মুহম্মদ মতিউল্লাহ্
আমার জন্মভূমি গ্রামের নাম রাজুয়া। স্বপ্নময় নিবিড় সবুজে ঘেরা একটি গ্রাম। আমার শৈশব কৈশোরের দিনগুলি কেটেছে সেই গ্রামীণ শ্যামলিমায়। বাবা ছিলেন স্বাস্থ্য বিভাগের আধিকারিক। ছুটি খুব কম পেতেন এবং ঘন ঘন বদলির চাকরি। আমার জন্মের আগে আমাদের পরিবার বাবার সঙ্গে কর্মস্থলেই থাকত নানা শহরে। কখনো উত্তরবঙ্গে। কখনো দক্ষিণবঙ্গে। কখনো বাঁকুড়া কখনো মেদিনীপুর। ঘনঘন বাসা বদলের ফলে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে, এ কারণে গ্রামের বাড়িতে থাকাটাই উচিত বলে বিবেচিত হয়েছিল পরে। বাবা ছুটি পেতেন কম। মায়ের অভিভাবকত্বে আমরা ভাইবোনেরা বড় হয়েছি। ছোটবেলার ঈদে কোনো কোনো বছর বাবা বাড়ি আসতেই পারতেন না। আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে বেশ একটা শূন্যতা বোধ জমাট বাঁধতো। আমরা মায়ের তত্ত্বাবধানে অভিভাবকত্বে ঈদের দিন কাটাতাম। বাবা বাড়িতে থাকলে সে বছর ঈদের দিনগুলি ছাড়াও রোজার দিনগুলি বেশ উৎসবমুখর হয়ে থাকত। বিশেষত বিকেলবেলার সময়টায়। বেলা পড়ে এলে মা ব্যস্ত থাকতেন ইফতারের নানা প্রস্তুতির কাজে। ইফতারের সময় সামনে খাবার সাজিয়ে আমরা ভাইবোনেরা বাবার সঙ্গে বসতাম। মাগরিবের আজানের সঙ্গে মসজিদে ঘন্টা বাজতো। সেই শুনে রোজা ভাঙা হত। বাবাকে দেখতাম অনেকক্ষণ ধরে ইফতারের আগে দোয়া দরুদ পড়তেন। তারপর দীর্ঘ মোনাজাত করতেন। তারপর রোজা ভাঙা হত। ইফতারের একটি চলতি নাম ছিল ‘মুখে পানি দেওয়া’।
ছেলেবেলার ঈদের সবচেয়ে আনন্দের দিন ছিল শেষ রোজার দিনটি। সন্ধ্যার আজানের পর থেকেই চাঁদ দেখার একটা অধীর অপেক্ষা থাকত। মসজিদ থেকে ঘোষণা করা হত, আগামীকাল ঈদুজ্জোহার নামাজ অনুষ্ঠিত হবে ঈদগাহে। এই আনন্দটি আবার কোনো কোনো বছর মনখারাপে পরিণত হত। যদি প্রত্যাশিত ঈদের চাঁদ দেখা না যায়। রাত্রে এশার আজানের পর যদি আবার ঘন্টা পেটানোর শব্দ আসে তাহলে বুঝতে হত, কালকেও রোজা হবে। অর্থাৎ ঈদ হচ্ছে না। এবার আবার পরের দিনের প্রতীক্ষা। সেই সন্ধ্যা আর রাত্রিটা যেন কাটতেই চায়তো না। একটা ঘনকালো মনখারাপের মেঘ আমাদের বালক মনে গভীর রেখাপাত করত। এবং তার পরের দিনে আসত প্রত্যাশিত আনন্দের দিনটি। আমরা ততদিনে বাবার মুখে শুনে ফেলেছি নজরুল ইসলামের সেই বিখ্যাত কবিতার লাইন :
‘শত যোজনের কত মরুভূমি পারায়ে গো
কত বালুচরে কত আঁখিধারা ঝরায়ে গো
বরষের পরে আসিলে ঈদ’।
আব্বাসউদ্দিনের কন্ঠের সেই গানের রেকর্ডিং বেজে উঠত বাংলাদেশ বেতার থেকে
‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’। সত্যিই একটা খুশির পরিবেশ তৈরি হয়ে যেত সেই সন্ধ্যা থেকে। গ্রামের সেই মসজিদ আমার কাছে পৃথিবীর সেরা মসজিদ। তার তুল্য অনায়াস-সহজতা আমি কোথাও আর পাইনি। এমন পবিত্র পরিবেশ পৃথিবীর কোথাও পাওয়া যাবে ভাবিনি আমি। শুক্রবার জুম্মারর নামাজে ইমাম কিবরিয়া সাহেবের সুললিত কোরানপাঠ আজও আমার কানে বাজে। আর তেমনি আকর্ষণীয় ছিল মোক্তার ভাইয়ের ভোরের আজান। ভোরে আগে থেকেই জেগে আমি আমার বাল্যকাল জুড়ে সেই আজানের সুর শুনে এসেছি। ভোরের বাতাসে সেই আন্তরিক উচ্চারণ গুলি কী এক ঐশী আবেশ তৈরি করতো। মনে হত চেনা পৃথিবীর বাইরে কোন সুদূরলোক থেকে ভেসে আসছে ওই আহ্বান ‘নিদ্রা অপেক্ষা উপাসনা শ্রেষ্ঠ।’ কিন্তু সেই মোক্তারভাই ছাড়া আর কারো কন্ঠস্বরে আজানের সেই আকুতি খুঁজে পেতাম না। পরবর্তীকালে বাবার একটি গদ্য ছাপা হয় সেকালের ‘নেদায়ে ইসলাম’পত্রিকায়। নাম ছিল ‘তোমার আজান করিয়াছে মোর নয়নের ঘুম চুরি’। মসজিদে তখনো ইলেক্ট্রিসিটি আসেনি। সন্ধ্যায় সেখানে সর্ষে তেলের প্রদীপ জ্বলতে দেখেছি। টিমটিম করে হারিকেনও জ্বলত। আবছা আলো অন্ধকারে নামাজি মুসল্লিরা বসে থাকতেন। কিংবা অলৌকিক নামাজ সম্পন্ন করে নিঃশব্দে ফিরে যেতেন যে যার। আমার সেই বয়সে মনে হতো মসজিদের রেহেলে রাখা কোরানশরিফ কিংবা ওই মিম্বর— ওখানে আল্লার কোনো স্পর্শ আছে। অলৌকিক ফেরেশতা নিশ্চয় ওই মিম্বর ছুঁয়ে থাকে। আমি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে সন্ধ্যার ভরা অন্ধকারে মিটমিট করা প্রদীপের আলোয় পশ্চিম দিকের মিম্বরটির দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতাম। কিন্তু কখনও এসব কথা বাবাকে কিংবা মাকে জিগ্যেসও করতামনা।
মসজিদের ওই সন্ধ্যার নিস্তব্ধতার ব্যতিক্রম ঘটত শেষ রোজার দিনে। মসজিদে উচ্চস্বরে আজান দেওয়ার জন্য অনেক উঁচু একটি মিনার ছিল। সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে সেখানে উঠে আজান দেওয়া হতো। শেষ রোজার দিন ওই মিনারে উঠে ঈদের চাঁদ উঠেছে কি-না দিব্যদৃষ্টিতে তার খোঁজ করা হত। এবং পশ্চিম আকাশের রক্তিম আভা চারিয়ে তারপর আসতো চাঁদ দেখতে পাওয়ার খবর। জানিনা পশ্চিম আকাশ কি তখন এতটাই উন্মুক্ত ছিল? আজ ইঁট কাঠ পাথর বহুতলের এত আড়াল আকাশকে সংকুচিত করেছে! এখন তো আমরা চাঁদের খবর পাই প্রযুক্তির ব্যবহারে। পশ্চিমদিগন্ত একটা দিকশূন্য মহার্ঘ রচনা থেকে অনেক দূরে সরে গেছে।
ঈদের জামাত হবে গ্রামের ঈদগাহে। ঈদগাহ আর গ্রামের কবরখানা সংলগ্ন মাঠ। গ্রামের জনবসতি তার একটু অদূরেই শেষ হয়েছে। হজরত শাহ কামাল পিরের মাজার সেখানেই। স্মরণাতীত কাল থেকে ওই সংলগ্ন মাঠেই চলে আসছে কবরখানা। তার পাশেই ঈদগাহ। দল বেঁধে এক এক পাড়া থেকে একেক দল চলেছে ঈদগাহের দিকে। নতুন জামাজোড়া। অধিকাংশজনই পাঞ্জাবি পায়জামা পরে। মাথায় শাদা টুপি। বাইরে কাজ করেন যাঁরা, চাকরি উপলক্ষে দূরে থাকেন— তারা সবাই ফিরে এসেছে নিজের পরিবারের কাছে। আমি সেই বয়সে বন্ধুদের সঙ্গে নয়, বাবার সঙ্গে, দাদাদের সঙ্গে ঈদের ময়দানে যেতাম। অনেক বড় সমাবেশ, অনেক মানুষজন। কতজনের কত ধরনের পোশাক; ভেতরে ভেতরে একটা খুশির আমেজ সমস্ত চরাচর ব্যাপ্ত করে রেখেছে। ঈদের নামাজের সারিতে ধনী- নির্ধন শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত-অশিক্ষিত, রাজনৈতিক ক্ষমতাবান কিংবা ফকির সকলেই পাশাপাশি। সকলেই ইমামের পিছনে। এমন কি দেশের রাষ্ট্রপতিও ইমামের পিছনে এক সারিতে। সবাই যেন ’দেবে আর নেবে মেলাবে মিলিবে যাবেনা ফিরে।’
বাবার সঙ্গে ঈদের জামাতে গেলে নামাজ শেষে দাদু-দাদিমা-র কবর জিয়ারত করা ছিল আর একটি পর্যায়। আমরা ক’ভাই মিলে বাবার সঙ্গে কবর জিয়ারত করতাম। তারপর বাড়ি ফেরা। যাওয়ার সময় যেমন দলবদ্ধভাবে ঈদের ময়দানে যাওয়া হয়েছিল, ফেরার সময়টা কিন্তু কাটাকাটা, ছোটো ছোটো পথে। ততক্ষণে অনেকেই ফিরতে শুরু করেছে। ফেরার পথে আমরা সরাসরি বাড়ি চলে এলেও বাবার ফিরতে দেরি হত। নানা জনের খবরাখবর নিতে নিতে তাঁর বাড়ি ফিরতে আরও দেরি হত। ততক্ষণে আমরা বাড়ি ফিরে দেখতাম মা আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন। কিংবা পাড়ার অনেক মহিলা এসেছে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে।
ঈদের দিনের খাওয়াদাওয়া র কথা ভুলে গেলে চলবে না। সিমাইয়ের পায়েস, ভাজা সিমাই, লাচ্চা এবং ক্ষীর। ক্ষীর একধরনের পায়েস হিসেবে তৈরি হয় ঈদের দিনে। তাছাড়া রকমারি মিষ্টি তো আছেই। আমাদের বাড়িতে ছোটবেলা থেকেই এগুলো দেখে আসছি।
সকালের দিকে ঈদের সমাবেশের পর ঈদ কিন্তু ক্রমশ ফুরোতে থাকে। সাকুল্যে কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার মনে হয়। ঈদ উপলক্ষে আনন্দ উৎসবটি বাড়ানো যায়না কেন! তার একটি কারণ এই, ইসলামে যেকোনো পরব এক অর্থে উপাসনা। ফলে তার যাবতীয় আয়োজন তার আন্তরঐশ্বর্যে।
বাহ্যিক আড়ম্বরকে ইসলাম গুরুত্ব দেয়নি।
ধর্মপ্রাণ ভক্তিবাদী মানুষেরা উপাসনার মধ্য দিয়েই ঈদের উদযাপন খোঁজেন।
একটি কবিতায় আমার শৈশব ঈদের একটি রেখাচিত্র তুলে এনেছিলাম একদা। কবিতাটি এখানে রাখলাম।
ঈদ
মসজিদের মিনার থেকে পশ্চিমে রাঙা আকাশের দিকে তাকিয়েছিলেন তিনি
তখন বাল্যকাল।সন্ধ্যাবেলা।একটু একটু অন্ধকার
আকাশ কৃষ্ণপক্ষের সমাপন বলছে এবং
মিনার ক্রমশ উঁচু হচ্ছে… কত উঁচু
একটু পরেই নেমে আসছেন ওই তো সিঁড়ি
ভেঙে ভেঙে
ইফতার শেষের সন্ধ্যায় দিগবলয় প্লাবিত অন্ধকারে
শেষ সিঁড়িতে নেমে এসে দীক্ষান্ত ভাষণ শেষে তিনি জানালেন চাঁদ দেখা দিয়েছে আকাশে…
ব্রত পালনের মতো সেই শৈশব আমি যত্নে থুয়েছি।