প্রচ্ছদগদ্যঈদের আনন্দ

লিখেছেন : কাজী জহিরুল ইসলাম

ঈদের আনন্দ

কাজী জহিরুল ইসলাম 

ঈদ এলেই প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াগুলোতে ইন্টারভিউ দেবার আমন্ত্রণ আসে। অবধারিতভাবেই যা জানতে চাওয়া হয় তা হচ্ছে, প্রিয় কোনো ঈদের স্মৃতি, জীবনের সেরা ঈদ, কি মিস করেন ঈদের দিন ইত্যাদি। ঈদের স্মৃতিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল হচ্ছে শৈশবের ঈদ। সত্তরের দশকে আমরা পুরনো ঢাকার কেএমদাস লেনে থাকতাম। কেরোসিনের স্টোভে আম্মা রান্না করতেন। গরুর মাংসের রেজালা, খিচুরি, পোলাও, মুরগির কোরমা, সেমাই, জর্দা এসব রান্না হতো। চাঁদরাতে রেডিওতে যখন ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ গান বাজত আম্মা রান্নার আয়োজন শুরু করতেন। সবার আগে চুলোয় তুলতেন গরুর মাংস। আমি ঢুলুঢুলু চোখে আম্মার পাশে বসে থাকতাম। মাংস কশানো হয়ে গেলে, দুটো টুকরো তুলে একটি হাফ প্লেটে করে আমাকে দিতেন। আমি কশানো গরুর মাংস খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। ঈদের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতাম আম্মা তখনো রান্না করছেন। সবশেষে চুলো থেকে নামাতেন পোলাও। গোসল করে নতুন পাঞ্জাবী-পায়জামা পরে এলে আম্মা সেমাই খেতে দিতেন। সেমাই খেয়ে আব্বার সঙ্গে নামাজে যেতাম, ফিরে এসে পোলাও, মাংস, খিচুরি খেতাম। আব্বা তখন একতাড়া কড়কড়ে নতুন টাকা বের করে আমাদের ঈদি দিতেন।

এরপর পাড়ার ছেলেমেয়েদের নিয়ে দল বেঁধে বাড়ি বাড়ি যেতাম। মুরুব্বীদের সালাম করে ঈদি তুলতাম। কিছু খুব কষ্টের স্মৃতিও আছে। আমার বন্ধু মনিরের আব্বার নাম আউয়াল সাহেব। তিনি উঠতি ধনি। চারতলা বাড়ির কাজে হাত দিয়েছেন। খুব হাসিখুশি একজন মানুষ। কিন্তু সবাই বলত তিনি নাকি খারাপ মানুষ, মদ্যপান করেন, জুয়া খেলেন। আমরা শিশুরা তাকে পছন্দ করতাম কারণ তিনি বেশি টাকার ঈদি দিতেন।

একবার সারাদিন মনিরদের বাসায় যাওয়া হয়নি। সন্ধ্যায় আব্বা-আম্মার সাথে ওদের বাসায় যাই। গিয়ে দেখি আউয়াল সাহেব বাসায় নেই। আমার খুব মন খারাপ হয়। ভালো ভালো খাবার দাবারের প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নেই, আমার লক্ষ ঈদি। কিছুক্ষণ পরে কারো কাছে খবর পেয়ে তিনি বাসায় আসেন। আমি টুপ করে তাকে সালাম করি। আমার দেখাদেখি মনিরও ওর বাবাকে সালাম করে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে তার মানিব্যাগ বের করে আমাদের ঈদি দেন। মনিরকে দেন ৫০ টাকা, আমাকে দেন ৫ টাকা। আমি খুব অপমানিত বোধ করি। দুজন শিশুর মধ্যে এই বৈষম্য তিনি কেন করলেন তখন আমার মাথায় তা ঢোকেনি। 

বেশ অনেক বছর পরে। তখন আমরা বাড্ডায় থাকি। আমি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। ১৩/১৪ বছর বয়স। সে বছর আমি ঈদে কোনো নতুন জামা পাইনি। অন্য ভাইবোন পেয়েছে। সারাদিন আমি উঠোনে একটি প্লাস্টিকের বেতের চেয়ার পেতে বসেছিলাম, কোথাও যাইনি। আম্মা বলেন, কিরে কোথাও গেলি না? আমি বলি, ঈদের দিন আমি কি পুরনো কাপড় পরে বাইরে যাবো? বিকেলে আমার ছোটোবোন শাহনাজ ওর নীল রঙের সালোয়ার কামিজ খুলে আমাকে দেয়। বলে, ভাইয়া আপনি এগুলো পরেন। আমি ওর সালোয়ার কামিজ পড়ে সারা বিকেল ঘুরে বেড়াই।

বড় হয়ে যখন কর্ম জীবনে ঢুকি কত ঈদ যুদ্ধ বিধ্বস্ত কোনো জনপদে নিঃসঙ্গ কাটিয়েছি। কত ঈদ প্লেনে বা কোনো বিমান বন্দরে কাটিয়েছি। আমার স্ত্রীকে বলেছি, মানুষ বছরে দুটো ঈদ করে আমরা ঈদ করবো প্রতি দুই মাস পরপর। যখনই আমি ছুটিতে দেশে আসবো তখনই আমাদের ঈদ।

২০১৩ সালের জুন মাস থেকে সবাই একসঙ্গে নিউইয়র্কে আছি। এখানে মামা, কাকা, খালারা নেই, আব্বা-আম্মা নেই, ভাই-বোনেরা নেই কিন্তু প্রতিবেশিরা আছে, বন্ধু-বান্ধবেরা আছে। তাদের সঙ্গেই আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে নিয়েছি। প্রতি বছর চাঁদরাতে জ্যাকসন হাইটসে যাই, বাচ্চারা হাতে মেহেদী পরে, কুল্ফি কিনে রাস্তায় হেঁটে হেঁটে কুল্ফি খায়, আমরা গড়ে নিয়েছি আমাদের অভিবাস জীবনের নতুন ঈদ-প্রথা। বর্তমানকে মেনে নিয়ে অভিবাস জীবন আনন্দময় করে তোলার চেষ্টা করছি।

২০২০ সালের ঈদে কোথাও যাওয়া হয়নি। লকডাউনের কারণে দুটো গৃহবন্দী ঈদ কাটিয়েছি। আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর নয় নতুন-স্বাভাবিক, শুরু হোক আগের মতো স্বাভাবিক জীবন, সীমিত পরিসরে হলেও। সকালেই একটি পরিবার আমাদের বাসায় বেড়াতে আসে। আমরা খুবই খুশি হই, তাদের যথাসাধ্য আপ্যায়ন করি। দুপুরে আমরাও বেরিয়ে পড়ি, তিনটি বাড়িতে বেড়াতে যাই। সবখানেই অতিথিদের ভিড়। প্রথম বাড়িতে ঢোকার পরেই একজন আমার লেখালেখি নিয়ে বেশ কিছু প্রসংশাবাক্য উচ্চারণ করেন। আমি খুব আপ্লুত হই এবং অনেকটা সময় তার সঙ্গেই গল্প করে কাটাই। ফেরার সময় গৃহস্বামীর সঙ্গে তার ভাই ব্যবসায়ী নাজিম চৌধুরী দরোজার বাইরে বেরিয়ে আসেন আমাদের এগিয়ে দিতে। হঠাৎ নাজিম ভাই বলেন, জহির ভাই, আপনার ‘পা’ কবিতাটি কিন্তু আমার ভীষণ প্রিয়। সঙ্গে সঙ্গে তার বড় ভাই ফার্মাসিস্ট আশরাফ চৌধুরী বলেন, আমার অবশ্য আপনার লেখা ‘ঢাকা’ এবং ‘চিঠি’ কবিতা দুটি বেশি প্রিয়। আমি বুঝতে পারি আশরাফ ভাই ‘প্রিয়তমা ঢাকা’ কবিতাটির কথা বলেছেন। কিন্তু চিঠি নামে তো আমার কোনো কবিতার কথা মনে পড়ছে না। পরে তিনি ব্যাখ্যা করলে বুঝতে পারি, ‘বাড়ি আছো’ কবিতাটির কথা তিনি বলেছেন।

সন্ধ্যায় যে বাসায় ডিনার খেতে যাই সেখানে দেখা হয় অধ্যাপক আখতার হোসেনের সঙ্গে। তিনিও আমাদের মতো অতিথি। এই সময়ের দুজন তুখোড় অর্থনীতিবিদ, যারা আজকাল সাহিত্যও লিখছেন, তাদের লেখার তীব্র সমালোচনা করেন তিনি। সেই সমালোচনার সূত্র ধরে বলেন, বাই দ্য ওয়ে, আমি কিন্তু আপনার উড়ালগল্প বইটি পড়েছি। আমার খুবই ভালো লেগেছে। একজন বয়স্ক অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিবের এক অপ্রাপ্ত বয়স্ক বলকান কিশোরীর প্রতি যৌনাকর্ষণ আপনি যেভাবে দেখিয়েছেন তা খুব সুখপাঠ্য। আমি বুঝতে পারি বইটি তিনি বেশ ভালো করেই পড়েছেন।

ফেরার পথে মুক্তিকে বলি, ঘটনাগুলো হয়ত তেমন কিছুই না কিন্তু আমি খুব আনন্দ পেয়েছি। এই যে তিনজন মানুষ, যারা সাহিত্যের লোক না, কবিতার মানুষ না, অথচ আমার কোনো কোনো কবিতার নাম বলে দিতে পারলেন, আমার ভ্রমণরচনার কোনো একটি ঘটনা এবং চরিত্রের কথা বলে দিতে পারলেন, এটি আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। এখন থেকে কেউ ঈদের স্মৃতি জানতে চাইলে আজকের এই ঘটনাগুলো আমি উল্লেখ করবো। আজকের ঈদটিও আমার জীবনের একটি উজ্জ্বল ঈদ। দেখি মুক্তির চোখ দুটোও আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তখন সত্যি সত্যি আমি আনন্দে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি এবং আমার চোখে আনন্দাশ্রু উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করে। নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হয়। একজন মানুষ শুধু যে আমার ছায়াসঙ্গী তাই নয়, আমার আনন্দে আনন্দিত হয়, আমার কষ্টে ব্যথিত হয়। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে? 

হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১৩ মে ২০২১।

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

  1. খুব ভালো লাগলো ঈদের স্মৃতি।
    আপনার গদ্য ঝরঝরে, অসাধারণ গল্পময়।
    ভালোবাসা সবসময়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা