প্রচ্ছদগদ্যঈদের স্মৃতি আমার জন্য বিশুদ্ধ আনন্দের সঙ্গে গভীর বেদনাবোধও বয়ে আনে

লিখেছেন : আবু রাইহান

ঈদের স্মৃতি আমার জন্য বিশুদ্ধ আনন্দের সঙ্গে গভীর বেদনাবোধও বয়ে আনে

আবু রাইহান

রমজান মাসের ৩০ দিনের রোজার শেষে আসে খুশির ঈদুল ফিতর। বাস্তব সত্য হলো যারা রোজা রাখে না তারা কোনদিনই ঈদের প্রকৃত আনন্দ অনুভব করতে পারে না। ঈদ কেবল তাদের কাছে একটা অন্যান্য উৎসবের মতো কেবল একটা উৎসব হয়ে থেকে যায়। যারা রোজাদার সারাদিন পানাহার থেকে বিরত থেকে নিজের হৃদয়কে বিশুদ্ধ করতে আত্মসংযম পালন করেন, তারাই কেবল অনুভব করতে পারেন ইফতারে সময় খাদ্য গ্রহণের আনন্দ এবং স্বাদ। দীর্ঘ সময় ধরে খতম তারাবী পড়ার সময় শারীরিক কষ্টের মধ্যেও অনুভবে জেগে ওঠে হৃদয় প্রশান্ত করা ভালোলাগা। রাত্রির নির্জন প্রহরে সেহরি খেতে উঠলে জেগে ওঠে বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিকতা। সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে নৈকট্য লাভের অদ্ভুত মানসিক অনুভব।
আমার কাছে ঈদ মানেই নস্টালজিক স্মৃতির মতো বারবার ঘুরে ফিরে আসে ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখার পর ইথার তরঙ্গে ভেসে আসা নজরুলের কালজয়ী গান–

‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ
আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমণ হাত মেলাও হাতে
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ’

এই গানটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়ে ঈদের জন্য অদ্ভুত আনন্দের শিহরণ বয়ে যায়। সেই সঙ্গে কেন জানিনা অদ্ভুত এক বেদনাবোধ হৃদয়ের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে। চোখ নিজের অজান্তেই অশ্রুসিক্ত হয়ে যায়। রমজান মাস চলে যাচ্ছে, ৩০ দিন ধরে যে আত্মসংযমের মধ্যে জীবন যাপন করছিলাম তার বাঁধন এবার আলগা হয়ে যাবে। ধীরে ধীরে আবারও শৃঙ্খলাহীন জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে যাব, এই কষ্ট বোধ আমাকে খুবই পীড়িত করতে থাকে।আগে রেডিওতে শুনতাম এখন ইউটিউবে যখন নজরুলের এই গানটি শুনি রমজান মাস চলে যাওয়ার বিয়োগ বেদনায় চোখের জল আর ধরে রাখতে পারি না

‘যাবার বেলায় সালাম লহো হে পাক রমজান।
তবু বিদায়-ব্যাথায় কাঁদিছে নিখিল মুসলিম জাহান।।
পাপীর তরে তুমি পারের তরী ছিলে দুনিয়ায়,
তোমারি গুণে দোজখের আগুন নিভে যায়;
তোমারি ভয়ে লুকিয়ে ছিল শয়তান।
ওগো রমজান, তোমারি তরে মুসলিম যত
রাখিয়া রোজা ছিল জাগিয়া চাহি তব পথ;
আনিয়াছিলে দুনিয়াতে তুমি পবিত্র কোরআন।।
পরহেজ্গা‌রের তুমি যে প্রিয় প্রাণের সাথী,
মসজিদে প্রাণের তুমি যে জ্বালাও দ্বীনের বাতি,
উড়িয়ে গেলে যাবার বেলায় নূতন ঈদের চাঁদের নিশান।’

ঈদের স্মৃতি সঙ্গে নজরুলের এই গানটি এমন ওতপ্রতভাবে আমার জীবনে জড়িয়ে রয়েছে যে, চাঁদ রাতের সন্ধ্যায় এই গানটি না শুনলে আমার যেন মনে হতো ঈদ আসেনি। রেডিওতে এই গানটি বেজে উঠলে মনে হতো সত্যিকারের ঈদ এসেছে। এই গানের মধ্যে আমি ঈদ আসার আনন্দ খুঁজে পেতাম।
আমার বাবা একটি হাই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তিনি ধার্মিক মানুষ ছিলেন, কিন্তু রেডিও শোনার পছন্দ নেশা ছিল। চাঁদ রাতের সন্ধ্যায় ইফতারের পর মাগরিবের নামাজ পড়া শেষ করে তিনি রেডিও খুলতেন।চাঁদের খবর জানার জন্যে বাংলাদেশের ঢাকা রেডিও সেন্টার ধরতেন। কারণ আমাদের এপার বাংলায় ঈদের চাঁদ দেখার খবর শোনা যেত সন্ধ্যে ৭টার স্থানীয় সংবাদের সময়। এবাংলায় ৩৫ শতাংশের বেশি ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষ বাস করলেও সরকারী সংবাদ মাধ্যম কোনোদিনই খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে মুসলিমদের সব চেয়ে বড়ো উৎসব ইদুল ফিতরের চাঁদ দেখার খবর করেনা। তাই এপার বাংলার মানুষদের একমাত্র ভারসা বাংলাদেশ বেতারের খবর। তবে প্রতিবেশী মানুষজন যারা সরকারী চাকরি করতেন, তাদের কিন্তু ঈদের চাঁদ দেখা গিয়েছে কিনা এই নিয়ে প্রবল উৎসাহ থাকতো। কারণ চাঁদ দেখা গেলেই ঈদের সরকারী ছুটির দিনটি পাল্টে যেত। কারণ এবাংলায় আজও ঈদে একদিনের ছুটি।
আকাশ পরিষ্কার থাকলে আমরা ঈদ রাতে চাঁদ দেখার জন্য ছোটরা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে চাঁদ দেখার চেষ্টা করতাম। ঈদের চাঁদ এত সরু এবং এত কম সময় থাকতো যে আমরা ছোটরা হাজার চেষ্টা করেও আকাশে চাঁদের খোঁজ পেতাম না। বেশিরভাগ সময় ব্যর্থ মনোরথ হয়ে বাড়ি ফিরে আসতাম। আর যদি কোন বছর হঠাৎ করে পশ্চিম আকাশে একফালি সরু ঈদের চাঁদ দেখতে পেতাম তখন কি যে আনন্দ হত তা ভাষায় ব্যাখ্যা করা যাবে না। এখন আধুনিক প্রযুক্তির যুগে চাঁদ দেখা অনেক সহজ হয়েছে। সৌদি আরব আমাদের অনেক কাছে চলে এসেছে। সৌদি আরবে ঈদ হয়ে গেলে আমরা নিশ্চিত হয়ে যাই পরের দিন আমাদের ঈদ হবে। তাই ছোটবেলার চাঁদ দেখার সেই আনন্দ এখন প্রযুক্তি এসে গিলে খেয়েছে। আমরা হারিয়ে ফেলেছি ছোটবেলার চাঁদ দেখার সেই অনাবিল আনন্দ,এখন সেসব কেবল স্মৃতি।
বাংলাদেশে চাঁদ দেখা গেলে বাংলাদেশ বেতারের বেজে উঠতো নজরুলের ঈদের গান। বাবার চালানো রেডিওতে সেই গান শুনতে শুনতে ঈদের আনন্দে অদ্ভুর ভাবে বিভোর হয়ে যেতাম। যদিও ছোটবেলার সেই ঈদগুলিতে এমন কিছু আড়ম্ভর ছিল না। আমরা ছয় ভাই বোন, আমার শিক্ষক বাবার আর্থিক সঙ্গতিতে কুলোতনা প্রতিবছর আমাদের ঈদের সময় নতুন জামা কিনে দেওয়ার।তাতে আমার অন্ততপক্ষে ঈদের আনন্দে কোন ভাটা পড়তো না। ঈদের আগের দিন মা আগের বছরের পাঞ্জাবী যত্ন করে ধুয়ে রাখতেন। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পুকুরে একসঙ্গে পাড়ার অন্যান্য ছেলেদের সঙ্গে সাবান মেখে ঈদের স্নান ছিল দারুন আনন্দময় যাপন। ঈদগাহের সামনের দিকে বসার জন্য সকাল সকাল ঈদগায়ে যাওয়ার দারুন উত্তেজনা অনুভব করতাম। মায়ের তৈরি করা শিমুই খেয়ে পাঞ্জাবি পরে বসে থাকতাম। পাজামার দড়ি লাগলো নিয়ে সমস্যায় পড়তাম।বাবা স্নান করে এসে তুলায় আতর লাগিয়ে দিতেন।সেটি কানে গুঁজে রাখতাম। তারপর বাবার হাত ধরে মাটির রাস্তা দিয়ে তকবির পড়তে পড়তে ঈদগায়ে যেতাম সমবেতভাবে।ঈদগাহের পথে হেঁটে যাওয়ার মধ্যেও গভীর আনন্দ খুঁজে পেতাম। ঈদগাহের কাছে পৌঁছে দেখতাম ঈদগাহের বাইরে বয়স্ক মহিলারা ঈদের দিন একটু বেশি ভিক্ষার আশায় সমবেত ভাবে বসে আছেন। সেইসব বয়স্ক মহিলাদের দেখে নিজের ভেতরে অদ্ভুত কষ্ট অনুভব করতাম। তখন নিজের নতুন জামা না পাওয়ার কথা ভুলে যেতাম। ঈদের নামাজ শুরু হওয়ার আগে বাবার কাছে সামনের দিকের কাতারে বসে থাকতাম। কিন্তু যখন ঈদের নামাজ শুরু হতো আমরা ছোট বলে আমাদেরকে শেষ পর্যন্ত পেছনের সারিতে চলে আসতে হতো। তখন মন খারাপ হয়ে যেত। নামাজ শেষ হওয়ার পর যখন ইমাম সাহেব খুতবা পড়তেন আবার দৌড়ে বাবার কাছে চলে যেতাম। বাবার সঙ্গে একসঙ্গে হাত তুলে মোনাজাতে শরিক হতাম। মোনাজাতে ইমাম সাহেবের সঙ্গে উপস্থিত মানুষজন আল্লাহর কাছে নিজেদের দোসত্রটি ক্ষমা করার জন্য ক্রন্দন করতেন। ইমাম সাহেবের দোয়ার সবকিছু বুঝতে পারতাম না। কিন্তু সকলের সঙ্গে আমার চোখ থেকেও অশ্রু ঝরে পড়তো। বড়রা বলতেন ঈদের নামাজ পড়তে এক রাস্তা দিয়ে যেতে হয়, আবার অন্য একটি নতুন রাস্তা দিয়ে ফিরে আসতে হয়। তাই আসার সময় আবার আমরা গ্রামের অন্য রাস্তা ধরে ফিরে আসতাম। গ্রামের মহিলারা আনন্দময় দৃষ্টিতে শুভ্র বস্ত্র পরিহিত ঈদ পড়ে ফিরে যাওয়া মানুষজনের দিকে চেয়ে থাকতেন। গ্রামের সেই সব মানুষদেরর সঙ্গে তখন অদ্ভুত এক আত্মীয়তা অনুভব করতাম মনে মনে।
২৭শে রমজানের দিন বাড়িতে গরীব বয়স্ক বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা আসতেন ফিতরার টাকা নেওয়ার জন্য। আমাদের বাড়ির সীমিত আর্থিক ক্ষমতার মধ্যেও দেখেছি সেই সমস্ত বয়স্ক বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের ফিতরার টাকার সঙ্গে লুঙ্গি এবং শাড়ি তুলে দিতে। তাঁরা খুব খুশি হয়ে আমাদের ছোটদের মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করতেন।তখন নজরুলের সেই বিখ্যাত গানের লাইন গুলো যেন সত্য হয়ে উঠতো–

‘যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী
সেই গরীব ইয়াতীম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ।’
ছোটবেলায় রমজান মাসের আরেক আনন্দময় স্মৃতি ছিল সেহেরির সময় রেডিওতে বাংলাদেশ বেতারের সেহরি অনুষ্ঠান শোনা। সেহেরী খাওয়ার পর আমাদের মাটির দোতলা বাড়িতে দোলনায় বসে বাবার রেডিওতে সেহরি অনুষ্ঠান শুনতাম। ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমাবো বলে অপেক্ষায় বসে থাকতাম।বাংলাদেশ বেতারের সেহরি অনুষ্ঠানে যখন নজরুলের বিখ্যাত ইসলামী গজল শুনতাম-তখন সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মনটা নরম হয়ে উঠতো।

“এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি
খোদা তোমার মেহেরবানি॥
শস্যশ্যামল ফসলভরা
মাঠের ডালিখানি
খোদা তোমার মেহেরবানি॥
তুমি কতই দিলে রতন
ভাই বেরাদর পুত্র স্বজন,
ক্ষুধা পেলেই অন্ন জোগাও
মানি চাই না মানি॥
খোদা! তোমার হুকুম তরক করি আমি প্রতি পায়,
তবু আলো দিয়ে বাতাস দিয়ে বাঁচাও এ বান্দায়।”

আগে সেহেরির সময় গ্রামের একদল মানুষ রোজাদারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঘুম থেকে ওঠাতে যেতেন সেহরি খাওয়ার জন্য। মসজিদে মসজিদে মাইকে ডাক দেওয়া হতো সেহেরী খেতে ওঠার জন্য। এখন সেসব আধুনিক কালের নিয়মে বদলে গিয়েছে। এখন বেশিরভাগ রোজাদার সেহেরির নির্দিষ্ট সময়ে ওঠার জন্য মোবাইলে এলাম দিয়ে রাখেন। একটা সময় ছিল গ্রামে গঞ্জে খুব বেশি ঘড়ির চলছিল না। ফলে সেহরির সময় শেষ হয়ে গেলেও অন্ধকার থাকলেই অনেকেই সেহরি খেতে দেখেছি।এখন প্রায় সমস্ত মানুষই নির্দিষ্ট সময়ে ঘড়ি ধরে সেহরি খান। ফজরের নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েন। আগে সেহেরিতে বেশিরভাগ বাড়িতে মহিলারা আগে উঠে গরম ভাত তরকারি রান্না করতেন। পাশাপাশি বাড়িগুলিতে কথাবাত্রা শুনে বোঝা যেত সকলেই সেহরির জন্য রান্না করতে উঠেছেন। সেহরির সময় একটা আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি হতো। এখন সেহেরির সময় রান্না করার রেওয়াজ প্রায় উঠেই গিয়েছে। সকলেই সেহেরির খাওয়ার আগে ভাগে তৈরি করে রেখে দেন।সেহরিতে নির্দিষ্ট সময়ে ওঠে গরম করে তা খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েন। এতে একটি লাভ হয়েছে মহিলাদের সেহরীর সময়ের কষ্ট অনেকটা কমেছে।

যখন স্কুলে পড়তাম তখন আমার আপারা এবং আমার কাকার ছেলেমেয়েরা ছুটির দিনে দু একটা রোজা রাখতো। আমারও ইচ্ছে হতো একটি দুটি রোজা রাখি। মূলত ইচ্ছা হওয়ার কারণ ছিল ইফতারের সময় বড়দের মত বেশি বেশি করে ইফতারে খেতে পাওয়া। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে মাকে বলতাম কাল রবিবার ছুটি আছে আমি রোজা রাখব, সেহরির সময় তুমি আমাকে ওঠাবে কিন্তু। আমার কষ্ট হবে বলে মা সেহরির সময় আমাকে ওঠাবেন না। সকালে যখন মার কাছে জিদ করতাম, বলতাম তুমি আমাকে ওঠালে না কেন সেহরির সময়। আমি সেহরি খেতে পেলাম না, রোজা রাখা হলো না। মা বলতো, তোকে তো উঠিয়েছিলাম। তুই তো ঘুমে কাতর হয়ে ছিলি,কিছুতেই উঠতে চাসনি। তাই ছোটবেলায় আমার আর কোনদিন রোজা রাখা হয়ে ওঠেনি। মাধ্যমিক দেওয়ার পর থেকে আল্লাহর অশেষ রহমতে রোজা করে আসছি।
মনে পড়ে আমি যখন ঝাড়গ্রাম কলেজে অনার্সে পড়ছি সেসময় মে মাসে রোজা পড়েছিল। আর ঈদের পর দিন ছিল অনার্সের পরীক্ষা। ঝাড়গ্রামে দিনের বেলা প্রচন্ড গরম। পরীক্ষার সময়,রাত জেগে পড়াশোনা করতে হতো। হোস্টেলে ১০০ জন ছেলের মধ্যে দুজন মাত্র মুসলিম ছিলাম। আমি একাই রোজা করেছিলাম। আমি একদিন সেহেরির সময় ঠিক সময়ে উঠতে পারিনি। ফলে সেহেরি না খেয়ে অনেক কষ্টে সারাদিন রোজা রাখতে হয়েছিল। এই কথা শোনার পর আমার হোস্টেলের বন্ধুরা তাদের একটি এলার্ম ঘড়ি আমাকে দিয়ে গিয়েছিল, যাতে আমি ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে রেখে নির্দিষ্ট সময়ে উঠে সেহরি খেতে পারি। যেহেতু অনার্স পরীক্ষার সামনে, তাই কলেজ স্টাডি লিভ দিয়েছিল। হোস্টেলে সারাদিন থাকতাম। আমার হোস্টেলের বন্ধুরা দিনে অনেকবার আমাকে দেখতে আসত রোজা রেখে আমি ঠিকঠাক আছি কিনা। আমি সুস্থ আছি দেখে তারা আশ্বস্ত হতো এবং আমি পড়াশোনায় নিমগ্ন আছি দেখে তারা বলাবলি করত রোজা রেখে তোর লাভ হয়েছে। সারাদিন খাওয়া-দাওয়ার ঝামেলা নেই, পড়াশোনা করে যেতে পারছিস।সেই সব দিনের কষ্টকর রোজা আমাকে মানসিক শক্তি যুগিয়েছে জীবন যুদ্ধের কঠিন লড়াইয়ে টিকে থাকতে।
আমি যখন মেদিনীপুর শহরে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় মাস্টার্স করছি, সে সময় রোজার মাসে একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। সেবারও রোজা পড়েছিল গ্রীষ্মকালে। আমরা থাকতাম মেদিনীপুর শহরে রাঙ্গামাটিতে একটি মেশে। মেদিনীপুর শহরে গ্রীষ্মকালে প্রবল গরমে জল সংকট দেখা দেয়। কূয়ার জল তলানিতে নেমে যায়। অনেক কষ্টে জল তুলতে হয়। আমরা মেসের ছেলেরা এক বালতি জল তুলে সেই জলে স্নান করতাম। স্নান করার পর সেই জলটি বালতিতে রেখে দিতাম। পরবর্তীতে ল্যাট্রিনে ব্যবহার করার জন্য। মনে মনে ভাবছিলাম এরকম অবস্থায় কিভাবে রোজা রাখব, পাঁচ বার নামাজই বা পড়বো কি করে। মনে মনে কষ্ট পাচ্ছিলাম আর আল্লাহর কাছে দোওয়া করছিলাম হে আল্লাহ এবার কি আমার তাহলে রোজা রাখা হবে না। হঠাৎ করে রোজা শুরু হওয়ার এক সপ্তাহ আগে অপ্রত্যাশিতভাবে গ্রীষ্মকালে মেদিনীপুর শহরে প্রবল বৃষ্টিপাত হলো। এই বৃষ্টিপাতের ফলে কুয়া একদম জলে ভরে উঠলো। ফলে আমার আর জলের জন্যে রোজা রাখার কোন সমস্যা হলো না।
ঈদের অনেক আনন্দময় স্মৃতির সঙ্গে বেদনাময় এক গভীর দুঃখবোধ আমার জীবনে জড়িয়ে রয়েছে। বাবার সঙ্গে বসে ইফতার করা, রেডিওতে বাংলাদেশের সেহেরি অনুষ্ঠান শোনা,একসঙ্গে তারাবি এবং ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়া এখন কেবল আমার কাছে আনন্দময় স্মৃতি।প্রায় দেড় দশক আগে ২৬ শে রমজান ইফতারের সন্ধ্যায় আমার বাবা না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন। সেই বছরের ঈদ শুধু নয় তারপরের বেশ কয়েক বছরের ঈদ আমার কাছে ছিল বিষন্নতায় মোড়া।ঈদের সময় নিয়ম করে বাড়ির সকলের জন্য নতুন জামা কাপড় কিনলও নিজের জন্য কোনো নতুন পোশাক কেনার উৎসাহ পেতাম না।আমার এটা দেখে মনে মনে খুব কষ্ট পেতেন। এক ঈদে মা নিজেই আমার জন্যে একটি পাজামা পাঞ্জাবী কিনে হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন ঈদের নামাজে এটা পরে যাবি। মায়ের মনে দুঃখ দিতে চাইনি, তাই সেবার নতুন পাজামা পাঞ্জাবী পরে ঈদ পড়তে গিয়েছিলাম। এখন ছেলে মেয়ে টাকা নিয়ে নিজেদের পছন্দের ঈদের পোশাক কেনে। আমাকে আর কিনতে হয়না। নিজের জন্যে ঈদের দিনে নতুন পোশাক কেনার উৎসাহটা হারিয়ে গেছে। মনে হয় কতো মানুষই পুরনো পোশাক পরে বছরের পর বছর ঈদ পড়ে আসছে, আমি না হয় তাদের দলেই থাকলাম।প্রতিবছর মাহে রমজানের ৩০ দিনের রোজার রোজার শেষে আমাদের বিশুদ্ধ হৃদয়ে কল্যাণ বোধ জাগ্রত করতে, সব মানুষের প্রতি সহমর্মী হতে, মানবিক বোধের স্ফুরণ ঘটাতে চান্দ্র মাসের গণনায় সারা বছর ধরে ঘুরেফিরে আসে খুশির ঈদ।

‘কোথা সে মহান শক্তি-সাধক আনিমে যে পুন: ঈদ?’
…ছিনিয়া আনিবে আশমান থেকে ঈদের চাঁদের হাসি,
ফুরাবে না কভু যে হাসি জীবনে, কখনো হবে না বাসি।
সমাধির মাঝে গণিতেছি দিন, আসিবেন তিনি কবে?
রোজা ইফতার করিব সকলে, সেই দিন ঈদ হবে।’

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

  1. ঈদের স্মৃতিবাহী গদ্যটি অসাধারণ।
    ধন্যবাদ এমন সুন্দর লেখার জন্য।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ

সৈয়দ আহমদ শামীম on বাংলা বসন্ত : তাজ ইসলাম
Jhuma chatterjee ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি on গোলাপ গোলাপ
তাজ ইসলাম on রক্তাক্ত স্বদেশ
আবু বকর সিদ্দিক on আত্মজীবনীর চেয়ে বেশি কিছু
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়। নিউ দিল্লি। on জন্মদিনের কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
দিশারী মুখোপাধ্যায় on গুচ্ছ কবিতা : গোলাম রসুল
দিশারী মুখোপাধ্যায় on নির্বাচিত ১০ কবিতা : কামরুজ্জামান
তাজ ইসলাম on Menifesto of the Inevitable Revolution
কাজী জহিরুল ইসলাম on দীর্ঘ কবিতা : তাজ ইসলাম
দীপশিখা পোদ্দার on গুচ্ছ কবিতা : কাজল সেন
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on গুচ্ছ কবিতা : তাজ ইসলাম
নয়ন আহমেদ on রবীন্দ্রনাথ
নয়ন আহমেদ on কিবরিয়া স্যার
বায়েজিদ চাষা on গুচ্ছ কবিতা : অরুণ পাঠক
আবু আফজাল সালেহ on দীর্ঘ কবিতা : অভিবাসীর গান
কাজী জহিরুল ইসলাম on রবীন্দ্রনাথ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on গুচ্ছ কবিতা : হাফিজ রশিদ খান
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on অক্ষয় কীর্তি
নয়ন আহমেদ on আমার সময়
মোঃবজলুর রহমান বিশ্বাস on গুচ্ছ কবিতা : দিলরুবা নীলা
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
তৈমুর খান on অক্ষয় কীর্তি
কাজী জহিরুল ইসলাম on অক্ষয় কীর্তি
Quazi Islam on শুরুর কথা
আবু হেনা আবদুল আউয়াল, কবি ও লেখক। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম, নওগাঁ সরকারি কলেজ নওগাঁ। on আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈশ্বিক ভাবনা
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
নয়ন আহমেদ on ফেলে আসা ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on ঈদের কবিতা
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
পথিক মোস্তফা on ঈদ স্মৃতি
Sarida khatun on ঈদ স্মৃতি
নয়ন আহমেদ on ঈদ স্মৃতি
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on দীর্ঘ কবিতা : আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
পথিক মোস্তফা on শৈশবের ঈদ : একটি স্মৃতি
পথিক মোস্তফা on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on স্মৃতির ঈদ
নয়ন আহমেদ on আমার ঈদ
নয়ন আহমেদ on ঈদের আনন্দ
শাদমান শাহিদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
নয়ন আহমেদ on শৈশবের ঈদ উৎসব
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on সাম্প্রতিক কবিতা : নয়ন আহমেদ
মুস্তফা জুয়েল on আমি আর আমার গাযালি
কাজী জহিরুল ইসলাম on গুচ্ছ কবিতা : মুর্শিদ-উল-আলম
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on অপদার্থবিদ্যা
সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব on দেশপ্রেমের ১০ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
কাজী জহিরুল ইসলাম on বিশ্ববিচরণশীল কবিমানুষ
আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ on নির্বাচিত ২৫ কবিতা : সাজ্জাদ বিপ্লব
মোহাম্মদ মাহিনুর আলম (মাহিন আলম) on প্রিয়াংকা
প্রত্যয় হামিদ on শাহীন খন্দকার এর কবিতা
মহিবুর রহিম on প্রেম ও প্যারিস
খসরু পারভেজ on কাব্যজীবনকথা
মোঃ শামসুল হক (এস,এইচ,নীর) on সুমন সৈকত এর কবিতা
এম. আবু বকর সিদ্দিক on রেদওয়ানুল হক এর কবিতা