আজিজ রাজ্জাক
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আধুনিকতা ও উত্তর আধুনিকতা
বলা হয়ে থাকে মানুষ যখন থেকে আগুনের ব্যবহার করতে শিখেছে তখন থেকেই আধুনিক। এরপূর্বের কৌম সমাজকে বলা হয় অনাধুনিক। আবার যা কিছু প্রতিক্রিয়াশীল, প্রগতিশীল নয় তা-ই অনাধুনিক; এমন তত্ত্বের চলও আমাদের সমাজে বিদ্যমান। সভ্যতার প্রতিটি পর্যায়ের মানুষ নিজেকে আধুনিক ভেবেছে। অর্বাচীন ভেবেছে। অতিক্রান্ত অতীতকে ভেবেছে সেকেলে। প্রস্তর যুগ, কৃষিজ যুগ, লৌহযুগ তবুও প্রচলিত সেক্যুলার ইতিহাসের উৎকর্ষতার এক একটি মাইলফলক। যীশুর জন্ম বিশ্ব ইতিহাসের নতুন অধ্যায়, আধুনিক যুগের সূচনা। যীশুর জন্মের অব্যবহিতপূর্বেই সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল প্রমুখের তত্ত্ব, দর্শন, চিন্তন সমগ্র বিশ্বকে প্রভাবিত করতে থাকে। আধুনিক মনন ও মানসের উৎপত্তি তখন থেকেই। বলা বাহুল্য, আধুনিক মন ক্রমেই যুক্তি ও প্রমাণ নির্ভর হতে থাকে। এরপর মধ্যযুগে আরব রেনেসাঁর হাত ধরে ইউরোপে আসে এনলাইটমেন্টের বিচ্ছুরণ। ফরাসি বিপ্লব, ইংলন্ডের শিল্পবিপ্লব, উপনিবেশবাদ, আমেরিকার স্বাধীনতা, দাসপ্রথা বিলুপ্ত, বলশেভিক বিপ্লব, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ গত সহস্রাব্দের উল্লেখযোগ্য ঘটনা যা সভ্যতা, সাহিত্য, সংস্কৃতির চিন্তাধারা আমূলে পাল্টে দেয়। আধুনিকতার প্রধান ভিত্তি ছিল হেগেল, ডারউইন, মার্কস, এঙ্গেলস, বোদলেয়ার, ফ্রয়েডের মতবাদ। যার উপর দাঁড়িয়ে আধুনিক মানুষ হয়ে উঠেছিল চরম যুক্তিবাদী, পরম অহমবাদী, পুঁজিবাদী, ভোগবাদী, সমাজবাদী, ফ্যাসিবাদী, নাৎসিবাদী, শুন্যবাদী, নাস্তিক্যবাদী, অবাধ যৌনাচারী ও নৈরাজ্যবাদী। হয়েছিল বিচ্ছিন্ন, হতাশাগ্রস্ত, মাদকাসক্ত। নিরংকুশ আধুনিকতা ও শ্রেষ্ঠত্ব মানবসভ্যতা চরম সংকট ও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তোর বোধদয় হয় বিশ্ববিবেকের। এন্টিহেগেল, এন্টি মার্কস, এন্টি ফ্রয়েডিয়ান গোষ্ঠীর দাপটে বিপন্ন বোধ করতে থাকে আধুনিকতাবাদ। মানুষ তথাকথিত যুক্তি ও তত্ত্বের বেড়াজাল থেকে বেড়িয়ে আসতে চায়। আধুনিকতার অচলায়তন ভেঙে জন্ম নিতে থাকে উত্তর আধুনিকতা। এ এক উত্তরণ। উত্তর আধুনিকতা কারও একক প্রচেষ্টা নয়। লেসলি ফিল্ডার ও ইহাব হাসানই প্রথম তাৎপর্যপূর্ণভাবে পোস্টমর্ডানিজম শব্দটি ব্যবহার করে। এরপর সত্তরের মধ্যভাগে আমেরিকায় জনপ্রিয় হয়। তারও পরে ফ্রাঁসোয়া লিওতর ফ্রান্সে (১৯৭৯ সালে The Postmodern condition’ ফরাসিতে প্রকাশিত হয়, ১৯৮৪ তে সেটি ইংরেজি অনুবাদ হয়) এবং হেবারমাস জার্মানিতে পোস্টমর্ডানিজমকে প্রাসংগিক করে তোলেন। পোস্টমর্ডানিজমের দার্শনিক ভিত্তি গড়ে ওঠে দেরিদা, ফুকো ও সাঈদের হাত ধরে। পোস্টমর্ডানিজম শিল্প-সাহিত্যে রূপায়িত হতে থাকে বিশেষ করে কবিতায়। পোস্টমর্ডান কবি হন দায়মুক্ত, শৃঙ্খলমুক্ত, যুক্তি ও কাঠামো বহির্ভূত।
বাংলা সাহিত্যে উত্তর আধুনিকতা
পোস্টমর্ডানিজম নিয়ে পশ্চিমের বই-পুস্তক বাঙালি লেখক-বুদ্ধিজীবিদের হস্তগত হতে প্রায় এক দশক লেগে যায়। কিন্তু তার আগেই সত্তরের দশকে অমিতাভ গুপ্ত, অঞ্জন সেন প্রমুখ পশ্চিম বাংলায় কবিতার ক্ষেত্রে উত্তর আধুনিক চেতনার উন্মেষ ঘটান। সেটি ছিল মূলত নকশাল আন্দোলনের প্রত্যক্ষ প্রভাব। ১৯৮৫ সালে অমিতাভ গুপ্তের প্রকাশিত ‘সরমা-পরমা’ প্রবন্ধটি এক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ ধরা যেতে পারে। উত্তর-আধুনিক অভিধাটি তিনিই প্রথম বাংলায় ব্যবহার করেন। উল্লেখ্য, পশ্চিমবঙ্গের ‘গাঙ্গেয় পত্র’ গোষ্ঠী যেমন–অঞ্জন সেন, উদয়নারায়ণ সিংহ, বীরেন্দ্র চক্রবর্তী, তপোধীর ভট্টাচার্য প্রমুখ ইউরোকেন্দ্রিক পোস্টমর্ডানিজমকে অস্বীকার করে স্থানিক উত্তর আধুনিকতার ধারণা দেন। সেটি হল, আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, লোকজ সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মিথ-পুরাণের সাথে যুক্ত করে কবিতাকে শেকড়সন্ধানী করে তোলা। কেননা ইউরোপ-আমেরিকার মর্ডানিজমের প্রতিক্রিয়ায় পোস্টমর্ডানিজমের উদ্ভব। যেহেতু আমাদের উপমহাদেশে সেই অর্থে ইউরোপের মর্ডানিজম আসেনি, এসেছে খণ্ডিত রূপে। তাই আমাদের উত্তর আধুনিকতাও তাদের মতো হবে না। হতে হবে এই জনপদের আঙ্গিকে। আর হুবহু ইউরোপের পোস্টমর্ডানিজমকে অনুকরণ-অনুসরণ করলে তা ত্রিশ কিংবা পঞ্চাশের কবিদের মতো ধারাচ্ছিন্ন, এলিয়েন সাহিত্য হিসেবেই গণ্য হবে।
বাংলাদেশে উত্তর আধুনিকতা
নব্বইয়ের শুরুতেই বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে উত্তর আধুনিকতার আলোর চিকেশ পড়তে থাকে। সেসময় তিনটি ধারা মূলত কার্যকর ছিল। সালাহউদ্দীন আইয়ুবসহ কেউ কেউ ইউরোকেন্দ্রিক পোস্টমর্ডানিজমকে প্রমোট করা শুরু করেছিলেন। তাদের মতে, অনুকরণ করলে পশ্চিমের করব, পশ্চিমবাংলার নয়। তাছাড়া যেহেতু এর উৎপত্তি পশ্চিমে, তাই পশ্চিমের অনুকরণই শ্রেয়। ঢাকায় উত্তর আধুনিক সাহিত্য আন্দোলন গড়ে তোলেন কবি ইশারফ হোসেন। তাঁর সম্পাদিত ‘সকাল’ পত্রিকা এতে মুখপত্রের ভূমিকা পালন করে। তিনি সাংগঠনিক তৎপরতা চালান। আড্ডা, সভা-সেমিনার ও লেখালেখির মাধ্যমে রাজধানীসহ সারাদেশের প্রান্তকে উত্তর আধুনিক সাহিত্য আন্দোলনে যুক্ত করেন। তিনি কবিতায় দেশ, কাল, ঐতিহ্যের কথা বলেন। তার মতে, বিশ্বাসী নান্দনিকতাও উত্তর আধুনিক কবিতার অন্যতম উপাদান ও লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশে প্রথম রাসুল সা.কে নিবেদিত কবিতার সংকলন ইশারফ হোসেনের সম্পাদনায় প্রকাশ হয়। আবদুল মান্নান সৈয়দ সেটির ভূমিকা লেখেন। এটিকে তারা উত্তর আধুনিক কাজ হিসেবে অভিহিত করেন। ঢাকার বাইরে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে এজাজ ইউসুফীর নেতৃত্বে ‘লিরিক’ গোষ্ঠীর উদ্ভব হয় যারা পশ্চিমবঙ্গের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে উত্তর আধুনিক সাহিত্যের এদেশীয় ভিত শক্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এছাড়া আন্দোলন গোছের না হলেও কতিপয় লিটলম্যাগ সেসময় উত্তর আধুনিকতার তাত্ত্বিক বয়ানে জোরালো ভূমিকা পালন করে যেমন– ঢাকা থেকে প্রকাশিত একবিংশ, প্রান্ত; চট্টগ্রামের সুদর্শনচক্র, সত্তা, একলব্য, উপমা, চম্পকনগর, ১৪০০, আড্ডারু প্রভৃতি; এবং বগুড়া থেকে প্রকাশিত : নিসর্গ, দ্রষ্টব্য, স্বল্পদৈর্ঘ্য।
উত্তর আধুনিক সাহিত্য আন্দোলনে বগুড়া
উত্তর জনপদের প্রাগ্রসর অঞ্চল বগুড়ার সাহিত্য সংস্কৃতির ঐতিহ্য সর্বজনবিদিত। সেন আমলের নথিপত্রে বগুড়ার দুজন কবির নাম মেলে। এরপর সুলতানি আমল, মধ্যযুগের মঙ্গলকবিদের প্রতিনিধিত্ব করেছেন বগুড়ার কবি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, রাজধানী ও চট্টগ্রামের পরে সাহিত্য-সংস্কৃতির উর্বর ভূমি বগুড়া। ছড়া-কবিতা, উপন্যাস কিংবা লিটলম্যাগে। উত্তর আধুনিক সাহিত্য চর্চায় প্রথম সারিতে উচ্চারিত হয়– সরকার আশরাফ সম্পাদিত ‘নিসর্গ’, কামরুল হুদা পথিক সম্পাদিত ‘দ্রষ্টব্য’ এবং সাজ্জাদ বিপ্লব সম্পাদিত ‘স্বল্পদৈর্ঘ্য’র নাম। এছাড়া সাজ্জাদ বিপ্লব ‘পংক্তি’ (প্রথম প্রকাশ ১৯৯৫) ও ‘বিকেল’ নামেও ছোটকাগজ সম্পাদনা করেন। ২০০০ সালের অক্টোবর মাসে স্বল্পদৈর্ঘ্য ‘উত্তর আধুনিক ভাবনা সংখ্যা’ বের করলেও কাগজটির অন্য সংখ্যাগুলোতে এবং পূর্বোক্ত ‘পংক্তি’ ও ‘বিকেল’ এর সংখ্যাতেও উত্তর আধুনিকতা বিষয়ক নানা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। যেমন– ‘বিকেল’ জুলাই ১৯৯৯ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় ফিরোজ আহমেদের লেখা ‘উত্তরাধুনিকতা : আশা ও হতাশা’ প্রবন্ধটি। ‘পংক্তি’ আগষ্ট ১৯৯৬ সংখ্যায় আজিজ সৈয়দ লিখেন ‘ওরিয়েন্টালিজম : প্রতীচ্যের দ্বন্দ্বীতত্ত্ব’ শীর্ষক প্রবন্ধ। খৈয়াম কাদের ‘স্বল্পদৈর্ঘ্য’, জুলাই ২০০০ তে লিখেন ‘বাংলা কবিতায় বিংশ শতাব্দীর সমাপ্তি দশক’। একই সংখ্যায় সৈকত ইসলাম লিখেন ‘উত্তর আধুনিকতা: স্ব-ভূমির দৃষ্টিতে’ শীর্ষক প্রবন্ধ। ‘দ্রষ্টব্য’ ১৯৯৩ সালের মে সংখ্যাতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ‘উত্তর আধুনিকতা কেন’ শিরোনামে লেখেন বীরেন্দ্র চক্রবর্তী এবং অঞ্জন সেন লেখেন ‘উত্তর আধুনিকতা : কাল, ঐতিহ্য, লোকবৃত্ত’ নামক গদ্য। ১৯৯২ সালে প্রকাশিত প্রথম সংখ্যা ‘দ্রষ্টব্য’র শ্লোগান ছিল–‘ঘেন্না–মৌলবাদ, সুবিধাবাদ, গোয়েবল্সবাদ আর শাদা মুখোশপরা ভণ্ডদের প্রতি’। ‘দ্রষ্টব্য’র সর্বশেষ সংখ্যা ছিল সুবিমল মিশ্রকে নিয়ে, ১৯৯৮ সালে ঢাকা থেকে। ‘নিসর্গ’ ১৬তম সংখ্যা ২০০১ সালে প্রকাশ করে উত্তর আধুনিকতা বিষয়ক জিললুর রহমানের অনুবাদ করা গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিকভাকের লেখা ‘সাবঅলটার্ন কথা বলতে পারে কি?’ প্রবন্ধ। ১৯৮৫ সালে প্রথম প্রকাশিত ‘নিসর্গ’ সমগ্র বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দীর্ঘায়ু ছোটকাগজ যা নব্বইয়ের দশকেই খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে যায় এবং পশ্চিমবঙ্গের ‘লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র পুরস্কার’ জিতে নেয়।
১৯৯৩ সালে বগুড়ার সাহিত্য অঙ্গনে আরেকটি বাঁকবদল হয়। সুস্থধারার নান্দনিক সাহিত্য চর্চার প্রয়াসে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘অবাচী সাংস্কৃতিক সংসদ’। ফয়জুল কবীর, শিকদার আ.ন.ম মঈনুদ্দীন, আজিজ সৈয়দ, কমল লোদী, প্রতীক নজরুল, সাজ্জাদ বিপ্লব, এফ শাহজাহানসহ অনেকেই এর সাথে যুক্ত হন। মূলত ১৯৯৫ সালে এই গোষ্ঠীর মুখপত্র হিসেবে ‘পংক্তি’ ছোটকাগজ বের হয়। যা দুই সংখ্যা পরে আর আলোর মুখ দেখেনি। এসময় ‘নোয়াজার্ক’ নামে আরেকটি ছোটকাগজও বের হয়। এসময় বগুড়ায় ‘পুণ্ড্রবর্ধন লিটলম্যাগাজিন লাইব্রেরি’র জন্মলাভ একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা, যেখানে ১০ সহস্রাধিক লিটলম্যাগাজিন ও বই-পত্র সংগ্রহে আছে বলে জানা যায়। এদিকে ঢাকার সাথে সাযুজ্য রেখে উত্তরের রাজধানী বগুড়ায় বেগবান হয় উত্তর আধুনিকতার তাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক চর্চা। নেতৃত্ব দেন সাজ্জাদ বিপ্লব ও তাঁর সম্পাদিত ‘স্বল্পদৈর্ঘ্য’ ছোটকাগজ। তাতে প্রাণিত হন কবি খৈয়াম কাদের, আজিজ সৈয়দ, তৌফিক জহুর, সৈকত ইসলাম, অনন্ত সুজন, মাসুদ কামাল, এফ শাহজাহান, রহমান তাওহীদ প্রমুখ। সাজ্জাদ বিপ্লব এ শতকের শুরুতে (প্রকাশকাল: ২০.১০.২০০০) স্বল্পদৈর্ঘ্য’র ‘উত্তর আধুনিক ভাবনা’ সংখ্যা সম্পাদনা করেন। সাড়ে চার ফর্মার খালিশপুরের কাগজে একরঙা প্রচ্ছদে নান্দনিক একটি সংখ্যা এটি। এতে লিখেছেন কবি ও ভাবুক ফরহাদ মজহার, ড. মমতাজ আহমেদ, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ইশারফ হোসেন, ফিরোজ আহমেদ, হোসেনুর রহমান, তৌফিক জহুর, হাসান দোহারি প্রমুখ। এছাড়া উত্তর আধুনিকতার খোঁজ-খবর শিরোনামে এ সংক্রান্ত প্রকাশিত সকল প্রবন্ধ, পত্রিকা ও পুস্তকের তালিকা দেয়া হয়েছে। ‘কোলাজ: উত্তর আধুনিকতা’ অংশে রবিউল হুসাইন ও আজফার হোসেন’র মতামত চিঠির আদলে তুলে ধরা হয়। এতে স্থান পাওয়া ড. মমতাজ আহমেদ ও হাসান দোহারির ইংরেজি প্রবন্ধ দুটি যদিও উত্তর আধুনিক সংক্রান্ত নয়। সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের লেখায় মূলত ইউরোকেন্দ্রিক পোস্টমর্ডানিজমের ডাল-পালার বিস্তার দেখা যায়। ফরহাদ মজহার ‘মৌলবাদ আতংকের স্বরূপ’ শীর্ষক প্রবন্ধে আধুনিকতাবাদীদের মৌলবাদের জুজুর ভয় এবং এর আড়ালে ইসলামোফোবিয়ার মুখোশ উন্মোচন করেন। মৌলবাদ এখন মূলত ব্রহ্মাস্ত্র হয়ে উঠেছে। খেয়াল করে দেখবেন চট্টগ্রামের লিরিক গোষ্ঠী একসময় ঢাকার সকাল গোষ্ঠীকে মৌলবাদের তকমা দিয়ে খারিজ করে দিয়েছিল। সেটিই আবার বুমেরাং হয়েছে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে। চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত আরেকটি ছোটকাগজ ‘সত্তা’, লিরিককে মৌলবাদের দোষে দুষ্ট সাব্যস্ত করেছে। সেজন্য এজাজ ইউসুফীকে মৌলবাদী নয় মর্মে ডিফেন্ড করতে হয়েছে। এই সংখ্যায় ইশারফ হোসেনের সাথে কবি অনন্ত সুজনের আড্ডা-আলোচনা (সাজ্জাদ বিপ্লব কর্তৃক ‘আধুনিকতা, উত্তর আধুনিকতা ও আমি’ শিরোনামে শ্রুতিলিখিত) অঘোষিত মূল প্রবন্ধ বললে অত্যুক্তি হবে না। দীর্ঘ সেই প্রবন্ধে ইশারফ হোসেন দেশীয় ঐতিহ্যের আলোকে উত্তর আধুনিকতার ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, “আধুনিকতা যে সমস্ত উপকরণ বা বৈশিষ্ট্যকে এক সময় নিরুৎসাহিত করেছে, খারিজ করে দিয়েছে, আজকে আর সে বিষয়গুলো খারিজ করা যাচ্ছে না। অর্থাৎ জিনিসগুলো সম্মানের সাথে গ্রহণীয় হচ্ছে বা বা গ্রহণ করা হচ্ছে।… আমাদের অস্তিত্ব যে বাস্তবতার উপর দাঁড়িয়ে আছে, এই বাস্তবতার চারপার্শ্বের সমস্ত ঘটনাপ্রবাহ-ই আমাদের সাহিত্যে আসতে পারবে। সেখানে কোন শর্ত বা বিধিনিষেধ থাকবে না। এটি হচ্ছে উত্তর আধুনিকতার মূলকথা।… প্রগতিশীলদের ত্যাগ নিয়ে যদি সাহিত্য হতে পারে, তাহলে বিশ্বাসীদের ত্যাগ, জীবনকর্ম নিয়েও সাহিত্য হতে পারে।”
উপসংহার : আজকে আমরা উত্তর আধুনিক সাহিত্য আন্দোলনে বগুড়ার ভূমিকা বিশেষ করে নব্বই দশককে ফোকাস করেছি। এটি মূলত আলোচনার সূত্রপাত। আরও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এখানে আরও তথ্য-উপাত্ত যোগ হবে আশা করি। আমরা উত্তর আধুনিকতা নিয়ে সিরিজ আড্ডা, ওয়ার্কশপ, সেমিনার করতে আগ্রহী। উত্তর আধুনিকতা নান্দনিকতার কথা বলে, ঐতিহ্যের কথা বলে, ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধকে বিবেচনায় নেয়। কিন্তু তার অর্থ উগ্র মৌলবাদ উসকে দেয়া নয়। ধর্মবিশ্বাস মানেই মৌলবাদ নয়। মনে রাখতে হবে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের টিকে থাকার মূলশক্তি। যেকোনভাবে আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও সংবিধানকে সমুন্নত রাখতে হবে। বরং উত্তর আধুনিকতা দেশ, কাল, ঐতিহ্য, কেন্দ্র, প্রান্ত, মেজরিটি, মাইনরিটি, আস্তিক, নাস্তিক-ধার্মিক সবাইকে সমীহ করে, যুক্ত করে। সমাজে সবার অবদানকে স্বীকার করে। নিজেকে আধুনিক দাবি করে বঞ্চিতকে দেখে নাক সিটকায় না, ধর্মীয় লেবাস দেখে উন্নাসিক, এলার্জিক হয় না। উত্তর আধুনিকতা সহনশীলতা শেখায়, সংকুলানধর্মী হওয়ার শিক্ষা দেয়। আমি নয় আমরা অর্থাৎ ব্যষ্টিক নয় সামষ্টিক হতে শেখায়। নেতি নয় ইতির উন্মেষ ঘটায়।
*উত্তর আধুনিক সাহিত্য আন্দোলন, বগুড়া আয়োজিত ‘সোমবারের সাহিত্য আড্ডা’য় ২৯ নভেম্বর, ২০২১ প্রবন্ধটি পঠিত হয়। উৎসুক পাঠকদের জন্য সেটি এখানে প্রকাশ করা হল।
** আজিজ রাজ্জাক, কবি ও উত্তর আধুনিকতা বিষয়ক গবেষক
ভাল আলোচনার দিক উন্মোচন করা লেখা বটে