঠককে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। পাঠককে সহযাত্রী করে শাকিল পর্যটন করেন তার কবিতার শৈল্পিক বিশ্বে। চোখ খুলে দেখা আমাদের এই জগৎ আর শিল্পের জগতের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আকাশে ঝকঝকে চাঁদ উঠেছে। এই চাঁদ আমরা দেখছি। ভালো লাগছে, তাই দেখছি। এর বাইরে আর কোনো উপলব্ধি আমাদের ভেতর তৈরি হবে না। কিন্তু যখন পড়ি, বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই, তখন বাস্তবে দেখা চাঁদের চেয়েও অনেক বেশি বাস্তব চাঁদ আমরা আমাদের অন্তর্জগতে দেখতে পাই। কেন এরকম ঘটে? ঘটে কারণ, আমাদের কল্পনার রঙ বাস্তবের রঙের চেয়ে আমাদের বেশি ঘনিষ্ঠ। আমাদের বোধের জগৎকে রাঙিয়ে যা কল্পনা হিসেবে ফুটে ওঠে, সেখানে আমাদের নিজের মতো করে দেখার চোখ তৈরি হয়। যে কোনো শিল্প ঠিক এই কাজটিই করে। শিল্পকর্মকে আমাদের বোধের রঙে রাঙিয়ে তোলে। যে কবিতা পাঠকের বোধকে রাঙাকে পারে না সেই কবিতা কেবলমাত্র একটি স্ট্রাকচার। সেখানে প্রাণের কোনোই স্ফুরণ নেই। সেই কবিতাই সার্থক যে কবিতা পড়তে পড়তে পাঠক নিজেকে সহযাত্রী ভাবতে পারে। শাকিল রিয়াজের কবিতা পাঠে আমার যেরকম মনে হয়েছে।
কান পেতে শুনতে পাচ্ছি, নব্বইয়ের দশকের কবিতার সড়কে হেঁটে যেতে যেতে শাকিল রিয়াজ ‘কবরের নিস্তব্ধতা’য় বিড়বিড় করছেন:

সূর্য অস্ত গেছে কবে!
চলো মারা যাই। মরে গিয়ে
কবরের নিস্তব্ধতা উপভোগ করি
আর তো আনন্দ নেই
তোমার সহাস্য স্তন থেকে জ্যোছনা পান করা শেষ…

আরও পড়তে পারেন

3 COMMENTS

  1. চমৎকার কবিতা-আলোচনা। শাকিলের কবিতা এভাবে আগে কখনো পড়া হয় নি, দেখা হয় নি। সরফরাজের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণে কবির চিন্তা, বোধ, কবিতার ভাষা কত সুন্দরভাবে বেরিয়ে আসলো। ধন্যবাদ আলোচক ও কবিকে।

  2. ভালো কবিতার, আমার কাছে ভালো কবিতা যা, হয়তো অন্যপাঠকের কাছে সেটা ভালো নাও হতে পারে। কিন্তু ভালো কবিতার যে ছাপচিত্রটি সরফরাজ নির্মাণ করেছেন, তাতে নতুন একটা বোধেরও জন্ম দেয়। শাকিল নব্বইয়ের আমার চোখে বা চেতনায় খুব ভালো একজন কবি। নব্বইয়ের যে কজনকে ভালো কবি হিসেবে আমিচিহ্নিত করি, তাদের মধ্যে শাকিল বিশিষ্ট স্থানে আছে। তিনি গদ্যও খুব ভালো লেখেন। বিশেষ করে কবিতার ওপর গদ্য। আমার কবিতা নিয়ে তিনি একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, সেটা পড়ে আমি চমৎকৃত হয়েছি।
    কবিতা কাঠমিস্ত্রির মতো নির্মিত হয়, ঘষেমেজে মসৃণ করে তোলেন নির্মাতা-কবি। তারপর তাতে পলিশ লাগালে দেখতে আকর্ষণীয় হয়। কিন্তু যে ডিজাইনটি তিনি নির্মাণ করেছেন, সেটা আদৌ আনন্দদায়ক বা কষ্টদায়িনী হলো কি না, তা বোঝার মতো পাঠকের তীব্র অভাব। আবার কবিতা নাযিল হয় এমন এক ছায়াচ্ছন্ন বোধের অন্তর থেকে, যার খোঁজ সব কবি পান না। কারণ, তারা ভাবুক নন, কবিতার মৌলশক্তি তো চিন্তার ভেতরে, বোধের অন্তর্গত, কল্পনার বহুমাত্রিক শাখাপ্রশাখায়, যা এমন এক জগতের ফসল, যাকে আসলে অনুভব ও উপলব্ধি করতে হয়। শাকিলের কবিতা মূলত সেই অন্তর্গত সত্য, যার কোনো সুনির্দিষ্ট অবয়ব নেই।
    শাকিলের কবিতার যে বর্ণনা বা ব্যাখ্যা দিয়েছেন সরফরাজ, তার পরযবেক্ষণ অগতানুগতিক ও নতুন চেতনার অভিসারী। দেখার এই যে অন্তর্নয়ন সরফরাজের, অনু-পরমানুর মধ্যেকার আকর্ষণ, তার সঙ্গে সিমিলি করে শব্দের নিখিলের কথা তিনি এনেছেন। আমার ভালো লাগলো। তাঁর এই মৌলিক চিন্তার পরিধি আমাদের মৌলিক কবিদের সামনে নিয়ে আসতে সাহায্য করবে, আমার ধারণা ও বিশ্বাস। সরফরাজ বলেছেন প্রত্যেক শব্দের প্রাণ আছে। আমারও সে বিশ্বাস আছে। গাছের যে প্রাণ আছে তা জগদীশ বসু না বললে আমি বা আমরা জানতাম না। তিনি বিজ্ঞানী বলেই তার কথা বিশ্বাস করেছি। মুসলমানদের মধ্যে কেউ কেউ বলেন কোনো কোনো বিশেষ রাতে গাছেরা সিজদা দেয় তার ঈশ্বরের প্রতি। শেকড়বাঁকড়শুদ্ধ গাছ কি করে সিজদা দেবে? তখন যুক্তি আর যুক্তির উর্ধ্বে যে যুক্তিহীনতার মহাকাশ আছে, তাকে বিশ্বাস করতে হয়। আল্লাহ সাত আসমান সৃষ্টি করেছেন, এটা আমরা বিশ্বাস করি। কিন্তু অন্য ধর্মাবলম্বীরা কি তা মানবেন? বিজ্ঞানও আজ বলছে বহু আকাশের কথা। বলছে ব্লাকহোল বা কালোগুহার অনন্তরূপের কথা যা সত্য। মানুষের কল্পনা যদি এমন মহাকাশী হতে পারে, সেখানে কবির কল্পনার তো কোনো সীমা নেই। সেই অসীমের প্রতিনিধি যদি কবিকে ভাবা হয়, তাহলে তো কবিতার শব্দ, পঙক্তি নাযিল হয়।
    সরফরাজ যে কবিতার এই অন্তর্গত সত্যটি ধরে আলোচনায় এনেছেন শাকিল রিয়াজকে, তার জন্য তাকে অবশ্যই ধন্যবাদ জানানো উচিত। এবং তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
    শাকিল রিয়াজ আমার দৃষ্টিতে রিয়েল পয়েট। এর চেয়ে বেশি কথা কি বলবার প্রয়োজন আছে?
    মাহবুব হাসান, বনশ্রী, ঢাকা

  3. শাকিল রিয়াজের কবিতা আমারও প্রিয়।
    খাঁটি কবি তিনি। তাঁর কবিতা পাঠে শব্দাতীত দ্যোতনা সৃষ্টি হয়। এটিই পরম পাওয়া।
    আপনার বিশ্লেষণ এককথায় অসাধারণ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা