spot_imgspot_imgspot_imgspot_img
প্রচ্ছদসাক্ষাৎকারকবিদের মধ্যে আবিদকে বেশী কাউন্ট করতাম : মাহবুব হাসান

সাক্ষাৎকার গ্রহণে : সাজ্জাদ বিপ্লব

কবিদের মধ্যে আবিদকে বেশী কাউন্ট করতাম : মাহবুব হাসান

. আপনার প্রথম প্রকাশিত বই কোনটি? কবে প্রকাশিত হয়েছিলো? প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি কেমন ছিলো?

–প্রথম কবিতার বই ‘তন্দ্রার কোলে হরিণ’। এটি বেরিয়েছিলো ১৯৮৪ সালে। আবিদ আজাদের শিল্পতরু প্রকাশনী থেকে।

আমার বন্ধুদের মধ্যে আবিদ আজাদকেই ভাগ্যবান বলে মনে করি। ওর কবিতার বই সবার আগে বেরোয়। আবিদ নিজে ভালো কবি। ৭-এর দশকের কবিদের কেউ যদি তালিকা বানায়, তাহলে আবিদের নাম এক নম্বরে লিখবে। কারণ আবিদ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের মর্মটুকু উদ্ধার করে কবিতায় লিখতে পেরেছিলো। তার ‘ঘাসের ঘটনা’ সেটা প্রমাণ করবে। আমার বই প্রকাশের তেমন একটা তাগিদ অনুভব করিনি আমি। বন্ধুরা তো বলতো বই বের কর। আমি বলতাম আমি তো আর প্রকাশক নই, কি করে বের করবো? দেশের প্রকাশকদের কেউই সত্তর দশকের কবিদের পাত্তা দেয় না, তারা ষাটের গুটি কয়েকের বই প্রকাশ করতেই উৎসাহী। এ ক্ষেত্রে আবিদ ব্যতিক্রম। ওর বইটা ষাটের কেউ একজন প্রমোট করেছিলো। ৮০ সালে আবিদ বললো কবিতা গুছিয়ে আনো বই বের করবো তোমার। ততোদিনে সে প্রকাশনী শুরু করেছে। তো আমি আর কবিতা খুঁজে পাই না। কাটিংস রাখার কোনো কথাই আমার মনে আসেনি কখনো। বাসায় যে সব সংকলন ছিলো সেখান থেকেই জড়ো করলাম কিছু কবিতা। দিলাম আবিদকে। সেগুলো হাতে কম্পোজ হতে থাকে। দেখা যায় ৬৪ পাতা ভরার মতো কবিতা নেই। তবু কাজটা চলতে থাকে। ৮৩ সালে কাজটা পরিপূর্ণ হয়। আফজাল হোসেনকে প্রকাশনা ‘বিপ্লবে’। আমিই ওকে জানাতেই বললো আমি কভার করে দিচ্ছি। ও তখন কাজ করে আমাদের দৈনিক দেশ-এর সাপ্তাহিক ডেকে এনেছিলাম বিপ্লবের জন্য। চমৎকার একটি শাদা-কালো ওয়াটার কালারের প্রচ্ছদ আঁকলো আফজাল। পেছনের কভারের জন্য ও ছবি তুললো পাভেল আল মাজির ক্যামেরায়, পত্রিকা অফিসের ছাদে গিয়ে। এ-ঘটনা ৮৩ সালের। সে-বছর বইটি বেরুলো না। মানে আবিদ বের করতে পারলো না। ভেতরের ফর্মাগুলো ছাপা হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু কভার করতে পারলো না। আমি আবিদকে এ-নিয়ে কিছু বলিনি। পরের বছর ১৯৮৪ সাল-এর ফেব্রুয়ারিতে ‘তন্দ্রার কোলে হরিণ’ বেরুলো। আবিদের ‘ঘাসের ঘটনা’ বেরুবার পর যে রকম আলোড়ন হয়েছিলো, আমার ‘তন্দ্রার কোলে হরিণ’ ততোধিক নীরবেই থেকে গেলো। এমন কি আমার বন্ধু-বান্ধবরাও, সাতের দশকের কবিরাও রা কাটলো না আমার সৃষ্টি নিয়ে। আমি কিন্তু তখনো এতোটা সার্পলি ভাবিনি যে কেন বন্ধুরা আমার বই নিয়ে কথা বলছে না। এমন কি আবিদও কোনো কথা বলে না।

আমি কবিদের মধ্যে আবিদকে বেশি কাউন্ট করতাম ওর ইমেজারিপূর্ণ কবিতার জন্য। কিন্তু চেষ্টা করতাম ওর মতো যেন আমি কবিতা না লিখি। কারণ আমি জেনেছিলাম যে প্রকৃত কবি কখনোই অন্য কবিতা দ্বারা প্রভাবিত হলেও সেই আকরণ ও প্রকরণে সাজাতে চায় না নিজের কবিতা। আমার কবিতাও ইমেজারিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ কিন্তু আবিদের মতো করে তা সাজানো নয়। ওকে এড়িয়ে কবিতায় নতুন কিছু করারই আমার চেষ্টা ছিলো সেটা আবিদ নিজেও জানতো। আর মাঝে মাঝে এ-নিয়ে কথা বলে মিষ্টি করে মুচকি হাসতো। শিহাব সরকার, জাহাঙ্গীরুল ইসলাম, আতাহার খান, জাফরুল আহসান, মাহমুদ শফিক, হাসান হাফিজ, জাহিদ হায়দার, নাসির আহমেদ, বিমল গুহ, আবিদ আনোয়ার, মাসুদুজ্জামান এবং আরো অনেক বন্ধু, তারা কেউ কোনো কিছু বলতো না। এটা সেই সময়ের কথা বলছি যখন সদ্যই স্বাধীনতার রোদ গায়ে মাখতে মাখতে আমরা বেড়ে উঠছি এবং জনজীবনের নাড়িভুড়ির সাক্ষাৎ পাচ্ছি চলমান জীবন-সংস্কৃতি থেকে। আর দেখছি কিভাবে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধেও অর্জন স্বাধীনতার সাহসকে কেড়ে-খুঁড়ে নিঃশেষ কওে দিচ্ছে। আমাদের ভেতরে দানা বাঁধছে হতাশা আর ক্ষোভ। গোটা সাতের দশকের, মুক্তিযুদ্ধের অবদান কি করে লুট হয়ে যাচ্ছে তার কিছু ছবি তো আমার কবিতায় উঠে এসেছে। সেটা ডাইরেক্ট প্রতিবাদের রাজনৈতিক শ্লোগানের মতো করে নয়, কাব্যিক ব্যঞ্জনায় উঠে এসেছে।

আমার মনে পড়ছে না কেউ আমার তন্দ্রার কোলে হরিণ নিয়ে এক লাইন রিভিউ করেছে। তখন রিভিউটাই ছিলো সবারই প্রত্যাশিত। একবার কবি মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ তার সুদীর্ঘ প্রবন্ধে অনেক কবিদের নামের সাথে আমার নামটাও লিখেছিলেন। আমি খুব কৃতজ্ঞ বোধ করেছিলাম মাহফুজউল্লাহ ভাইয়ের প্রতি। আবদুল মান্নান সৈয়দের সাথে আমার ও আবিদের ঘনিষ্টতা এমন ছিলো যে আবিদ তাকে ‘শিল্পতরু’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক করে মাসে মাসে অনেক টাকা বেতন দিতো। সেই তিনি আবিদ ছাড়াও সাতের অনেক বাজে কবিকেও নানাভাবে তার লেখায় তুলে আনতেন, কিন্তু কখনোই আমার নাম নিতেন না। দেখো আল মাহমুদকে। তিনিও তো আমার প্রিয় কবি। তাকে আমি বহুভাবে সম্মানিত করার আয়োজন করেছি। কিন্তু একবারও বলিনি আমাকে নিয়ে কিছু লেখেন। অথচ তিনি তো শিবিরমার্কা অনেককে নিয়েও প্রবন্ধ লিখেছেন।

না ষাটের কেউ না পঞ্চাশের কেউ না সত্তরের কেউ আমার কবিতা নিয়ে কথা বলেছে। আমি কিন্তু সেই কবি যার ভেতরে আছে অসাধারণ সব উপাদান উপকরণ। আমি বুঝে কবিতা লিখি। ভাব নিয়ে লিখি না। ভাব ধরে থাকি না। কবিতা লেখার জন্য প্রচুর গদ্য সাহিত্য, সংস্কৃতি বিষয়ক, ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিষয়ে পড়াশোনা দরকার। পড়া দরকার কমপিউটার বিষয়ক রচনা। তাহলেই কবিতার ক্ষেত্র সম্প্র্রসারিত হবে। চলমান জীবনের রুপরেখা উঠে আসবে কবিতার ডালপালায়।

. সাহিত্যে আপনি কার উত্তরাধিকার বহন করেন?

–কবিরা তাদের পূর্বসুরীদের উত্তরাধিকার ধারণ করে। আমিও করেছি। এই উত্তরাধিকার ধারণ মানে তাদের অনুকারী হওয়া নয়, এটা বুঝতে হবে।

. এ যাবৎ সর্ব মোট আপনার কতটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে? এর মধ্যে কোনটি বা কোনকোন কাজকে বা কোন বইকে আপনি আপনার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি বলে মনে করেন?

–এ-যাবৎ হয়তো ৪০টিরও বেশি বই বেরিয়েছে।  আসল সংখ্যা বলা যাবে না। এ-বছরও বেশ কয়েকটি বেরিয়েছে। কারণ আমার মনে নেই। আর প্রতিবছরই তো বই বেরোয়, তো সংখ্যা নিয়ে আমি ভাবিনি। আর বইয়ের সংখ্যা দিয়ে কি হবে? যদি তুমি ভালো কিছু সৃষ্টি করতে না পারলে তাহলে শত শত বই লিখে লাভ কি? হুমায়ুন ও মিলনের মতো পয়সা কামানো তো সাহিত্যের কাজ না ।

সবাই যা বলে আমিও সেটাই বলি, যে, আমি তৃপ্ত নই কোনো বইয়ের ওপরই। আসলে কোনো বই ধরে তো কবি এগোন না। তার চিন্তার রাজপথ গলিপথ আর উপগলি পথ ছাড়াও তো বিশাল স্বপ্নরাজ্য রয়ে গেছে। সৃষ্টি চেতনা সেই সব এলাকায় এক লহমায় ঘুরে আসতে পারে। ব্যবহার করতে পারে তার একটুখানি কোণা বা ঝরে পড়া উপাদান। কবির চেতনাকে তুমি সহজেই তোমার ভাষায় আটকাতে পারো না। সে ক্ষমতা তোমার ভাষার নেই। পৃথিবীর কোনো ভাষাই কবি-হৃদয়কে ধারণ করবার মতো পরিসরের নয়। আমি আমার চিন্তা আর ভাবনারাজির কিয়দংশই কেবল ভাষায় অনুবাদ করতে পারি। সেটুকুই তো আমরা বুঝতে পারি না। বোঝার জন্য তো ওই সব এলাকায় হাঁটতে হবে, অনুভব করতে হবে, উপলব্ধির জালে ছেকে তুলতে হবে। নাকি… ।

. সম্প্রতি প্রকাশিত আপনার নতুন বই সম্পর্কে বলুন ।

–সাম্প্রতিক কোন বইটা নিয়ে বলবো? ‘কবিতার কথা’ বইটি আসলে ১৫/১৬ বছরের আগে লেখা প্রবন্ধ নিয়ে বেরুলো। কবিতার আলোচনা এটি। আমার তো কবিতা ব্যাখ্যা করতে ভালোই লাগে। তোমরা পড়ে দেখতে পারো কি বলবার চেষ্টা করেছি। তবে এ বইটি উপকারে আসবে যারা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনো করছে, তাদের। এখন তো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলাদেশের আধুনিক কবিতা বিষয়ে পাঠদান করছে। আর ‘শূন্যতার কাঁটাতারে শুয়ে আছি’তো কবিতার বই। কবিতাগুলো বহন করছে আমার হৃদয়াবেগের কণা। পড়ে অন্য কারো ভালো লাগতে পারে। আমারও লাগে কোনো কোনো কবিতা। আর সমগ্র কাব্যযাত্রায় কিছু কবিতা আমার খুব ভালো লাগে। আমার মা’কে নিয়ে লেখা ‘আমার আকাশ-১,২,৩,৪, নয়নতারা, মন্ত্র, সাত মাত্রার মাত্রাবৃত্তে লেখা ‘কানাডা কতোদূর/ কে বলে কতো দূর, তারপর কাজলরেখা, নদী কাহিনী, এ-রকম আরো কিছু  কবিতা আমার ভালো লাগে । তোমরাও পড়ে দেখতে পারো ।

. আপনি নিজেকে কোন দশকের কবিলেখক বলেন? কেন?

–আমি কুড়ি শতকের সাতের দশকের। কেন মনে করি? কারণ আমার কাব্য চেতনার উন্মেষ হয়েছে ওই দশকে। সময় মানুষকে তার ছাচে ফেলে তৈরি করে। আমার মেধা-মনন আর চিন্তার পথ তৈরি হয়েছে ওই দশকে। আমি ওই কালেই বুঝতে পেরেছিলাম যে আমাদের শিক্ষাটা আসলে কোনো রকম শিক্ষার মধ্যেই পড়ে না। কারণ এটি ঔপনিবেশিক চিন্তাধারা আর প্যাটার্ণের অন্তর্গত হওয়ায় আমরা পশ্চিমাদেশগুলোকেই প্রাগ্রসর ভাবতে শিখি। এবং তাদের সেই প্রাগ্রসরতারই গুণ গাই, গান করি। এটা আমাদের কালচারালি পরাধীন করে  রাখার জন্য ব্রিটিশরা চালু করেছিলো। জ্ঞান আর জ্ঞানের উপাত্ত-উপকরণ ও উপাদান সব কিছুই উরোপে, বাকি বিশ্বে কিছু নেই। আমরা ‘সাংস্কৃতিকভাবে নিম্নমানের, নিম্নস্তরের এবং কোনো কোনো জাতিগোষ্ঠীর কোনা কালচারই নেই’ বলে ঘোষণা করেছিলো ব্রিটিশ দখলদার শাসকরা। দুইশ বছরের চর্চার ফলে আমাদের মজ্জাগত হয়েছে যে যা কিছু উন্নত তা ইউরোপের। ফলে আজ আমরা ভাবতে পারছি না যে আমরা কালচারাল হেজেমনির শিকার।

. আপনার সমকাল নিয়ে বলুন ।

আমার সমকাল বলতে কি বোঝাচ্ছো? আমার কবিতা-যাত্রা সাতের দশকে। মিলিনিয়ামের রাজপথ ধরে এখন আমি একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের একজন মানুষ। এই গোটা সময়ই আমার কাল। এই সমকাল খুবই ঝঞ্জা-বিক্ষুব্ধ সময় পার করে চলেছে। পৃথিবীর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক যাত্রায় এখন মেরুকরণই প্রধান কাজ বলে মনে হচ্ছে। ক্ষমতায়নের  ক্ষেত্রে নানামুখি অভিযান চলছে। মানুষের সভ্যতার মধ্যে, চিন্তার মধ্যে ক্ল্যাশ চলছে। কিছু মূল্যবোধ গুড়িয়ে যাচ্ছে, কিছু নতুন চিন্তার কুড়ি দেখতে পাচ্ছি আমরা। আর তার প্রকাশ মাধ্যমও ভিন্ন। এই সময়-যাত্রায় যারা সামিল হতে পারবে তারাই নতুন কিছু সৃজন করতে পারবে।

. সাম্প্রতিক কালে কারা ভালো লিখছে বলে মনে করেন?

–কারা ভালো লিখছে তাতো বলতে পারবো না । আমি নাম মনে রাখি না বা রাখতে পারি না । মানুষের স্বভাব হচ্ছে একটা জিনিস দেখতে দেখতে সে মনে রাখতে শেখে। বাংলা কবিতার আকরণ ও প্রকরণকলায় কিছুটা নতুন হয়েছে–এমনটা আমার অভিজ্ঞতায় নেই। এটা হতে পারে আমি হয়তো নতুন কবিদের চিন্তার সাথে কম্যুনিকেট করতে পারছি না বা তারা আমাকে দিতে পারছে না নতুন কিছু। ধরো, মাইকেল মধুসূদন দত্ত আর রবীন্দ্রনাথের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিগত যে পার্থক্য যতোটা আকরণ-প্রকরণগত পার্থক্য তেমন ব্যাপক নয়। আবার রবীন্দ্রনাথের সাথে নজরুলের পার্থক্য আকরণ ও প্রকরণগত পার্থক্য ব্যাপক হলেও তাকে সমানভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। আসলে রবীন্দ্রনাথের সাথে নজরুলের মনোমিথিক্যাল  পার্থক্য রচিত হয়েছে মননগত, ভাষাগত ও দৃষ্টিভঙ্গিগত দিক থেকে । ফলে এটা চোখে পড়ে সহজেই। এই রকম কোনো নতুন কিছু আমার চোখে পড়েনি।

তবে অনেকেই ভালো লিখছে সে কথা শুনি, অনেকেই বলেন। আমিও কিছু কিছু কবিতা পাঠ করে আনন্দ পাই, বুঝতে পারি কিছু একটা হচ্ছে।

. কত দিন আপনার প্রবাস জীবন? কোথায় আছেন? কি করছেন? পারিবারিক পরিচিতি জানতে চাই।

–আক্ষরিক অর্থে আমি প্রবাস জীবন যাপন করছি। কিন্তু মানস ও মনন জগতে আমি একই পরিসীমায় বাস করছি। আর যদি বলো দেশের, বাংলাদেশের পরিসর থেকে প্রবাসে কতো বছর হলো আছি, তাহলে তার বয়স ৫ হলো । জন্মভূমির জন্য আমি সব সময় টান অনুভব করি। দেশ নামক কারাগারের মধ্যে থাকতে আমার ভালো লাগে না। আমি যুদ্ধ করেছিলাম দেশ স্বাধীন করতে। সীমান্ত ধরে আমাদের স্বাধীনতা এসেছে। কিন্তু আসল স্বাধীনতা আসেনি। আপাতত সেই স্বাধীনতা আসবে বলে আমার মনে হয় না। সেই স্বাধীনতার জন্য রক্তাক্ত যুদ্ধের প্রয়োজন নেই, আছে যুক্তির যুদ্ধ। সেই যুক্তি আবার পরাধীনতার আঁচলে বাঁধা যুক্তি নয়, সেখান থেকে মুক্তির যুক্তি। যাকে বলে হিউম্যান র‌্যাশনালিটি। আমি সেই যুদ্ধেরও একজন সৈনিক।

. প্রবাস জীবনে সাহিত্যচর্চায় প্রতিবন্ধকতা বা সুবিধা কিকি? কোথায়?

–প্রবাসজীবনে সুবিধাই বেশি যদি তুমি তোমার চাকর-জীবনের রাশ টেনে মুক্তচিন্তার মধ্যে বাস করতে পারো। জ্ঞানার্জনের জায়গা হিসেবে নিউ ইয়র্ক বেশ ভালো। কিন্তু তুমি যদি সংঘবদ্ধ না হও, তাহলে তোমার কোনো কিছুই গ্রহণযোগ্য হবে না। কে বা কারা গ্রহণ করবে তোমাকে? ওই তারাই যারা তোমার চিন্তার চারপাশে বসবাস করে। যারা চিন্তার স্বাধীনতায় বসবাস করতে শিখছে। আমি যদি কোনো ইজমের অধীনে আমার চিন্তা-ভাবনাকে চালিত করি, তাহলে তা বৃত্তাবদ্ধ হতে বাধ্য। আমি সেই বৃত্তের বা ঘেরাটোপের বাইরে কিছুই ভাবতে পারবো না। আমার ভাবনাগুলো সেই ঘেরের ভেতরকার যুক্তি দিয়েই সৃষ্টি হবে। এরই নাম চিন্তার পরাধীনতা। চিন্তাকে যদি মুক্ত না করতে পারো, তাহলো তাহলে সৃজনের ক্সেত্রেও তা প্রচলকেই বহন করবে। নতুন কিছু সৃষ্টির পেরণা পাবে না। 

১০. আপনি কখনো কি কোন পত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিন অথবা সংকলন সম্পাদনা করেছেন? বিস্তারিত বলুন ।

–ছাত্রাবস্থায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমি একটি দেয়াল পত্রিকা সম্পাদনা করতাম।  সেটা ৭৩/৭৪ সালের দিকে। বেশ কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশ করা হয়েছিলো। আমার হাতের লেখা তেমন সুন্দর না হলেও আমিই করতাম। তারপর আমার ক্লাশফ্রেন্ড সাইফুন নবী লিখে দিতো। এর পর আরো একটা সংকলন আমি করেছিলাম, কিন্তু সম্পাদনায় নাম দিয়েছিলাম আমার ক্লাশফ্রেন্ড বান্ধবী মোরশেদা আখতার রানুর নাম। আর মনে রাখার মতো কাজটা ছিলো ‘কবি’ সম্পাদনা। এর নামটাও আমার দেয়া। আমি আর আবিদ এটা সম্পাদনা করতাম। প্রথম সংখ্যা বেরুবার পর আমি পড়াশোনোয় মনোযোগ দিই। ফলে, কবি গ্যাপের মধ্যে পড়ে যায়। আবিদ অনেক পরে আবার শুরু করে এটি। তখন সে আমাকে চেয়েছিলো কিন্তু আমি আর ওই সব সম্পাদনা সম্পর্কে তেমন উৎসাহ পাইনি। অনেক লিটলম্যাগের জন্মকালেই আমি যুক্ত ছিলাম, বিশেষ করে বন্ধুদের মধ্যে যারা বের করতো। ‘উপকণ্ঠ’ নামে একটা লিটলম্যাগ করার কথা বললে আমি এটির সম্পাদক হারুন রশীদকে সাহায্য করি। মূলত গোটা পত্রিকাটির লেখা নির্বাচনই ছিলো আমার। এটির কভার ডিজাইন করে দিয়েছিলেন অকাল প্রয়াত আমার শিল্পী-বন্ধু কাজী হাসান হাবীব। কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের ‘কবিকণ্ঠে’র একটি সংখ্যা হাতে লিখে বের করতে চাইলেন। সেটার সব কবিতাই আমার হাতের লেখায় বেরিয়েছিলো। 

১১. লিটল ম্যাগাজিন এর সংজ্ঞা কি? এ নিয়ে আপনার ভাবনা বলুন ।

–লিটল ম্যাগের সংজ্ঞা নিয়ে কখনো ভাবিনি। কেন ভাবিনি তার ব্যাখ্যায় যাওয়ার দরকার নেই। নিয়মিত প্রকাশ পাওয়া সাহিত্য পত্রিকাগুলো আর অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর মধ্যে চারিত্রগতভাবে তেমন কোনো পার্থক্য নেই বা ছিলো না। পার্থক্য কেবল দৃষ্টিভঙ্গিতে । লিটল ম্যাগ প্রচলকে ভাঙতে চায়। সে নতুন চিন্তার আবাহন করে । চিন্তার স্বাধীনতাকে মুক্তি দিতে আগ্রহী। সেই চিন্তা যদি প্রচল সাহিত্য ধারাকে আঘাত করতে পারে, যদি নতুন কোনো সত্তার পরিচয় তুলে আনতে পারে, যদি প্রচল সমাজের বিধিবদ্ধ ধ্যান-ধ্রণাকে নাকচ করে নতুন বিধির উদ্বোধন করতে পারে, তাকেই বলা যেতে পারে নিটলম্যাগের চারিত্র্যধর্ম। লিটল ম্যাগের সম্পাদকরা নবীন। প্রবীণদের কথা ভাবতে হয় না তাদের, ভাবে না। তাদের কাছে নিজেদের মনের চাহিদাই বড়। সৃষ্টিশীলতার বেদনাই তার কাছে প্রধান। ভাষা আর ভাবনার সমন্বয় করারও একটা চিন্তা তারা করেন। আসলে নতুন কিছু সৃষ্টির আনন্দের নামই লিটল ম্যাগ হতে পারে ।

০৪/১৫/১৭

নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

সাক্ষাৎকার গ্রহণে : সাজ্জাদ বিপ্লব

আরও পড়তে পারেন

1 COMMENT

  1. খুব ভালো লাগলো মাহবুব ভাইয়ের খোলামেলা কথাগুলো।
    তবে সত্তর দশক নিয়ে আরও কিছু বললে ভালো লাগতো। পরবর্তীতে তাঁকে নিয়ে কে কী মন্তব্য করেছে, ওটা শোনার আগ্রহ ছিলো। আবিদ, মান্নান, আল মাহমুদ তাঁরা কিছু বলেনি, কথাটা কষ্ট লাগলো। তাঁদের কাছে এমন নিস্পৃহতা আশা করিনি।
    সাহিত্য জায়গাটা বোধহয় এমনই, কেউ কাউকে জায়গা দিতে চায় না। হয়তো এজন্যই আমাদের এতো এতো সীমাবদ্ধতা…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_imgspot_imgspot_imgspot_img

জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য সমূহ