দুই হাজার সাল। এপ্রিলের শেষ। আকাশে ঝকঝকে সূর্য। তীব্র নীল আকাশ। এতো নীল যে মনে হয় কোনো খেয়ালী শিল্পী শাদা ক্যানভাসে উপুড় করে ঢেলে দিয়েছেন তার সবটুকু নীল রঙ। গা থেকে শীতের জড়তা ঝেড়ে ফেলে জেগে উঠছে বলকান প্রকৃতি। গাছে গাছে সবুজের কুঁড়ি, পাতাদের হাস্যোজ্জ্বল উঁকি-ঝুঁকি। দুপুরের রোদ আমাদের শীতার্ত দেহকে প্রিয়তমার উষ্ণ স্পর্শের মতো জড়িয়ে আছে। কোনো এক আড়ালে বসে একটি ঘুঘু ক্রমাগত ডেকে চলেছে। স্থানীয় আলবেনিয়ান ভাষায় ঘুঘুকে বলে ঘুঘুৎকা। কী করুণ ঘুঘুৎকার সেই ডাক। আমি ক্রমশ ঘোরাচ্ছন্ন হয়ে পড়ি।
যুদ্ধের দ্রোহে পোড়া এক জনপদ কসোভো। জাতিগত সংঘাতের ক্ষতচিহ্ন এখনো সর্বত্র। বিদ্যালয়ে, পুলিশ স্টেশনে, রেকর্ড রুমে, সর্বত্রই মৃতের কংকালের মতো হা হয়ে আছে দালানের পাঁজর। আমি জাতিসংঘের একজন কর্মী। ভোটার ও সিভিল নিবন্ধন দলের দলনেতা। আমরা তাঁবু গেড়েছি দক্ষিণ কসোভোর একটি গ্রাম পোজরানের ভাঙা রেকর্ডরুমটিতে। পোজরান একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম এবং কসোভোর সবচেয়ে বড় গ্রাম বলে এর সুখ্যাতি রয়েছে। পাশেই পোজরান হাই স্কুল। দুপুরে মধ্যাহ্নবিরতির সময় স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকারা ছুটে আসেন এই ভাঙা রেকর্ডরুমটিকে ঘিরে একদল স্বদেশী-ভিনদেশী মানুষের যৌথ কর্মযজ্ঞ কৌতূহল এবং কৌতুকভরে প্রত্যক্ষ করার জন্য। আমাদের নিরাপত্তার জন্য রয়েছে এক প্লাটুন ইউএস মিলিটেরি, অত্যাধুনিক অস্ত্র-সস্ত্রে সজ্জিত। ওদের ঘিরেও স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের সীমাহীন কৌতূহল।
আজ এসেছে সিনিয়র গ্রেডের একদল ছাত্রী। ষোল-সতের বছর বয়েসী উচ্ছল–উর্বশী তরুণীদের পদচারণায় মুখর এখন রেকর্ড রুমের আঙিনা। কসোভোর মেয়েদের গায়ের রঙ শাদা কিন্তু টিপিক্যাল ইউরোপীয়দের মতো রুক্ষ বা আঁচিলে পূর্ণ নয়, বরং ভূমধ্যসাগরীয়দের মতো মসৃণ ত্বক। মেয়েগুলোর নবীন ত্বকে প্রতিফলিত সূর্যকিরণ এক স্নিগ্ধ দ্যুতি ছড়িয়ে দিচ্ছে। ওদের চুল কালো, চোখ কালো। এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে এর চেয়ে সুন্দর আর কোনো কম্বিনেশন হতেই পারে না। মেয়েগুলোর কালো চোখের দৃষ্টিতে কৌতূহল আছে বটে তবে কোনো সন্দেহ নেই, যেন এক পরম নির্ভরতা, যেন ওরা জানে আমরা এসেছি এই যুদ্ধাহত জনপদের সব ক্ষত মুছে দেবার জন্যে। এক ঘণ্টার মধ্যাহ্ন বিরতি ঘোষণা করে কাজ-কর্ম গুছিয়ে আমরাও নেমে আসি আঙিনায়। অতিথিকে যতটা সম্ভব সম্মান করা বলকান মুসলিম প্রথা। অতিথিকে ওরা বলে মুসাফের। মুসাফের ওদের কাছে ভগবানতূল্য। আমরা উঠোনে নেমে আসতেই মেয়েগুলো সুশৃঙ্খলভাবে সারি বেঁধে এক পাশে দাঁড়িয়ে পড়লো। একে একে সবাই এসে আমার সাথে হাত মেলালো। শুধু একটি মেয়ে কাছে এসে আমাকে দেখলো এবং তার হাত গুটিয়ে নিল। আমি খুব আহত হলাম। বুঝলাম এটা বর্ণবাদ। বুঝলো আমার স্থানীয় সহকর্মীরাও কিন্তু আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করলো, মেয়েটি পাগল।
এর মধ্যে পেরিয়ে গেছে পাঁচ বছর। আজ ৬ই মার্চ ২০১৫। আমি এখন জাতিগত দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জর্জরিত আরেক জনপদ পশ্চিম আফ্রিকার আইভরিকোস্টে। গতকাল গিয়েছিলাম সানপেদ্রো সৈকতে। বুনো আটলান্টিকের ফেনায় লুটোপুটি খেয়ে নিজেদের অব্যক্ত কষ্টগুলোকে সমুদ্রের বিশালতার কাছে জমা রেখে এসেছি। ফেরার পথে এক চেকপোস্টে গাড়ি থামাল আফ্রিকান পিসকিপার মিলিটারিদের একটি দল। ওদের ঘিরেও একদল স্থানীয় শিশু-কিশোরের জটলা। আমার সাথে আরো দু’জন বাংলাদেশী সহকর্মী, ওরাও সেনাবাহিনীরই সদস্য কিন্তু সিভিল পোশাকে, অফ ডিউটি। ছেলে-ছোকড়ার দলটি আমাদের দেখে স্থানীয় ভাষায় ভেংচি কাটছে আর কি যেন বলছে। একটি ধ্বনি শুধু বুঝতে পারছি, “তু বাবু”। এদের মধ্যে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক লোক, তিনি আবার ইংরেজী বলেন। তাকে ডাকলাম এবং জিজ্ঞেস করলাম, তু বাবু অর্থ কি? তিনি জানালেন, তুমি শাদা। ওরা শ্লোগানের মতো আর কি বলছে? এ প্রশ্নের উত্তরে লোকটি কোনো দ্বিধা না করেই জানালো, ওরা বলছে, “তোমরা শাদা, তোমাদেরকে আমরা বিশ্বাস করি না।
বাসায় ফিরে আমার খুব মন খারাপ হলো। পাঁচ বছর আগে কসোভোর একটি মেয়ে আমার সাথে হ্যান্ডশেখ করেনি আমি কালো বলে, আর আইভরিকোস্টের কালো মানুষেরা আমাদের বিশ্বাস করছে না কারণ আমরা শাদা। মধ্যবর্তী অবস্থানের এ কেমন বিড়ম্বনা? প্রায়শই খবর আসছে দারফুরে, আফগানিস্তানে, ইরাকে সহকর্মীদের স্থানীয় বিদ্রোহীরা ধরে নিয়ে যাচ্ছে, নির্যাতন করছে, মেরে ফেলছে। মাঝে মাঝে অ্যামবুশ হচ্ছে, আমাদের মিলিটারী/পুলিশ সহকর্মীরা মারা পড়ছেন। মধ্যবর্তী গাত্রবর্ণের বিড়ম্বনা এবং সহকর্মীদের নিখোঁজ/নির্যাতিত হবার দুঃসহ কষ্টের গল্পগুলো শুনে শুনে আমার মধ্যে একটি কবিতার জন্ম নিলো এবং আমি সেই রাতেই “মধ্যবর্তী” কবিতাটি লিখে ফেললাম।
মধ্যবর্তী
আমাকে কেন যে ওরা ধরে নিয়ে এলো
ভালো করে কিছুই বুঝতে পারছি না।
আমার দু’হাত এখন পিছমোড়া করে বাঁধা
পা বাঁধা
চোখ দুটো কালো কাপড়ে শক্ত করে বেঁধে দিয়েছে ওরা
চারপাশে হল্লার শব্দ শুনতে পাচ্ছি
উৎকট গন্ধ এসে লাগছে নাকে
আকাশে কি শকুন উড়ছে? মৃত্যুর শব্দ পাচ্ছি
আগুনের আঁচে আমার চামড়া পুড়ে যাচ্ছে
তবে কি ওরা আমাকে অগ্নিদগ্ধ করবে?
জীবন এবং মৃত্যুর মাঝখানের রেখাটি ক্রমশই মুছে যাচ্ছে
যে-কোনো মুহূর্তে আমাকে জ্বলন্ত আগুনের ভেতর নিক্ষেপ করা হতে পারে
অবধারিত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার মুহূর্তে
বারবার কেবল প্রিয়তমা মুক্তির কথা মনে পড়ছে
মনে আছেতো, জলকে গান শেখাবে আর অগ্নিকে গিটার
ওরা দুই ভাই-বোন, আমার প্রিয় দুই সন্তান
আমার রচিত গানগুলো ছড়িয়ে দেবে পৃথিবীর বাতাশে
সেই বাতাশে নিঃশ্বাস নিয়ে পৃথিবীর মানুষেরা হয়ে উঠবে প্রেমিক।
শুনতে পাচ্ছি একদল ভয়ঙ্কর কালো মানুষ
আমার সারা গায়ে ঘৃণার থু থু ছিটাতে ছিটাতে
খিস্তি গাইছে, “শাদা কুত্তাটাকে মার,
জাতিসংঘের শাদা কুত্তাটাকে পুড়িয়ে মার।”
মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হঠাৎ খুব হাসি পেল
মাত্র দু’বছর আগে এক জার্মান তরুণী
আমার সাথে হ্যান্ডশেখ করেনি গায়ের রঙ কালো বলে
অথচ সেই আমি আজ পশ্চিম আফ্রিকায় এসে
শাদা হবার অপরাধে মৃত্যুর মুখোমুখি
মধ্যবর্তী অবস্থানের সুবিধাটা কখনোই বুঝি নিতে পারলাম না
আমার সারা শরীর অসংখ্য বুটের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হতে লাগলো
সেই সাথে শক্ত লাঠির আঘাত
আমি আর চিৎকার করতেও পারছি না
গলা শুকিয়ে গেছে, জিহবা নড়ছে না
চামড়া ফেটে সমস্ত শরীর থেকে অসংখ্য রক্তের ধারা
গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে আফ্রিকার মাটিতে
আমার খুব ঘুম পাচ্ছে এখন
তবে কি আমি মৃত্যুর গহীন অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি?
কিন্তু আমার মস্তিষ্ক এখনো সজাগ
আমি স্পষ্টতই মনে করতে পারছি আমার সেই সহকর্মীটির কথা
ইরগালেম গেব্রেসেলাসি, স্বাধীনতার জন্য
যার তিন ভাই প্রাণ দিয়েছে ইরিত্রিয়ার মাটিতে
কিন্তু সেই মেয়েটি এখন কোথায়?
ও-তো আমার সঙ্গেই ছিল
শহর থেকে দূরে, লেগুনের ওপারে, একটি গহীন অরণ্য পেরিয়ে
যুদ্ধ বিদ্ধস্ত এক গ্রামে গিয়েছিলাম আমরা
অসহায় ভূখা মানুষের মধ্যে খাবার বিতরণের জন্যে
তবে কি মিলিশিয়ারা ইতোমধ্যেই ওকে মেরে ফেলেছে?
নাকি ওর শরীরে উন্মত্ত হুংকারে ঢালছে ঘৃণার ভাইরাস?
আমাকে গাড়িতে তোলা হলো এবার
সম্ভবত একটি খোলা জিপ
নিস্তেজ শরীরের ক্ষত স্থানগুলোতে গ্রীস্মের হাওয়া লেগে
টনটন করে উঠছে
আনুমানিক ঘণ্টা দুয়েক চলার পর
কোনো এক নির্জন মরুভূমিতে ওরা গাড়ি থামাল
এরপর মৃত ভেবে আমাকে ওরা বধ্যভূমিতে ছুঁড়ে ফেলবার আগে
লাশের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিলো
কিন্তু আমার চোখ এখনো বাঁধা।
পুনশ্চঃ পাঁচ বছর আগে এক আলবেনিয়ান শ্বেতাঙ্গিনী তরুণী আমার সাথে হ্যান্ডশেখ করেনি কিন্তু এই কবিতায় আমি ব্যবহার করেছি দু’বছর আগের এক জার্মান তরুণীর কথা। আমার অভিজ্ঞতাটির মতো প্রায় একই রকম অভিজ্ঞতার কথা আমি শুনেছি অন্য সহকর্মীর কাছে কোনো এক জার্মান মানুষের সাথে। কসোভো তখনো স্বাধীন হয়নি, সার্বিয়ানদের দ্বারা অত্যাচারিত, নিগৃহীত স্বাধীনতাকামী এই জনগোষ্ঠীর মানুষকে ছোট করতে চাইনি বলে নিজের অভিজ্ঞতার কথাটি না বলে অন্যের অভিজ্ঞতা ধার করেছি।