শিমুল আজাদ
লেখালেখি ও লিটল ম্যাগাজিন করার সুবাদে ১৯৯২ এর দিকে সর্বপ্রথম বন্ধু শুভঙ্কর দাশ তার সম্পাদিত ‘উত্তরপর্ব এই বিষ অর্জন’ ও তার লেখা আমন্ত্রণপত্র আমার যশোরের বাড়ির ঠিকানায় পাঠিয়েছিলো। তারই সূত্র ধরে ১৯৯৩ এর দিকে ২/এ টিপু সুলতান রোড শুভঙ্করের বাড়ি তথা গ্রাফিত্তির ঠেকে ঢুঁ মেরে ছিলাম। বন্ধু শুভঙ্কর, শর্মী, শান্তনু ও গার্গী চক্রবর্তীরা আমাকে প্রতিষ্ঠান বিরোধীতার ঘোরে ঘূর্ণায়মানের চেষ্টা করেছিল। তখনকার দিনে ক্যাসেট প্লেয়ার ছিল রেকর্ডিং এর একমাত্র মাধ্যম। গভীর রাত অবধি সে আলাপচারিতা ছিল উদ্যমতাপূর্ণ। এর পূর্বে গ্রাফিত্তি‘তে শুভঙ্কর আমার ৩/৪টি কবিতা ছেপেছিল। প্রতিষ্ঠান বিরোধীতা বিষয়ক সেই আড্ডা পরবর্তীতে গ্রাফিত্তি’তে ছাপা হয়েছিল।
তারুণ্যের প্রবল তমসায় বন্ধু শুভঙ্কর আমাকে আচ্ছন্ন করেছিল তুমুল। বোধ হয় সে কারণে আমার যতটা মনে পড়ে– আমার কাছের এক বন্ধু সাজেদকে সাথে নিয়ে কলকাতা যাই। সেখানে সূর্যসেন স্ট্রিটের আইডিয়াল হোটেলে উঠি। তখনও মোবাইল ফোনের ব্যবহার সাধারণের হয়ে ওঠেনি।
টেলিফোনে শুভঙ্করকে জানাই যে আমি কলকাতায়। সে সময় কলকাতায় প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিলো, একটু বৃষ্টি হলেই কলকাতার রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে যায়, চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়ে।
তবুও শুভঙ্কর সেই বিপর্যয়ে হাঁটু অব্দি পানিতে ডুবে আমার কাছে আসে, আমার বন্ধুসহ আমাকে হোটেল থেকে তার নতুন আবাসস্থল যতীন দাস পার্কে নিয়ে যায়। সেখানে শর্মীর আতিথিয়েতায় আর প্রবল আড্ডায় কাটে কয়েকটি দিন। এরই মাঝে একদিন সকালে হাংরি কবি প্রদীপ চৌধুরী সেখানে হাজির, আমার সাথে সামান্য পরিচয়েই আমাকে জাপ্টে তার বাসা বাড়ি যাদবপুরের একটি ফ্লাটে নিয়ে যায়। সেখানে সে আমাকে হাংরি জেনারেশন ও তার সতীর্থদের নিয়ে নানা ইতিহাসে আমাকে ভিজিয়ে তোলে। সে ছিল এক বিস্ময়কর বিরল সান্নিধ্য আর অভিজ্ঞতার ক্ষণ।
কবি প্রদীপ চৌধুরী তাঁর সম্পাদিত ‘ফু’, হাংরি বুলেটিনসহ বেশ কিছু বইপত্র উপহারস্বরূপ দিয়েছিলেন, যা এখন আমার আর সংগ্রহে নেই।
কবি প্রদীপ আমাকে শৈলেশ্বর ঘোষ, মলয় রায়চৌধুরী, হারাধন বসাক তথা দেবী রায়ের ভূমিকার কথা বিশেষ জ্ঞাত করেছিলেন। আমাকে তিনি শৈলেশ্বর ঘোষের সাথে দেখা করার তাগিদ দিয়েছিলেন; সেই তাগিদকে মান্য করে আমি অনেক দূরের পথ ডিঙিয়ে এক কর্কশ দুপুরে বনহুগলি যাই, এবং কবির বাসায় পৌছে বিরল সান্নিধ্য লাভ করি। বাড়তি প্রাপ্য হিসেবে কবির লেখা ‘ হাংরি কিংবদন্তি ‘ প্রাপ্ত হই। এসব কিছুর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এক মহান হাংরি কবির কথা স্বভাবতই এসে যায়। তিনি মলয় রায়চৌধুরী।
তিনি কলকাতার নাগতলায় থাকতেন। বন্ধু শুভঙ্কর আমাকে নিয়ে গেলেন কবির বাসায়।
অবশ্য তার পূর্বে আমি একাকী কবির সাথে সাক্ষাৎ করে এসেছিলাম। কবি মলয় বিটনিক আন্দোলনের কবি এলেন গিন্সবার্গের কথা এবং তাদের দূর্লভ স্মৃতি সৃষ্টি নিয়ে নানা কথা আমাকে ব্যক্ত করেছিলেন। গিন্সবার্গের স্বকণ্ঠে ধারণকৃত ক্যাডিস এর পাঠ কপি করে দিয়েছিলেন।
মূলত শুভঙ্কর তার পরিসর আমার এবং অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে ইতিহাসের অংশ হয়ে রইলো।
শুভঙ্কর বা না শুভঙ্কর
শুভঙ্কর ও তার লম্বা ফুলহাতার জামা গড়িয়ে পড়েছে রাস্তায়। আজ তার গলে যাওয়া শরীরের বাড়তি মেদ
কয়েকটন মদের প্রভাবে তরলাবৃত রাস্তার ফুটপাতে।
যদিও কলকাতার যুবক কবিদের মধ্যে
শুভঙ্কর এগিয়ে;
একা একা সে কেবল কবিতাকে খুঁজেছে।
আর কবিতাকে খুঁজতে যেয়ে সে আবিষ্কার করেছে কয়েক হাজার চিত্রকল্প,
অনুভব আর উপলব্ধির নতুন এক শহর।
মূলত শুভঙ্কর নগরের কবি।
সে একই সাথে আধুনিক, উত্তরাধুনিকও বটে।
নগর জীবনের ক্রুরতা, স্থুলতা ডিঙিয়ে
সে হয়ে উঠেছিলো
একটি ভিন্নতর চাঁদের আকর।
ভ্রমণ পিপাসু, চমকে যাওয়া ধ্বনির উল্লাস
বাক্যের আকস্মিক ঝড় ছড়িয়ে
যদিও সে এখন আত্মগোপনে।
এই বিষন্ন সন্ধ্যায়–
তবুও মেঘ আর বৃষ্টিতে ভেজা
স্নিগ্ধ কোনো এক কাক হয়ে
শুভঙ্কর, অবিরাম ভিজেই চলেছে।
……………..…
মহাপৃথিবীর বুকে
মৃতকুমারীর কাঁটার আঘাতে
সম্পূর্ণ এক কবি হয়ে অজস্র বছর
নিজের রহস্যগুলি জানাতে
এবং তার সক্ষমতা ছড়াতে
সে এক শান্ত,স্থির উন্মাদ!
ডুবেছিল অক্ষরের গভীরে
বালির, কাগজের
আর শত ছাপাখানায়।
সঙ্গপ্রিয়তার দীর্ঘ এক চাদরের প্রভাবে
তার পাশে অনেকেই পৌছেছে।
তাদেরই কেউ ছদ্মবেশী, কেউ প্রকৃতই বন্ধু
যারা তার সাথে পাশাপাশি আড্ডায় বসে মদের গ্লাসে ঠোঁট, আর সিগারেট ফুঁকেছে বাস্তবিক সে হেঁটেছে মহাপৃথিবীর বেশ কটি স্থান।
২৪ মে, ২০২৪।