মজিদ মাহমুদ
রুমাল
রুমালে তুলেছিল ফুল রেখেছিল বুকের গভীরে
অনেক দিনের কথা কতকাল আগে গেছ ফিরে।
থোকা থোকা অন্ধকার একটি গাছ নির্জন একা
সেই স্মৃতি এঁকেছিল প্রথম তার হয়েছিল দেখা।
চামচিকে উড়েছিল উপস্থিতি পেয়েছিল টের
তার ডানার ঝাপটা অঙ্কিত নিপুণ সুচিকর্মের।
যত না এঁকেছিল তারচেয়ে অনুক্ত ছিল ঢের
যদিও ইঙ্গিত ভাষা তবু কেউ পেয়েছিল টের।
কলেজ হয়েছে বন্ধ বাড়ি গেছ গ্রীস্মের ছুটিতে
কত না ভয় সঙ্কটে রুমাল তুলে দিলে মুঠিতে।
একটি রঙির ফুল মৌমাছির ডানার গুঞ্জরণ
সেই খানে থেমেছিল মুহুর্তে পৃথিবীর ক্ষণ।
অনেক দিনের কথা কোথায় রেখেছ রুমাল
বিস্মৃত হয়েছ সেই সব মনে হয় গতকাল।
মহাজাগতিক
তুমি যে নক্ষত্র-জাত তার ছায়া পৃথিবীতে পড়েছিল কাল
দু’একটি টেলিস্কোপ আগেই বানিয়েছিল গ্যালিলিও হুবাল।
সমুদ্রের জরায়ুতে এসেছিলে ভেসে যে-সব আলোর কণিকা
মহাকাশ গবেষণা শেষে আবিষ্কৃত সেই সব সুদূর নিহারিকা।
শত সহস্র কোটি বছরের যাত্রায় কতবার নক্ষত্রের ধূলিঝড়
কত ছায়াপথ মিল্কিওয়ে পার হয়ে এই খানে বেঁধেছিল ঘর।
সময়ের দিনক্ষণ মাতৃগর্ভ আজ আর নেই আমাদের মনে
সেই সব স্বাতী-নক্ষত্র অস্থির কশেরুকায় রয়েছে গোপনে।
কয়েক কোটি আলোকবর্ষ পেরিয়ে শূণ্যের ক্ষণিক ইশটিশন
তত্ত্বের বেড়াজালে এই খানে হয়েছিল থিতু আমাদের মন।
যদিও আমরা জানতাম নারী ও পুরুষ– তবু গ্যাসের কুণ্ডলি
বায়ুর অম্লজান নিয়ে সবুজ পল্লবে হেসে উঠেছিল ফুলগুলি।
জন্মের রহস্য নিয়ে তবু করেছি অমীাংসিত তর্কের বিবাদ
কবিতা ও বিজ্ঞান অনুমেয় থেকে যাবে ধর্ম-দর্শন-মতবাদ।
ছবিদের বয়স নিয়ে আর থাকব না অমীামাংসার বেড়াজালে
তুমি আর আমি শুধু কাছাকাছি থেকে চুম্বন এঁকে দেব গালে।
পড়ন্ত নক্ষত্রের গান
আজ পাতা ঝরে যাচ্ছে, অভাব দেখা দিয়েছে জল সিঞ্চনে
হলুদ মেঘে ঢেকেছে বায়ু– ভ্রান্তির কবলে বাড়ি ফেরার পথ
বন্ধুরা যারা তুলেছে কণ্ঠে শীত-কম্পন, ডাকিছে আকিঞ্চনে
কাশ যুবতীর কেশ হয়েছে শুভ্র শরতে, এখন যাবার শপথ।
এসেছে গ্রীষ্মে যদিও, হেমন্তও চলে গেছে মরা-কার্তিকে
পোস্ট-মাস্টার লিখেছে চিঠি– প্রকৃতির নানা রঙ উপাচারে
প্রস্তুত হও বরফ ঘুমে, পল্লব ঝরে গেছে তোমাদের শোকে
বাইরে নবান্ন উৎসব– ভেতরে কান্নায় ভিজেছে বারে বারে।
তুষার শ্রভ্র মেয়েরা মিলায় হিসাব– কয়টা দিনের ব্যবধানে
এখানে কুসুম ফুটেছিল- মধুর মতো ঝরেছিল শ্রভ্র স্তন
হঠাৎ ওঠে চমকে গভীর রাত্রে–উদ্ভ্রান্ত মৌমাছির গানে
শীতের পাখিরা ডানা ঝাপটায়, শূন্যতা আর কতক্ষণ।
যদিও সঙ্গীত যাবে থেমে অকস্মাৎ ফুরাবে ব্যর্থ আয়োজনে
তবুও থাকবে না পৃথিবীর ধূলিকণা– পড়ন্ত নক্ষত্রের গানে।
মহিষাসুর
তোমার হাতে হত্যা হতে হতে
ঠাঁই পেয়েছি পায়ের তলে– হয়তো কোনো মতে
খাড়ার ঘায়ে মারার আগে দৃষ্টি হেনে বান
মাগো আমি পাতক ছিলাম তোমায় অপমান
খুন করেছি পুত্র তোমার সুন্দরী এক কনে
বিশ্বটা আজ পদানত অবৈধ এক রণে
শাসন করার মানস নিয়ে শোষণ করার পণ
তোমার খাড়া আসলে নেমে নাশতে কতক্ষণ
ঘোড়ার পিঠে আসন মাগো গাধার পিঠে ঠাঁই
তোমার থানে ভাগ্য গোনে দুঃশাসনের ভাই
অসুর বধের প্রজ্ঞা নিয়ে খাড়ায় কুপোকাত
তারাই এখন তোমার পায়ে পুষ্প করে পাত
জগত জুড়ে শাসন করে বক্ষে রেখে পা
হয়তো অসুর- সবাই জানে তুমিই তাদের মা
তোমায় রেখে বাপের বাড়ি মাত্র কটা দিন
লোক দেখানো মায়ের সেবা তিলক এঁকে ঋণ
এক অসুরে বধতে তোমায় ধরার আগমণ
তোমার সেবায় মত্ত অসুর লক্ষ কোটি জন
কোন অসুরকে মারবে তুমি কোন অসুরে ঘায়
পাপ-পুণ্যের হিসাব জটিল আজকে বসুধায়
তবু যদি শান্তি আসে তোমার খাড়ার বলে
এই অসুরে বিনাশ করো তোমার পদতলে
বিশ্ব থেকে বিদায় করো দুঃশাসনের রাজ
তবেই তুমি অসুরনাশা মায়ের মতো কাজ।
অর্জুন
অর্জুন গাছ জড়িয়ে ধরলে ব্লাড-প্রেশার কমে
অর্জুনের ছাল হৃদরোগের মাহৌষধ
এমন একটা গাছকে আমি বিয়ে করতে চাই
বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেলে
রক্তের চ লতা বেড়ে গেলে
যে আমাকে আলিঙ্গন করবে
বল্কলের পোশাক খুলে বলবে
আমার রস শুষে নাও
তোমার হৃদপিণ্ড সচল করো
আমি সপ্রাণ-গাছ তবু ব্যথা নেই
অভিযোগ নেই
আমি সারাদিন সূর্যের আগুনে রান্না করি
রাত এলে অন্ধকারে একা দাঁড়িয়ে থাকি
নির্জন বিটপীর তলে
আবার কি আমাদের দেখা হতে পারে
আমরা কি অনেকটা দূর চলে গেছি
সায়াহ্ন কি হয়েছি পার
ফিরতে গেলে বেলাবেলি বড় কি দেরি হয়ে যাবে
বৃক্ষের নিচে কি নেমেছে ছায়া
পাতার আড়াল থেকে পারব কি চিনতে অবয়ব
আলো থেকে দূরে গেলে তুমি কি তেমনই থাক
পুনরপি ভাবতে গেলে নিশ্চিত সায়ংকাল
নদীও হয়েছে উত্তাল ভরপুর
অবিরাম ধরছে বৃষ্টির ধারা
মাঝি চলে গেছে পারে
অথৈ তটিনী আমি পাব কি সন্তরণে
এই ভর সন্ধ্যায় ফিরে গেলে তুমিও
নাকি আমারই মতো দ্বিধায়
নাকি বিপদ ঘনিয়েছে ঘনিষ্ঠতার দায়ে
এখনো প্রান্তরে বুড়ো বিটপীর নিচে
সাঁঝের অন্ধকারে খুঁজছ কোনো মুখ
প্রেতমূর্তি হয়তো একা একা কইছে কথা
এখানে এসেছে নেমে বিচ্ছেদের শূন্যতা
অন্ধকার রাতে বৃষ্টির বারতা।
সাপেক্ষ
অনেকেই জানতে চান– জন্ম সম্বন্ধে কি আমার মত
ঈশ্বর আছে কিংবা নাই
মানুষ কি বানর জাতীয় প্রাণি থেকে এসেছে
পৃথিবী কি সূর্যের চারিদিকে ঘোরে
মানুষের দুরাচারে ওজোনস্তর যাচ্ছে হয়ে ফুটো
একদিন এ গ্রহে ছেড়ে মঙ্গলে মানুষ বাঁধবে ঘর
বরফ-গলনে উঁচু হচ্ছে সমুদ্রের তল
আর কতটা দেরি মসিহ ঈসার কাল
গণতন্ত্র ভালো না উন্নয়ন
আমি শুধু দেখি রুয়ান্ডা থেকে বুরুন্ডি
দারফুর থেকে রাখাইন
নগ্ন পায়ে হেঁটে যাচ্ছে ঈশ্বর– জঙ্গলে সমুদ্রে
পানিতে ভেসে উঠছে লাশ
পালিয়ে যাচ্ছে অন্য কোনো গ্রহের সন্ধানে
সূর্য ঘুরছে পৃথিবীর চারিদিকে
মসিহ পথ দেখায়ে নিয়ে যাচ্ছে তাদের
পোড়া মাংসের পাশে নৃত্যরত দাজ্জালের ঘোড়া
অথচ এখনো যারা উত্তরের অপেক্ষায় আছেন
তাদের শুধু বলি– এবার সাপেক্ষ বলে দিতে হবে
মজিদ মাহমুদ এর লেখালেখি
মজিদ মাহমুদ কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। তিনি বর্তমান সময়ে বাংলা ভাষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি ও চিন্তাশীল প্রাবন্ধিক হিসাবে বিবেচিত। ‘মাহফুজামঙ্গল’সহ বেশ কিছু জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা। তিনি নজরুল ইনসটিটিউটের গবেষণা বৃত্তির অধীনে ‘নজরুল তৃতীয় বিশ্বের মুখপাত্র’ এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের গবেষণা বৃত্তির অধীনে ‘রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণ সাহিত্য’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভ রচনা করেন।
তার রচনা কমনওয়েলথ ফাউন্ডেশন, ইন্ডিয়ান রিভিউ, সিঙ্গাপুর আনবাউন্ড-সহ দেশি-বিদেশি স্বনামখ্যাত জার্নাল ও পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে থাকে। ইংরেজি ছাড়াও ফরাসি, চায়না ও হিন্দি ভাষায় তার বই অনূদিত হয়েছে। ইতোমধ্যে তার ২০টি কাব্যগ্রন্থ ২০টি প্রবন্ধ গ্রন্থসহ ৫৬টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তার প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে।
তিনি ২০২১ খ্রিস্টাব্দে তার উপন্যাস ‘মেমোরিয়াল ক্লাব’ এর জন্য বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কারে ভূষিত হন, এছাড়া জাতীয় প্রেসক্লাব, অরণি, শুভ্রাবসু, চর্যাপদ, জীবনানন্দ দাশ, সমধারা, পদক্ষেপ ও বিনয় মজুমদারসহ বেশ কিছু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তিনি দৈনিক বাংলা, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা, অর্থনীতি প্রতিদিনসহ বেশ কিছু পত্রিকায় কাজ করেছেন। এছাড়া মুড়াপাড়া ডিগ্রি কলেজ ও কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থার প্রধান নির্বাহী।
মজিদ মাহমুদ ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৬৬ সালের ১৬ এপ্রিল পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার চর গড়গড়ি গ্রামে এক মুক্তিযোদ্ধা পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা কেরামত আলী বিশ্বাস, মা সানোয়ারা বেগম।
তার উল্লেখযোগ্য বই:
কবিতা :মাহফুজামঙ্গল (১৯৮৯), গোষ্ঠের দিকে (১৯৯৫), বল উপাখ্যান (১৯৯৮), আপেল কাহিনি (২০০১), ধাত্রী-ক্লিনিকের জন্ম (২০০৬), অনুবিশ্বের কবিতা (২০০৭), দেওয়ান-ই-মজিদ (২০১০), সিংহ ও গর্দভের কবিতা (২০১৩), সন্ত কবীরের ১০০ দোঁহা (২০১৪), গ্রামকুট (২০১৬), কাটাপড়া মানুষ (২০১৬), শুঁড়িখানার গান (২০১৬), লঙ্কাবিযাত্রা (২০১৬), ষটকগুচ্ছ (২০২১), শ্রী শ্রী সন্ন্যাসীতলা (২০২২), খুঁত (২০২১), যুগলপদ (২০২২) আনন্দিনী রায় (২০২২)
কথাসাহিত্য: মাকড়সা ও রজনীগন্ধা (১৯৮৬), সম্পর্ক (২০১৮), মেমোরিয়াল ক্লাব (২০২০), তুম শুনিতে চেয়ো না, (২০২০) ক্যালকাটা গোয়িং (২০২১)।
প্রবন্ধ ও গবেষণা: নজরুল তৃতীয় বিশ্বের মুখপাত্র (১৯৯৬), কেন কবি কেন কবি নয় (২০০৩), নজরুলের মানুষ ধর্ম (২০০৪), ভাষার আধিপত্য ও বিবিধ প্রবন্ধ (২০০৫), উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্য ও অন্যান্য (২০০৭), সাহিত্যচিন্তা ও বিকল্পভাবনা (২০১০), রবীন্দ্রনাথ ও ভারতবর্ষ (২০১২), নির্বাচিত প্রবন্ধ (২০১৪), ক্ষণচিন্তা (২০১৬), নতুন সাহিত্য চেতনা (২০১৮), সাহিত্যে মহামারী (২০২১), মহাজীবনের মহাকাব্য (২০২১), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: পরিপ্রেক্ষিত সাহিত্য সাংস্কৃতিক আন্দোলন ( কোলকাতা, ২০২২)।
অনুবাদ: যাযাব প্রেম (উপন্যাস) ২০১৭, মূল মরোক্কান লেখক ইউসুফ আমিনি ইলালামি, ঈশ্বর ছুটিতে (২০১৭) মূল অজিত কৌর, পরদেশি কবিতা (২০২১), পরদেশি গল্প (২০২২)।
শিশুসাহিত্য: বৌটুবানী ফুলের দেশে (১৯৮৫), বাংলাদেশের মুখ (২০১৬), বর্ণমালায় বাংলা ভাষা (২০১৯)।
সম্পাদনা: রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণ সাহিত্য (২০০৭), মধুসূদন দত্তের শ্রেষ্ঠ কবিতা (২০০৯), বৃক্ষ ভালোবাসার কবিতা (২০০০), জামরুল হাসান বেগ স্মারক গ্রন্থ (২০০৩), হাবীবুল্লাহ সিরাজীর শ্রেষ্ঠ কবিতা (২০২২), মুখোমুখি: কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার সাক্ষাৎকার (২০২২)।
পেশা: উন্নয়ন-কর্মী, শিক্ষকতা ও লেখালেখি ।